আমরা যদি অভিধানে ‘ভদ্রলোক’ শব্দের অর্থ খুঁজতে যাই তা হলে যে সব অর্থ দেখতে পাবো তার সঙ্গে ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণি বলতে আসলে যা বোঝায় তার যথার্থ মিল পাবো না। অথবা যা পাবো তা অন্ধের হস্তী দর্শনের মত। খন্ডিত অংশের আভাষ মাত্র। অভিধানে ভদ্রলোকের প্রতিশব্দ বোঝাতে কোথাও লেখা আছে – ‘ভালো আচরণসম্পন্ন ব্যক্তি’ কোথাও বা ‘সজ্জন’ কোথাও বা ‘শিষ্ট, সভ্য’। এর মধ্যে কোনোটাই ভদ্রলোক শ্রেণিকে সম্যক ভাবে বোঝাতে পারে না ।
ভদ্রলোক খুব প্রাচীন শব্দ নয়। উনিশ শতকের প্রথম দিকে এই শব্দবন্ধের প্রয়োগ শুরু হয়েছে । ঔপনিবেশিক শাসনের ক্ষেত্র বিস্তারিত লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে যখন বাঙালি সমাজের একটা নুতন করে শ্রেণিবিন্যাস ঘটে যাচ্ছিল, তখনই এই ভদ্রলোক শ্রেণির উদ্ভব হয় এবং কালক্রমে এই শ্রেণির জীবনশৈলী এবং সংস্কৃতির মধ্যে এমন কিছু বিশেষত্ব তৈরি হয়, যেগুলি বাঙালি ভদ্রলোক শ্রেণির পরিচায়ক হয়ে ওঠে ।
সাবেকি নৃতত্ব, সমাজতত্ব বা প্রত্নতত্ব কোনো বইতেই এই ‘বাঙালি ভদ্রলোক’ নামের বিশেষ শ্রেণীর উল্লেখ পাওয়া যাবে না‘। কারণ এদের গায়ের রঙ, চোখের মণি, শারীরিক গঠন, জিনোম সিকোয়েন্সিং এই সবের মধ্যে এমন কোনো বৈচিত্র্য পাওয়া যাবেনা যা দেখে আলাদা করে এই শ্রেণিকে চিনে নেওয়া যেতে পারে।
কিন্তু তাও বাঙালি ভদ্রলোক বললে জনমানসে এক ধরণের ছবি ভাসে । কয়েকজন সমাজবিজ্ঞানী ‘বাঙালি ভদ্রলোক’কে আলাদা আলাদা রকম ভাবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। সে কথায় পরে আসছি। ইংরেজরা নিজেদের প্রয়োজনেই বাঙালিদের কিছু শ্রেণি বিভাগ করে নিয়েছিল ।
১৮২২ সালে এইচ টি প্রিন্সেপ সাহেব (ইংরেজ আমলা, আই-সি-এস এবং ঐতিহাসিক) রাধাকান্ত দেবকে অনুরোধ করেছিলেন তৎকালীন বাংলার সম্মানীয় ব্যক্তিদের একটি তালিকা তৈরি করে দিতে। সাহেব কি চাইছেন তা রাধাকান্তকে বোঝাবার জন্যে যে শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছিলেন সেটি হল – “respectable and opulent natives of the Presidency”। রাধাকান্ত দেব সাহেবের মন রাখতে তাঁর মত করে তেইশটি পরিবারের একটি তালিকা তৈরি করে দিয়েছিলেন, যদিও ‘ভদ্রলোক’ শব্দটি রাধাকান্ত ব্যবহার করেন নি । এই তেইশটি পরিবারকে বেছে নেওয়ার পিছনে তাঁর ঠিক কি মাপকাঠি ছিল তা জানা যায় না। তবে এই তালিকায় তখনকার অনেক বিশিষ্ট ব্যাক্তির নামই বাদ পড়েছিল। তার মধ্যে ছিলেন রামমোহন রায়, মতিলাল শীল, রামকমল সেনের মত মানুষেরাও। এর কারণ এটা হতে পারে যে সে কালেও বাঙালির গ্রুপবাজি ব্যপারটা বোধহয় বেশ প্রকট ছিল। রাধাকান্ত দেব তাঁর অপছন্দের মানুষদের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন। কারণ যাই হোক, প্রিন্সেপ সাহেব তাঁর নিজের অজান্তে তখনই বাঙালিদের মধ্যে এই ভদ্রলোক গোষ্ঠীর সূচনা করে দিয়েছিলেন।
প্রায় এই রকম সময়েই ভবনীচরণ বন্দোপাধ্যায় তাঁর ’কলকাতা কমলালয়’ নামের একটি বইতে ‘ভদ্রলোক’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন। তিনি হয়ত ইংরেজদের ‘gentleman’ শব্দটির একটি যুতসই প্রতিশব্দ খুঁজে বার করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে ইংরেজদের ‘gentleman’ যে অর্থে ব্যবহৃত হত বাঙালি ভদ্রলোক শব্দের ব্যঞ্জনা তার থেকে অনেকটাই আলাদা। অবশ্য ভবানীচরণ তাঁর লেখা বই ‘নববিবিবিলাস’ এবং ‘কলিকাতা কমলালয়’-তে এই ভদ্রলোক শ্রেণীকে ব্যঙ্গই করেছেন তাদের বাবুয়ানির জন্য । তবে অন্য মতে ভদ্রলোক শব্দটি ব্যবহার হয়েছিল ১৮২১ সালে সমাচার দর্পন পত্রিকায়। তবে প্রথম উল্লেখের সন তারিখ যাই হোক, ভদ্রলোক শব্দটি খুব একটা ব্যবহার তখন শুরু হয়নি।
J.H Broomfild সাহেব একজন সামাজিক-ইতিহাসের স্কলার এবং লেখক, যিনি ‘বেঙ্গল’কে তাঁর আগহের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে বেশ কিছু লেখালেখি করেছেন , তিনি বাঙালি ভদ্রলোকের একটি সংজ্ঞা নির্ধারন করেন – “ … distinguished by many aspects of their behavior , their deportment , their speech , their dress, their style of housing , their eating habits, their occupation and their association – and quite fundamentally by their cultural values and sense of social propriety.
সেই সঙ্গে ব্রুমফিল্ড সাহেবের পর্যবেক্ষণে ভদ্রলোকেদের আরো কয়েকটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ধরা পড়েছে, সেগুলি এই রকম –
১) কায়িক শ্রম বা চাষবাসের প্রতি অনীহা।
২) নিজেদের সামাজিক অবস্থানের উন্নতি ঘটানোর জন্যে জমির মালিক হওয়া বা জমিদারি পাওয়ার আকাঙ্খা।
৩) যে কোনো মূল্যেই হোক ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণ করার চেষ্টা।
৪) সংস্কৃতি চর্চায় আগ্রহ, বিশেষ করে সংগীতে।
৫) শহরে বসবাস করা এবং বাড়ি তৈরি করার আকাঙ্খা পোষণ করা
৬) মাসমাইনের চাকরিতেই সন্তুষ্ট থাকা।
খুব ছোটর মধ্যে হলেও এই কয়েকটি বাক্যে সাহেব কিন্তু বাঙালি ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের মূল বিশেষত্বর জায়গাটা ধরেছেন ঠিক। তাদের আচরণ, রীতিনীতি, কথাবার্তার ধরণ, পোশাক আসাক, গৃহসজ্জা, তাদের বৃত্তি, তাদের মেলামেশার পরিধি এবং অবশ্যই তাদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং সামাজিক অবস্থান – এ সবই তো ভদ্রলোকের পরিচয়-চিহ্ন বহন করত ।
তবে উনিশ শতকে ভদ্রলোক শ্রেণির সঙ্গে জাতপাতেরও একটা অলিখিত সম্পর্ক ছিল বলেই অনেকে মনে করেন। উনিশ শতকে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ এবং বৈদ্য এই তিন জাতের মধ্যেই ভদ্রলোক শ্রেণি সীমিত ছিল। ব্রুমফিল্ড সাহেবে স্বীকার করে নিয়েছেন বিংশ শতাব্দীতেও এই চিত্র খুব একটা বদলায় নি। পশ্চিমবাংলার সংস্কৃতি, শিক্ষা এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে মূলত এই তিন জাতির প্রতিনিধিত্বই এই সময়েও বেশি দেখা যায়। অবশ্য অনেক গবেষক এ কথা মেনে নিতে চান নি। কেউ কেউ উদাহরণ দিয়েছেন মতিলাল শীল (সুবর্ণ বনিক), গৌর চাঁদ বসাক(তন্তুবায়) – এদেঁর মত ব্যাক্তিও চিলেন, যাঁরা ভদ্রলোক শ্রেণীকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
কি ভাবে এই শ্রেণীর উৎপত্তি হল তা একটু বোঝবার চেষ্টা করা যাক ।
ঔপনিবেশিক শাসনকালে শাসন ব্যবস্থাকে চালু রাখার জন্যে দরকার হয়ে পড়ল কিছু ইংরেজী জানা নেটিভ মানুষজনের, যারা মূলত করণিকের কাজ বা মুৎসদ্দি, দেওয়ানগিরি, মুন্সি, বেনিয়ান গিরি এই সব ধরণের কাজ করবে।
বেনিয়ান শ্রেণি মূলত নিজেদের টাকা বিনিয়োগ করে ব্যবসা করত এবং প্রায়শই বেশ ভালো রকম লাভ করত। বৃটিশ কর্মচারীরা তাঁদের নাম ব্যবহার করতে দিত এবং আইনসম্মত অধিকার দিত। অবশ্যই সেটা অর্থের বিনিময়ে।
দেওয়ানরা নিজেরা অর্থের বিনিয়োগ করত না। তারা বৃটিশদের হয়ে ব্যবসার সমস্ত কিছু দেখাশোনা করত। উৎপাদন, সরবরাহ থেকে ব্যবসা চালানোর সব খুঁটিনাটিই নিয়ন্ত্রণ করত। তাঁদের নিচে ছিল গোমস্তা, দালাল, পাইকার ইত্যাদিরা। কিছুটা ইংরেজদের বদান্যতায়, কিছুটা নিজেদের কুশলতায় অনেক বাঙালিই এই সব করে ভালো রকমের অর্থ রোজগার করতে লাগল ।
কলকাতা শহর ভারতের রাজধানী হওয়ার ফলে এখানে সরকারী এবং বেসরকারী দপ্তরের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগল। অনেক চাকরির সুযোগ তৈরি হতে লাগল। চাকরি পাবার জন্যে বাঙালিদের ইংরেজি শেখার শুরু হলেও এই শিক্ষাই তাদের কাছে সভ্যতার আলোর সন্ধান এনে দিল। এবং শিক্ষার আলোকপ্রাপ্তির ফলস্বরূপ তাঁদের মধ্যে কিছুটা আত্মানুসন্ধানের আগ্রহও তৈরি হয়ে গেল। তাদের ভাবনা চিন্তার মধ্যে যেমন ইয়োরোপিয়ানার প্রভাব পড়লো, তেমনি আবার তারা নিজস্ব সংস্কৃতির ধারাটিকে খুঁজে নেবার চেষ্টা করতে লাগল। এই সব মিলে মিশে এক জাতীয় শিক্ষিত বাঙালি ভদ্রলোক শ্রেণির সৃষ্টি হল যাদের মধ্যে একধরণের সংস্কারমুক্ত মূল্যবোধ এবং সুস্থ রুচিবোধের প্রকাশ হতে লাগল, যেটাকে প্রিন্সেপ সাহেব cultural values এবং sense of social propriety বলেছেন।
ঐতিহাসিক সুমিত সরকারের মতে উপনিবেশিক বাংলায় মধ্যবিত্ত বাঙালির ইংরেজী শিক্ষায় আগ্রহই তাঁদের এগিয়ে যাবার সুযোগ করে দিয়েছিল। সেই সময় সম্মানজনক পেশাগুলি একচেটিয়া ভাবে এই মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক শ্রেণির দখলে চলে যায়। ওকালতি, ডাক্তারি, সাংবাদিকতা, শিক্ষকতা থেকে কেরানিবৃত্তি, এই সব বৃত্তি একচেটিয়া ভাবে মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকেদের কুক্ষিগত হয়ে যায়। একেবারে উঁচুতলার চাকরিতে বৃটিশরা নিজেদের হাতে রাখলেও তার নিচে শ্রেণির চাকরিতে দেশীয় লোকেদের নেওয়া ছাড়া তাদের উপায় ছিল না। ১৯০১ সালের সেনসাসে দেখা যায় ইংরেজী-জানা পুরুষের অনুপাত তখন জনসংখ্যার ১ শতাংশেরও কম ছিল। কিন্তু ইংরেজী-জানা ব্রাহ্মণ পুরুষের অনুপাত ১৫.৭ শতাংশ, বৈদ্য পুরুষের ৩০.৩ শতাংশ এবং কায়স্থ পুরুষের অনুপাত ছিল ১৪,৭ শতাংশ। একই সেনসাসে দেখা যায় ব্রাহ্মণ, বৈদ্য এবং কায়স্থের মিলিত জনসংখ্যার ৫.২ শতাংশ হলেও সম্মানজনক সরকারি চাকরির ৮০.২ শতাংশই তাদের দখলে ছিল।
বিশ শতকে এসে এই মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকরাই বাঙালি জাতির আধুনিকতার মুখ হয়ে উঠল। সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, শিক্ষার প্রসার, সামাজিক আন্দোলন, রাজনৈতিক আন্দোলন সবেতেই তারাই অগ্রণী ভূমিকা নিতে শুরু করল। স্বাধীনতা আন্দোলনে এরাই অনুশীলন সমিতি বানালেন, এরাই অসহযোগ আন্দোলন করলেন, ধর্মঘট করলেন, অনশন করলেন, জেলে গেলেন, এরাই নানা ধরনের পত্র-পত্রিকা ছাপিয়ে তার মাধ্যমে নিজেদের সাহিত্য রুচি, আধ্যাত্মিকতা, ধর্মচিন্তা, নান্দনিক বোধ, স্বাদেশিকতা, সমাজসংস্কার, সৃষ্টিশীলতা ইত্যাদির চর্চা করতে লাগলেন।
কিন্তু সেই সঙ্গে এরা বৃহত্তর জনসমাজ নিজেদের কিছু আলাদাও করে ফেললো । উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে কলকাতায় প্রচুর ছাপাখানার আবির্ভাব ঘটলো। প্রচুর পত্র পত্রিকা এবং বই ছাপা হতে লাগল। নতুন আসা মুদ্রন-সংস্কৃতির সঙ্গে ভদ্রলোকেদের নিবিড় সংযোগ স্থাপন হয়ে গেল। শিক্ষিত লোকেদের মধ্যে একটি নুতন সাহিত্যরুচি, শিল্পরুচি, নান্দনিকবোধ গড়ে উঠল। কিন্তু এ সব যেন তাদেরই জন্যে। এ সবের জোরেই তারা ভদ্রলোক, যারা এ সবের মর্ম বোঝে না তাঁদের করুণা করা ছাড়া তাঁদের যেন আর কোনো দায় নেই ।
এক শ্রেণির ভদ্রলোকেরা আবার জমি-জমার মালিক হলেও নিজেরা চাষ বাস থেকে দূরেই থাকত। নিম্ন শ্রেণির লোকেদের দিয়ে চাষ বাসের কাজ করিয়ে তারা অর্থ উপার্জন করাটাকেই তারা পেশা হিসেবে নিল। খেটে খাওয়া মানুষেদের প্রতি ভদ্রলোকেদের মনোভাব কেমন ছিল তা বুঝতে সুকুমার রায়ের স্যাটায়ার-ধর্মী কবিতা ‘ষোলো আনাই মিছে’-র উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে । যেটির শুরু এই রকম –
‘বিদ্যে বোঝাই বাবুমশাই চড়ি সখের বোটে,
মাঝিরে কন, ”বলতে পারিস সূর্যি কেন ওঠে?
চাঁদটা কেন বাড়ে কমে? জোয়ার কেন আসে?”
বৃদ্ধ মাঝি অবাক হয়ে ফ্যালফ্যালিয়ে হাসে।
বাবু বলেন, ”সারা জীবন মরলিরে তুই খাটি,
জ্ঞান বিনা তোর জীবনটা যে চারি আনাই মাটি।”
এই ভাবে মাঝিকে নানা প্রশ্ন করে আর মাঝি তার উত্তর দিতে পারে না । বাবুটি মাঝিকে বোঝাতে থাকে তার জীবনের কত আনা ফাঁকি । চলতে চলতে চলতে এক সময় খুব ঝড় ওঠে । নৌকা ডুববার উপক্রম হয় । তখন –
মাঝি শুধায়, ”সাঁতার জানো?”- মাথা নাড়েন বাবু,
মূর্খ মাঝি বলে, ”মশাই, এখন কেন কাবু?
বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে,
তোমার দেখি জীবন খানা ষোল আনাই মিছে!”
এমন কি বৃটিশ সরকারের তরফ থেকে কিছু আমলারা যখন শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়িয়ে তা নীচু তলার মানুষদের কাছে পৌঁছাবার চেষ্টা করছিল, তখন এক শ্রেণির ভদ্রলোকেরা তার বিরোধিতাও করেছিল। বিদ্যাসাগর মশাইয়ের অনুগামী কিছু মানুষের চেষ্টায় অবশ্য ক্রমে সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
স্বাধীনতা পাবার পরেই দেশভাগের প্রবল চাপ নেমে এলো বাঙালিদের উপর। আর্থিক থেকে আত্মিক অনেক রকমের সংকট দেখা দিল। জমিদারি প্রথার বিলোপের পর বিত্তবান বাঙালির সংখ্যা বেশ কমে গেল, এবং মধ্যবিত্তের পরিধি বেড়ে গেল।
কেমব্রিজ ইউনিভারসিটির আধুনিক দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসের অধ্যাপক, জয়া চ্যাটার্জী ( ২০২৪ সালে ইনি আনন্দবাজার অন লাইনের ‘বছরের বেস্ট’ পুরস্কার পেয়েছেন), তাঁর ‘স্পয়েলস অফ পার্টিশন’ নামের বইতে মত প্রকাশ করেছেন যে ১৯৪৭ সালের পর এই ভদ্রলোক শ্রেণির অবনতির শুরু হয়। তাঁর মতে – ‘সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্ব এবং রাজনীতির প্রতি তাদের অনুমিত প্রতিভা নিয়ে প্রবল আত্মবিশ্বাস থাকার পরেও, বাংলার ভদ্রলোক গোত্রীয় নেতারা বিষয়গুলো নিয়ে গভীর ভুল বিচার করেছিলেন কারণ, প্রকৃতপক্ষে, তারা রাজনৈতিক শ্রেণী হিসাবে গভীরভাবে অনভিজ্ঞ ছিলেন। তাঁরা উচ্চশিক্ষিত এবং পরিশীলিত ছিলেন যা অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু তাঁরা কখনই বাংলার রাজনীতি বা অর্থনীতির নেতৃস্থানীয় হতে পারেননি।’
তবুও এ কথা বলা যেতে পারে যে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও বাঙালি মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকেরাই ঝোড়ো হাওয়ার দাপটের বিরুদ্ধে মূল্যবোধের নিবু নিবু শিখাটিকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্যে চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন।
আমাদের গল্পে উপন্যাসে নাটকে সিনেমায় নানা ভাবে উঠে এসেছে এই মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকেদের মূল্যবোধ বাঁচিয়ে রাখার লড়াইয়ের কথা ।
রবীন্দ্রোত্তর বাঙালি সাহিত্যিকরা প্রায় সবাই এই মধ্যবিত্ত বাঙালি শ্রেণি থেকেই এসেছিলেন। তাই তাঁদের লেখায় বেশি করে উঠে এলো ভদ্রলোকের চোখ দিয়ে দেখা পারিপার্শিক জগতের অবক্ষয়ের কথা এবং সেই সঙ্গে বাঙালির মূল্যবোধের সঙ্কটের কথা।
পঞ্চাশ ষাটের দশকে বাংলা সিনেমায় উত্তম-সুচিত্রা জুটির অসম্ভব জনপ্রিয়তার একটা কারণ এইটা যে তাদের সাধারণ মানুষ এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিভূ বলে মনে করত । তাদের মধ্যে দিয়ে নিজেদের জীবন-সংগ্রামের, ব্যর্থতা এবং সাফল্যের, আশা এবং নিরাশার প্রতিফলন দেখতে পেত। এই সব সিনেমায় গল্পের শেষে কিন্তু সততার, ভালোত্বের, মূল্যবোধের জিত দেখে দর্শকরা নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি ফিরত।
তারপর বাঙালি আরো অনেক রকম পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে। একান্নবর্তী সংসার ভেঙে যাওয়া, সমাজের কাঠামোর বদল, মানুষে মানুষে সম্পর্কের ধরণে বদল, প্রযুক্তির প্রবল প্রভাবে জীবনশৈলীর বদল, এ সবের বদলের মধ্যে দিয়ে বঙ্গসমাজকে যেতে হয়েছে। তাই সেখানে কিছুটা বদল হওয়া স্বাভাবিক।
কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যাবে অন্তত গত দু আড়াই দশক ধরে এই মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক শ্রেণি আগেকার তুলনায় কেমন যেন একটু বেশিই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। এর পিছনে কিছুটা সার্বিক সামাজিক অবক্ষয় এবং কিছুটা রাজনীতির মারপ্যাঁচ আছে বলেই মনে হয়। ভোট ব্যঙ্কের রাজনীতিতে ভদ্রলোকেরা তো অনেকটাই অপাংক্তেয়ই হয়ে গেছেন। আর মূল্যবোধ, আত্মসম্মান, সংস্কৃতির অভিমান যা নিয়ে মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকেরা গর্ব করতেন, সে সব এখন একেবারেই অপ্রয়োজনীয় বস্তু হয়ে গেছে।
এমন কি সিনেমা-সিরিয়ালের গল্পেও মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের গল্প আর ধর্তব্যের বিষয় নয়। একদা সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণাল সেনের ছবিতে মধ্যবিত্ত বাঙালির অন্তঃপুরের বাস্তবতা যে ভাবে সিনেমার ধরা হয়েছিল তা এখনকার সিনেমার পরিচালকরা সযত্নে এড়িয়ে চলে।
সমাজ যেন এই ভদ্রলোকেদের ছাড়াই দিব্যি চলছে। অবশ্য তারা একটা ছোট পরিধির মধ্যে তাদের কন্ঠস্বর শোনাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে । কিন্তু তা যেন আর আগেকার মত অভিঘাত আনতে করতে পারছে না। এখন মনে হচ্ছে তাদের অস্তিত্ব যেন ঐ সমাজ-মাধ্যমের পরিসরেই সীমাবদ্ধ। সেখানেই তাঁদের যত আলোচনা, উদ্দীপনা, বাক বিতন্ডা, রঙ্গ, ব্যঙ্গ এবং প্রতিবাদ। কিন্তু এটা বোঝা যাচ্ছে সমাজ মাধ্যমের বাইরে তাদের আর বৃহত্তর সমাজকে তেমন ভাবে প্রভাবিত করার ক্ষমতা নেই বললেই চলে। তার জন্যে কতটা ভদ্রলোক শ্রেণীর গুণগত অবনমন কতটা পারিপার্শিকতার পরিবর্তন দায়ী, এ’ নিয়ে অনেক রকম মতবাদ আছে।
তবে বাংলার নবজাগরণে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভূমিকা সব চেয়ে বেশি ছিল, স্বাধীনতা এবং দেশভাগের পর থেকেই সেই ভদ্রলোক শ্রেণির কিছুটা পিছন দিকে এগিয়ে যাওয়ার শুরু হয়েছিল। সত্তরের দশকে সেটার গতি কিছুটা বাড়ে। এই সময়ে সামাজিক শেণিবিন্যাসে পরিবর্তনের ফলে নুতন ভদ্রলোক শ্রেণীর উৎপত্তি হয়। তারপর থেকে ক্রমাগত ভাবে রাজ্যের অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া, শিক্ষার মানের অবনতি হওয়া, মেধার বহির্গমন হতে থাকা, জনমানসে রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়া এ সবের মিলিত অভিঘাত তো ছিলই।
১৯৯১ সালে ভারতীয় অর্থনীতিতে উদারীকরণের ঢেউ এসে লাগল। এতদিনকার বন্ধ দুয়ার খুলে ফেলার সরকারী প্রয়াস দেখা গেল। বিশ্বায়নের হাওয়া শুধু অর্থনীতিতেই নয় , সমাজজীবনেও তার প্রভাব পড়ল। সংখ্যাতত্বের হিসেবে দেশে মধ্যবিত্তের অনুপাত বেড়ে প্রায় দ্বিগুন হয়ে গেল। বাঙালি মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকেদের সমাজেও এর প্রভাব পড়ল। ভোগবাদ তার মায়াজাল বিস্তার করল। ভদ্রলোকেদের সেই সাবেকি ‘plane living high thinking’- দর্শনটি প্রবল ভাবে আক্রান্ত হল। ভদ্রলোক বাঙালির মধ্যে দ্বিচারিতা, দেখনদারি, স্বার্থপরতা আরও একটু বেশি করে প্রকট হল।
তবে গত দুই দশকে সাধারণ মানুষের নীতিবোধ, সৌজন্যবোধ এবং আত্মসম্মানবোধের ব্যাপক নেতিবাচক পরিবর্তন বাঙালি জাতিকে সার্বিক ভাবে এমন একটা জায়গায় এনে ফেলে দিয়েছে যে এখন ভদ্রলোক শ্রেণীর অস্তিত্ব সত্যিই বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এখান থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তার আপাতত কোনো দিশা দেখা যাচ্ছে না।
সোমেনবাবুর লেখায় সবসময় থাকে নতুনত্বের স্বাদ। দিনকাল যা পড়েছে, মধ্যবিত্ত বাঙালির সেই পরিচয়টা পেতে এমন লেখাই এখন ভরসা।