(১)
বিকালের এই সময়টা খুব প্রিয় বাবানের। সারা দিনের তেজ হারিয়ে লালচে রবি পাড়ি দিচ্ছে অন্য দেশে। পাখিরা ডানায় আজকের হুটো-পাটির স্মৃতি নিয়ে নীড়ে ফিরছে। ক্লান্ত মাঝিও সারাদিনের পারাপার সাঙ্গ করে ঘরে ফিরছে। এরকম লালচে-নীল বিকাল সঙ্গী করে তিয়াসা এসে বসল দোলতলা ঘাটে, আগে থেকে বাবানের ঠিক করে রাখা পছন্দের আসনে।
‘কি রে, মন দিয়ে কি এত দেখছিস’, বাবানকে খোঁচায় তিয়াসা।
‘তুই কখন এলি’, বাবান গঙ্গার ঘাট থেকে দৃষ্টি ফেরায়।
‘সেই তো, আমার উপস্থিতি চোখে পড়ার সময় কোথায় তোর’, কপট চাউনি দেয় তিয়াসা।
‘স্যরি’, ঈষৎ দুঃখ প্রকাশ করে বাবান।
আরো বলে, ‘কি সুন্দর লালচে টপ পড়েছিস,নীল জিন্সটার সঙ্গে দারুন মানিয়েছে, ঠিক যেন আজকের বিকালটার মতন স্নিগ্ধ, সুন্দর’।
তিয়াসা বুঝে যায় এতক্ষণ কী নিয়ে তন্ময় ছিল বাবান। বরাবরই ও এরকম রোমান্টিক, তন্ময় হয়ে ভাবে চলমান জীবন নিয়ে, এই জন্যই বাবানকে এত ভালোবাসে তিয়াসা। এই ভাবনার মাঝেই প্রেমের কবিতা যখন ভর করে, লিখে হোয়াটস-অ্যাপে পাঠায় বাবান, তিয়াসার মন ভরে যায়।
ইলেভেনে ইংরাজী টিউশান পড়তে গিয়ে আলাপ বাবান আর তিয়াসার। আলাপ থেকে অন্তরঙ্গ হল পরিচয়, পড়া শেষ হলেই চলে আসত উত্তরপাড়ার গঙ্গার এই ঘাটে। ব্যস বাবানকে আর পায় কে, অনুপমের লেখা-সুর দেওয়া গানগুলো গেয়ে উঠত বাবান পরপর। মাঝে মাঝে গীটার সঙ্গ দিত। ভরে যেত আশপাশটা, ঝুপ করে সন্ধ্যা নামত, দূরে স্টিমারের ভোঁ দিন শেষ জানান দিত।
‘কি রে, কি এত ভাবছিস’, বাবানের কথায় বর্তমানে ফিরে আসে তিয়াসা অতীত থেকে।
‘আজ কোন গান শোনাবি বাবান’, তিয়াসার কথায় পুরনো দিনের রেশ।
বাবান একটু ভেবে বলে, ‘মাথায় এসেছে একটা ভাবনা, বাড়ী ফিরে লিখে পাঠাব’।
তিয়াসা চুপ থাকে, প্রতিক্রিয়া দেখায় না। ও আসলে অন্য কথা ভাবছিল ভেতরে ভেতরে। স্কুল পাশ করে বিটেক পড়তে কলকাতা চলে যায়, পাশ করে সেখানেই চাকরী। ওর অফিসের যাতায়াতের কথা ভেবে বাবা-মা নিউটাউনৈ ফ্ল্যাট কিনেছে, উত্তরপাড়ার পাট চুকিয়ে সবাই ওখানে চলে গেছে। বাবান এখানেই থেকে গেছে, কলেজ পাশ করে একটা কলেজে পড়ায়, সঙ্গে ওর গানের দল আছে এখানেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। ছুটির দিনগুলোয় তিয়াসা চলে আসে, এই গঙ্গার ঘাটে দেখা করতে।
আজ যেমন এসেছে, ওদিকে অফিস থেকে নতুন প্রোজেক্টে দিল্লী যেতে বলেছে। কি করে দেখা হবে চলে গেলে, বিচ্ছেদের বেদনায় গলা ধরে আসছিল।
শোনার পর বাবানও কিছুক্ষন চুপ ছিল।
‘কবে যেতে হবে’, উদাস মাখা গলায় শুধোয় বাবান।
‘পরের উইক-এন্ডে’, বাবানের হাত জড়িয়ে তিয়াসা উত্তর দেয়। সন্ধ্যাতারা ওর নীরব অভিমানের সাক্ষী থাকে। ‘ওখানে খুব মিস করব বাবান তোকে, চাইলেও দেখা হবে না। আর মিস করব নদীর পাড়ে বসে চলে যাওয়া বিকেল দেখতে’।
ছোটবেলার বন্ধু তিয়াসার জন্য একটি নদী কিনবে ভেবেছে বাবান, অনেকদিন ধরে।
তিয়াসাকে একথা বলতে তিয়াসা ভাবে, নাহ, বাবান টা আগের মতন খেয়ালি রয়ে গেল।
(২)
পাঁচ মাস পর নিজের শহরে ফিরে বেশ রোমাঞ্চ লাগছে তিয়াসার। এই ক’মাস দিল্লীতে খুব মিস করেছে কলকাতা, বাবা-মা আর বাবানকে। বাবান সারপ্রাইজ দেবে বলেছে তিয়াসার জন্মদিনে, তাই আসতে বলেছে। কিন্তু পরিচিত দোলতোলা-ঘাট, উত্তরপাড়া কফিশপ নয়, নতুন ঠিকানা, জিটিরোডের ওপর নতুন অ্যাপার্টমেন্ট। লিফ্ট করে চারতলায় উঠেই দেখে একগাল হাসি নিয়ে বাবান দাঁড়িয়ে। জড়িয়ে ধরে একটা নতুন ফ্ল্যাটে নিয়ে গেল, হলটা বেলুন দিয়ে সাজান, সঙ্গী ‘হ্যাপি বার্থডে তিয়াসা’। ওকে টেনে মাস্টার বেডরুমে নিয়ে গেল বাবান, পশ্চিম দিকের জানলা দিয়ে দেখা যায় গঙ্গা আর বইছে খোলা হাওয়া। লালচে-নীল আকাশ, আর শোনা যায় স্টিমারের ভোঁ।
‘করেছিস কি’, বিস্ময় কাটে না তিয়াসার।
‘অনেকদিন ধরে ভেবেছি তোকে নদী কিনে দেব, লোন নিয়ে গঙ্গাপাড়ের ফ্ল্যাট কিনে নিলাম। যখন দিল্লীতে নদীর পাড়ে বিকাল মিস করবি, ছুটে চলে আসবি এখানে কাকু-কাকিমাকে নিয়ে। চুটিয়ে সূর্যাস্ত উপভোগ করবি প্রতিদিন, আমি যেদিন ঘুরঘুর করব আশেপাশে, নেমে আসবি। আগের মতন ঘাটে চলে যাব বিকাল দেখতে’, একনিঃশ্বাসে বলে থামে বাবান।
‘সে তো বুঝলাম কিন্তু তার জন্য গোটা ফ্ল্যাট কেউ কেনে’, জন্মদিনের সারপ্রাইজে ঘোর কাটে না তিয়াসার, ‘আর প্রোজেক্ট শেষ হলে কলকাতায় ফিরে আসবই’।
‘জানি, ততদিনে বিয়ে করে থাকব আমরা দুজন এখানে’, পরিকল্পনা জানায় খেয়ালি বাবান।
‘আর আমার অফিস, এতদূর থেকে…’, তিয়াসার কথা শেষ হয় না, বাবান কাছে টেনে নেয়, ‘পরে ভাবা যাবে, আর তোদের কিসব ওয়ার্ক-ফ্রম হোম আছে কি করতে’ বাবানের আদর আর, যুক্তিবানে হাল ছেড়ে দেয় তিয়াসা।
অপূর্ব। খুব সুন্দর ভাবনা, ঝরঝরে লেখা। চরিত্রগুলো খুব জীবন্ত, চোখের সামনে ভেসে উঠল। লেখকের হাতে ভালবাসা জমা রইল।
ধন্যবাদ ভালো লাগা জানানোর জন্য
মন ভালো করা একটা লেখা। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম।😊