শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

ইন্টারেস্টিং

কাল দুপুরের পর আর খাওয়া হয়নি। আজও সূর্য মাথায় উঠে গিয়েছে। সে সবের মধ্যেও রাস্তা দিয়ে হাঁটছে রতন, যেমন সবাই হাঁটে তেমনই। অনেক লোক আশেপাশে। মহিলা পুরুষ, কয়েকটা পথ কুকুর, এলোমেলো কাক, দুয়েকটা শালিক, গোছা ধরে পায়রা। প্রতিদিন যেমন হয়, কোথাও কোন পরিবর্তন নেই। একেই কি আবহমান বলে? মানুষের ষাট সত্তর আশি বছরের কূপমাত্র জীবনে আবহমান-এর অর্থ-র চেয়ে বড় মাপ ধরার কোন ব্যাপ্তি নেই। তুলনা করার মতো তুলাদন্ড নেই। রতন থেমে যায়। থেমে থাকে সময়, এক ঝিম ধরা নিরন্তর একঘেয়ে ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর নিজের কোটর জাত সে সময়, তার সঙ্গে যে অসংখ্য তারকামন্ডলী জোতিষ্ক উল্কাপিন্ড ইত্যাদির সময়ের কোন সম্পর্ক নেই। মহাবিশ্বের অর্বুদ অর্বুদ সূর্যের উদয় বা অস্ত কোনটাই হয় না, রাত দিন আসবে কোথা থেকে?

এমন নয় যে, রতন খাবার জোগাড় করার চেষ্টা করেনি। মাস তিনেক আগে একটা কোম্পানির রানার-এর কাজে ঢুকে ছিল। সেখানে হাঁটার জন্যই টাকা পেত। কখনও কোর্টে যেত স্ট্যাম্প পেপার কিনতে, কখনও কুরিয়ার আপিসে চিঠি পোস্ট করতে, কখনও বড় সাহেবের বাড়ি থেকে, ম্যাডামের সই করিয়ে আনতে, রতন হেঁটেই যেত। হাঁটতে হাঁটতে রতন শহর চেনে, হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়িয়ে পড়ে, রাস্তা কত গল্প সাজিয়ে রাখে। লোকজন গল্প করে, ঝগড়া করে। ফিলিস্তিনী ইহুদী, রাশিয়া ইউক্রেন, ভারত পাকিস্তান, ইদানীং বাংলাদেশ ভারত ইত্যাদি নানা বিষয়। রতন ভুলে যায়, কোথায় যাওয়ার কথা? কী যেন করার কথা? এমনি করলে কোম্পানিও ভুলে যাবে, এ আর আশ্চর্য কী! রতন দমে না, হাঁটতেই থাকে, হাঁটতেই থাকে। কেউ বলল, “অন্য কোথাও চেষ্টা কর।”
চেষ্টাও হয় তেমনই। হাঁটতে হাঁটতে ভুলে যায়, কোথায় যেন যাওয়ার ছিল?

রতন অনায়াসে বিশ্বাস করতে পারে, ঠিক কোনভাবে পার হয়ে যাবে। রাস্তা জুড়ে এত শালিক, কিম্বা পায়রা অথবা কুকুরের দল। এদেরও চিন্তা থাকে, পেট ভরানো, মন ভরানো। সে ভাবনা কে ভাবলো? ঠিক ঠিক তো জুটেও গেল। রতন তেমন হাঁটতে থাকে এক কোম্পানি থেকে অন্য কোথাও। জলের ওপর পানা যেমন। চলতে চলতে আটকে যায় কোন ঘাটে, আবার কেউ জল ছেটালো, ঢেউ তুলল হালকা করে। ভাসতে ভাসতে হাসতে হাসতে রতন তেমন চলতে থাকে।

হঠাৎই বাইরে চোখ যায়, বড় দিঘির পাড়ে কৃষ্ণচূড়া আর জারুল, বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে। রতন বোঝে অবিকল, এ তো পরিচিত পাড়া নয়, অনায়াসে ভেবে নিতে পারে কোন ভিনদেশী রাজপথ, এখুনি রাজন্যবর্গের পালকি আসবে। রতনের আজ মনে প্রভূত আনন্দ! রাজ সন্দর্শনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে। রতন অনায়াসে ভুলে যেতে পারে যে, কাল দুপুরের পর খাওয়া জোটেনি। এর জন্য শরীরটা একটু আনচান করছে বটে, তবে মন খারাপ নেই। চুলে একটু আঙুল চালায়, পুরোন জামাটা একটা ঘটিতে গরম জল ঢেলে, তাই দিয়ে ইস্ত্রি করার চেষ্টা করে। ভাঁজগুলো মোটামুটি দূরীভূত হয়। প্যান্টের ওপর ছাল ওঠা পুরানো বেল্টের ফাঁক দিয়ে জামাটা গুঁজে ফেলে। বেল্টের দৈন্য নজরে পড়ায়, জামা খুলে পরাই সাব্যস্ত করে। দুবার পেরক ঠোকা চটিতে পা গলিয়ে দিঘির পাড়ে গিয়ে উপস্থিত হয়।

পালকি নেই, পোর্শে আছে। নাটি রথসচাইল্ড নেমে এসেছে দরজা খুলে। দীর্ঘদেহী, উন্নত নাসা, গৌরবর্ণ, স্বাস্থ্যবান নাটি, একজন ইরানী ইহুদী। রতনের চোখে রাজপুরুষ এমনই হয়। হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎই কয়েকটি অল্প বয়সী ছেলে ওকে ঘিরে ধরে। সম্ভবত টাকা চাইছে। রতন এই ছেলেদের চেনে, এই পাড়ার মুখে ওদের রাজনৈতিক আড্ডাঘর। রতন বুঝতে পারে সাহেব বেশ বিব্রত। রতন ভিড় ঠেলে কাছে যায়। ও কাজ চালানোর মতো ইংরাজি জানে। তাই দিয়েই নাটিকে আশ্বাস দেয়। ছেলেগুলোকে বোঝায়, সাহেবকে যেন ও নিতে এসেছে। ছেলেগুলো বেশ বিরক্ত। গজগজ করতে করতে সরে যায়। একজন আওয়াজ দেয়, “ইংরাজি পারিস বলে, একাই খাবি?” রতন জবাব দেয়না। নাটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে এসে, ভাঙা ভাঙা ইংরাজিতে রতনকে একটা ঠিকানা জিজ্ঞাসা করে। ওদের পাড়ার শেষে এখনও কয়েক ঘর ইহুদী বসবাস করে। ওরা বলে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। ঠিকানা দেখে বোঝে, ‘মেম-মাসি’-র বাড়ি। নাটি সেই জায়গার কথাই বলছে। রতন, সম্মোহিত-র মত রাস্তা দেখায়। এত হদ্দ সরু গলিতে অমন ময়ূরপংখী গাড়ি ঢুকবে না। রাজপুরুষ হেঁটেই চলে, রতনকে বলে, “প্লিজ, এসকর্ট, ইফ ইউ আর নট বিজি।”

হেঁটে বেড়ানোই রতনের কাজ, তাই নাটির সঙ্গে চলল। রতন জিজ্ঞেস করে, “মেম-মাসি তোমার কে হয়?”
“ইউ মিন, অ্যানি? শি’জ মাই আন্ট।”
“তোমারও মাসি? আমরাও মাসি বলি।”

“তোমরা মানে?”
“আমাদের পাড়ার সবাই। মেম-মাসির কেক খুব ফেমাস। ক্রিসমাসে সবাই লাইন দিয়ে কেনে।”
“ক্রিসমাস? তোমরা ক্রিসমাস পালন কর?”
রতন শুনে অবাক হয়ে যায়! একজন সাহেব ক্রিসমাস শুনে এমনভাবে চমকে যাবে, ওর ভাবনার বাইরে।
নাটি হেসে বলে, “তোমাদের এখানে ছুটি থাকে নাকি?”
রতন বলে, “ও বাবা! ক্রিসমাসে সারা দেশ ছুটি!”
“বল কী! তোমাদের দেশেও এই পরবে ছুটি?”
“আমাদের সবার পরবেই ছুটি থাকে। তোমাদের থাকে না?”
“না না ক্রিসমাসে ছুটি কেন থাকবে? আমাদের সেপ্টেম্বর আর এপ্রিলে প্রধান ফেস্টিভাল।”

রতন একটু থেমে বলে, “তোমাদের তো যুদ্ধ হচ্ছে। তাই না?”
“আমি ম্যারিকা থাকি। হ্যাঁ, তেল আবিভ-এ কিছুটা ডিস্টারবেন্স আছে।” ভাঙা ইংরাজিতেই বলে নাটি।
রতন হাসে, এসব গল্প সে রাস্তাঘাটে শুনে শুনে জেনে গেছে। এখানকার হাওয়াতেও শত্রুতা ঘোরে। রতন যেন গোলাবারুদের গন্ধ পায়।
নাটি বলে, “তোমাদের পাশের দেশেও তো ডিসটার্বান্স চলছে।”
“ঝামেলা কোথায় নেই?” রতন খুব গম্ভীর বিশেষজ্ঞর মতো কথা বলে। মনে মনে ভাবে, নিজের পেটের ভেতরই কত ঝামেলা! কাল থেকে খাবার না পাওয়াতে, সেখানেও একটা বিদ্রোহ দানা বাঁধছে। তবে হাতের কাছে একজন সদ্য বিদেশ থেকে আসা মানুষকে পেয়ে, আরও অনেক প্রশ্ন বুড়িবুড়ি কাটে, “ওই লোকগুলো না থাকলে, পৃথিবীটা সুন্দর হত, তাই না?”
নাটি এতটা আশা করেনি। হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়িয়ে পড়ে। বৃষ্টিভাব বাতাসে ভাসে, লম্বা শ্বাস টেনে বলে, “তাহলে পৃথিবীটা বোরিং হয়ে যেত। কনফ্লিক্ট মেকস লাইফ ইন্টারেস্টিং!”
রতন যেন খুব বুঝেছে। ঘাড় নেড়ে বলে, “যুদ্ধ না হলে পৃথিবীর রঙ ধরবে না?”
“ভেবে দেখো।”
রতন চিন্তায় পড়ে যায়। ওকে এভাবে কেউ বলেনি। রাস্তাঘাটে, আপিসে আদালতে, আলোচনার ক্ষেত্রে, সবসময়ই লোকজন একজন প্রতিপক্ষকে দাঁড় করায়। এতে বোধহয় তর্ক করতে সুবিধা হয়। সত্যিই শত্রুতা না থাকলে, লোকে কী নিয়েইবা আলোচনা করত? রামায়ণ বা মহাভারতের মতো মহাকাব্য তো শত্রুতার জন্য লেখা হয়েছে। সব ঠিকঠিক চললে তো নিছক ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে যাবে।

হাঁটতে হাঁটতে দুজনে পাড়ার ভেতরে সেঁধিয়ে যায়। লাল বাড়ির সবুজ দরজা, এ বাড়ি রতনের চেনা। মেম-মাসি থাকে। আওয়াজ পেয়ে ছিটকিনি খোলে বুড়ো মেম। রতন অবাক চোখে দেখে, নাটি গিয়ে জড়িয়ে ধরে মেম-মাসিকে। ঠিকানা দেখিয়ে রতন ফিরে আসবে, তখন নাটি ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, “থাংক্যু ভেরি মাচ।”
মেম-মাসি-রও খেয়াল হয়, রতন দাঁড়িয়ে আছে। সে দিকে চোখ ফেরায়, “রতন! ভেতরে আয়।”

পাড়ায় সময়ে অসময়ে রতন কাজে আসে। সবাই ওকে চেনে। ফাইফরমাস খেটে দেয়। ঠোঁটে হাসি লেগে থাকে অমলিন। ঘরের ভিতর অন্ধকার। পুরোন আলোর অত জোর নেই যে ঠেলে সরাবে! লোকটিকে দেখিয়ে মেম-মাসি বলে, “আমার দিদির ছেলে। আমেরিকায় থাকে। আমায় দেখতে এসেছে।”

প্রাচীন আসবাবে ঠাসা এই ঘরে রতন আগেও এসেছে। এমন ফুলছাপ ওয়ালপেপার লাগানো ঘরে, কাঠের গোল টেবিল আর চেয়ার। রাশি করা বই, জামা, ওয়াইনের বোতল সহ আরও হিজিবিজি জিনিস। সে সব ঠেলেঠুলে জায়গা করে দেয়। নাটি বসে, রতন দাঁড়িয়ে থাকে।

নাটি বলে, “হোয়াই ডোন্ট ইউ সিট?
রতন হাসে। মেম-মাসির অগোছালো ঘর, বসার জায়গা নেই, রতন জানে। দাঁড়িয়েই থাকে।
বোন-পো কে যত্ন করতে মেম-মাসি তখন ব্যস্ত। রান্নাঘরে খুটখাট আওয়াজ হয়। একটু পরে একটা প্লেট-এ করে বেশ কয়েক টুকরো কেক নিয়ে অসে। নাটিকে দেয়, তারপর রতনের দিকেও মেলে ধরে। রতন হাত পেতে নেয়। মেম-মাসির রান্নার হাত জবরদস্ত। এ পাড়ায় ওঁর কেক, পাউরুটি, পেস্ট্রির খুব কদর।
কেকটা খেয়ে উল্টো হাতে মুখ মোছে। শরীরটা যেন খিলখিলিয়ে ওঠে। চব্বিশ ঘন্টা পার করে কিছু পেটে গেল, তা আবার এমন অপূর্ব স্বাদ। খালি পেটে যে যুদ্ধটা চলছিল, সেটাই যেন কেক-এর স্বাদটা আরও ইন্টারেস্টিং করে তুলল। “আমি যাই, মাসি?”
মেম-মাসি একটু হাসে, “কটা কেক ঘরে নিয়ে যা।”
“আমার ঘরে রাখার জায়গা নেই।”
“তার চেয়ে বল, কেক পছন্দ হয়নি।”
“কী যে বল মাসি? তোমার কেক লোক যে লাইন দিয়ে নেয়!”
“তাহলে তুই নিচ্ছিস না কেন?”
“সত্যিই রাখার জায়গা নেই। আবার খেতে ইচ্ছে হলে, চলে আসব।”
মেম-মাসি হাসে, “ঠিক আছে, আসিস।”
নাটি বাংলা কথা বোঝার চেষ্টা করে, “আর ইউ লিভিং?”
রতন আবার হাসে।
নাটি পকেট থেকে পার্স বার করে। দুটো পাঁচশো টাকার নোট নিয়ে রতনকে দিতে চায়। রতন চমকে ওঠে, “কেন?”
“ইউ হেল্পড আ লট। থ্যাংক্যু।”
ঠোঁটের কোণে কেক-এর টুকরো লেগেছিল। হাত দিয়ে পরিস্কার করে, হেসে বলে “লাগবে না।”
হাজার টাকা মানে অন্ততঃ দশ বারো দিনের খাওয়ার চিন্তা চলে যেত। রতনের ভিতরে কী যেন জেগে ওঠে! ওকে দুহাত দিয়ে অনেক ওপরে তুলে ধরে। এই এঁদো গলি, সুন্দর পোর্শে, মেম-মাসির কেক-এর গন্ধ, অনেক দূরের কোন দেশের যুদ্ধ, বোমার আঘাতে গুঁড়িয়ে যাওয়া বাড়িঘর হাসপাতাল, সব ছাড়িয়ে অনেক উঁচুতে উঠে যায়।

এতক্ষণে বেলা পাল্টে রাত নেমে এসেছে। রতন রাতের দিকেও অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। দিনের বেলা আকাশে কিছুই চোখে পড়ে না। অথচ রাত নামলেই কেমন ফুটকি ফুটকি আলোতে সবটা ভরে যায়। সব তো এখানেই থাকে, কিন্তু দেখা যায় না। ঠিক যুদ্ধের মতো, সবসময়ই মানুষের মনে মধ্যে লড়াই, ঘৃণা চলতেই থাকে, বাইরে থেকে বোঝা যায় না। মনে হয় কত না সদভাব! যেই একজন বোমা ফাটায় অমনি সবার বুকের ভেতর থেকে জমে থাকা শ্লেষ্মার মতো সব বেরিয়ে আসতে থাকে। চারিদিক দূষিত করতে থাকে। অথচ নাটি তাকেই ‘ইন্টারেস্টিং’ বলল। রতন ভাবে আর হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে খুঁজতে থাকে, ইন্টারেস্টিং হয়ে ওঠার মানে।

[লেখকের অন্য রচনা]

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Sougata Dey
Sougata Dey
4 days ago

Darun!

গণদীপ বিশ্বাস
গণদীপ বিশ্বাস
3 days ago

অপূর্ব চরিত্র বিন্যাস। দুটি ভিন্ন জগৎ কে আঁকা হয়েছে শব্দের তুলিতে এক অনবদ্য মুন্সীয়ানায়। চরিত্রগুলি যেন আমাদের ভীষন চেনা, তাই আরও নৈকট্য অনুভব করলাম। লেখক সৌরভকে অনেক শুভেচ্ছা।

2
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x