শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

আগে একবার জিজ্ঞেস করলেই …

প্রতিবার রহস্য করে গল্প শুরু করার কোন মানে হয় না। এবার শুরুতেই বলে নেওয়া যাক এই গল্পের নিষ্প্রাণ নায়ক একটি ‘কামড়ানো কাঁঠাল ছাপ’ আমিফোন। তবে নায়ক ? না খলনায়ক ? না শেষ পর্যন্ত কোন বিবেকের ভূমিকায় সে আছে সেটা ঠিক বোঝা গেল না। আপাতত আমরা যাব দীননাথ দন্ডপাটের শোবার ঘরে। ভয় নেই। লেখক নিতান্ত ধম্মোভীরু ভদ্রলোক। শোবার ঘর বটে, তবে রাতের বেলা নয় – দিনের বেলা – এই ধরুন এগারোটা নাগাদ।

এই মুহূর্তে যত বড় হাঁ করেছে দীননাথ তাতে তাদের পোষা খাঁটি রোডেন্সিয়ান কুকুর গোলুমোলুও লজ্জায় জিভ বার করে ফেলল। গোলুমোলুকে যখন সংগ্রহ করা হয়েছিল প্রতিবেশীর বাগান থেকে তখন তার ঠিকঠাক চোখ ফোটেনি। দু তিন মাসের মধ্যেই চন্দ্রকলা থেকে পুর্ন চাঁদের মত গোল হয়ে উঠেছিল। তাই তখন তার নামকরণে কোন গোল ছিল না। কিন্তু ধীরে ধীরে নিয়মাফিক খেঁকি আকৃতি পাওয়ার পরও গোলুমোলু নামটা রয়েই গেছে। সে কিন্তু অন্যান্য স্বজাতির মত স্বভাবজ ইংরেজ নয়। বাংলায় ধমক বোঝে, ছোট খাটো নির্দেশ – যেমন কাগজটা নিয়ে এস বললে – নিয়ে আসে। অতিথিকে ভালো করে শুঁকে – ঝাল না লাগলে – তবেই সোফায় বসতে দেয়। বৃষ্টি পড়লে দীননাথের সঙ্গে বসে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনে। দীননাথের সব কথা বোঝে এবং সাধ্যমত পরামর্শ দিয়ে থাকে। পরামর্শ অবশ্য বাংলায় দিতে পারে না তবে একেক রকম ল্যাজ নাড়ে। সেই গুপ্ত সংকেত আবার শুধু দীননাথেরই বোধগম্য হয়। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে সে নিদান নেওয়া না নেওয়া অবশ্য দীননাথের উপর। গত দশ বছর এরকমই চলছে। এমন কি দীননাথের বিয়ের পরও এই বিধির পরিবর্তন হয়নি। তবে এ গল্প গোলুমোলুকে নিয়ে নয় – তার নবীন মালকিন তৃষ্ণা তরফদারকে নিয়ে। আরো ভালো করে বললে তার নতুন দাবী-সনদ নিয়ে। গল্পের শুরুতে যে হাঁ করেছে দীননাথ, সেটা সেই চাহিদার ফলশ্রুতি।

বিয়ে হয়ে আসা ইস্তক গত তিন বছরে তৃষ্ণা কোন দাবী দাওয়া পেশ করেনি। শাড়ি গয়না যা পেয়েছিল তার সাতান্ন ভাগের এখনও নিজস্বী তোলা বাকি। নতুন করে কিছু চাইবার আগেই – জন্মসূত্রে আর আইনি পথে পাওয়া আত্মীয়রা – দু হাত ভরে দিচ্ছেন। তার বাক্যও বাবলা ডালের মত নয় বরং মুথাঘাসের মত ল্যাপটানো। এগারো মাসের মাথায় – বাপের বাড়ির টিকটিকিটাও শ্বশুরবাড়ির চেয়ে সরেস – এমন কিছু বিপজ্জনক ঘোষণা সে করেনি। শ্বশুরের সঙ্গে শব্দ ছক কষে। শাশুড়ির সঙ্গে মন্দিরে যায়। দীননাথের সঙ্গে যায় নাটক দেখতে।

অন্য পক্ষে এ’ বাড়ির লোক জনও খামোখা বৌকে খোঁচান না। টিভির উপরটা চেঁছে ময়লা দেখেন না। কাজের মাসি আছে। চিকেন রেজালার উপকরণ জানতে চান না। রান্নার লোক আছে। ‘আমাদের কপালে কি আর নাতির মুখ দেখা আছে’ বলে – সবাই শুনতে পাবে এমন স্বগতোক্তি করেন না। বরং তৃষ্ণার কচিকাঁচা বিদ্যালয়ের খন্ডকালীন চাকরি – আর তার দিনান্তের গল্প সব চেষ্টা করেন মন দিয়ে শুনতে। যতটা মেনে নিলে পরে মা ও স্ত্রী দুজনেই হাসি মুখে থাকে – দীননাথকে ততটা মাতৃভক্ত ওরফে স্ত্রৈণ বলা যায়। এমন কি গোলুমোলুও – তৃষ্ণা ও তার বাড়ির লোকেদের না শুঁকেই সোফায় বসতে দেয়।

প্রশ্ন হল ‘এত্তে ভালা পাকের মাসি পাইল্যা যদি পিসা, ডাইল্যে দেহি শুঁটকি মাছ মরিচ দিয়া ঠাসা।‘ – আহা, সে তো প্রথমেই বলা হয়েছে। গোল বাধিয়েছে কাজের মাসি। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, তার হাতের নতুন ‘কামড়ানো কাঁঠাল’ ছাপ আমিফোন। এখানেই চাপ।

আজ রবিবার সকালে কাজের মাসি তাদের ডাইনিং টেবিলে হাতের ঝকঝকে আমিফোনটি রেখে সবে ঝাঁটা ধরেছে তখন সেখানে তৃষ্ণা ও দীননাথ বসে চায়ের তৃষ্ণা মেটাচ্ছিল। হঠাৎ করে সেই ঝাঁ চকচকে রকেটের অবতরণে – তাদের চায়ে ডোবানো বিস্কুট কাপেই আত্মহত্যা করে। দুজন খানিকক্ষণ যামিনী রায়ের ছবির মত বড় বড় চোখ করে বসে থাকে । তার পর তাদের চোখ ‘এক কান কাটা ভ্যান গ্যখের ‘ প্রতিকৃতির মত করুণ হয়ে যায়। তৃষ্ণা কোনোক্রমে জিজ্ঞেস করে –

-‘মাসি এটা কি নতুন নিলে?’

মাসি মোনালিসার হাসি দিয়ে জবাব দেয় –

– ‘হ্যাঁ গো।‘

তারপর সবেগে ঝাঁটা চালাতে শুরু করে । তার আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্যে দুজনে শোবার ঘরের খাটে গদিয়ান হয়ে বসে। দীননাথ খবরের কাগজ খুলে বসলেও তৃষ্ণা জানলা দিয়ে বাইরে চায়ের দোকানের ধোঁয়া ওঠা দেখতে থাকে। এই সাদা কালো ধোঁয়া ওঠার মধ্যে এক কালে নতুন ঢেউ এর সিনেমা পরিচালকরা মানসিক ধন্ধ চমৎকার বুঝিয়ে দিতেন। ধরুন পথের পাঁচালিতে সর্বজয়ার সামনে ফুটন্ত ভাতের ধোঁয়া। জলসাঘরে – বিশ্বম্ভর রায়ের হাতি ঢেকে গেল ট্রাকের ধুলো ধোঁয়ায়। যেমন চালচিত্র সিনেমায় তোলা উনুন ……… এই এক বাঙালির বিপদ। সুযোগ পেলেই কি জানে – তা লোককে জানানোর আবেগ সোডার মত ভসভসিয়ে ওঠে। এরকম আবার হলেই আপনারা … মানে আপনাদেরও লেখককে সামলানোর কিছু দায়িত্ব থাকে কি না? তবে এখানে ঐ প্রয়োগ যথাযথই হচ্ছিল। কিছুক্ষণ পরে তৃষ্ণা বললে –

– আমার একটা ‘কামড়ানো কাঁঠাল’ ছাপ আমিফোন চাই। আর সেটা যত শিগ্রি সম্ভব।

দীননাথ মন দিয়ে রবিবারের কাগজে কম খরচায় বেড়াবার জায়গা খুঁজছিল। হঠাৎ এমন যুদ্ধ ঘোষণায় ছিটকে পড়ল পুরুলিয়া থেকে পুতিনের কোলে। (এবার প্রথম স্তবক আবার পড়ে নিতে পারেন … বা … তারপর থেকে কি হল এবার বলা যেতে পারে।) দীননাথ মোটামুটি চাকুরে। তেমন একটা যন্ত্র-কুশলী নয়। তবু যতটা জানে তাতে ওই ‘কামড়ানো কাঁঠাল’ ছাপ আমিফোনের দাম প্রায় তার দেড় মাসের মাইনের সমান। তাছাড়া বিয়ের প্রথম বার্ষিকীর সময় – অর্থাৎ – বছর দুয়েক আগেই নতুন মুঠোফোন কেনা হয়েছে। এখনো তার কাঁচে মুখ দেখা যায়। তবে ? মিন মিন করে বলল –

– মানে ওটার তো অনেক দাম। তাছাড়া আমাদের ফোনগুলো তো নতুনই বলা যায়। এখন আবার নতুন …।

তৃষ্ণা হাত তুলে থামাল তাকে। একবার দরজার দিকে চোরা চোখে চেয়ে চাপা স্বরে বলল –

– সে যাই হোক। আমার সামনে কাজের মাসি ‘কামড়ানো কাঁঠাল’ ছাপ আমিফোন নিয়ে ঘুরবে আর আমি ‘চ্যামচ্যুং’ ফোন নিয়ে – এ কিছুতেই হতে পারে না। তুমি ব্যবস্থা দেখো। আজ কালকের মধ্যেই বলছি না কিন্তু যত শিগ্রি সম্ভব। আমি উঠলাম।

এই প্রস্থান বুঝিয়ে দিল যে কোথাও আপিলের কোন সম্ভাবনা গোড়াতেই রদ। দীননাথ মেজেতে বসা গোলুমোলুর দিকে চাইল। তার ল্যাজ নড়ে উঠল কিছুটা। দীননাথ অনুবাদ করে বলল –

– বাবার সঙ্গে কথা বলতে বলছিস। ঠিক আছে । দেখি।

সন্ধেবেলা শাশুড়ি আর বৌমা পাশাপাশি বসে ‘কুটনি শাশুড়ি – পিটুনি বৌমা’ আর অন্যান্য সমাজ দর্পণ সিরিয়াল দেখে থাকেন। বাড়িতে অন্তত ঘণ্টা দুই আড়াই বাবা-ছেলের স্বাধীনতা। বাবা এই সময়টা বিভিন্ন বিষয়ের বই পড়ে কাটান। ছেলে যায় আড্ডায়। আজ অবশ্য আড্ডায় যায় নি। অপেক্ষা করছিল সঠিক সময়ের। টিভি তে চরিত্র লিপি শুরু হতেই সুড়ুৎ করে বাবার সামনে গিয়ে বসল। একবার গলা খাঁকারি দিল দীননাথ। যদিও তার প্রয়োজন ছিল না – কারণ আগেই বাবা বইটি মুড়ে তার দিকে তাকিয়েছিলেন। এবার মুখের থেকে চুষিকাঠি নামিয়ে বললেন –

– বৌমা ‘কামড়ানো কাঁঠাল’ ছাপ আমিফোন চেয়েছে তো?

এই মুখের চুষিকাঠিটি নিয়ে একটু স্পস্টিকরন দেওয়া বিধেয়। দৃশ্যত বেশ অদ্ভুত ব্যাপার। কিন্তু সিগারেট ছাড়ার পর সব সময় সিনিয়ার দন্ডপাটের মুখ সুলসুল করে। বহু কিছু চেষ্টা করলেন। চকলেট খেয়ে রক্তে চিনি বেড়ে গেল। নিমের ডাল চিবিয়ে কমালেন। এমন কি আধসেদ্ধ সজনে ডাঁটাও ঠোঁটে ঝুলিয়ে দেখলেন কিন্তু কিছুতেই শান্তি ফিরল না। শেষে শিশু বিশেষজ্ঞ বাল্য বন্ধুর পরামর্শে এই ঘরোয়া টোটকা চালাচ্ছেন। ওভার টু হতবুদ্ধি দীননাথ।

– তুমি … তুমি কি করে …।

– এ বাড়িতে তোমার বৌয়ের আগেও একজন বিয়ে হয়ে এসেছিলেন। তোমার মায়ের কথাই বলছি আর কি। তিনি ও চেয়েছেন ।

– অ্যাঁ । মা-ও?

– তিনি কি মহিলা নন ? একই কাজের মাসি কি আমাদের ঘর মোছে না? হাঁ বন্ধ করো।

– তুমি কি করলে।

– নিবারণ করলাম।

– কি করে ? মানে যদি আমাকেও বল তবে আমিও ……।

– শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ বলেছেন এক পথ সবার জন্যে নয়। আমি যে ভাবে সামলালাম তুমি তো তা পারবে না।

– আচ্ছা বলে তো দেখো ?

– নিশ্চয়ই । তবে আমার মৃত্যু বা তার পরেও গোপন রাখার সর্তে। তোমাকে বলতে পারি কারণ আমার বয়সে তুমি এই পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারো। তবে তার আগে নয়।

– বাবা আর হেঁয়ালি করো না। বলছি তো আমি কাউকে বলবো না।

– তবে শৃ্ন্বন্তু। আমার দ্বিতীয় ব্যাঙ্ক আক্যাউন্টে আমি শুধু ঘর খর্চার টাকা রাখি। তবে আর একটি আছে । তাতে হঠাৎ বন্যার জলে পড়লে বাঁচবার রসদ থাকে । সেটা হাতির চিবোনোর দাঁত। দেখাবার নয়। আমি তোমার মায়ের সামনে এই মাসকাবারি – দ্বিতীয় ব্যাঙ্কের – মানে আদতে যেটা প্রথম – পাস বই ফেলে দিলাম এবং জিজ্ঞেস করলাম কোথা থেকে অত টাকা আসবে যদি বলে দেয়। অবশ্য তোমার মা যে খুব জোর করেছিল তা নয় তবে সেও তো … ওই যাদের সাত হাত কাপড়েও কি যেন হয় না।

– বাবা, মাকে এ রকম বলা কিন্তু খুব ……।

– জিতে রহো বচ্চা। এ পরিকল্পনা তিন বছরের বিবাহিতদের পক্ষে বাতিল । অন্য কিছু বার করো বা কিনেই দাও। ব্যাঙ্ক ধার দেবে – ই এম আই তে।

– কিন্তু শুধতে তো …।

– তিন বছরেই এত ভেবো না। ধরো আমি কিছুটা সাপ্লাই বাড়িয়ে দেবো। আগে ভজুর দোকানে গিয়ে দেখো সে বস্তুটির দাম কেমন। তোমার বন্ধু লোক । কিছু কম-সমের সন্ধান দিতে পারে। আগে তো গজল শুনতে, জগজিত শোনো নি? ‘য়া তো মিট যাইয়ে, য়া মিটা দিজিয়ে। কিজিয়ে জো ভি সওদা খরা কিজিয়ে। বঁ ভোয়াজ।‘

আবার চুষিকাঠি ফিরল ঠোঁঠে। গোলুমোলুও সদর্থক ল্যাজ নাড়ল।

পরের পর্দা উঠছে ভজুর ঝাঁ চকচকে দোকানে। দীননাথ বেশ মুগ্ধ হয়ে দেখছে সোনালী রুপোলী রঙে মেশা মুঠোফোনটিণকে। ভজু ধারা ভাষ্যকারদের মত গড়গড়িয়ে ব্যাখ্যা করছে তার গুণপনা –

– ওজন 164 গ্রাম, 7.4 মিমি পুরু, 256 GB স্টোরেজ, সামনে কাঁচ, পিছনে কাঁচ – ভাঙে না, অ্যালুমিনিয়াম ফ্রেম, ন্যানো-সিম, ডুয়াল স্ট্যান্ড-বাই, ধুলো/জল প্রতিরোধী, অসাধারণ ছবি, বাজের মত আওয়াজ, মুখ চিনে দোর খোলে, সেলফি তোলে একেবারে তাড়কা টু তারকা, তাছাড়া ……।

কাতর কণ্ঠে দীননাথ বলে –

– একটু দম নে। আমাকেও নিতে দে।

– নিলাম ও দিলাম। আসলে গ্রাহককে ভাবতে দিলে যে আমাদের লোকসান। তুই বন্ধু বলেই থামলাম। এখন বল দেখি কার জন্যে চাই ?

– কেন আমি কিনতে পারি না?

– পারিস, কিন্তু তোর মধ্যে সেই গন্ধ … মানে Flavour-টা নেই? ঠিক করে বলতো কে চালাবে ?

– বৌ চালাবে ভাই। এখন দামটা যদি বলিস । দেড় মাসের মাইনে দিয়ে ……।

– না দেড় মাস হবে না , তবে সওয়া দু মাস হতেই পারে । তা এখন আর পুরো পয়সা দিয়ে কেনে কোন গাধা। এত এত ব্যাঙ্ক চারিদিকে। তোর ব্যাংকারকে বল ছত্রিশ কিস্তি।

– অনেক সুদ লাগে তো।

– আট বৌয়ের একজনার জন্যে সাজাহান তাজমহল বানিয়ে দিল, আর তুই এক মাত্র বৌএর জন্যে ……। কাল ব্যাঙ্কে যা। তোর জন্যে একদম লে-টেস্ট জিনিস রেখে দেব । তারপর যখন বৌকে দিবি তখন ……।

– আগে ব্যাঙ্কে তো যাই কাল।

সে রাতে অবশ্য তৃষ্ণা কোনো উচ্চ বাচ্য করল না। মুখে কুলুপ দিয়ে শুয়ে রইল তৃষিত দীননাথ। ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখল সে যেন – না সাজাহান নয় – আবু আল-ফাত মহম্মদ জালালুদ্দিন আকবর। জ্যান্ত কবর দিচ্ছে আনার কলিকে । আর কি আশ্চর্য আনারকলির মুখটা ঠিক কাজের মাসির মত। প্রতিবার ঘুম ভেঙেই দশবার ভগবানের কাছে মনে মনে নাক কান মুলল সে। ছি ছি নরহত্যা। স্বপ্নে হলেও তো মহাপাপ। কাঁঠাল ছাপ কিনতে পারলে মা তেঁতুল-ঘোরার মন্দিরে গিয়ে স’ পাঁচ আনার – আচ্ছা আর একটু বেশী – এগারো টাকার পুজো দিয়ে আসবে। কি ঠেলায় ফেললি মা। কাল লাঞ্চ আওয়ারে ব্যাঙ্কে যেতেই হবে। মাইনে তো ওখানেই হয়। হয়ত সাহায্য পাওয়া যাবে।

বিদেশী ব্যাঙ্কের দেশী সুন্দরী সর্বাঙ্গ হাসিয়ে অভ্যর্থনা জানালো দীননাথকে। সেই চোখ-পাতা ফেললে ইস্টম্যান কালার আর উঠলে সাদা কালো – দেখে দীননাথ উদ্দেশ্যই ভোলে আর কি। । খুব একটা কষ্ট করতে হল না অবশ্য। সুন্দরী হেসে হেসেই ব্যক্ত করিয়ে নিল সব গুপ্ত কথা। কিম্বা প্রায় কোন কথাই শুনল না শুধু ‘ ধার নেবো’ ছাড়া । টুক করে দীননাথের কাটাকুটি করা মাইনের কাগজ দেখে নিল। কালো কি বোর্ডে তার নীল নখাগ্র ‘হুদহুদ ‘ ঝড়ের মত চলল মিনিট দুয়েক। তারপর আবার শিরদাঁড়া বাঁকিয়ে দেওয়া হাসি। মেহেন্দি লাগানো তার হাত একটা কাগজ দীননাথের হাতে দিয়ে বলল –

– Here you are Mr Dandapat. Now go and get the lovely gift for your better half. Nice meeting you.

দীননাথ চেকটি হাতে নিয়ে ‘গ্রেগরি পেকের’ ভঙ্গীতে বাও করে বলল – It’s actually my pleasure Madam. What a joy in mating you.

সুন্দরীর বাগান করা ভ্রূ দুটি কপালে উঠল। গালের নিয়ন গোলাপি রং – রুবী লাল হয়ে আবার টিউলিপ লাল রং এ স্থির হল। থতমত খাওয়া দীননাথ আঁচ পেলো কিছু ভুল হয়েছে। নিশ্চয়ই উচ্চারনের ভুল। একটু পিজা বার্গারের মত ইংরেজি বলতে গিয়েছিল আমানি খাওয়া ছাত্র। এবার না ঠ্যাঙানি খায়। হে মা তেঁতুল-ঘোরা, এগারো টাকা নয় একেবারে একুশ টাকার পুজো দেবো।

অবশ্য এত ভয়ের কিছু ছিল না। সুন্দরী মহিলা মাত্রেই এ রকম জিভে গিঁট পড়া মানুষ দেখে থাকে রোজ। ম্যাডাম এক লহমা পরেই আবার হাসির মুখোশ পরে নিল। তবে এবারের মুখোশ ছৌ নাচের দুর্গার মত মোলায়েম হল না। হল কথাকলির রাবন রাজা। ভয়ঙ্কর সুন্দর। তারপর পরিষ্কার বাংলায় বলল –

– ‘ঠিক আছে তাহলে। মনে হয় বিকেলের মধ্যেই আপনার মিসেস উপহারটা পেয়ে যাচ্ছেন। আর একটা কথা – মানে পরামর্শ বলতে পারেন। আপনি চেয়ারে বসলে ভুঁড়ির ওপর দুটো বোতাম খুলে যাচ্ছে। কামড়ানো কাঁঠাল ছাপ আমিফোনের সঙ্গে এটা যায় না। একটু আপনাকেও স্মার্ট হতে হবে আমিফোন হাতে মিসেসের পাশাপাশি। আসুন তাহলে। নমস্কার’।

দীননাথ প্রায় দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে দেখে সত্যিই তার শার্টের দুটো বোতাম খোলা। তবু ভালো গোলমাল আরো নিচে নামেনি। ছুটির পরে সোজা ভজুর দোকান। ভজু তৈরি ছিল। মাত্র মিনিট তিনেকের মধ্যেই সম্মোহিত দীননাথের হাতে তুলে দিল কামড়ানো কাঁঠালের ছবি আঁকা বাক্স। বলে দিল একবার বৌদির এখনকার ফোনটা নিয়ে আসতে তাহলে বাকি এদিক ওদিক করার কাজগুলো সে করে দেবে। ঘর দূর নয় তবু যেন উড়ে পৌঁছল দীননাথ। বসার ঘরে চোখাচোখি হল বাবার সঙ্গে। সে চোখে কৌতুক আর বাৎসল্য, মুখে রবীন্দ্র সঙ্গীত ‘জীবনে আমার যত আনন্দ…।’।

জীবনে প্রথম বার সওয়া সাতটার সময় সিরিয়াল ফেলে শাশুড়ি মা এবং বৌমা এসে বসলেন বাইরের ঘরে। প্যাকেট খোলা হতেই সবাই সম্মোহিত। সোনালি রুপোলী আলো চমকাচ্ছে সে মুঠোফোনে। শাশুড়ির মুখ অন্ধকার হতে হতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল কারণ তৃষ্ণা খুব উদার ভাবেই তার দু বছরের পুরোন মুঠোফোন মাকে দেবার ঘোষণা করে দিল। সেটা এত না হলেও দামী। ছবিতে আশা পারেখের চোখের পলক অব্দি দেখা যায়। একটা বিপর্যয় আসতে আসতে মায়না-মারের দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। পরিস্থিতি বিবেচনা করে গোলুমোলু ও একটা নতুন ল্যাজের ভঙ্গী দেখাল দীননাথকে আর এই প্রথম দীননাথ পুরো মানেটা ধরতে পারল না।

সেই রাতে রাত ছিল পূর্ণিমা। দীননাথ আর তৃষ্ণা …… আপনারা যা ভাবছেন তেমন কিছু আমার জানা নেই। আপনাদের ভাবনা আমার কলমে বসানোর চেষ্টা করবেন না। আমি বরং আপনাদের বলি সে রাতে স্বপ্নে কি দেখল দীননাথ। এবার আর সে আকবর নয়, সেলিম। আনারকলির সঙ্গে তার জবরদস্ত ইংরেজিতে কথোপকথন চলছে। আর আনারকলির মুখটা … হ্যাঁ মশাই স্বাভাবিক কারণেই তৃষ্ণার মত। বাজে ভাবনা রেখে পরের দিন সকালে কি হল সেটা শুনুন।

পর দিন সকাল থেকেই তৃষ্ণা তৈরি। ডাইনিং টেবিলে আলগোছে পড়ে আছে নতুন কামড়ানো কাঁঠাল ছাপ আমিফোন। যেন বেশ অবহেলা ভরেই রেখেছেন মালকিন । যেন এমন তো থাকেই পড়ে। পাঁচ মিনিটের হাড় জ্বালানো বিলম্বের পর কাজের মাসির হরিণীর পিছনে শকুন্তলার মত ঝটিকা প্রবেশ। ঢুকেই নিজের ফোন নতুন অতিথির পাশে রেখে বলল –

– আরে বৌদি এটা যে আমারই মতন। কাল আনলে বুঝি? কত নিল ?

তৃষ্ণা যেন বলতে হয় তাই বলা – গোছের আলতো করে বলল –

– সে তো তোমার জানাই আছে। কিনেছ তো?

– হ্যাঁ সেতো বটেই । তবে ভজু মুখপোড়া ঠকালে কিনা তাই জিগালুম। তা এটা তো আমারটার থেকে একটু ছোট মনে হচ্ছে। আমারটা দু হাজার নিয়েছিল । তোমারটা বোধ হয় দেড় হাজার । না কি ষোল ?

– মানে! দু হাজার টাকায় নতুন ফোন? কি বলছ কি ?

– ও তো নতুন নয়। আমাদের ভজু সেকেন্ড হ্যান্ড না কি বলে – সে রকম মড়া ফোনের এইটার নাড়ি ওইটার ভুঁড়ির সঙ্গে জুড়ে নতুন একটা খোলসের মধ্যে পুরে দিয়েছে। দেখতে বড় হয়েছে কিন্তু চাবি গুলো এ দিক ওদিক। দরকারে খুঁজে পাই না। মাথায় থাকুক আমার বড় ফোন। আমি আবার আজ কালের মধ্যেই পুরোন ফোনে ফেরত যাব। গরীবের আবার ঘোড়া রোগ।লোভে পড়ে খামখা এক গাদা টাকা নষ্ট। তুমিও পারলে পালটে নিও। যাই বাসন গুলো আগে ধুই গে।

এবার তিনজন আর আমিফোন মুখোমুখি বসে। বৈঠকখানায় বাবা গান ধরলেন ‘ যে ভালো করেছ কালি আর ভালোতে কাজ নাই, এখোন ভালোয় ভালোয় বিদায় দে মা আলোয় আলোয় চলে যাই’।

ইদানীং ছোটগল্পে কোন নির্দিষ্ট পরিণতি না থাকলেও চলে। শেষ পরিচ্ছেদে শিক্ষামূলক কিছু গুঁজে দেওয়া – সেও এখন অতীত । তবু এ গল্পের শেষে বেশ কয়েকটা হাঁস – মানে মরাল – যেন ভেসে ভেসে আসছে। কিন্তু লেখক নিজের প্রাক-টাকে অনেক হাত বুলিয়েও ঠিকঠাক ধরতে পারছে না। এ’ গল্পের উপসংহার কি ভাবে করা যায় তার দায় পাঠকের মাথায় চাপিয়েই লেখক ‘সায়োনারা’ জানাচ্ছে। আপনাদের মনে কিছু এলে আমাকে জানাবেন। শুধু একটা ইংগিত দিতে পারি। সব কিছুর পরে গোলুমোলুর ল্যাজ নাড়া দেখে অগ্নিশর্মা দীননাথ চেঁচিয়েছিল –

– আবার যদি ও কথা বলিস তবে আজই তোর ল্যাজ কেটে নেবো।
ওম সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ ।

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.