
১৮০০ শতকের ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুল অধুনা এন আর এস… ছাত্রদের তুমুল বিক্ষোভ, পিকেটিং চলছে। মেয়েদের হোস্টেলে চলছে ইঁট-পাটকেল, ঢিল ছোঁড়া। মিঃ গিব্বন পুলিশ ডাকবেন… এই আন্দোলনের কারণ, এক মহিলা ছাত্রী ফাইনাল পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন। আর ১/২ নং কম পেয়ে ২য় গোপালচন্দ্র দত্ত। সোনার মেডেলের দাবিদার একজন মহিলা ছাত্রী? এ অসম্ভব ব্যাপার, এ হতে দেওয়া যায় না। তাই বিক্ষোভ। এমনকি কিছু ছাত্র বললে, “মেরে ফেলা হোক, পথের কাঁটা সরে যাওয়াই ভাল।” অন্যান্য শিক্ষকরা মি: গিব্বনকে পুলিশ ডাকতে বাধা দিলেন। তাতে যে ছেলেদের মান যাবে! শেষ পর্যন্ত সেই মহিলা ছাত্রীকে গভর্নরের কাছে মুচলেকা দিতে হল যে সোনার মেডেল-এর তাঁর প্রয়োজন নেই। বদলে মাসিক স্কলারশিপ-এর ব্যবস্থাতেই রাজি। তাঁকে দেওয়া হল রুপোর মেডেল। ছাত্রদের আন্দোলন স্তিমিত হল। ইনি ডাঃ হৈমবতী সেন… বাল্যবিধবা থেকে চিকিৎসক হয়ে ওঠার এক অদম্য লড়াইয়ের কাহিনী।

এ কাহিনীর সূত্রপাত প্রায় ৮০ বছর পরে উদ্ধার হওয়া সিন্দুকবন্দী হাতে লেখা এক আত্মকথন। ট্রাঙ্কবন্দী এই মণিমুক্তার আলো যাঁকে ঘিরে সেই অসামান্য এক মহীয়সী নারী.. ডঃ হৈমবতী সেন… আমাদের মাতামাতি বরাবরই কাদম্বিনী গাঙ্গুলিকে নিয়ে। সম্ভ্রান্ত বংশীয়া উচ্চশিক্ষিতা, স্বামী-আনুকূল্যে প্রতিভাত। বাল্যবিধবা হৈমবতীর কথা ক’জনই বা জানি? এক নিঃসহায় বাল্যবিধবার দাপুটে চিকিৎসক হয়ে ওঠার সেই কাহিনি?
সন ১৮৬৬। মা, ঠাকুমা, পরিবারের সদস্যরা যখন ছেলের আশায় দিন গুনছেন, সমস্ত আশা ব্যর্থ করে মেয়েটির জন্ম খুলনায়। জমিদার পিতা প্রসন্নকুমার ঘোষ মেয়ের নাম দিলেন চূণীবাবু। ছেলের পোষাক পরিয়ে রাখা হল, তা প্রায় ৫-৬ বছর অবধি।
চূণীবাবু লুকিয়ে পাঠশালার পড়া শোনে, শুনেই মুখস্থ হয়ে যায়। ইন্সপেক্টর পরিদর্শনে এসে প্রশ্ন করেন ছেলেদের। কেউ যখন উত্তর করতে পারলে না, সেই চূণীবাবু সঠিক উত্তর করে বসল। অথচ অক্ষরজ্ঞান নেই তার। যাওয়ার আগে প্রসন্নকুমারকে অনুরোধ করে গেলেন, মেয়েকে যেন লিখতে শেখান। পিতার প্রশ্রয়ে লুকিয়ে চলল পড়াশোনা। যেদিন প্রথম মা, ঠাকুমাকে রামায়ণ পড়ে শোনালো হৈম, অন্দরমহলে গেল গেল রব উঠল। “এ মেয়ের আর পাত্র জুটবে না।”
সাড়ে-নয় বছরের কুলীনকায়স্থ নাবালিকাকে ৪৩ বছরের ম্যাজিস্ট্রেট-এর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে উদ্ধার করা হল। স্বামীর ঘরে তখন তাঁর দুই স্ত্রী আর দুই সমবয়সী কন্যা বিরাজমান। পিতা প্রসন্নর বুঝতে বাকি রইলনা তার সাধের চুণীবাবুর সলিলসমাধি হল।
নিজের আত্মকথনে ঠোঁটকাটা হৈম মাঝবয়সী স্বামীর যৌননির্যাতন নিয়ে অকপট ছিলেন। এতটাই আতঙ্কিত ছিল বালিকাবধূটি যে বারবার অজ্ঞান হয়ে যেতেন, পাঠিয়ে দেওয়া হত বাপেরবাড়ি। বিয়ের বছর তিনেকের মাথায় স্বামী নিউমোনিয়ায় পরলোকগত হলেন। তৃতীয় স্ত্রী, ১২ বছরের বাল্যবিধবা স্বামীর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে শূন্য হাতে ফিরে এলেন বাপেরবাড়ি। ডায়রিতে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন বিধবাদের প্রতি হিন্দুধর্মের অন্যায় আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। মাথামুড়িয়ে, সাদা থানে ঢাকা এইসব বাল্যবিধবারা তথাকথিত ভদ্রসমাজের ভোগলালসা আর চরম আর্থিক বঞ্চনার শিকার হতেন। ১৮৫৩ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শুধু কলকাতাতেই ১২,৭১৮ জন দেহব্যবসায় নিযুক্ত ছিল, যার সিংহভাগই ছিল বাল্যবিধবারা।
তখন কলকাতায় বিদ্যাসাগর মহাশয় সরব হয়ে উঠছিলেন বিধবাবিবাহ, নারীশিক্ষার সমর্থনে। ব্রাহ্ম সমাজে জোর দেওয়া হচ্ছে নারীশিক্ষায়, তারই ঢেউ এসে লাগল খুলনায়।

বিধবার অগতির গতি সেই কাশীধাম। সহৃদয় পুলিনবাবু (এক তুতো বোনের স্বামী) মাসিক ২০ টাকা ভাতা বরাদ্দ করলেও বাদ সাধলো সেই বোন। “লোকে কি বলবে?”, অল্পবয়সী সুন্দরী বিধবার জন্য কাশীধাম মোটেই নিরাপদ ছিল না সে সময়। অল্পের জন্য দু-দুবার হৈমবতী রক্ষা পান। শেষপর্যন্ত ১০টাকা বেতনের মেয়েস্কুলে পড়ানোর কাজ পান। সেই প্রথম স্বনির্ভরতার স্বাদ পেলেন। কিন্তু উচ্চশিক্ষার জন্য মন পড়ে রইল কলকাতায়। ব্রাহ্ম সমাজের দুই উচ্চপদস্থ ব্যক্তির সাথে কাশীধামে পরিচয় হয়। তাঁদের সুপারিশ চিঠি নিয়ে কলকাতায় এসে হৈমবতী দেখেন যে তাঁরা তখন বিদেশে। নিরাশ্রয় বিধবা, অনটনে জর্জরিত হয়ে আবারও ব্রাহ্ম সমাজের দ্বারস্থ হলেন। গেরুয়াবসনধারী, পরোপকারী, উদারচিত্ত কুঞ্জবিহারী সেনকে দেখে বিধবাবিবাহে রাজী হলেন তিনি। অন্ন বস্ত্র, বাসস্থানের জন্য অন্তত দোরে দোরে ঘুরতে হবে না, তারপর উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেতে অসুবিধে হবে না। বাস্তবে দেখা গেল স্বামীটি আদ্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন পরগাছা, অলস আর স্ত্রীর রোজগারে বসে খাওয়া ভন্ড ছাড়া কিছুই নন।
অনাহুত সন্তান আসে এবং মারা যায়। হৈমবতী কঠিন সংক্রমণ আর জ্বরে মরতে বসেন। এইসময় ডাঃ সুন্দরীমোহন দাস ও স্ত্রী ধাত্রী হেমাঙ্গিনীর সেবা আর চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠেন। এই সাহচর্য তাঁকে চিকিৎসা শাস্ত্রের প্রতি আগ্রহী করে তোলে।

১৮৮০ সাল, ততদিনে কলকাতা মেডিকেল কলেজ, বেথুনকলেজ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ডাঃ দাস একবছর পরে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। সবই ছিল সম্ভ্রান্তদের জায়গা। ১৮৭৩-এ শিয়ালদহে তখন গড়ে তোলা হল ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুল। দুস্থ, গরিবের হাসপাতাল। ঊচ্চশিক্ষিত ডাক্তাররা সেখানে পরিষেবা দিতে নারাজ। ঘোষণা হল লেডি ডাফরিনের ফান্ডের সাহায্যে কিছু হাসপাতাল সহায়িকাকে ট্রেনিং দিয়ে তৈরি করা হবে। অল্প শিক্ষিত কিছু মহিলাকে কিছু প্রাথমিক আর অত্যাবশ্যকীয় বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়ে জেলায় পাঠানোটাই মূল উদ্দেশ্যে ছিলো।
১৮৮৫ সালে কোলিন ম্যাকেঞ্জির অনুমতিতে গঠিত হল Vernacular Licentiate in Medicine and Surgery VLMS… প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে ১৭জন মহিলাকে। কাদম্বরী দেবী বা অবলা দেবীর মত সম্ভ্রান্ত উচ্চবংশীয় মহিলা ডাক্তাররা কলকাতাতেই শুধু ডাক্তারি করতেন। অল্প শিক্ষিত মহিলাদের এই ট্রেনিং নিয়ে উঠল আপত্তি। এতে চিকিৎসার মান নাকি নিম্নমুখী হবে। যথারীতি পরীক্ষা নেওয়া হল। প্রথম সুবর্ণলতা, ২য় হৈমবতী আর ৩য় ইদ্দিন্নেসা। পুরষ ডাক্তারদের সহকারী হিসেবেই কাজ করবেন, স্বাধীন ভাবে প্র্যাক্টিসের অনুমতি মিলবে না।

ডায়রিতে লিখেছেন, “এনাটমি, সার্জারি আর মেটেরিয়া মেডিকা পড়ানো হত। সকালে যেতে হত ডিসপেনসারি-তে। কিছুই বুঝতেন না। শেষে ৩টাকা মাসিক চুক্তিতে ডিসপেন্সিং শেখাতে রাজি হন কম্পাউন্ডার।” মাসিক ৭টাকা বৃত্তি পেতেন, যার পুরোই তুলে দিতে হত কুঞ্জবিহারীকে। সংসার সামলে চলল মেডিকেল শিক্ষা। ডিসেকশন ক্লাসে বমি হত, মাথা ঘুরত। যোগীন্দ্রবাবু হাতে ছুরি ধরিয়ে বলতেন… “পশুর চামড়া কাটছো ভেবে নিয়ে ছুরি চালাও। তবেই শিখবে।”
জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই হাসপাতালে ছিলেন। হাসপাতালে প্রচুর রুগী দেখতে হোত। ক্লিনিকের সাথে সাথে রুগী দেখতে যেতে হোত বাড়িতেও। মাসিক আয় ৩০০-৪০০ টাকা হোত, যার পুরোটাই কেড়ে নিতেন স্বামী। এই লিঙ্গবৈষম্য এখানেও পিছু ছাড়েনি তাঁর। সহকারী সার্জেন বদ্রীনাথ উত্যক্ত করতেন, যৌন হেনস্থা করতেন হৈমবতীকে। শেষে আর এল দত্ত নামক এক সিনিয়র সার্জেনের কাছে নালিশ জানান। বদ্রীনাথের হাসপাতালে ঢোকা বন্ধ করেন।
১৮৮৯ সালের একটি নিদারুণ ঘটনা বাংলায় আলোড়ন তুলেছিল। ১১ বছরের নাবালিকা ফুলমণি দাশের মৃত্যু। মধ্যবয়সী স্বামীর ধর্ষণের শিকার হয়ে রক্তপাতে অচৈতন্য অবস্থায় হৈমবতীর কাছে নিয়ে আসা হয়। উনি আরো দুজন সহকারী সার্জেনকে ডেকে নেন। মেয়েটির মৃত্যু হয়। সার্জেন মিথ্যে সার্টিফিকেটে লেখেন বয়স ১৪ এবং সংক্রমণ মৃত্যুর কারণ। তোলপাড় হয়। শেষে আইন পাশ করা হয় ১২ বছরের নিচে নাবালিকার সাথে যৌনসংসর্গ নিষিদ্ধ।
হৈমবতীকে ৫০০ টাকা ঘুষ দিয়ে মুখ বন্ধ করতে বলা হয়। এই টাকা উনি প্রতিবেশীর দুস্থ শিশুদের জন্য পুরোটাই দান করেন।
দুটি পুত্রসন্তানের পর কন্যা বিধুমুখীকে নিয়ে সংসার। কুঞ্জবিহারীর গার্হস্থ্য হিংসা চরম আকার ধারণ করে। স্বামী অন্যত্র বসবাস শুরু করেন আর সংসারের সমস্ত দায় এসে পড়ে হৈমবতীর ওপর। ১৯০২ সালে নিউমোনিয়ায় মারা যান কুঞ্জবিহারী।
এরপর থেকেই হৈমবতী, অনাথ শিশুদের আশ্রয় দেওয়া, দুস্থ বালিকাদের বিবাহ এরকম সমাজ সেবার কাজে ডুবে যান। পুত্রকন্যাদের থেকেও তিনি পান দুর্ব্যবহার। ব্যক্তিগত জীবনে চরম একাকীত্ব তাঁর সঙ্গী। ডায়রি লিখতেন। কঠোর সমালোচনা করেছেন সম্ভ্রান্তবংশীয় উচ্চশিক্ষিত মহিলা ডাক্তারদের, যাঁরা স্বামী পুত্র নিয়েই ব্যস্ত। বার বার বলেছেন মেয়েদের আরো এগিয়ে আসতে হবে সমাজসেবায় নইলে এই শিক্ষা আর মেধার অপচয় ছাড়া আর কিছুই হবেনা। সারাজীবন রোজগার করেছেন, সংসার সামলেছেন, প্রায় ৪০০ অনাথ শিশুর দায়িত্ব নিয়েছেন।
শেষের কথা:
অধ্যাপক ডাঃ ইন্দ্রাণী সেন বলেছেন সেযুগের অত্যন্ত অগ্রগণ্য আধুনিক নারী ছিলেন ডাঃ হৈমবতী সেন।
ব্যতিক্রমী নারীমাত্রেই একাকীত্বই সর্বক্ষণের সঙ্গী… ৩রা অগাস্ট ডায়রিতে শেষ লেখা, “হে মা! দয়া করো। শান্তি দাও।” তার ঠিক দুদিন পরে ৫ই অগাস্ট ১৯২০ সালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন হৈমবতী। আর ট্রাঙ্কবন্দী হয়ে চলে যায় তার আত্মকথন বিস্মৃতির আড়ালে।
বাল্যবিধবা থেকে এক মহিলা চিকিৎসক হয়ে ওঠার এই দীর্ঘযাত্রাপথ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে এক সোচ্চার প্রতিবাদ। আশি বছর বাদে উদ্ধার হওয়া এই আত্মকথনে উঠে আসে ব্যতিক্রমী অনমনীয় এক মহিলা চিকিৎসক-এর জীবনযুদ্ধের কাহিনী। আজ আমরা যারা সমাজ, সংসার, সন্তান, হাসপাতাল, ক্লিনিক সামলে মহিলা চিকিৎসক হয়ে এখন পুরুষতন্ত্রের বৈষম্যের সাথে যুদ্ধ করি, তাদের কাছে ডাঃ হৈমবতী সেন এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব, এক অনুপ্রেরণা, এক প্রজ্জ্বলিত আলোকশিখা।
তথ্য ঋণঃ The Memoirs of Dr Haimabati Sen, by Geraldine Forbes and Tapan Raychaudhury
চিত্রঋণঃ আন্তর্জাল
এমন এক শ্রদ্ধেয় অথচ অনালোকিত ঐতিহাসিক চরিত্রের কথা আমাদের জানিয়ে লেখিকা এক অসামান্য সামাজিক দায়িত্ব পালন করলেন। খুব ভাল লাগল।