শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

পায়ের চিহ্ন নিয়ে পড়ে থাকা পথটার গায় …

রবিচক্রের বরিষ্ঠ সম্পাদক মশাই দুখিরামকে ফরমান দিয়েছেন একটি রচনার জন্যে। তেনার ছাগল দিয়ে যব মাড়ানোর এই (কু)অভ্যাস আর গেল না।

যে নক্ষত্র মণ্ডলী রবিচক্রকে কেন্দ্র করে অলাতচক্রের মত স্ফুলিঙ্গ বিকিরণ করছে … সেখানে দুখিরাম একটি ফুলকি বিশেষ। এই বৈদ্যুতিন পত্রিকাটির সম্পাদকদ্বয় … বরিষ্ঠ জন তো বটেই … এমন কি বয়োকনিষ্ঠ জনাও এমন পরিশীলিত বাংলায় বাঙময় হন – যে দুখিরামের দেহ কণ্টকিত হয়। এতো তারও মাতৃভাষা। তবে তার বাচনে সেই ঝঙ্কার নেই কেন? কারণ আছে। তার জীবনের সিংহভাগ কেটেছে বহির্বঙ্গে। যেমন কাটিয়েছেন আভাষ কুমার গাঙ্গুলি।. ঘোড়ার খুরে – ঘুরে ফিরে – যদি বা শেষ জীবনে দুখিরামের বাংলা-বাস নসিব হল … ভারতের সাংস্কৃতিক পীঠস্থান কলিকাতা কমলালয়ে তার মেয়াদ বড় জোর বছর সাতেক। কুল্লে এটুকু পুঁজি নিয়ে জাতে উঠতে চাওয়া – একটু বজ্জাতি হবে না তো? তা … সে কথা জজে বিচার করবেন।

ভরসার কথা সম্পাদক মশাই সে ব্যাপারে অবহিত, উদার ও বিবেচনা-কারী। বিষয় দিলেন – অবাঙালি গায়ক গায়িকাদের পুজোর আধুনিক গান। অর্থাৎ বিপুল তরঙ্গ দেখে ভীত দুখিরামের দায়রা সোপর্দ হল – একটি মোটামুটি সাঁতার কাটা যায় – এমন ঝিলের জলে। দুখিরাম নিম-পণ্ডিত হলেও – তার নিমগ্ন শোতৃপদ খারিজ করে কে? বাল্যকাল থেকে তার কত না গন্ধর্বের সঙ্গে ‘সেই সাগরবেলায় ঝিনুক খোঁজার ছলে – গান গেয়ে পরিচয়’। আজ সে ভালোবাসার লক্ষণ প্রকাশ করলে শূর্পণখার মত তার নাক কান কাটা যাবার ভয় নেই। দুখিরাম খুশি। সাবর্ণকাল হলে সম্পাদকদের রায়বাহাদুর খেতাব দিত। একালে শিরোপা দিলে- দুখিরামের দুঃসময়ে – তারা আবার ফিরিয়ে দিতে পারেন … এই ভয়ে কিছু দিল না।

আচ্ছা বুটের ফিতে বাঁধার আগে এক ফালি অরাজনৈতিক চর্চা। যারা অবাঙালি এবং বাঙলা গান গেয়েছেন তাঁরা কি উদ্বস্তু? চিনি মোড়ানো বাংলায় অনুপ্রবেশকারী? বঙ্গজননী তাঁদের ভালোবেসেছেন তো? জেনে রাখা ভাল। কবে কোন চেয়ারের লুকানো পেরেক পরনের কাপড় ছিঁড়ে ফেলবে – সে বড় সুখের সময় নয়। তবে দুখিরামের বিদ্যে বুদ্ধি যা বলে – শিল্প বা শিক্ষায় … বলা ভালো … প্রতিভার পৃথিবীতে – অনুপ্রবেশ হয় না। কারণ তাদের কোন ঐহিক জায়গা জমির দাবি নেই। হৃদয়ে লেখো নাম সে নাম রয়ে যাবে। ব্যবহারিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কিছুটা রাজনীতি বা কাজনীতি আছে বলে খবরে প্রকাশ। এখন আর কোনো শিল্পী বোতাম ছেঁড়া কোট গায়ে দিয়ে মঞ্চে ওঠেন না। কাজেই টাকা যেখানে – সেখানে টনৎকারও থাকবেই। কিছু কিছু বঙ্গীয় শিল্পীর – অবঙ্গভাষী গায়কদের প্রতি অসূয়া গভীর ক্ষরণ ঘটায় তবু তাঁদের গান শুনে আমরা মুগ্ধ হই। সার সংক্ষেপে বলা যায় – বঙ্গ গানের ভুবন ভঙ্গ হয়নি – সারা ভারতের রাখী বন্ধন সেখানে।

যদিও এই সংখ্যাতেই ব্যাপারটি অনেক গবেষক সুচারু ভাবে বোঝাবেন … তবু ধরতাই হিসেবে দুখিরামের অল্প প্রাককথন রইল। এই পুজোর সময় গানের ডিঙা ভাসানোর ব্যাপারটি অন্য ভাষায় নেই । এটি পরিকল্পনা করেছিলেন বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় এইচএমভি, কলম্বিয়া, হিন্দুস্তান, মেগাফোন, মেনোলা প্রভৃতি রেকর্ড কোম্পানির প্রথম পুরুষরা। সে সময় প্রতি মাসেই বেরতো গানের রেকর্ড। তবে বিশেষ করে পুজোর প্রাক্কালে আগমনী, বিজয়া, বাগানবাড়ির গান, ভক্তিগীতি, নাটকের গানের পাশাপাশি ঠাঁই নিত আধুনিক গান।


এই আধুনিক খেতাব এলো কবে? ১৯৩০ সালের ২৭ এপ্রিল কলকাতা বেতারে হৃদয়রঞ্জন রায় নামে এক শিল্পীর বাংলা গান সম্প্রচারের সময় উপস্থাপক বাংলা গান কথাটির আগে আধুনিক শব্দটি ব্যবহার করেন। হয়ত বলার সময় তেমন সুদূর প্রসারী চিন্তা ভাবনা তার মাথায় ছিল না কিন্তু বাজার – এই শিরোনাম হাতে গরম শিঙ্গাড়ার মত ঠাণ্ডা হতে দিল না। এরকম – কথা কিছু কিছু – রয়ে যায়। পরে যেমন হয়েছে পঞ্চ কবির গান, জীবনমুখী কিম্বা সেকালের আধুনিক সামান্য বুড়ো হয়ে হল স্বর্ণ যুগের গান ইত্যাদি। এমন কি রবীন্দ্র গান কেন সঙ্গীত এবং নজরুল কেন লিখলেন গীতি – সেটিও সেই দুখিরামের কাছে তেমন সুস্পষ্ট নয়। কিন্তু আজ রবীন্দ্র-গীতি মনে মনে ভাবলে – ভাতের কাঁকড়ের মত দাঁতে লাগে। অর্থাৎ এক রকম ব্রান্ডিং মনের মাথায় বসানো খুব জরুরী। সেটি প্রাসঙ্গিক হবার সঙ্গে সঙ্গে চিত্ততোষীনী হওয়াও দরকার। এক সময় পানামা ব্লেডের বিজ্ঞাপনে যেমন হাস্যমূখী মহিলার ছবি থাকত। (দুখিরামের ছোটবেলায় একটি কবিতার পঙক্তি তার মনে শিহরন তুলত – তোমার হাসিতে পানামা ব্লেডের ধার।)

তবে ‘পুজোর গান’ পুজোর বাজারে নতুন কাপড়ের মত আবশ্যিক হতে কিছুটা কালক্ষেপণ ঘটেছে। কারণ কলের গান ও রেকর্ড – মহার্ঘতার কারণেই – উচ্চবিত্তের বৈঠকখানাতেই থানা গেড়ে বসেছিল। আপামরের হৃদয় হরণ করার বাণিজ্যকরণ হল অনেক পরে – ষাটের দশকে। ততদিনে চোঙা শিঙে ফুঁকেছে আর সেই বৃহৎ কলের গান ছোট হতে হতে একা মানুষের সুটকেসের মত আকার নিয়েছে। এই কারণে – অর্থাৎ – সময় বহিয়া গেছে – এই ওজরে – এই লেখা থেকে বাদ পড়লেন কাশিম মল্লিক আর কুন্দন লাল সাইগল।

ছয়ের দশকের গোড়া থেকেই সারা বছর ধরে রেকর্ড প্রকাশ কমানো হল। বাড়ানো হল পুজোর সময় বেরোনো রেকর্ডের সংখ্যা। খুব তাড়াতাড়ি জনপ্রিয় তকমা পড়ল ‘পুজোর গান’। মনে রাখতে হবে এই সময় ‘সুখী গৃহকোণ , শোভে গ্রামাফোন’-এর স্বপ্ন মধ্যবিত্ত সমাজে সত্যি হয়েছে। এইচ এম ভি আবার ‘এগিয়ে থাকে – এগিয়ে রাখে’ আঙ্গিকে প্রকাশ করত গানের বাণী ও শিল্পীদের ছবিসহ ছোট্ট এক পুস্তিকা, রেকর্ড বেরোবার মাস খানেক আগে। রামের জন্মের আগেই রামায়ণ। এও বিপণন । বাঙআলির উৎসব আনন্দের সুহাসিনী পমেটম। সব রেকর্ড তো কেনা যায় না, অন্তত বাণী পড়ে কিছুটা আত্মার আরাম হত। আর সে সব বাণী পঠনযোগ্য ছিল । ধরুন, কোন একাকী সন্ধ্যায় এমনিই পড়লেন … ক’ ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ যে তুমি ভালবাসবে, কত নিশি গেছে নীল তারা ওগো, … কিম্বা … রূপের ওই প্রদীপ জ্বেলে কি হবে তোমার …। আহা – সে সব পৃথিবীর গান আকাশ নাই বা মনে রাখল … আমরা রেখেছি যে। এই রে । দুখিরাম বুঝি বুড়ো হল। না, না একটু পা চালিয়ে ভাই।

ভালো হোক বা মন্দ, রাজনৈতিক বা সামাজিক – পরিবর্তন ই জীবনের একমাত্র অপরিবর্তনীয় ধারা। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিও তাই। যেমন দাদু পরতেন হাফ প্যান্ট এবং দুখিরাম পরে বারমুডা। সত্তর দশকের শেষ থেকেই আবার সারা বছর গান প্রকাশের ধারাটি ফিরে আসতে লাগলো। রেকর্ড বিলীয়মান, বাজারের দখল নিল ক্যাসেট। তারপর সিডি … তারপর … তার আর পর নেই । শিল্পীতে শিল্পীতে ছয়লাপ হলেও – বাঙলা আধুনিক গানের সাজান বাগান কিছুটা শুকিয়ে গেল। সুমন ফুটল জীবনমুখীর হাত ধরে নব্বুইয়ের মাঝামাঝি। অনেকেই নতুন রকম ‘নচিকেতা’ হবার দৌড়ে সামিল হলেন। তানপুরা ছেড়ে ধরলেন গীটার। সুনামি হলেও তার তেজ কমে যায়। সুমনামী কোটালে ভাঁটা পড়ল। আন্তর্জালের কোপে এখন রেডিও, গ্রামাফোন, টেপ রেকর্ডার , সিডি প্লেয়ার, আই পড – প্রাচীন পুরাকীর্তি হয়ে ঘরে সাজানো। আজকের লব্জ পালটে গেছে ‘সুখী জনমন, হাতে মুঠোফোন’। হরি মন মজায়ে লুকালে কোথায় ?

বিষাদ যাপন থাক, এখন – কোন খান থেকে আর কোন জনকে দিয়ে সে দিনের আখ্যান শুরু করা যায়? দুখিরাম যখন – ‘ভাবতেছি তাই আপন মনে … ‘ তখনই অকারণে একটি গানের কলি ভেসে এলো – ‘মন কে কিছু বল না, মন তো কথা শোনে না’। ঠিক তাই । এ লেখার পাঠক মনের অধিক মনন দরকার নেই। অল্প স্বল্প গল্পের মশলা ছিটিয়ে দু মিনিটে চটপট খাবার পরিবেশন করবে দুখিরাম। উপাদানের নিজ গুনেই পদটির স্বাদ সৌরভে তন্ময় হবেন পুরবাসী।

মুকেশ চন্দ্র মাথুর


শুরু করা যাক উনিশশো কুড়ির দশক দিয়ে । দেখা যাক কুড়ি থেকে তিরিশে সালের মধ্যে জন্ম নেওয়া কোন কোন অবাঙালি জাতক / জাতিকা ঋদ্ধ করেছেন বাঙলা সঙ্গীতকে। মনে গুন গুন করে ওঠা গানটি গেয়েছিলেন স্বভাব সুন্দর মাথুর সাহেব – পুরো নাম মুকেশ চন্দ্র মাথুর (১৯২৩)। উত্তর প্রদেশের মানুষ, এনাদের আদি-ধাম ছিল সম্ভবত মথুরায়। প্রেমের ঠাকুর কৃষ্ণ ছিলেন যেখানে। মুকেশ নামের মানে বোবার ভগবান। তা বলা যায়। মুক বিরহীর বিষণ্ণতা মুখর তার কণ্ঠে। এরকম মন কেমন করিয়ে মন টানার গান – নাহ – আর কেউ তো স্মরণে আসেন না। কথা লিখেছিলেন মুকুল দত্ত, আর সুরারোপন ? সে আবার আরেক মহীরুহ – বাংলায় জন্মে ভারত জয় করা হেমন্ত কুমার। প্রকাশ উনিশশো সাতষট্টি, প্রকাশক এইচ এম ভি। অবশ্য তার আগেই তিনি বাঙলা সিনেমায় কণ্ঠ দিয়েছেন, সরি ম্যাডাম। প্রথম পুজোর গান পুলক বাবুর কথায় ‘ওগো আবার নতুন করে ভুলে যাওয়া নাম ধরে ডেকো না’ এবং ‘দেহেরই পিঞ্জিরায় প্রাণ পাখি’। তারপর ‘মন মাতাল সাঁঝ সকাল’, ‘মন্দ বলে লোকে বলুক না’, ‘ঝুন ঝুন ময়না নাচ না’ ইত্যাদি। সমস্তই বাঙালি জীবনের নিজস্ব আনন্দ বিষাদ গাথা।

মহম্মদ রফি

যদি মাথুর কীর্তনই হল তবে তার সমসাময়িক জাঠ পাঞ্জাবি মুসলিম নিপাট ভদ্রলোকটির কথাও সেরে নিতে হয় – যার ডাক নাম ফিকো আর ভালো নাম ‘রূপোলী পর্দার সোনালী কণ্ঠ’। মাপ করবেন তাঁর জীবনী লিখতে গিয়ে এমনটাই বলেছেন শ্রীমতী সুজাতা দেব। আমরা বলছি গায়ক মোহাম্মদ রফির কথা (১৯২৪)। মুকুল দত্তের কথায় রেকর্ড করলেন প্রথম পুজোর গান – ‘তোমাদের আশীর্বাদের এই শতদল মাথায় রাখি’। সুর করেছিলেন স্বল্পশ্রুত সুরকার জুটি বাসু চক্রবর্তী আর মনোহারি সিং। পঞ্চম বাবুর বৃন্দ বাদনে প্রথম জন বাজাতেন বেহালা আর অন্য জন সাক্সোফনের যাদুকর। বেশ কয়েকটি বাঙলা গান পুজোয় বাজারে এসেছিল তার – ‘যেমন তোমার নীল দোপাটি চোখ , না না না পাখিটার বুকে যেন তীর মেরো না, এখনি বিদায় বোলো না, এবার তাহলে আমি যাই, গুলমোহরের ফুল ঝরে যায়’ ইত্যাদি। কিন্তু তুলনায় বাংলা গানে তেমন জনপ্রিয়তা পান নি রফি সাহেব । আসলে তার নিজেরই হিন্দি গানের প্রবল জনপ্রিয়তার তুঙ্গ বিন্দুটি – বাংলা গানের সফরে তিনি স্পর্শ করতে পারেন নি।

তালাত মামুদ

সেটা পেরেছিলেন নায়ক গায়ক বাঙালির তপন কুমার, সারা ভারত যাকে চেনে তালাত মামুদ (১৯২৪) নামে। জন্ম লক্ষ্ণৌতে, এক রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে। গুরুজনদের আগ্রহ না থাকলেও তাঁর প্রারম্ভিক সঙ্গীত শিক্ষা মরিস কলেজ অফ মিউজিক-এ, পরে যা হয়েছে ভাতখন্ডে মিউজিক ইন্সটিটিউট। মাত্র ষোল বছরেই শুরু হয়ে যায় পেশাগত সঙ্গীত জীবন। তিনি একাধারে হিন্দি / উর্দু গজল সম্রাট আবার বাঙলা আধুনিক গানের ইতিহাস তাকে ছাড়া লেখাই যাবে না। অবশ্য তাঁর পরিষ্কার বাঙলা উচ্চারণ ও বাঙলা প্রেম এক বাঙালিনীর জন্যে – শ্রীমতী লতিকা মল্লিক। আদতে খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী হলেও তালাত মামুদকে বিয়ের পর ধর্ম পরিবর্তন করে নাম নেন নাসরিন। উপরোক্ত দুই ভারত কাঁপানো শিল্পীরা যখন হাজার হাজার রেকর্ড করছেন এই সুভদ্র মানুষটি আজীবনে করেছেন মাত্রই সাতশো পঞ্চাশটির মত রেকর্ড। তাতেই তাঁর পদ্মভুষন সম্মান লাভ। সে কথা বাঙালির মনে নেই কিন্তু যে কোন বয়সেই তারা গুনগুনিয়ে থাকেন ‘রূপের ওই প্রদীপ জ্বেলে কি হবে তোমার’। তালাত মানেও যে সৌন্দর্য। পরের পর পুজো মণ্ডপ মাতিয়ে রেখেছে তাঁর গানের ডালি ‘যে আঁখিতে এত হাসি লুকানো’, ‘চাঁদের এত আলো’, ‘যেথা রামধনু ওঠে হেসে’, ‘তুমি সুন্দর যদি নাহি হও’। আর একটি গান … ‘এ যদি আকাশ হয় তোমায় কি বলে আমি ডাকবো বল’। কোন নায়িকা যে গানের স্থায়ীতে ফেরার আগে – তারপর – বলেছেন সেই গবেষণা চলত মুখে মুখে। পরে জানা গেল বাক্য-বন্ধটি বলেছেন … আর কেউ নয় … স্বয়ং মুকুলিত গীতিকারের স্ত্রী, অর্থাৎ কি না …। (পাঠক মহল তার নাম খুঁজে নেবেন এবং কমেন্টে জানাবেন। সঠিক উত্তরের জন্যে কোন পুরস্কার নেই শুধু আবিষ্কারের আনন্দ।) প্রাক বৃদ্ধ, প্রায় বৃদ্ধ রা কি নিজেরদের হৃৎস্পন্দনে তাঁর পরশ পাচ্ছেন?

লতা ও আশা

সুধী শ্রোতা অনেক ধৈর্য ধরে আছেন এবং তারা হয়ত ভাবতে বসেছেন দুখিরামের ভীমরতি কি নিকটবর্তী? তা না হলে পৃথিবী কাঁপানো দুই মঙ্গেশকার ভগ্নীর উল্লেখ এখনো আসছে না কেন? আসলে পুজোর গানে তাদের উপস্থিতি এতই স্বাভাবিক যে তারা যে বঙ্গভাষী নন এমনটা মনে হয় না। দিদি হেমা (১৯২৯) প্রায় চার বছরের বড় – বোন আশার থেকে। হেমা দিদি কিছুটা আগে পা রেখেছেন রূপোলী জগতে, নাম পেয়েছেন লতা। বালিকা শিল্পী হিসেবেই চোখে পড়েছেন নামী সুরকারদের। প্রারম্ভিক কিছুটা নড়বড়ে জীবন কাটালেও ধীরে ধীরে বট বৃক্ষ হয়ে গেলেন হিন্দি ছায়া ছবির দুনিয়ায়। ছত্রিশটি ভারতীয় এবং বেশ কিছু বিদেশী ভাষায় গেয়েছেন তিনি। বাঙলা তাঁর মধ্যে অন্যতম। এনার পুজোর গান নিয়ে বলা মানে বাঙালি শ্রোতার নিখাদ ভালোবাসায় খাদ মেশানো। বরং তাঁর পুজোর গান – না গাওয়ার একটা গল্প বলা যায়। মান্না – তখন বাঙলা গান – গাননা। নিজেকে দেখতে চান সুরকারের ভূমিকায়। সেবার সুর করেছেন লতা দিদির জন্যে কিন্তু বার বার তারিখ পালটাচ্ছেন অতি ব্যস্ত গায়িকা। সময়াভাবে আর কিছুটা বিরক্ত হয়ে মান্না দে নিজেই রেকর্ড করে ফেললেন গান দুটি। ‘কত দূরে আর নিয়ে যাবে বল’ এবং অন্য পিঠে ‘তীর ভাঙ্গা ঢেউ আর নীড় ভাঙ্গা ঝড়’। ইতিহাস লেখা হয়ে গেল আর মান্না দের ভাগ্য লিপিও। বঙ্গভাষীর মিলন বিরহের তিনি আজও প্রথম ভাষ্যকার। সেই সত্ত্বার নিচে চাপা পড়ে গেল শুধু মাত্র সুরকার হবার স্পৃহা। লতা দিদি আসেননি – ভাগ্যিস!

আশা ভোঁসলে বিষয়ক একটি অনুরূপ গল্প আছে । লতা দিদির উপর একটি কারণে রেগে ও পি নাইয়ার সাহেব তাঁকে বর্জন করে ডেকে নিলেন আশা মঙ্গেস্করকে এবং পরের পর হিট। তাঁকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় নি। বাঙলা গানে অবশ্য তাঁর আবির্ভাব বেশ পরে – ১৯৫৯ প্রথম পুজোর গান রেকর্ড। সা-রে-গা-মা-য় দখল প্রশ্নাতীত, চটুল গানেও সমান সক্ষম। উদাহারন নিষ্প্রয়োজন, আশা-দিদি তার জবাব দেননি। গিনেস বুক অফ রেকর্ডে তাঁর নাম সব থেকে বেশি ধ্বনি-মুদ্রিকার শিল্পী বলে লেখা আছে এবং তা ক্রমবর্দ্ধমান । ওই রেকর্ডের কিছুটা দাবি বাঙলা গানেরও আছে, সেটাই আমাদের গৌরব। গানের উদাহারন এত যে – তাঁর দিদির মতই – বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে।

বেগম আখতার

মলিকা এ গজল আখতারী বাই ফৈজাবাদী (১৯১৪) কে একবার মানতে হয়েছিল গুরু জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের অনুরোধ। পুজোর গানের দরবারে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর ই পি রেকর্ড ‘চুপি চুপি চলে না গিয়ে’ আর ‘জোছনা করেছে আড়ি’। বাঙ্গালী শ্রোতা নবীন বরন করে নিয়েছিল তাঁকে। তবে পরে আর সেই ভালোবাসার রাজ প্রাসাদে খুব বেশি দেখা যায়নি গজল সম্রাজ্ঞী কে। চুপি চুপি ই চলে গেছিলেন বাংলার আকাশ ছেড়ে।

সুমন কল্যাণপুর


লতা – আশার সমসাময়িক বেশ কিছু মহিলা কণ্ঠ উপযুক্ত উড়বার আকাশ পাননি। খানিকটা বিধাতা আর খানিকটা মানুষ – তার জন্যে দোষী । বানী জয়রাম, হেমলতা আর সবার উপরে আরতি মুখোপাধ্যায়। তবে একই সময় আর একজন ছিলেন । তিনি বিখ্যাত হবার সুযোগটি পেলেন কারণ পঞ্চাশ ষাট দশকের একটা সময় – রয়্যালটি নিয়ে কিছু মত বিরোধে লতা এবং রফি একে অন্যের সঙ্গে যুগল গীত অস্বীকার করেন। ব্যাস। সে বিরোধ মিটতে না মিটতেই তিনি রফির সঙ্গে গেয়ে নিলেন ১৪০টি গান। তার মধ্যেই বাঙলা গান। অবাঙালি হিসেবে তাঁর বাংলা উচ্চারণ অন্যদের থেকে কয়েক যোজন কাছের। তিনি সুমন হেম্মাডি (১৯৩৭)। জন্ম ঢাকায় , হেম্মাডি তাঁর পূর্ব পুরুষের গ্রাম, মহারাষ্ট্রে । বিয়ের পরে পদবি পেলেন কল্যাণপুর। হিন্দি ছাড়া গেয়েছেন বাংলা, মারাঠি, অসমীয়া, গুজরাটি, কন্নড়, মৈথিলী, ভোজপুরি, রাজস্থানি, ওড়িয়া এবং পাঞ্জাবি গান । হতে পারতেন আঁকিয়ে – হয়ে গেলেন গাইয়ে। উনিশশো সাতষট্টি তে প্রথম পুজোর গান ‘মনে করো আমি নেই – বসন্ত এসে গেছে’। কথা পুলক বন্দ্যো, সুর রতু মুখো। আবির্ভাবেই ভিনি ভিসি ভিডি। এলেন, দেখলেন , জয় করলেন, গান পাগল পশ্চিমবঙ্গ । তারপর ‘পায়ের চিহ্ন নিয়ে পড়ে থাকা পথটার গায়’, ‘আকাশ অজানা তবু – পাখা মেলে উড়ে যায় পাখি’, ‘আমার স্বপ্ন দেখার দুটি নয়ন’, ‘শুধু স্বপ্ন নিয়ে খেলা চলেছে’ – কোনটির উল্লেখ করা যায় কোনটিকেই বা বাদ – দুখিরাম সেই কাজে ডাহা ফেল। তাঁর গলায় সব সময় এক অবুঝ বিষণ্ণতা, নিবিষ্ট শ্রোতাকে আতুর করে। তিনি দীর্ঘজীবী হোন।

আচ্ছা বাঙালি আর বঙ্গভাষী কি এক? ঠিক জবাব জানে না দুখিরাম। তাই আজন্ম প্রবাসী, বাঙলা অক্ষর লিখতে পড়তে অপারগ, আভাষ কুমার গাঙ্গুলিকে বাঙালি ভেবেই এ লেখার চারণ ভূমি থেকে বাদ দিল দুখিরাম । একই কারণে বাঙলা গানের স্তম্ভ প্রমাণ ত্রিপুরার রাজকুমার পিতা পুত্রকে লম্বা সেলাম ঠুকে সরে থাকল সে। তাঁরা তো রইলেনই তার মনের ময়ূর মহলে, ভাটি গাং বেয়ে যেখানে থাকতে এসেছিলেন রুবী রায়।
Photo: Singers’ Photos in Word file (as provided by Shouvik De)

এবার কিছু অন্য অনন্যসাধারণ শিল্পীর কথা আলোচনা করে নেওয়া অসমীচীন হবে না। এরা এক দু বার ছুঁয়ে গেছেন পুজোর গানের আসর। তাদের উপস্থিতি তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি। নাম নেওয়া যায় জগজিৎ সিং, বানী জয়রাম, ভুপিন্দর, কবিতা কৃষ্ণ মূর্তি, মহেন্দ্র কাপুর, ঊষা মঙ্গেস্কর … আরো কয়েকজনের। ঊষা উথুপ অবশ্য বেশ জনপ্রিয় হয়েছেন কিন্তু সে তাঁর অন্য রকম গায়ন ভঙ্গীর জন্যে। তার ‘ আমি শিল্পী চাই শিল্পীর সম্মান’ এক সময় প্রতিবাদের ঢেউ তুলেছিল। রুপোলী দুনিয়ার থেকে ঢুঁ মেরেছিলেন হেমা মালিনী, বৈজয়ন্তী মালা । (একটি অপ্রাসঙ্গিক তথ্য – রেকর্ড আছে টলিগঞ্জের ম্যাডাম বা সুচিত্রা সেনেরও) তবে সে যেন শীতল পানীয়র ক্ষণেক বুদবুদ। উড়ে গিয়ে ফুরিয়ে গেল সেই তারি আনন্দ। অমৃক সিং অরোরা অবশ্যই বিশেষ মনোযোগের দাবী রাখেন। কিন্তু তাঁর প্রকাশিত প্রায় ২০০০ গানের ডালিতে তিনি মূলত ভক্তি গীতি গেয়েছেন, আধুনিক গান হাতে গোনা । তাই শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁকে এই বলয়ের বাইরে রাখা হল।

ঘুঁড়ি এবার গুটিয়ে নেওয়া যাক। যদি কেউ রয়ে গেলেন অনুল্লিখিত – স্মৃতি ভরসা দুখিরাম মার্জনাপ্রার্থী। তবে এই বিষয়ের চর্চায় বেশ ঘুরে আসা গেল ফেলে আসা পথ, ঘাট, গলির নির্জন প্রান্তে। কখনও বয়ে গেল মন খারাপের মন্দ মধুর হাওয়া, কখনও ভিজিয়ে গেল ভালোবাসার ইলিশে গুঁড়ি। কানে কানে বলে গেলেন রবীন্দ্রনাথ ‘রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে’।

কৃতজ্ঞতা – বাঙলা এশিয়া নেট নিউজ, আন্তর্জাল, উইকিপিডিয়া, সম্পাদক মশাইয়ের তাগাদা আর অবিশ্বাসী স্মৃতি শক্তি।

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x