শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

অন্ধকারে প্রোথিত শিকড়, খুঁজে ফিরি আলো

সময়ের জটিল বয়নে অন্ধকার গাঢ় হয়ে উঠলে আলোর তৃষ্ণা যেন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে!

কোনও কোনও মহল থেকে আজকাল প্রায়ই শুনতে পাই, রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর থেকে বিবেকানন্দ, এঁদের সবাই-ই নাকি ঔপনিবেশিকতার ‘ দালাল’ এবং একইসঙ্গে কেউ কেউ তথাকথিত ব্রাহ্মণ্যবাদী ও সাম্প্রদায়িক! সময়ের সঙ্গে এবং দৃষ্টিকোণ পাল্টালে তথাকথিত বিখ্যাতদের মূল্যায়নে পরিবর্তনই স্বাভাবিক। আপত্তি তার অতি-সরলীকরণে! অতি-সাধারণীকরণে। আপত্তি প্রেক্ষিতহীন একমাত্রিক বিবেচনাতেও! আর এঁদের বিপরীতে উঠে আসা বিকল্পসব আদর্শ? সে-সব যত কম বলা যায় ততই ভালো।

এই ভুলভাল বিকল্প আদর্শায়নের সর্বাঙ্গ জুড়েইতো সময়ের নিরবচ্ছিন্ন বিকার আর অন্ধকারের নিবিড় বয়ন! এর বিপ্রতীপে আমাদের সত্যিকারের আশ্রয় কয়টি? সেইতো গুটি কয়েক মাত্র! আমাদের আদর্শগত তৃষ্ণার যাবতীয় অবলম্বন ও আশ্রয়, স্বপ্ন ও কল্প-পৃথিবী, সব শুধু তাঁদের কয়েকজনকে ঘিরেই! এদিকে অন্ধকার যত গাঢ় হচ্ছে চারিদিকে, ততই যেন অনিকেত আদর্শের যন্ত্রণা আরও প্রবল হচ্ছে!

আজ মনে পড়ছে এমন দুজন বাঙালির কথা বছরের এই তৃতীয় কোয়ার্টারেই যাঁরা জন্মেছিলেন। তাঁদের নিয়েই এই সংক্ষিপ্ত লেখা।

হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোথা…”

তাঁর জীবন আর সারস্বত সাধনার মধ্যেই রয়ে গেছে কূট অ্যকাডেমিক বিতর্কের একটা পরিসর। জ্ঞানের স্পেশালাইজেশনের যুগে আগ্রহের অনুভূমিক বিস্তারের সঙ্গে উল্লম্ব বিস্তারের বোধহয় একটা অনিবার্য সংঘাত আছে। বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে আগ্রহের অনুভূমিক বিস্তার যেন কখনোই বিশেষ একটা বিষয়ের ব্যুৎপত্তি বা গভীর আগ্রহকে সুনিশ্চিত করে না। এটাই প্রচলিত ধারণা।

জ্ঞানের বিশেষায়িত( specialized) একটা পরিমণ্ডলে নিজেকে সীমায়িত রাখার প্রবণতার মধ্যে বহুক্ষেত্রেই রয়ে যায় তথাকথিত বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিতির ছদ্ম অহমিকা। প্রশ্ন এখন এটাই যে এই নাক-উঁচু আধুনিক পর্যবেক্ষণে অতিসরলীকরণের দোষ নেই তো? তা যদি হয়, তাহলে বুঝতে হবে মনের বাকি সব জানালাকে রুদ্ধ করে এই তথাকথিত গভীরতাসন্ধানী তৃষ্ণা বহুক্ষেত্রেই আসলে এক অন্ধকূপযাত্রা!

যদি তাই হয়, তাহলে বিপরীতমুখী তৃষ্ণায় প্রথমেই আজ মনে আসবে এমন একজনকে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই যাঁর জন্ম। ৩ রা সেপ্টেম্বর জন্মদিন এই বিরল সারস্বত প্রতিভার, যাঁর সম্পর্কে স্যাডলার বলেছিলেন —“ — — প্রাচ্যে বা পাশ্চাত্যে পাণ্ডিত্যের প্রসারতায়,গভীরতায় এবং মৌলিকত্বে এই মানুষটির সমকক্ষ কেউ নেই। ” স্যাডলার কমিশন যতই বিতর্কিত হোক, স্যাডলারের এই প্রশংসায় প্রশংসিত মানুষটার গুরুত্ব কমে না এতটুকু। বরং বাড়ে। জ্ঞানের বিশেষায়ণের একমাত্রিকতার বিপ্রতীপেই তাঁর সামগ্রিক অস্তিত্ব আর সারস্বত সাধনা। অতৃপ্ত এই জ্ঞানভিক্ষুর গোটা জীবনটাই এক অন্তহীন উড়ান!

আসুন, কতগুলো বইয়ের নাম শুনে আন্দাজ করার চেষ্টা করি লেখক কোন বিষয়ের লোক হতে পারেন। ‘A memoir on the coefficient of numbers’, ‘Neo- Romantic movement in bengali literature’, ‘Introduction to Hindu Chemistry’, ‘ A comperative study of Christianity and Vaisnavism’, ‘The quest eternal’, ‘New essays in criticism’
ঠিকই ধরেছেন। বিষয়গুলো হবে যথাক্রমে বিশুদ্ধ গণিত, সাহিত্য বা সাহিত্যের ইতিহাস, রসায়ন, তুলনামূলক ধর্ম বা দর্শন, শেষের দুটি একাবারে আন্তঃবিষয় গবেষণার আধুনিক ঝোঁক– সাহিত্য ও দর্শনের এক অন্তর্লীন সঙ্গম।

এবার আমাদের অবাক হওয়ার পালা। সব কটা বইয়ের লেখক কিন্তু একজনই মানুষ। কে তিনি? তিনি এমন একজন মানুষ, বিএ পাশ করার পর ইংরাজী সাহিত্যে তাঁর ব্যুৎপত্তির জন্য সিটি কলেজ থেকে যাঁকে আহ্বান করা হলো অধ্যাপক পদে যোগ দিতে। শুরু হলো ২০ বছরেই তাঁর শিক্ষক জীবন। তিনি এমন একজন মানুষ, এম এ পরীক্ষার ফর্ম পূরণ করতে এসে কয়েক মাস বাদের পরীক্ষার বিষয় নির্বাচনে যিনি দ্বিধাগ্রস্ত । কোন বিষয় ফেলে কোনটা নির্বাচন করবেন? ইংরাজী? গণিত? না দর্শন? শেষপর্যন্ত পরীক্ষার বিষয় হিসেবে দর্শনকে বাছলেন এবং প্রথম হলেন। তিনি এমন একজন মানুষ বিবেকানন্দ(জেনারেল আ্যসেম্বলি বা স্কটিশচার্চে তাঁর সহপাঠী ), রবীন্দ্রনাথ, ম্যাক্সমূলার যাঁর জ্ঞানদীপ্তিতে মুগ্ধ। কয়েকবছর পরই স্বপ্নের বিশ্বভারতীর উদ্বোধনী সভায় সভাপতিত্ব করতে রবীন্দ্রনাথ আহ্বান জানাবেন যাঁকে, উনি তিনিই।
তিনি আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ। ব্রজেন্দ্র নাথ শীল (৩সেপ্টেম্বর, ১৮৬৪ – ৩ ডিসেম্বর ১৯৩৮)।

দার্শনিক হিসাবে যাঁর মৌলিকত্বের বিচ্ছুরণের শুরু হিস্টরিক্যাল মেথড-এ হেগেল ও স্পেনসারের সীমাবদ্ধতা নির্ণয়ে। আর শেষ — ওয়ার্ল্ড হিউম্যানিসম অর্থাৎ দর্শন-মনীষার এক যুগান্তকারী পরিণতিতে।

সংস্কৃত ,গণিত, অর্থনীতি , দর্শন, ধর্মতত্ব ,পদার্থবিদ্যা ,রসায়ন,ইতিহাস ও ইংরাজী সাহিত্য, সর্বত্র তাঁর নির্বাধ বিচরণ! গ্রীক সংস্কৃতির পরিভাষায় একজন আদর্শ ‘পলিম্যাথ’ তিনি।

যাঁরা পড়েছেন তাঁদের বিস্মিত প্রশ্ন। আত্মীকৃত মনীষা আর প্রজ্ঞা কতটা সৃজনশীল হলে মিলটনের ‘প্যারাডাইস লস্টে’ র সমান্তরালে ‘ফউস্টিয়ান’ রীতিতে লিখে ফেলা যায় আর এক মহাকাব্য ‘দ্য কোয়েস্ট এটারনাল’? তীক্ষ্ণ যুক্তিবাদ, অসাধারণ বিশ্লেষণী ও সংশ্লেষণী ক্ষমতা আর অন্তহীন অনুসন্ধিৎসার উন্নততম সৃজনধর্মী সমবায়ই ছিলেন ব্রজেন্দ্রনাথ।

অধ্যাপক থেকে আচার্য, একটা থেকে আর একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর অতৃপ্ত যাত্রা! এই যাত্রাতো আসলে বাহ্যিক আর প্রতীকী ! আসলে যেন তা এক অতৃপ্ত অন্তরাত্মার অব্যক্ত যন্ত্রণা! ‘হেথা নয় হেথা নয় অন্য কোথা, অন্য কোনখানে’।

জ্ঞানতৃষ্ণা কখনও যে নিশ্চল হতে দেয় নি তাঁকে।
জানি, আমাদের বহু আদর্শই দূরপ্রণম্য মাত্র। শুধুই বাৎসরিক আনুষ্ঠানিকতায় উদযাপনযোগ্য। আত্মীকরণের বাস্তবতা সেখানে নেই। তবু আদর্শ আদিঅন্তহীন স্বয়ম্ভূ কিছু নয়। তা একটা পরম্পরা। আদর্শটা একটু বড় হলে বিবেক অন্তত কূপমণ্ডূক হতে পারে না হয়তো।

সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই প্রত্যেকবার স্যোশাল সাইটকে ছেয়ে যেতে দেখি এক নেতিবাচক বিতর্কে। এক কুম্ভীলকের জন্মদিনে জাতীয় শিক্ষক দিবস কেন? এই প্রশ্ন উঠে আসে এমনই কুৎসিত পরিবেশনায়! এই অভিযোগের তথ্যগত সত্যিমিথ্যে নিয়ে অতিমুখরতার মধ্যে একটু ইতিবাচক কিন্তু হওয়াই যায়। কাউকে ছোট করার দরকার নেই। বরং উঠে আসতেই পারে একটা পরিপূরক প্রস্তাব। বাঙালির নিজস্ব একটা শিক্ষক দিবস পালিত হোক বরং। কোন দিনে পালিত হতে পারে সেটা? আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের জন্মদিন খুব ভালো একটা বিকল্প হওয়া উচিত। নয় কি?

দিশাহীন সময়ের দিশা

সমস্ত সুশিক্ষিত মানুষই আসলে স্বশিক্ষিত”— প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অন্তঃসারশূন্যতার বিপ্রতীপে এই প্রতিস্পর্ধী মন্তব্যের প্রসঙ্গ কী ছিল? কে জানে! তবে ঐ উক্তির প্রসঙ্গ ও প্রয়োগসীমা যাই হোক, যে দুই বাঙালি সম্পর্কে এ কথা সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য, ঘটনাক্রমে তাঁদের দুজনেরই জন্ম ১৮৬১তে !

দুজনের মধ্যে যিনি তিন মাসের ছোট, তাঁরও বিদ্যালয় শিক্ষায় ছেদ পড়ল বছর তিনেকের জন্য শারীরিক অসুস্থতার কারণে। ভাগ্যিস ছেদ পড়ল! তাইতো পাঠক্রমের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হলেন কিছুটা! তাইতো ১০-১৩ বছরেই শৃঙ্খলমুক্তির ঐ অবসরে প্রাথমিক ব্যুৎপত্তি অর্জন করে নিলেন ৪ টে ভাষায়— গ্রীক, ল্যাটিন, ফ্রেঞ্চ ও সংস্কৃত! তীব্র তৃষ্ণায় তিনি সেই বয়সেই পড়ে নিচ্ছেন ‘Selections from Modern English Literature’ অথবা Goldsmith এর Vicar of Wakefield । যদিও বছর সাতেক বাদেই ৪টে ভাষায় ব্যুৎপত্তি দেখিয়ে এনং গিলক্রিস্ট স্কলারশিপ নিয়ে তিনি University of Edinburgh তে পড়াশুনা করতে যাবেন এবং DSc করবেন অন্য একটা বিষয়ে নিয়ে । মাতৃভূমির উন্নয়নের স্বপ্ন ছুঁয়ে যে বিষয় তাঁর প্যাশান, সেই রসায়নে।

১৮৬০-১৮৯০ বাঙ্গালির সমাজ-চেতনায় অর্ন্তবিপ্লবের উল্লেখযোগ্য ৩০ বছর। প্রত্যক্ষ ঘাত-প্রতিঘাতেরও। ভারতীয় সমাজ-মননের রক্ষণশীলধারার বিপ্রতীপে শুরু হল এক সমাজবিপ্লব। রামমোহন-কেশব সেন-বিদ্যাসাগরের চেতনায় আলোকিত হয়ে। সঙ্গে রইল ইয়ংবেঙ্গলের উজ্জ্বল উত্তরাধিকার! প্রয়োজনীয় পরিমার্জনা সহ অবশ্য।

১৮৬০-১৮৭০, তারই প্রথম অংশ। ভারতীয় রেনেসাঁর এক স্বর্ণপ্রসূ দশক। ১৮৬১তে জোড়াসাঁকোয় আবির্ভূত হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। একই দিনে মতিলাল। তিন বছর আগে জগদীশচন্দ্র। মাত্র দু বছর পর জোড়াসাঁকোর ঢিল ছোঁড়া দুরত্বে জন্ম নিচ্ছেন এমন একজন মহাপুরুষ যাঁর হাত ধরে হৃদয়বৃত্তির অনন্য সংযোজনে মেধাবী বেদান্তই অন্ধকারে নিমজ্জিত এক জাতিকে দেবে কিছুটা আলোর সন্ধান। ঐ সময়কালের আগে পরে জন্ম নিচ্ছেন আশুতোষ, মদনমোহন মালব্য, লালা লাজপত প্রমুখ।

এই প্রাক্-উত্তর কাল-আবহেই ১৮৬১-র ২ আগষ্ট জন্ম নিলেন প্রফুল্লচন্দ্র। জগদ্-জীবনের যে বিষয়েই সভ্যতার উত্তরাধিকার, তাতেই তাঁর অপার আগ্রহ! গ্যেটে, দ্য ভিঞ্চি, রবীন্দ্রনাথ, ব্রজেন্দ্রনাথ শীলদের ধারার সহনাগরিক। জ্ঞানের ‘বিশেষায়ণ’এর ( specialization) বা অতি-বিশেষায়ণ-এর ( Sub/ Super specialization) নামে এক ছদ্ম-আত্মতৃপ্তিতে যাঁরা একটা বাদে মনের আর সব জানালা বন্ধ করে আত্মরুদ্ধ করতে রাজি ছিলেন না।

সব ব্যাপারেই তাঁর তীব্র অনুসন্ধিৎসা! যশোরের বাড়ি থেকে কলকাতায় এসে ভর্তি হলেন স্কুলে। তীব্র কৌতূহলে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে দেখেন ভূগর্ভের জলের পাইপ বসানোর কৌশল। মেট্রোপলিটান কলেজের(আজকের বিদ্যাসাগর কলেজ) ছাত্র হয়েও এক দুর্বার আকর্ষণে প্রেসিডেন্সিতে ছুটে যান রসায়নের শিক্ষক আলেকজাণ্ডার পেডলারের বক্তৃতা শুনতে। রসায়নের প্রতি তাঁর দুরপনেয় আসক্তি। একই সঙ্গে ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেক্সপীয়ার , কোলরিজের রোমান্টিসিজমে তিনি রীতিমত উণ্মাদ। তাই তো পরবর্তী কালে সায়েন্স কলেজের এক চিলতে ঘরে ছোট্ট লোহার চেয়ার আর খাটের সঙ্গে এক আলমারি ইংরেজি সাহিত্য দেখে মহাত্মা গান্ধীতো অবাক হবেনই।

সম্পূর্ণ নিজের আগ্রহে শিখে ফেলেছিলেন গ্রিক, ল্যাটিন ও ফরাসি ভাষা। রসায়ন পড়তে গিয়ে ডুবে রইলেন ইতিহাস, Political economy বা Indian finance সম্পর্কিত প্রবন্ধে। এক অতলান্ত এষণায় মননশীললতার সব জগতেই তাঁর প্রবেশাধিকার চাই যে ! মারকিউরাস নাইট্রেট বা তাঁর গবেষণা পেপার –“Conjugated Sulphates of the Copper-magnesium Group: A Study of Isomorphous Mixtures and Molecular Combinations”—- এর সঙ্কীর্ণ পরিসরে তাঁকে ছোঁয়া যাবে না। বরং বিচিত্রমুখী মননশীলতা ঘিরে এক স্বর্গীয় অতৃপ্তির আলোয় প্রফুল্লচন্দ্রকে ধরতে হবে।

ততদিনে এক সর্বগ্রাসী মেধাবী অনুসন্ধানের সঙ্গেই মনের অভ্যন্তরে শুরু হয়েছিল দেশপ্রেমের এক সযত্ন লালন। রেনেসাঁ আর স্বাধীনতা সংগ্রাম তাতে নতুন মাত্রা যোগ করল। জাতীয়তাবোধ আর দেশবাসীর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ল্যাবরেটরির বাইরে টেনে আনল তাঁকে। জাতীয় সংগ্রাম থেকে সমাজমানস পরিবর্তনে উদ্যোগ, সব ব্যাপারেই জড়িয়ে ফেলেছেন নিজেকে ততদিনে। বন্যাত্রানে নিজের সর্বস্ব দিচ্ছেন। ন্যাশানাল সোশ্যাল কনফারেন্সে ভারতীয় জাতিভেদ প্রথার নিবারণে সর্বস্ব পণ করছেন।

ওদিকে দেশীয় উত্তরাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে নতুন এক গবেষণার পথে।

আধুনিক রসায়নের শিকড়ের সন্ধান চলতে থাকল। নাগার্জুন থেকে চরক, প্রাচীন রসায়নের ভারতীয় অনুষঙ্গের উজ্জ্বল উদ্ধার তাঁর অন্বিষ্ট যে! সে-ও যে তাঁর দেশপ্রেমের ভিন্নতর এক সংস্করণ। জীবনের শেষ সঞ্চয় দু লক্ষ টাকা দিয়ে গেলেন দুটো স্কলারশিপ সহ সায়েন্স কলেজের রসায়ন বিভাগের আধুনিকীকরণে।

আর একদিকেও তিনি এক অনন্য বাঙ্গালি। চাকুরী-সন্তুষ্ট অলস ও শিথিল চরিত্রের পারিপার্শ্ব ডানে- বাঁয়ে নিয়েও স্ব-উদ্যোগের অনন্য নজির স্থাপন করলেন তিনি। মাত্র কয়েক হাজার টাকার পুঁজি নিয়ে স্থাপন করলেন বেঙ্গল কেমিক্যাল। কীটনাশক, কসমেটিকস্ অনেক কম দামে পৌঁছল সাধারণের ঘরে। এক তাত্ত্বিক রসায়নবিদের ফলিত আকাঙ্ক্ষা আর পরীক্ষাসন্ধানী প্রবৃত্তি চরিতার্থ হল। তার থেকেও বড় কথা নিশ্চয়তা-পিয়াসী ভীতু বাঙ্গালির সামনে অভূতপৃর্ব এক দৃষ্টান্ত স্থাপন হল স্ব-উদ্যোগের। দ্বারকানাথের উত্তরাধিকারের কথা মনে রেখেও বলা যায় শুরু হল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির স্ব-নির্ভর উদ্যোগযাত্রা( self entrepreneurship)। যা পেশা হিসেবে আজকের চাকরি-সঙ্কোচনের যুগে ভীষণ ভীষণ প্রাসঙ্গিক।

মারকিউরাস নাইট্রেট আর তার ডেরিভেটিভ নিয়ে তাঁকে ঘিরে বাঙ্গালির আবেগ আন্তর্জাতিক স্তরের গবেষণার মাপকাঠিতে বাড়াবাড়ি কিনা সেই বিতর্ক এড়িয়ে গিয়েও এটুকু বলা যায় যে মনের আর সব জানালা বন্ধ করে জাতীয় জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধুমাত্র গবেষণায় নিজেকে তিনি যদি ডুবিয়ে দিতেন, তাহলে আমরা হয়তো অনেক বড় একজন রসায়নবিদ পেতাম। কিন্ত জীবন-কৃষ্টি -মানবপ্রেমের বহুমুখী ধারার অদ্ভুত রসায়নের জীবন্ত এক সমন্বয়কে অবশ্যই হারাতাম।

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
MILAN KANTI BARUA
MILAN KANTI BARUA
16 days ago

দারুনভাবে উপভোগ করেছি অজানা তথ‍্য সমৃদ্ধ লেখা থেকে। লেখকের প্রতি প্রণতি।

1
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x