বিস্মৃতিচারণা – পর্ব (৯)
আশি ও নব্বইয়ের দশকে বাংলার রসসাহিত্যের অদ্বিতীয় লেখক তিনি। বাংলা সাহিত্যের পাঠক মাত্রেই জানেন যে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, রাজশেখর বসু (পরশুরাম) ও শিবরাম চক্রবর্তীর পর বাংলা সাহিত্যে রসের ধারাটিকে সজীব করে তুলেছিলেন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় তাঁর সহজাত দক্ষতায়। রাজনীতি, সমাজ, গৃহকোণ সর্বত্রই অবাধে বিচরণ করেছেন রঙ্গব্যঙ্গ, বিদ্রুপ ও শ্লেষের ক্ষুরধার ও তীক্ষ্ণ লেখনীটি নিয়ে, অল্প সময়ের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন আবালবৃদ্ধবণিতার কাছে। তবে শুধুমাত্র রসসাহিত্যেই নয়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়কে বাংলা সাহিত্য মনে রাখবে তাঁর গভীর জীবনবোধের লেখা ‘লোটাকম্বল’ উপন্যাসের জন্যেও। পাশাপাশি ছবি আঁকার ও সাঙ্গীতিক দক্ষতা, সুন্দর হস্তাক্ষর এবং অসামান্য সরস বাচনিক ক্ষমতার অধিকারী তিনি। গান শিখেছিলেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছে, চিত্রাঙ্কন রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে।
এহেন একজন বহুগুণান্বিত মানুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগ ঘটেছিল আমার আশির দশকের বেশ কিছুটা সময়কাল ধরে। তাঁর বরাহনগরের বাড়িতে আমার অবাধ যাতায়াত, প্রভাসতীর্থে তাঁর বহুবার আতিথ্যগ্রহণ, কত ব্যক্তিগত আলাপচারিতা, কত সাহিত্যসভায় উপভোগ্য ভাষণের মুগ্ধ শ্রোতা, সব মিলিয়ে বড় অন্তরঙ্গ একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সে’ সময়ে তাঁর সঙ্গে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই মানুষটির বেশ কিছু উজ্বল ও মনোরম স্মৃতি আজও ধরা আছে মনের মণিকোঠায়।
আমার পিতৃবন্ধু পানিহাটি নিবাসী শান্তি কুমার মুখোপাধ্যায় ছিলেন ওঁর এক মাতুল। তাঁর সূত্রেই শ্রী সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম আগমন আগরপাড়ার প্রভাসতীর্থে অনুষ্ঠিত এক সাহিত্য সভায়। তখনও তিনি সেভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেননি।
একটু প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে জানাই, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের বহু কিশোর কাহিনির পটভূমি তাঁর পানিহাটির মামার বাড়ি। জনা তিনেক বর্ণময় মামা চরিত্রের বিচিত্র সব আচার আচরণ তাঁর বহু গল্পের অবলম্বন। এই চরিত্রগুলি যে নিছক কাল্পনিক নয়, সে অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে, কারণ তাঁর সেই মামার বাড়িতে আমার ছিল অবাধ গতিবিধি। মামাদের নিয়ে ভাগ্নে নানান সরস ছবি আঁকলেও গল্প কাহিনির চরিত্র হওয়াটা তাঁরাও দিব্য উপভোগ করতেন ও গৌরবান্বিত বোধ করতেন।
এবার আসি আগরপাড়ায় সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম সাহিত্য সভার প্রসঙ্গে।
সেই তাঁকে আমার প্রথম দেখা। সঞ্জীব বাবুর পাতলা ছিপছিপে চেহারায় আহামরি বৈশিষ্ট্য কিছু ছিল না, যা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। আমাদেরও করেনি। তবে উজ্বল বড় বড় দুটি বুদ্ধিদীপ্ত চোখে একটা অন্তর্ভেদী দৃষ্টি ছিল। মনে আছে, তাঁর প্রথম আগমনের দিনটিতে সভাঘরের মঞ্চে অতি বিনীত এক সুভদ্র সুজনের মতো বসেছিলেন তিনি। খুবই অন্তর্মূখী এক নিরীহ ধরণের মানুষ মনে হয়েছিল তাঁকে।
ছবিটা একটু একটু করে বদলে গেল তাঁর বক্তব্য রাখার সময় কথা বলা শুরু করার পর। অল্প সময়ের মধ্যে শ্রোতাদের সমস্ত মনোযোগ আকর্ষণ করে নিলেন তিনি। আপাত গাম্ভীর্যময় মুখমন্ডল, কিছুটা মিহি কণ্ঠস্বর, কিন্তু কথকতার পরতে পরতে রসসিঞ্চন, শ্লেষ, রঙ্গ-ব্যঙ্গ সমসাময়িক জীবন প্রবাহ, রাজনীতি, সমাজ, সবই উঠে এল তাঁর সাবলীল আলোচনায়। শ্রোতাদের মধ্যে হাসির রোল উঠল মুহূর্মুহু। লক্ষ্য করলাম, তাঁর সমালোচনার যাঁরা অঘোষিত লক্ষ্য (যে সব শ্রেণীর কেউ কেউ সভায় উপস্থিত), বুঝতে পারছেন তাঁরাও। বাচনভঙ্গীর সরসতায় তাঁদের মুখেও হাসি দেখতে পেয়েছিলাম। সভাশেষে বুঝলাম, মানুষটি ঠিক ততটা নিরীহ নন! সমাজ ও জীবনকে দেখার ও বোঝার একটা অসামান্য তৃতীয় নয়ন আছে তাঁর। আছে অসাধারণ প্রকাশভঙ্গী ও শব্দ প্রক্ষেপন ক্ষমতা। তাঁর এই অসামান্যতা বহু, বহুবার খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য আমার দীর্ঘ সময় ধরে হয়েছে।
আলাপের পর ধীরে ধীরে কাছে চলে এলাম মানুষটির। স্নেহের স্পর্শে সিক্ত হতে থাকলাম। তাঁর বাসগৃহে আমন্ত্রণ ও আপ্যায়নও পেতে থাকলাম। গড়ে উঠল ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সখ্য। ততদিনে উনি ঘনিষ্ঠ পিতৃবন্ধু ও আমার সঞ্জীব কাকু।
গোড়ার দিকে একদিন একটি সাহিত্য সভার শুরুতে তাঁকে বললাম, আজ আপনার সাহিত্য জীবন নিয়ে কিছু শুনতে চাই। অর্থাৎ কেমন করে একজন সাদামাটা সরকারী চাকরীজীবী থেকে আপনি পুরোদস্তুর সাহিত্যিক হয়ে উঠলেন, সেই যাত্রাপথের কাহিনি। কিছু বললেন না, শুধু মুচকি হাসলেন তিনি।
‘বাংলার রসসাহিত্যের ধারা ও সাহিত্যিক’ নিয়ে বলতে গিয়ে মুখবন্ধে আমার আবদারটি তিনি রাখলেন। বললেন, ‘নিজের সম্পর্কে দু’ কথা বলে আমি আজকের আলোচনায় ঢুকব। দেখুন, আপনারা আমাকে কোনও তাবড় সাহিত্যিক ঠাওরাবেন না যেন। নিতান্ত গোবেচারা নিরীহ ও নির্বিবাদী একটি মানুষ আমি, যে বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের বিশিষ্ট সাহিত্যিক জনোচিত নয়। সাহিত্যিকেরা অধিকাংশই এলিট সম্প্রদায়ের মানুষ হন। চিন্তায়, ভাবনায়, চালে চলনে, জীবন যাপনে তেমন কোনো আভিজাত্যই আমার নেই।’
সরস ভঙ্গিতে আত্মকথনে মশগুল হয়ে বলতে থাকেন সঞ্জীব কাকু, ‘সাহিত্যিক জন্ম নেন দুভাবে। একদল আজন্ম সাহিত্যিক, মা সরস্বতীর বরপুত্র তাঁরা, যেন হাতে কলম নিয়েই তাঁদের জন্ম। লিখতে শুরু করেই চিনিয়ে দেন নিজেদের জাত-গোত্র। আর একদল হলেন, রীতিমতো চাপে পড়ে বা দায়ে পড়ে সাহিত্যিক। আমি হলুম ওই দ্বিতীয় শ্রেণীর। আমার চেহারাটা তো দেখছেন। এরকম ল্যাকপ্যাকে নিরীহ চেহারা নিয়ে আমার নাকাল হবার অন্ত ছিলনা। ট্রামে, বাসে, অফিসে, পাড়ায়, গৃহের অভ্যন্তরে কনুইয়ের গুঁতো খেতে খেতে জীবন যখন ওষ্ঠাগত, তখন বেপরোয়াভাবে রুখে দাঁড়ানোর বা প্রতি আক্রমণের একটা অস্ত্র খুঁজছিলাম। কিন্তু সাধ থাকলেও সাধ্য হচ্ছিল না। আমার গলার স্বর তো দেখছেন, কোনোভাবেই সপ্তমে চড়ে না। অন্যদিকে এ’ হাতে তো পেটো কিম্বা ছোরা ছুরিও মানায় না! ঠিক তখনই কোনো দিক দিয়েই সুবিধে করতে না পেরে অস্ত্র হিসেবে তুলে নিলাম কলমটাকেই। ঠিক করলাম, যে যেখানে আমাকে গুঁতো মারবে, তা সে ঘরেই হোক বা বাইরে, তখনই তার বিরুদ্ধে দু’ কলম লিখে দেব আমি। আর এই করতে করতেই আপনাদের কাছে আমার সাহিত্যিক পরিচয় তৈরি হয়ে গেল।’
শুনতে শুনতে সেদিন মনে হয়েছিল, নিজেকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করতে না জানলে কোনো শিল্প মাধ্যমেই বোধহয় হাস্যরসের কান্ডারী হওয়া যায় না!
নিজেকে ও তাঁর নিকটজনকে নিয়ে রঙ্গ রসিকতা ছিল সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য যা নিঃসন্দেহে তাঁর রসসাহিত্য সৃষ্টিতে একটা বড় রসদ জুগিয়েছে। একথা তাঁর পাঠকরা যেমন জানেন, আপনজনেরাও অনুভব করেছেন মর্মে মর্মে। এ নিয়ে মাঝে মাঝে মৃদু প্রতিবাদের হিল্লোল উঠলেও বড় বিভ্রাট কিছু ঘটেনি লেখকের নির্বিকার চিত্ততায় ও স্থিতধী লেখক-জায়ার (আমার ব্যক্তিগত সম্বোধনে কাকীমা) অসামান্য সহনশীলতায়! সঞ্জীব কাকুর খুব কাছের মানুষজনের কাছ থেকেই ঘটনাগুলো শুনেছি ও অনুভব করেছি। মজাও পেয়েছি।
প্রসঙ্গত জানাই যে ‘শ্বেত পাথরের টেবিল’ তাঁর নিজস্ব বৃত্তের কাহিনি এবং ‘সোফা কাম বেড’ কাহিনিটি সঞ্জীব কাকুর অতি নিকটজনের যৌথ পরিবারের গৃহাভ্যন্তরের বাস্তব ঘটনা, যেটি লেখকের রসসিক্ত কলমে উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। তবে যাঁদের বাড়ির ঘটনা এটি, কাকীমার কাছে শুনেছি যে তাঁরা বইটি পড়ে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াতেই প্রায় মারমুখী হয়ে উঠেছিলেন। সামাল দিয়েছিলেন সর্বংসহা কাকীমাই, যিনি নিজেও সঞ্জীব কাকুর বহু কাহিনিতে ধরা দিয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন রূপে ও মেজাজে, যার কিছুটা সত্য, বাকিটা তাঁর রসসিক্ত কলম ও মস্তিষ্কের অবদান।
কিছু কিছু প্রতিবাদী আলোড়নের পর নিস্পৃহ ঔদাসীন্যে লেখক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের অসহায় যুক্তি শুনেছিলাম: ‘কি মুশকিল, তোমরা এরকম করলে তো আমার কলম বন্ধ করে রাখতে হবে! যা দেখি, তাইতো কিছু কল্পনার মিশেলে ভেসে ওঠে আমার কলমে।’ মেনেই নিয়েছিলেন কাকীমা।
কিন্তু তিনি মানলেও প্রতিবেশীরা মানবেন কেন? পাড়ার বর্ণময় চরিত্র, সকাল বিকেল নজর টানছেন রসের কারবারী সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের। দেখতে দেখতে লিখে ফেললেন ‘ছাগল’ কাহিনিটি। একদিন বিকেলে বসে গল্প করছিলাম সঞ্জীব কাকুর সঙ্গে ওঁর সুসজ্জিত পড়ার ঘরে। পুত্র ফুটবল খেলে কর্দমাক্ত অবস্থায় হন্তদন্ত ও উত্তেজিত হয়ে ঘরে ঢুকে পিতাকে প্রশ্ন করল: “বাবা, তুমি এসব কবে বন্ধ করবে? ও পাড়ার অমুক বাবু আমাকে সকলের সামনে বললেন, ‘আমাকে নিয়ে গল্প লেখা হচ্ছে! তোমার বাবার আমি টেংরি খুলে নেবো।’ উত্তরে সঞ্জীব কাকুর বিস্মিত ও নিরীহ মন্তব্য, ‘সেকীরে, আমি তো নাম ধাম কিছু দিইনি আমার গল্পে!’ এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দেখেছ, নিজেকে ঠিক চিনতে পেরে গেছে!’ তারপর শান্ত কণ্ঠে পুত্রকে বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, কিন্তু টেংরি খুলতে গেলে তো বাড়িতে আসতে হবে! একদিন আসতে বলিস ওঁকে।’
কিছুদিন পরে প্রশ্ন করে জেনেছিলাম যে ‘ছাগল’ কাহিনির মূল চরিত্র একদিন বাড়িতে এসেছিলেন। তবে টেংরি খুলতে নয়, আলাপ করতে ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করতে। বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ আলোচনাই হয়েছিল দু’ জনের মধ্যে!
দু’ চোখ মেলে প্রতিনিয়ত চারপাশের ঘটনাগুলো নিস্পৃহ ভঙ্গিতে নজর রাখতেন। ওগুলোই একটু রঙ বদলে ফিরে আসত তাঁর লেখার খাতায়, কাহিনিতে। দৈনন্দিন জীবনের অতি সাধারণ ঘটনাগুলো হাস্যরসে টইটম্বুর হয়ে ভেসে উঠত ওঁর অসামান্য উপস্থাপনায়।
সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্থ সঞ্জীব কাকু তখনও গণ পরিবহনে প্রায়শই অফিসে যাতায়াত করেন। আনন্দবাজারের অফিস থেকে বাড়ি ফিরছেন মিনিবাসের আসনে বসে। একই বাসে আমি উঠলাম মাঝপথ থেকে। বিশেষ ভীড় ছিল না বাসটিতে। ওঁর আসনের সামনে দাঁড়িয়ে টুকটাক কথা বলছিলাম। হঠাৎ সামনে থেকে বাস কন্ডাক্টারের সঙ্গে জনৈক যাত্রীর কিছু বাদানুবাদের আওয়াজ কানে এল। ঝগড়া ক্রমবর্ধমান। দুজনেই তাকিয়ে দেখলাম। আমি ঘটনাটাকে গুরুত্ব না দিয়ে ওঁর সঙ্গে কথা বলে যেতে লাগলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাত দেখিয়ে আমাকে থামিয়ে দিয়ে উনি বললেন, ‘ব্যাপারটা বেশ জমে উঠেছে। দাঁড়াও, একটু দেখে নিই। একটু অবাক হলেও পরে বুঝলাম, এর মধ্যেও হাস্যরসের উপকরণ খুঁজছেন রসের কান্ডারী!
স্বামী ও স্ত্রী দুজনেরই অসম্ভব রকমের পশুপ্রেম দেখেছি। ওঁর খেতে বসার সময় গোটা আঠারো নানান আয়তনের বেড়াল বসত ওঁর খাবার থালা ও আসনকে ঘিরে প্রসাদ ও দাক্ষিণ্য পাবার দাবী নিয়ে। তৎসহ বাড়িতে ছিল তিনখানি নানা বংশধারা ও কৌলিন্যের কুকুর, আশ্চর্যজনকভাবে যাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল ঐ বৃহৎ বেড়াল বাহিনীর সঙ্গে।
রসসাহিত্যে জনপ্রিয়তার মধ্যগগনে থাকা এহেন এক সাহিত্যিক হঠাৎই একদিন কলমের অভিমুখ ঘুরিয়ে দিলেন ভক্তিরসের আঙ্গিকে। জীবনে ও সাহিত্যে ওঁর বিষয় হয়ে উঠল ভক্তিরস এবং আরাধ্য হয়ে উঠলেন শ্রীরামকৃষ্ণ, সারদাময়ী ও স্বামী বিবেকানন্দ। তিনটি চরিত্রকে কলমে ও কথকতায় ধারণ করলেন তিনি বিপুল অনুশীলনে ও শ্রদ্ধায়।
বন্ধু সমরেশ মজুমদার প্রবল অনুযোগ করলেন, ‘সঞ্জীব, তুমি এটা কী করলে! বাংলার রসসাহিত্যের শেষ ধারাটি বেঁচে ছিল তোমার কলমে, আর সেই তুমি কলম তুলে নিলে?’ সঞ্জীব কাকু হেসে জবাব দিয়েছিলেন, ‘ভাই, আমি আগে মাছ বেচতাম, এখন ফুল বেচি।’
এই অভাজন অনুরক্তের ধারণা ওঁর মুগ্ধ পাঠকরা বোধহয় ‘মৎসজীবী’ সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়কেই স্মৃতিতে ধরে রাখতে চাইবেন, যদিও তাঁর জীবন সায়াহ্নের প্রগাঢ় প্রেমকেও অস্বীকার করা অসম্ভব। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, সম্প্রতি “শ্রীকৃষ্ণের শেষ কটা দিন” উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার পেলেন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়।
তাঁকে নিয়ে আমার অনেক স্মৃতি, তেমনি অনেক বিস্মরণও। তার থেকে সামান্য কিছু আজ পরিবেশন করতে পারলাম। তবে তাঁর সাহচর্যের দুটি বিশেষ স্মৃতি আমার আজীবনের সঙ্গী।
এক, সত্তরের দশকের উদীয়মান লেখক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্যজীবনের প্রথম সম্বর্ধনা সভার অনুষ্ঠান প্রভাসতীর্থের সভাঘরে, ব্যক্তিগত এক বিয়োগান্ত ও অনিবার্য পরিস্থিতিতে যে সভার মানপত্র লেখার দায়িত্ব পড়েছিল সেদিনের তরুণ ও আজকের বিস্মৃতিচারণার এই প্রৌঢ় লেখকের ওপর।
এর পর দুই দশকের ওপর সময়কাল ধরে শ্রী সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় বারংবার সাড়া দিয়েছেন প্রভাসতীর্থে আয়োজিত সাহিত্যসভাগুলির আমন্ত্রণে, অসামান্য সব বক্তৃতায় আলোকিত ও আলোড়িত করেছেন আলোচনাসভা ও মঞ্চগুলিকে। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে, নব্বইয়ের দশকের মধ্য পর্বে আগরপাড়ায় একটি উন্মুক্ত নাগরিক সভায় তাঁর সাহিত্যকৃতির জন্যে এই প্রবীণ সাহিত্যিকের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল “প্রভাস বন্দ্যোপাধ্যায় স্মৃতি স্মারক পুরস্কার”। তখন অবশ্য তাঁর সাহিত্য দিক-বদল করে শ্রীরামকৃষ্ণ-স্বামী বিবেকানন্দ ভাব-আন্দোলনের চর্চার স্রোতে প্রবাহিত। সেই সভাতেও একটি অসামান্য আলোচনায় উপস্থিত জনতাকে মন্ত্রমুগ্ধ করেছিলেন তিনি।
দুই, আমার পিতা প্রভাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের অকাল প্রয়াণের পর তাঁর স্মরণসভায় শ্রদ্ধেয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ও সাহিত্যিক কালীপদ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে উপস্থিত সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের অসামান্য অভিভাষণ এবং আমাদের বিপর্যয়ের দিনে তাঁর স্নেহময় মানসিক শুশ্রুষা।
দুটি ব্যক্তিগত স্মৃতিই আমার মনের ক্যানভাসে অবিনশ্বর হয়ে থেকে যাবে। আমৃত্যুই।