
ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য সাংসারিক অশান্তি এড়াবার জন্য ঠাকুরদা টালিগঞ্জের বাড়িটি বিক্রি করে দিলে যৌথ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমরা বরানগরের ভাড়া বাড়িতে এসে উঠলাম ফেব্রুয়ারি ১৯৪৯-এ। আমার তখন বয়স চার, ফলে টালিগঞ্জের স্মৃতিতে নেই কোনো পরিবারের মানুষজন, শুধু থেকে গেছে বাড়ির সামনের বাগানে একটি ফলবতী পেয়ারা গাছের আবছা ছবি।

[ছবি- লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে]
(ছবি-পরিচিতি : কমলা বন্দ্যোপাধ্যায় – ২২ মার্চ ১৯১৮ – ২৭ অক্টোবর ২০০৫)
বরানগরের ভাড়াবাড়ির বর্ণনা আমার মা কমলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কয়েকটি সাক্ষাৎকার (২৭ অক্টোবর ২০০৫ প্রয়াত হয়েছেন) এবং দু-একজন শিল্পী-সাহিত্যিকের স্মৃতিচারণ থেকে অনেকেই হয়তো কিছু কিছু জেনে গিয়েছেন। দু-টি ঘরের একটিতে আমরা ছোট চার ভাইবোন আর আমাদের মা, অন্য ঘরটির মাঝামাঝি চটের পার্টিশনের একপাশে লেখকের বৃদ্ধ পিতা, অন্য অংশটি বরাদ্দ পুত্র মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য। সেখানে একটি কাঠের চেয়ার, টেবিল, ছোট একটি বুক-সেলফ্, শোওয়ার জন্য একটি তক্তপোশ, তক্তপোশের উপরে পাতলা তোশক (?) আর একটি কাঠের পুরানো আলমারি। আলমারিতে লেখকের সংগ্রহের কিছু বই আর তাঁর পিতৃদেবের সংগ্রহ চামড়া/রেক্সিনে বাঁধানো বেশ কিছু ভারতবর্ষ, প্রবাসী, বিচিত্রা, বঙ্গশ্রী, কালি-কলম ইত্যাদি পত্রিকা। আমরা সাধারণত ওঘরে বেশি যেতাম না, কারণ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিবিষ্ট মনে লিখে চলেছেন। মাঝে মাঝে মা ফ্লাস্কে চা নিয়ে নিঃশব্দে রেখে আসতেন। তবে পার্টিশনের ওপাশে শায়িত অশীতিপর বৃদ্ধ পিতার বার্ধক্যের একাকীত্ব বা অসহায়তার দীর্ঘশ্বাস লেখকের মনঃসংযোগে বিঘ্ন ঘটাতো কিনা আজ আর জানার উপায় নেই।

[ছবি- লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে]
(ছবি-পরিচিতি : বরানগরের ভাড়াবাড়ি – ‘ক্যানভাসের পার্টিশন’-এ বিভাজিত সিঁড়ি-সংলগ্ন ঘরের ডানদিকে লেখকের পিতার বাস, বাঁদিকের অর্ধাংশে জীবনযাপন তথা সাহিত্যচর্চা। তার পাশে একেবারে বাঁদিকের জানলা-সংলগ্ন ঘরটি চারটি সন্তানসহ লেখক-পত্নীর ব্যবহারের জন্য।)
কখনো বাবাকে দেখেছি ওই ঘরের সামনের ছোট বারান্দায় বসে প্রশস্ত মাঠটির দিকে প্রসারিত দৃষ্টিতে একান্ত চিন্তামগ্ন, হয়তো তখন মানসপটে অংকুরিত হচ্ছে ইতিকথার পরের কথা, আরোগ্য, তেইশ বছর আগে পরে, হলুদ নদী সবুজ বন-এর মতো উপন্যাস বা বিচার, উপায়, কালোবাজারের প্রেমের দর, আর না কান্না-র মতো গল্প।
লেখার কোনো নির্দিষ্ট সময় ছিল না, সাধারণত খুব ভোরে বা সন্ধ্যার পর বেশি রাত পর্যন্ত লিখতেন কিংবা দুপুরে। বিকেলে পাড়ার ছেলেমেয়েদের খেলা দেখতেন বারান্দায় বসে, মাঝে মাঝে মাঠে বাঁশি নিয়ে রেফারিং করতে নেমে পড়া। আবার ছেলেমেয়েদের ঝগড়ার মীমাংসাও করতে হতো তাঁকে। বাড়িতে লুঙ্গি আর হাফহাতা গেঞ্জি, বাইরে বেরোবার জন্য লংক্লথের সাদা গোল-হাতা ফুল পাঞ্জাবি আর মিলের ধুতি। বাড়িতে খড়ম পরতেন। মাঝে মাঝে লেখা ছেড়ে এঘরে চলে আসতেন আমাদের কাছে, এঘরে রাখা বিয়ের খাটটিতে বসে দুই দিদিকে ডেকে নিয়ে সে-সময়ের বিখ্যাত ‘ডোয়ারকিন’ হারমোনিয়াম নিয়ে দিদিদের গান ধরতে বলতেন, দিদিরা তখন নিয়মিত গান শিখতো। কখনো কখনো বাবাও গলা মেলাতেন, হারমোনিয়ামও বাজাতেন। প্রধানত রবীন্দ্রসংগীত, এছাড়া নজরুলগীতি, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত বা দ্বিজেন্দ্রগীতি, কখনো বা রামপ্রসাদী। বাবার একটি প্রিয় গানের কথা মনে আছে, ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’। বাড়িতে পাঁচ-ছটি বাঁশি ছিল, অধিকাংশই আড়বাঁশি। মাঝে মাঝে বেশি রাতে ঘুম ভেঙে যেত বাঁশির শব্দে, বিশেষ করে চাঁদনি রাতে। আমাদের জানা ছিল ওই ঘরের সামনের বারান্দায় বসে বাবা বাঁশি বাজাচ্ছেন।

[ছবিঃ লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে]
সাধারণভাবে বাবাকে একটু রাশভারী বলেই মনে হতো। আবার একই সঙ্গে তাঁর কিছু কিছু ব্যবহারে ছিল শিশুর সারল্য। সংসারের খুঁটিনাটি সবকিছু সামাল দেওয়ার দায়িত্ব ছিল আমাদের মায়ের। তবে প্রয়োজনে লেখা ফেলে রেখে এসব দায়িত্ব তাঁকেও পালন করতে হয়েছে কখনো কখনো, যার কিছু কিছু উল্লেখ তাঁর ডায়েরিতে রয়েছে। নিয়মিত বাজার করতে হতো, আমিও মাঝে মাঝে হাত ধরে সঙ্গে যেতাম। বাবার বাধ্যতামূলক ব্যবস্থাপনায় প্রতিবছর আমাদের সকলকে কয়েকটি অসুখের প্রতিষেধক হিসেবে TABC ইঞ্জেকশন্ নিতে হতো, ফলে প্রায় দু-দিন ধরে প্রচণ্ড ব্যথা আর জ্বরে কাবু আমরা সকলে। মাঝে মাঝে সারারাত ধরে ভেজানো চিরতার জল সকালে উঠেই গলাধঃকরণ করতে হতো বাবার নির্দেশে। বাবারই আগ্রহে আমাদের রামায়ণ আর মহাভারত পড়তে বসতে হতো। সাধারণত মা পাঠ করতেন, কখনো দিদিরা। মাঝেমধ্যে ছেদ পড়ে যেত, হঠাৎ একদিন বাবা সচেতন হলেন, আবার শুরু হলো পড়া। দু-টি মহাকাব্যই শেষ পর্যন্ত পড়া হয়েছিল কিনা আজ আর মনে নেই।
তদানীন্তন কমিউনিস্ট আন্দোলনের কাউকে দেখেছেন বলে মনে পড়ে আপনাদের বাড়িতে? তাঁদের আসা-যাওয়া কেমন নিয়মিত ছিল?
বরানগরের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃস্থানীয় কিছু মানুষজন মাঝে মাঝে আসতেন। পার্টির সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের বিশিষ্ট জনেরাই আসতেন বেশি। সাধারণত তাঁরা সকালের দিকে আসতেন, ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনা চলত। মাঝে মাঝে মা চা পৌঁছে দিতেন। অনেকের নাম মনে পড়ে যায়, যেমন গোপাল হালদার, অনিল কাঞ্জিলাল, অনিল সিংহ, গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, গোলাম কুদ্দুস, অমল দাশগুপ্ত, চিন্মোহন সেহানবিশ, সুলেখা সান্যাল, রমাকৃষ্ণ মৈত্র, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, প্রসূন বসু এবং আরো কেউ কেউ। মস্কো থেকে এসে কলকাতায় থাকলে ননী ভৌমিক। আর বিশেষ করে মনে পড়ে সরোজ দত্তের কথা।

[ছবি – আন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত]
কবে প্রথম বুঝলেন, যদি মনে করতে পারেন, আপনার বাবা একজন প্রখ্যাত লেখক?
স্তূপাকার কাগজপত্রের ভিড়, নানান বইপত্র চারপাশে, কলম হাতে একজন মানুষ লেখার টেবিলে এবং সর্বোপরি ইতস্তত ছাপার অক্ষরে ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়’ — এভাবেই বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারি উনি লেখক। আর কাগজপত্রে ছাপার অক্ষরে মাঝে মাঝেই নাম দেখতে পেলে বিখ্যাত বা প্রখ্যাত মনে তো হবেই।
কবে প্রথম বুঝলেন, আপনার বাবার তদানীন্তন রাজনৈতিক আবহাওয়ার সঙ্গে যোগ ছিল?
এতো হঠাৎ একদিন বুঝতে পারার ব্যাপার নয়। বাড়িতে নিয়মিত স্বাধীনতা পত্রিকা আসতো। সেখানে দিনের পর দিন পুলিসি অত্যাচারের ছবি এবং তার সঙ্গে খবরের শিরোনাম থেকেই কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিরোধের ভূমিকা সম্পর্কে ভাসাভাসা ধারণা গড়ে উঠতে থাকে। এছাড়া, এরই প্রতিক্রিয়ায় বাবার মাঝে মাঝে সহমর্মিতার প্রকাশ বা উচ্চারণ কিংবা মিটিং মিছিলে যোগদানের ঘটনাগুলিই জানিয়ে দেয় তিনি এইসব অত্যাচারের সক্রিয় প্রতিবাদী। একেই রাজনীতি বলে জানার কথা তো আমার ক্ষেত্রে পরে আসবে।

[ছবিঃ লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে]
বাবা শেষদিকে অন্তত দু-বার বড়ো সময়ের জন্যে হাসপাতালে ছিলেন। আপনি তখন কিশোর। মন খারাপ করতো বাবার জন্য? সেই দিনগুলি কেমন কেটেছে?
আমার জন্মের পর স্মৃতিধারণের ক্ষমতা যখন একটু একটু করে গড়ে উঠছে, তখন থেকেই দেখেছি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মাঝে মাঝেই অল্পবিস্তর অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এছাড়া, তাঁর সচেতন পাঠকমাত্রই জানেন তিনি প্রায় ২৬ বছর বয়স থেকে (১৯৩৫ বা সমসময়) দুরারোগ্য মৃগীরোগে আক্রান্ত ছিলেন। ডাক্তারদের মতে প্রাণান্তকর সাহিত্যসাধনার ধকল এর কারণ। আমরা জানি তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ তিনটি উপন্যাস রচিত হতে থাকে প্রায় সমসময়েই, দিবারাত্রির কাব্য বঙ্গশ্রী পত্রিকায় বৈশাখ ১৩৪১ থেকে, জৈষ্ঠ ১৩৪১ থেকে পূর্বাশায় শুরু হচ্ছে পদ্মানদীর মাঝি, ভারতবর্ষ পত্রিকায় পৌষ ১৩৪১ থেকে পুতুলনাচের ইতিকথা। ফাল্গুন ১৩৪১ সালে প্রকাশিত হয়েছে আর একটি বিশিষ্ট উপন্যাস জননী। এই রোগের আক্রমণে তাঁকে প্রায়ই দেখেছি রক্তাক্ত হতে। হয়তো বাবা তাঁর লেখার টেবিলে, মা এবং আমরা ভাইবোনেরা পাশের ঘরে। হঠাৎই একটা গোঙানির আওয়াজ — মা দিদিরা ছুটে গিয়ে বাবার মুখে গামছা গুঁজে দিচ্ছেন। যদিও ইতিমধ্যে প্রবল খিঁচুনিতে মুখের ভিতরে রক্তপাত ঘটে গিয়েছে। এমনও হয়েছে, পড়ে গিয়ে ফেটেছে মাথা। ফলে দিনের পর দিন বাবার অসুস্থতা, রক্তাক্ত হওয়ার দৃশ্য কখনো বা মদ্যপানে ঝিমিয়ে যাওয়ার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে কিছুটা মানসিক প্রস্তুতি হয়তো ছিল আমার। সর্বোপরি মনে হয় অত অল্প বয়সে খুব বেশি গভীরে মন খারাপ করে না।
আপনার পিতামহের কথা কি মনে পড়ে?
আমার ঠাকুরদা ছিলেন যথেষ্ট ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ এবং অনেকাংশে সংস্কারমুক্ত। বাবার প্রয়াণের দু-বছর পর তিনি প্রয়াত হন। ইতিমধ্যেই তিনি প্রত্যক্ষ করেন একই ঘরের ক্যানভাসের পার্টিশনের ওপাশে কৃতী পুত্রের অকাল প্রয়াণের প্রস্তুতি।
আপনারা আপনাদের আত্মীয়স্বজনদের সহায়তা কেমন পেয়েছেন? বিশেষত পিতৃকুলের, আপনাদের দুঃসময়ে বাবার মৃত্যুর পর কি কোনো যোগাযোগ ঘটেছিল? তাঁদের মধ্যে কেউ আসতেন? কোনো সহায়তা?
পিতৃকুলের সঙ্গে যোগাযোগ সাধারণভাবে অনিয়মিত ছিল বাবার জীবিতকাল থেকেই। অন্যান্য সহায়তা, ধরে নিচ্ছি আর্থিক সহায়তার কথা বলা হচ্ছে, ছিল না। আমার মনে হয়, সাহিত্যক্ষেত্রে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থান সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন না থাকলে সহায়তাদানের তাগিদও বোধ হয় সেভাবে আসে না। এবং বাস্তব ঘটনা হল তাঁদের সাধারণভাবে সাহিত্যের প্রতি বা অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে খুব একটা আকর্ষণ ছিল না, যদিও লেখকের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্কের গর্ব তাঁদের ছিল।

[ছবি – আন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত]
আপনার বাবার শেষ দিন মনে পড়ে? শোকযাত্রা? বাড়িতে জনসমাগম?
বাবা মারা গেলেন নীলরতন সরকার হাসপাতালে ৩ ডিসেম্বর ১৯৫৬, ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ। এর দু-দিন আগে থেকেই বাড়িতে শয্যাশায়ী প্রধানত ব্যাসিলারি ডিসেন্ট্রির আক্রমণে। ক্রমশ অচেতন হয়ে পড়তে থাকেন। শেষ পর্যন্ত ২ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর অ্যাম্বুলেন্সে প্রায় অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে। আজও আমার সেই দৃশ্য মনে পড়ে, প্রায় অচেতন অবস্থায় কলম ধরার ভঙ্গিতে ডান হাতটি শূন্যে তুলে ধরে কিছু একটা লেখার প্রাণান্তকর চেষ্টা করছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, যন্ত্রণাকাতর মুখে অস্ফুট অব্যক্ত ভাষা।
শোকযাত্রায় শুধুমাত্র আমার দাদাকে নেওয়া হয়েছিল মুখাগ্নি করার জন্য। অন্তিমযাত্রার বিবরণ আমরা পরের দিন খবরের কাগজ পড়ে জানতে পারি। বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো জনসমাগম বাড়িতে অন্তত হয়নি। শেষ কয়েক বছর যাঁরা, বাবা এবং আমাদের নানান সহায়তা দিয়েছেন, তাঁরা অবশ্যই নিয়মিত এসেছেন।
বাবার কোনো স্মরণসভায় গিয়েছেন?
প্রয়াণের ঠিক পরে পরেই কোনো স্মরণসভায় সম্ভবত যাইনি। তবে পরবর্তীকালে দু-একটি সভায় নিশ্চয়ই গিয়েছি, নির্দিষ্ট করে মনে করতে পারছি না।
বাবার প্রয়াণের পর আপনার স্বাবলম্বী হয়ে ওঠা, সংসারের হাল ধরা — মাঝের এই দীর্ঘ সময় নিয়ে যদি কিছু বলেন।
অনেকেই হয়তো জানেন, বাবার জীবিতকালের শেষ কয়েকটি বছর তাঁর চিকিৎসা এবং আর্থিক সঙ্কট সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক জগতের বিশিষ্ট কয়েকজনের ভূমিকার কথা। প্রখ্যাত ব্যারিস্টার এবং সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক অতুলচন্দ্র গুপ্তের অভিভাবকত্বে, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সক্রিয় সহযোগিতায় দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অমল দাশগুপ্ত, রমাকৃষ্ণ মৈত্র, প্রসূন বসু প্রমুখের প্রচেষ্টা লেখকের প্রয়াণের পরও অব্যাহত ছিল। তবে স্বভাবতই সেসব ছিল সাময়িক সমাধান। ১৯৫৮ সালে ঠাকুরদার প্রয়াণের পর আমরা কাছাকাছি অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ার (৬৫ টাকা থেকে ৫০ টাকা) একটি বাড়িতে উঠে আসি। এ সময়ে এমনও হয়েছে আমাদের এক শুভানুধ্যায়ীর ব্যবস্থাপনায় বাবার বইগুলির কিছু কিছু সৌজন্য সংখ্যা বরানগরের এক বই বিক্রেতার দোকানে অর্ধেক দামে বিক্রি করার ব্যবস্থা করা হয়। আবার, ঘনিষ্ঠ কয়েকজন আত্মীয়ের পরামর্শে সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার উপায় হিসেবে বহুল প্রচলিত প্রতিদিনের লক্ষ্মীপুজোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আমাদের মা সাধারণভাবে এধরনের ধর্মাচরণে খুব আগ্রহী ছিলেন না। তাছাড়া আমার গলার জোরও একটু একটু করে বাড়ছে। দেখা গেল অর্থাগম বৃদ্ধি পায়নি বরং বাতাসা, নকুলদানার খরচ থেকে যাচ্ছে। ফলে দেড় দু-বছরের মধ্যেই ওপাট চুকে গেল। এ সময়ে আমাদের এক অতিনিকট আত্মীয় দায়িত্ব নেয় প্রকাশনা-সংক্রান্ত বিষয়গুলি দেখাশোনা করার। কিছুকাল পরে আমাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যের একনিষ্ঠ পাঠক কবি যুগান্তর চক্রবর্তীর। ক্রমশ ঘনিষ্ঠতা থেকে লেখকের কনিষ্ঠ কন্যা আমার ছোড়দি শিপ্রার সঙ্গে বিবাহের আয়োজন। এ উপলক্ষে অর্থ সংস্থানের উদ্যোগ নিতে গিয়ে দেখা গেল সেই ঘনিষ্ঠ আত্মীয়টির দ্বারা আমরা প্রতারিত হয়েছি। ব্যাঙ্কের সঞ্চয় শূন্য, প্রকাশকদের কাছ থেকেও প্রাপ্য অর্থ তুলে নেওয়া হয়েছে। এ সময়েই প্রকাশনা-সংক্রান্ত বিষয়ের সমস্ত দায়িত্ব নিলেন যুগান্তরদা এবং তখন থেকে লেখকের রচনাগুলি অনেকাংশে সুষ্ঠুভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। মনে আছে, ১৯৬১-তে ছোড়দির বিয়েতে শ্রদ্ধেয় মুজফ্ফর আহ্মদ বিয়ের দিন সকালে এসে একটি দামী শাড়ি উপহার দেন। ১৯৬২-তে আমার বড়দি শান্তার বিবাহ হয়। দু-টি বিবাহই সামান্য আয়োজনে সম্পন্ন হয়। এরপর ১৯৬৬ সালে আমি একটি ব্যাঙ্কে চাকরি পাই, ফলে কিছুটা আর্থিক সচ্ছলতা আসে।

[ছবি – আন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত]
বাবার প্রয়াণের পর তাঁর পান্ডুলিপি, বইপত্র, কিভাবে রক্ষিত হল? কারা উদ্যোগ নিয়েছিলেন?
আমরা সকলেই ছোট, আমাদের মা সংসার এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামলাতেই ব্যস্ত। ফলে পান্ডুলিপিগুলি বাঁচিয়ে রাখার গুরুত্ব আমরা বুঝিনি সেই সময়। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা বা বাবার বাতিল করা কাগজপত্র দিয়ে নিয়মিত উনুন ধরানো হয়েছে। লেখক-পিতার মৃত্যু এবং নষ্ট করা পাণ্ডুলিপির জন্য আজও মনটা ভীষণ ভারাক্রান্ত হয়ে যায় আমার। পাণ্ডুলিপি বলতে শেষ পর্যন্ত থেকে গেছে কয়েকটি উপন্যাস, গল্পের বিচ্ছিন্ন কিছু অসম্পূর্ণ অংশ, প্রবন্ধের একাধিক অসম্পূর্ণ পাঠ, কয়েকটি ডায়েরি, বাঁধানো ছোটবড় কয়েকটি খাতা, চিঠিপত্র, কবিতার দু-টি খাতা, কবিতার কিছু ছিন্ন পৃষ্ঠা, ইংরেজিতে লেখা কিছু ‘নোটস্’ ইত্যাদি।
এই থেকে যাওয়া পাণ্ডুলিপি থেকেই আমরা পেয়ে যাই বাংলা সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পাদনা-সমৃদ্ধ লেখকের ডায়েরি, চিঠিপত্রের সংকলন, ‘অপ্রকাশিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় : ডায়েরি ও চিঠিপত্র’। সংকলনটি প্রকাশের পরে পরেই ডায়েরির কোথাও কোথাও লেখকের তথাকথিত ‘অতিলৌকিক’ উচ্চারণ প্রকাশ করার যৌক্তিকতা নিয়ে সম্পাদক যুগান্তর চক্রবর্তীকে অনেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করান, কখনো কখনো লেখক পরিবারকেও। তবে আজ এতদিন পরে মনে হয়, এই অভিযোগ অনেকটাই স্তিমিত হয়েছে। লেখকের সমগ্র সাহিত্যকর্ম, তাঁর বেঁচে থাকার সংগ্রাম, স্থায়ী অসুস্থতা, সর্বোপরি অস্তিত্বের অমোঘ দ্বান্দ্বিকতাই হয়তো এর কারণ। এছাড়া, এই পাণ্ডুলিপিগুলি থেকেই আমরা পেলাম তাঁরই সম্পাদনায় লেখকের কবিতার একটি সংকলন ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা’।
এ পর্যন্ত লেখকের মূল পাণ্ডুলিপির কিছু অংশ পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি এবং বাংলা একাডেমি, ঢাকাকে সংরক্ষণ তথা সম্ভাব্য গবেষকদের ব্যবহারের উদ্দেশ্যে প্রদান করা হয়েছে। ১৯ মে ১৯৯৭ লেখকের নব্বইতম জন্মদিনে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জননী, দিবারাত্রির কাব্য (প্রধানত আদিপাঠ), পদ্মানদীর মাঝি, পুতুলনাচের ইতিকথা, জীবনের জটিলতা (বহুলাংশে ভিন্ন একটি পাঠ), অহিংসা এবং কয়েকটি গল্পসহ মোট ৪৪৬ পৃষ্ঠার মূল পাণ্ডুলিপি কমলা বন্দ্যোপাধ্যায় তৎকালীন সংস্কৃতি দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাতে তুলে দেন। একইসঙ্গে বাংলাদেশের অগণিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাঠকের প্রতি কিছুটা দায়বদ্ধতা থেকে লেখকপত্নী ঢাকার বাংলা একাডেমিকে পাণ্ডুলিপির কয়েকটি পৃষ্ঠা প্রদানের একটি প্রস্তাব দেন এবং বলা বাহুল্য, তাঁরা অবিলম্বে সম্মত হন। ওইদিন সকালে কলকাতার বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশন দপ্তরের মাধ্যমে ঢাকা বাংলা একাডেমিকে বিভিন্ন রচনার নমুনাস্বরূপ ৪৬ পৃষ্ঠার মূল পাণ্ডুলিপি প্রদান করা হয়েছে। আমাদের কাছে থেকে যাওয়া পাণ্ডুলিপিগুলি ভবিষ্যতে উপযুক্ত স্থানে প্রদান করা হবে।

[ছবি – আন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত]
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নানা লেখালিখি, তার নানা পাঠ, সংস্করণ উদ্ধারে সুকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি ভূমিকা আছে আমরা জানি। এই কাজে কবে ব্রতী হলেন?
অনেকেই হয়তো জানেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমগ্র সাহিত্যের খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশ দীর্ঘকাল বন্ধ ছিল, প্রধানত সঠিক পাঠ সহ একটি সুসম্পাদিত রচনাবলী প্রকাশের তাগিদে। শেষ পর্যন্ত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অনলস উদ্যোগে আইনী জটিলতার বাধা পেরিয়ে, এবং অবশ্যই পূর্বতন প্রকাশনা সংস্থার সহযোগিতায়, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি থেকে নতুন ভাবে সমগ্র রচনা প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখনই সকলের সহযোগিতায় দ্বিগুণ উৎসাহে বেশ কিছু বলা যেতে পারে ‘উজ্জ্বল উদ্ধার’ সম্ভব হয়েছে। বিস্তারিত তথ্যে যেতে চাই না।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষ পালনের এক ব্যাপক উন্মাদনা চারপাশে দেখছি। যে মাত্রায় শতবর্ষ পালনের আয়োজন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কি ততখানিই পঠিত ? আমি এমন কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিনের কাছ থেকে শতবর্ষ পালনে আমার কিছু সহযোগিতার অনুরোধ পেয়েছি, যেসব পত্রিকায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্য নিয়ে এ পর্যন্ত হয়তো একটিও প্রবন্ধ বা আলোচনা প্রকাশিত হয়নি। তাঁর কিছু কিছু সাহিত্যকর্ম অবশ্যই পাঠক আনুকূল্য পায়, তবে তা কখনোই তাঁকে স্মরণ করার এই সার্বিক উদোগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আমার মনে হয়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিজীবনে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম, সাধারণ মানুষের প্রতি নির্ভেজাল দরদ, মমত্ব (যা তাঁর প্রথম লেখাটি থেকে শেষতম রচনাগুলির বাক্যবন্ধে এমনকি একটি বা দু-টি শব্দ নির্বাচনেও প্রকাশ পায়), লক্ষ্যে অবিচল থাকা, সর্বোপরি সাম্যবাদে আস্থা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা সম্ভ্রমের দূরত্বও এনে দিয়েছে এবং তাঁকে স্মরণ অনেকাংশে আনুষ্ঠানিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সন্দেহ নেই, তাঁর সাহিত্যের চর্চা উত্তরোত্তর বেড়েছে। আমাদের পারিবারিক সংগ্রহেই রয়েছে প্রায় ৪৫টির মতো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্য নিয়ে আলোচনাগ্রন্থ। কিছুকাল আগেও বাংলাদেশের সমালোচনা সাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ততটা চর্চিত ছিলেন না, কিন্তু আজ সেখানেও বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর সাহিত্যের আলোচনা প্রকাশিত হতে দেখি।
এই সুযোগে সাহিত্য সমালোচনা প্রসঙ্গে দু-একটি কথা বলতে চাই। লেখকের কিশোর গল্পগুলিকে বাদ দিলে এ পর্যন্ত লভ্য বড়দের গল্পের সংখ্যা ২৭২ এবং এর মধ্যে সাধুভাষায় লিখিত গল্প ৭৬টি এবং চলিতভাষায় ১৯৬টি। উপন্যাসের ক্ষেত্রে সাধুভাষায় ১১টি, চলিতে ২৬টি এবং কিছুকাল আগে সংগৃহীত একটি অগ্রন্থিত উপন্যাস লেখা হয়েছে আংশিক চলিত ভাষায় এবং বৃহত্তর অংশটি সাধু ভাষায়। কোনো একটি গল্প বা উপন্যাস কেন সাধুভাষায় বা চলিতে, গল্প বা উপন্যাসটির রচনার সময়কাল, সর্বোপরি রচনাটির কাহিনির প্রয়োজনেই সাধু বা চলিত ভাষায় প্রয়োগ, এ বিষয়েও তো চুলচেরা চর্চা হতে পারে ? প্রসঙ্গত, অধিকাংশ গল্পের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশের সময়কাল থেকে দেখা যাচ্ছে সাধারণভাবে ১৯৪১-৪২ সালের পর থেকে প্রকাশিত গল্পগুলির প্রায় সবকটি চলিত ভাষায় লেখা। আমরা জানি ১৯৪৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভের কয়েক বছর আগে থেকেই বিভিন্ন গণ-সংগঠনের সঙ্গে তাঁর সংযোগ বাড়ছে। এই সময়কালে বিভিন্ন মিছিলে দৃপ্ত পায়ে হেঁটে চলার সঙ্গে সঙ্গে লেখার ভাষাতেও কি আনতে চাইছেন সেই ঋজুতা এবং তাই এই চলিত ভাষার ব্যবহার ? আবার দিবারাত্রির কাব্য উপন্যাসটির প্রথম তথা আদিপাঠ লিখিত হলো সাধুভাষায়। প্রায় পাঁচ বছর পরে বঙ্গশ্রীতে ধারাবাহিক প্রকাশিত পাঠ লিখিত হলো চলিত ভাষায় এবং এটিই গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় গৃহীত হলো। কেন ভাষার এই পরিবর্তন ? কিছুকাল আগে আবিষ্কৃত এবং এ পর্যন্ত অগ্রন্থিত একটি উপন্যাসের পত্রিকাপাঠে এক ব্যতিক্রমী ভাষার প্রয়োগ লক্ষ্য করা গেল। ১২ কিস্তিতে সমাপ্ত ‘খুনী’ উপন্যাসটির প্রথম চারটি কিস্তি চলিত ভাষায় লিখিত হয়ে পঞ্চম কিস্তি থেকে শেষ পর্যন্ত সাধু ভাষার ব্যবহার। পঞ্চম কিস্তির সঙ্গে প্রকাশিত হলো লেখকের চার লাইনের প্রাসঙ্গিক মন্তব্য। তারই দু-টি লাইন : “… কাহিনীটি মনের মধ্যে স্পষ্টরূপ গ্রহণ করায় এখন মনে হইতেছে শুদ্ধ ভাষাই কাহিনীটির পক্ষে বেশি উপযোগী হইবে। তাই ভাষার এই পরিবর্তন।’ এবং উপন্যাসটি পাঠ করলে দেখা যাবে এখান থেকেই চরিত্রগুলির জটিলতা প্রকাশে রচনাশৈলীর এক আশ্চর্য উত্তরণ এবং সাবলীল গতি।
আর একটি বিষয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। তিনি তাঁর সমগ্র সাহিত্যকর্মের অধিকাংশ রচনার ক্ষেত্রে পত্রিকায় প্রকাশিত পাঠ গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় কম বা বেশি পরিমার্জন করেছেন এবং তুলনা করলে দেখা যাবে সেগুলির উল্লেখযোগ্য উত্তরণ ঘটেছে। এগুলি নিয়েও তো গভীরে আলোচনা হতে পারে।
সবশেষে, সাম্প্রতিককালের মানিকচর্চা বিষয়ে একটি আশার কথা বলি। সেটি এই যে, ইদানীং দেখা যাচ্ছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এখন আর ততখানি ফ্রয়েড বা মার্কস-এ অথবা প্রাক-কমিউনিস্ট বা কমিউনিস্ট-পরবর্তী পর্বে বিভাজিত হচ্ছেন না, সমগ্র মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সমস্ত দ্বন্দ্ব নিয়েই বিবেচিত হচ্ছেন। শৈলজ শিলা, টিকটিকি, ভূমিকম্প বা হলুদপোড়া প্রভৃতি গল্পকে অস্বীকার করবো কি করে?
(গণশক্তি, শারদ সংখ্যা ২০০৮ থেকে পুনর্মুদ্রিত)