শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী – অগ্নিযুগের এক অনন্য চরিত্র

একটি কাহিনি দিয়ে শুরু করি দেশের স্বাধীনতার জন্য নিবেদিতপ্রাণ এক অকুতোভয় মহাজীবনের কথা।

১৯১৫-এর ২  আগস্ট। চব্বিশ পরগণা জেলার আগরপাড়া স্টেশনে বিকেল ৫ টা ১৪-র  ট্রেনে সোদপুরের দিক থেকে নামলেন দুই যুবক ভ্রাতা, ক্ষেত্রনাথ পাল আর ননীনাথ পাল। এঁরা ছিলেন পৌরসভার ট্যাক্স সংগ্রাহক ওরফে সরকার বাবু। দু’জনের সঙ্গেই তখন সারাদিনের সংগ্রহ।  আগরপাড়া স্টেশন থেকে যে রাস্তাটি সোজা ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডের দিকে যাচ্ছে সেই রাস্তা দিয়ে দুই ভাই এগোতে শুরু করলেন তাঁদের বাড়ির দিকে। কিছুদূর এগোবার পর এলো নীলগঞ্জ রোড আর স্টেশন রোডের সংযোগস্থল চার রাস্তার মোড়।  সেখানে আগে থেকেই ঘোরাঘুরি করছিলেন ছ’-সাত জন ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত বাঙালি যুবক। দুই ভাই ওখানে পৌঁছতেই তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিন-চার জন। ননীনাথ নিজেকে বাঁচিয়ে বড় রাস্তার দিকে দৌড়াতে লাগলেন ও সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে লাগলেন।  ছিনতাই হয়ে গেল ক্ষেত্রনাথের টাকা ভর্তি ব্যাগ।

এদিকে ননীনাথের ডাকে সাড়া দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিল স্থানীয় বাসিন্দা হরিপদ বাগদি, বিজয় বাগদী এবং সত্যচরণ বাগদী। তাদের ধারণা হয়েছিল, আক্রমণকারীরা পেশাদার ডাকাত। স্বাভাবিকভাবেই তারা দৌড়ে গিয়েছিল চার রাস্তার মোড়ের দিকে।  দ্রুত গতিতে তাদের আসতে দেখে ক্ষেত্রনাথের ব্যাগ ফেলে সকলে বিভিন্ন দিকে দৌড়ে পালিয়ে যায়।  বাগদীরা তাদের পিছন দিক থেকে তাড়া করে। বেশ কিছুটা পিছু তাড়া করে তারা একজনকে ধরে ফেলে।  পুলিশ ঘটনাস্থলে আসবার পরে সেই ব্যক্তির পরিচয় সবার সামনে উন্মোচিত হয়। তিনি বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী। ব্রিটিশ সরকারের খাতায় তার আদি নিবাসী হিসেবে চিহ্নিত ছিল উত্তর চব্বিশ পরগনার হালিশহর এবং কলকাতার ৪ নম্বর দুর্গাচরণ পিতুরি লেন।  ভারত শাসন আইন অনুসারে তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা তখনো পর্যন্ত বিচারাধীন। কিন্তু ব্রিটিশ পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে পারছিল না। আগরপাড়ার স্থানীয় মানুষদের সহায়তায় সেদিন গ্রেফতার হয়ে গেলেন বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের অন্যতম নেতা বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি।


এরপরের পর্ব বিচারের। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল খড়দহ হাইওয়ে ডাকাতি মামলা।  বিচার হয়েছিল আলিপুরের আদালতে।  বিচারের দায়িত্ব পেয়েছিলেন প্রেসিডেন্সি ডিভিশনের কমিশনার। এই মামলা ছাড়াও সেই সময় তাঁর বিরুদ্ধে উঠেছিল রড্ডা কোম্পানির অস্ত্র এবং গোলাবারুদ লুণ্ঠনের অভিযোগ। উঠেছিল গার্ডেনরিচ এবং বেলেঘাটায় ডাকাতির অভিযোগ।


বিপিনবিহারী গাঙ্গুলীর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্তে সহায়তা করছিলেন পানিহাটি পৌরসভার তৎকালীন পৌর প্রতিনিধি মুরারি মোহন মিত্র। ৫০ বছর বয়সী এই মানুষটি বাস করতেন আগরপাড়ায় গঙ্গা তীরবর্তী অঞ্চলে।  তাঁর কৃতকর্মের ফলে বিপ্লবীদের নেকনজরে পড়ে যান মুরারি বাবু এবং শেষে পর্যন্ত তাঁদের গুলিতে নিহত হন মুরারি মোহন মিত্র। ব্রিটিশ আধিকারিকদের বয়ানে বলা হয়, এই ঘটনার পেছনে রয়েছেন বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী স্বয়ং।

আদালতে ব্রিটিশ আধিকারিকরা দাবি করলেন.  মুরারি মোহন মিত্রের ছেলে এই মামলার একজন অন্যতম সাক্ষী। তাদের ভয় দেখিয়ে প্রভাবিত করবার কারণেই এই হত্যাকান্ড। শুনানির পর ১৮ সেপ্টেম্বর আদালত বিপিনবিহারী গাঙ্গুলিকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। দীর্ঘদিন ধরে ব্রিটিশ সরকার যাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল, এক সময় যাকে জীবিত অবস্থায় পেলে পুরস্কার দেবে বলে ঠিক করেছিল ব্রিটিশ সরকার, শেষ পর্যন্ত সেই মানুষটি আগরপাড়া থেকে ধরা পড়লেন এবং বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ঘটে গেল তাঁর কারাবাস।

কিন্তু আগরপাড়ায় কিভাবে এলেন বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি? উত্তর চব্বিশ পরগনার গঙ্গা তীরবর্তী সমৃদ্ধ গ্রাম হালিশহর।  গাঙ্গুলী পরিবার ছিল সেই গ্রামের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরিবার।  এই পরিবারের কেদারনাথ গাঙ্গুলীর কন্যা ভুবনমোহিনী সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল হুগলী জেলা দেবানন্দপুর এর অধিবাসী মতিলাল চট্টোপাধ্যায়ের। এদেরই পুত্র কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।  কেদারনাথের ভাই অক্ষয় নাথের তিন ছেলে।  ললিতমোহন , বঙ্কিমচন্দ্র ও বিপিনবিহারী।  অক্ষয়নাথ কর্মসূত্রে মধ্য কলকাতার দুর্গা পিতুরি লেনে বসবাস করতে শুরু করেন।  সেই হিসেবে বিপিনবিহারীর শৈশব কেটেছে কলকাতায়।  বিপিনবিহারী যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন বাংলার বিপ্লবীদের আদি সংগঠন আত্মোন্নতি সমিতির সঙ্গে। কলকাতা থেকেই তাঁর বিপ্লবী কর্মকাণ্ড প্রসারিত হয়েছিল আগরপাড়ায়।

উনিশ শতকের শেষের দিকে মধ্য কলকাতায় গড়ে উঠেছিল আত্মোন্নতি সমিতি নামে একটি গোষ্ঠী। ১৩ নম্বর ওয়েলিংটন লেন  রঘুনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে গড়ে ওঠা এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ডন পত্রিকা খ্যাত সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সহ একদল বিপ্লবী । পরবর্তী সময়ে এই সংগঠনটি চলে আসে তিন নম্বর ওয়েলিংটন স্কোয়ারের খেলাৎচন্দ্র ইনস্টিটিউশনের বাড়িতে। আর সেই সময়েই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি।

বিপিন বিহারীর বিপ্লবী জীবন ছিল নাটকীয়তায় ভরপুর।

১৯০২ সালের একটি ঘটনা। ধর্মতলা চত্বরে বিশেষ কাজে গিয়েছিলেন বিপিন বিহারী।  হঠাৎ চোখে পড়ল একটি বাঙালি ছেলেকে দুই-তিন জন সাহেব রাস্তার মাঝখানে ভীষণভাবে মারধর করছে।  তৎক্ষণাৎ সেখানে ছুটে গেলেন। যোগ দিলেন ওই বাঙালি যুবকের সঙ্গে। দুজনের সঙ্গে পেরে উঠল না সাহেবরা।  আহত যুবকটিকে সরাসরি নিয়ে এলেন আত্মোন্নতি সমিতির কার্যালয়ে। এখানে উপস্থিত ছিলেন সমিতির সম্পাদক হরিশচন্দ্র শিকদার। পরবর্তী সময়ে সেই যুবকটি হয়ে উঠেছিলেন সমিতির একজন অন্যতম কর্মী, নাম ধরানাথ ভট্টাচার্য।

১৯০৩ সালে তাঁর যোগাযোগ হল বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে। অরবিন্দ ঘোষের সান্নিধ্যে তখন বাংলার বিপ্লবীরা ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করেছেন। সরাসরি মুরারি পুকুরের বাগানে বিপিন বিহারী যাতায়াত না করলেও তাদের কাজকর্মের সঙ্গে তিনি পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। যুক্ত ছিলেন ময়মনসিংহের বিপ্লবীদের সংগঠন সুহৃদ সমিতির সঙ্গেও।

আলিপুর বোমার মামলা চলাকালীন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ওরফে বাঘাযতীনের সঙ্গে বাংলার বিপ্লবীদের একত্রিত করতে শোভারাম বসাক লেনের মেসে একটি বিপ্লবীদের কেন্দ্র গড়ে ওঠে। উত্তর কলকাতার বিভিন্ন গলিতে গড়ে উঠতে থাকে বেশ কিছু মেস।  প্রধানত ছাত্র এবং কলকাতা শহরে আসা চাকুরীজীবীদের আশ্রয়স্থল হলেও এই মেসগুলোই কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিপ্লবীদের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে।  এ ধরনের মেসগুলি ছিল মেডিকেল কলেজের উল্টোদিকে আর পুলি লেন, মির্জাপুর স্ট্রিট, কর্নওয়ালিস স্ট্রিট এবংমার্কাস স্কোয়ারের পশ্চিম দিকের বসতি অঞ্চলগুলিতে, যেখানে বসবাস ছিল প্রধানত অবাঙালিদের। এই মেসেই বাস করতেন রড্ডা বন্দুক চুরির মামলার অন্যতম অভিযুক্ত বিপ্লবী প্রভুদয়াল হিম্মৎশিংকা। ১৯১০ সালে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের বিপ্লবীদের একত্রিত করবার জন্য একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন বিপ্লবী অবিনাশ চক্রবর্তী। মূলত তাঁর উদ্যোগেই বাংলার বিভিন্ন বিপ্লবী দলের নেতারা একত্রে গঙ্গাবক্ষে গোপনে একটি বৈঠকে মিলিত হন। সেই বৈঠকে বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী এবং যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বিপ্লবীদের একত্রিত করবার জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেন।  ইতিমধ্যে আত্মোন্নতি সমিতির ব্যায়ামাগার স্থানান্তরিত হয়েছে মদন বড়াল লেনের মাঠে। আর সেই ব্যায়ামাগারকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠল রড্ডা কোম্পানির অস্ত্র লুণ্ঠনের পরিকল্পনা।

১৯১৪ সালের ২৬ আগস্ট সংঘটিত হলো রড্ডা কোম্পানির অস্ত্র লুণ্ঠন।  এই কাজের পরিকল্পনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি। সেদিন তাঁর অনুগামী শ্রীশ চন্দ্র মিত্র , হরিদাস দত্ত , অতুল কৃষ্ণ ঘোষ সহ বিপ্লবীরা ৫০টি মাউজার পিস্তল এবং ৪৬,০০০ কার্তুজ তাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। সিডিসন কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছিল ১৯১৪ সালের আগস্ট মাসের লুট হওয়া ওই অস্ত্রই পরবর্তীকালে ৫৪ টি ডাকাতি এবং হত্যার কাজে ব্যবহার করা হয়। রড্ডা বন্দুক চুরির ঘটনায় মলঙ্গা লেনে অবস্থিত বিপ্লবী কর্মীদের উপরে বিশেষ চাপ সৃষ্টি করা হয়। পুলিশি তৎপরতায় বেশ কিছু অস্ত্র এবং কার্তুজ উদ্ধার হয়।  কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন অনুকুল মুখার্জি , গিরীন্দ্র ব্যানার্জি , নরেন ব্যানার্জি , কালিদাস বসু সহ কয়েকজন বিপ্লবী । বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী সেই সময়ে আত্মগোপন করেন। আগরপাড়া ছিল তার আত্মগোপনের স্থান। আগরপাড়ার নিবাসী বিশিষ্ট সাংবাদিক তথা ভারতবর্ষ পত্রিকার সম্পাদক ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এ’ প্রসঙ্গে লিখেছেন,  বিপিন বিহারী গাঙ্গুলীর বেশ কিছু অনুগামী সেই সময় দক্ষিণেশ্বর,  আড়িয়াদহ এবং বরানগরের অধিবাসী ছিলেন। সম্ভবত বিপ্লবী সুরেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের যোগাযোগের সুত্রেই বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী গঙ্গার ধারে আগরপাড়ায় একটি বাগান বাড়িতে আশ্রয় নেন। 

১৯১৫ সাল। রাসবিহারী বসুর নেতৃত্বে তখন সারা ভারত জুড়ে একটি বিপ্লবের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তার সঙ্গে নেতৃত্ব হিসেবে যুক্ত হয়ে পড়ছেন মানবেন্দ্রনাথ রায় এবং বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী। ‌ ব্রিটিশ পুলিশ আধিকারিক জে সি নিক্সন ১৯১৭ সালে এই ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে সরকারি নথিতে উল্লেখ করছেন কলকাতায় এই পরিকল্পনায় মূলত যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁরা হলেন নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ওরফে মানবেন্দ্রনাথ রায় এবং বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী। বিপিন বিহারীর অন্যতম সহযোগী বরানগর নিবাসী খগেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি তাঁর এক স্মৃতিচারণে বলেছেন, বিপিন বিহারী তখন ছদ্মবেশ ধারণ করে শিখ পাঞ্জাবীদের পোশাক পরতেন। ‌ মাথায় থাকত পাগড়ি। ‌ দাড়ি রেখেছিলেন, হাতে বালাও পরতেন। ‌ আর সেই ছদ্মবেশে অবাধে প্রবেশ করতেন ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে। ‌ কথা বলতেন দেশীয় সৈন্যদের সঙ্গে।‌

এর পরবর্তী পর্যায়ে যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের অন্যতম সহযোদ্ধা চিত্তপ্রিয়কে কলকাতার ‌গোপন আশ্রয়ে আত্মগোপন করবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন বিপিন বিহারী। সেই আস্তানা কখনো ছিল তালতলা অঞ্চলের ৩৩ নম্বর তালতলা লাইব্রেরী রো-তে। কখনো এই আস্তানা ছিল বরানগরের মেথর পাড়ায় পার্বতী চরণ মুখার্জির বাড়িতে। ‌যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় যখন সহযোগীদের নিয়ে বালেশ্বরের দিকে রওনা দিচ্ছেন, সেই সময়ে চিত্রপ্রিয়কে গোপনে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দিয়েছিলেন বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী।‌ এই সময়ই ব্রিটিশ পুলিশ তাঁর পিছু নেয়।‌ ব্রিটিশ পুলিশকে ধোঁকা দিয়ে চলন্ত গাড়ি থেকে নেমে তিনি আবার ওই গাড়িরই পিছনের একটি বগিতে চেপে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছেছিলেন।

আগরপাড়া গ্রামে ঐতিহাসিক ডাকাতি এবং মুরারি মোহন মিত্রের হত্যার ঘটনার পর কারাদণ্ডে দণ্ডিত বাংলার এই বিপ্লবীকে ব্রিটিশ সরকার কখনো নিয়ে যায় দিল্লিতে, কখনো বা দেশের অন্যান্য প্রান্তে। তাঁকে রাখা হয় কনডেম্ড সেলে বা নির্জন কক্ষে। মানুষের সঙ্গে দেখা করার কোনো সুযোগ ছিল না। ছিল না কোন বই পড়ার সুযোগ। ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, কা্রাবাস  শেষ হওয়ার পর তার যখন মুক্তি হচ্ছে সেই সময়ও তাঁর  ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখার হুকুম ছিল ব্রিটিশ পুলিশের ।

আগরপাড়া গ্রামে ঐতিহাসিক ডাকাতি এবং মুরারি মোহন মিত্রের হত্যার ঘটনার পর কারাদণ্ডে দণ্ডিত বাংলার এই বিপ্লবীকে ব্রিটিশ সরকার কখনো নিয়ে যায় দিল্লিতে, কখনো বা দেশের অন্যান্য প্রান্তে। তাঁকে রাখা হয় কনডেম্ড সেলে বা নির্জন কক্ষে। মানুষের সঙ্গে দেখা করার কোনো সুযোগ ছিল না। ছিল না কোন বই পড়ার সুযোগ। ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, কা্রাবাস  শেষ হওয়ার পর তার যখন মুক্তি হচ্ছে সেই সময়ও তাঁর  ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখার হুকুম ছিল ব্রিটিশ পুলিশের ।

বিপিনবিহারী গাঙ্গুলীর বিপ্লবী কর্মকান্ডের ধরণ ছিল সেই সময়কার অন্যান্য বিপ্লবীদের থেকে কিছুটা আলাদা। নিজের স্বভাবসুলভ কর্মময় জীবনের বিভিন্ন পর্বে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে তিনি রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করতেন যদিও  কারাবাস তাঁর বিপ্লবীস্পৃহাকে দমিয়ে রাখতে পারে নি। মুক্তি পাবার পরে বারে বারে বিপ্লবীদের আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিয়েছেন বিপিনবিহারী। ১৯২৪ সালে কুখ্যাত ব্রিটিশ পুলিশ আধিকারিক টেগার্টকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন বিপ্লবী গোপীনাথ সাহা। এই ঘটনাতে পরিকল্পনাকারী হিসেবে আবার জড়িয়ে পড়ল তার নাম। গ্রেপ্তার হলেন এবং পাঠানো হলো মান্দালয় জেলে।  ১৯২৪ থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত মান্দালয় জেলে কাটাবার পর ফিরে এলেন কলকাতায়। 

ব্রিটিশ প্রশাসন বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী সম্পর্কে কি ধারণা পোষণ করতেন তার একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় পাওয়া যায় ১৯২৯ সালে তৈরি বাংলার বিপ্লবীদের সম্পর্কে ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগের গ্রীন লিস্টে। ‌পরবর্তী সময়ে এই গ্রীন লিস্টটি পুরোটাই প্রকাশ করেছিলেন যুগান্তর বিপ্লবী সম্মেলনের বিপ্লবীরা। এই তালিকায় ৩৮৪ নম্বরে পাওয়া যায় বিপিন বিহারী গাঙ্গুলীর নাম।‌ তাঁর পৈতৃক পরিচয় ও ঠিকানার বিবরণ দেওয়ার পর তাঁর সম্পর্কে বলা হয়েছে যে তিনি যুগান্তর বিপ্লবী দলের নেতা, ‌বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক হত্যা এবং ১৯১৪ সালের আগস্ট মাসে ‌অস্ত্র চুরির ঘটনায় তিনি অভিযুক্ত। ‌ আগরপাড়া থেকে বন্দুক কেনার মামলায় ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯১৫ থেকে পাঁচ বছরের কারাবাসের পর ‌২৭ সেপ্টেম্বর ১৯১৯ সালে বিপিন বিহারী মুক্তি পান এবং এর পর তিনি প্রকাশ্যে কংগ্রেস ও খিলাফত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন।‌ প্রকাশ্যে শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও ১৯২৩ সালে বেশ কিছু স্বদেশী ডাকাতি ও প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ পুলিশ অফিসারদের হত্যার পরিকল্পনা ব্যাপারেও যুক্ত ছিলেন তিনি। ‌ সরকারি প্রতিবেদনে এও বলা হয়েছিল যে তিনি জাল নোট তৈরি করতেন। ‌ভারতের বিভিন্ন রাজ্য এবং বিদেশের বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। ‌ ১৯২৩ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ব্রিটিশ পুলিশ তাঁর গতিবিধি বুঝতে পারায় তিনি আত্মগোপন করেন। ‌ ১৯২৪ সালের ৯ মার্চ তিনি আবার গ্রেফতার হন এবং মুক্তি পান ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২৮-এ।

এর পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে বাঁকুড়াতে গৃহবন্দী করে রেখে দিল। 
১৯৩১ সালে ডিসেম্বর মাসে কলকাতার ১৬ নম্বর শাখারীতলা লেনের বাড়িতে ব্রিটিশ পুলিশ যখন তাঁকে গ্রেপ্তার করতে উপস্থিত হয়, সেখান থেকে কৌশলে পলায়ন করে তিনি বাংলা এবং উড়িষ্যার বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপন করে রইলেন। 
আত্মগোপন স্তরে তিনি বিভিন্ন জায়গার বিপ্লবীদের সংগঠিত করেছেন এবং সেই সমস্ত এলাকায় বিপ্লবী আন্দোলন শক্তিশালী হয়েছে। ব্রিটিশ প্রশাসন তাঁর পিছু ছাড়েনি এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৩৪ সালে তিনি আবার গ্রেপ্তার হন। 
এবার প্রেসিডেন্সি জেল থেকে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল দেউলীর বন্দী শিবিরে। দেউলী থেকে স্থানান্তরিত হন বহরমপুরে।

১৯৩৮ সালে মুক্তি পেলেন বিপিন বিহারী। সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে যখন আজাদ হিন্দ বাহিনী সক্রিয় হয়ে উঠছে,  বিপিনবিহারী তার অনুগামীদের নিয়ে সেই আন্দোলনের সমর্থনে সংগঠিত করছেন বিপ্লবীদের।  আগড়পাড়া গ্রাম থেকেই সেই সময়ে আজাদ হিন্দ  বাহিনীতে যোগ দেবার জন্য গিয়েছিলেন ধীরেন পাল।  এই ধীরেন পাল, রামকুমার রাই ছদ্মনামে মনিপুর ফনট্রিয়ার রাইফেলস বাহিনীতে যোগদান করেন।  পরে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করবার সময় উত্তরপূর্ব ভারতের কোন এক চেকপোস্টে তার মৃত্যু হয়।  রামকুমার রাই-এর কর্মকাণ্ডের বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়ে ব্রিটিশ সরকার আগরপাড়া গ্রাম থেকে গ্রেফতার করলেন বিপ্লবী সুরেশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিপ্লবী নির্মল চট্টোপাধ্যায়, অধ্যাপক সাতকড়ি মিত্রসহ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের, যাঁদের অনেকের সঙ্গেই বিপিনবিহারী গাঙ্গুলীর ছিল নিবিড় যোগাযোগ।

১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় আইন সভায় সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন বিপিন বিহারী। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৫২ সালের সাধারণ নির্বাচনে চব্বিশ পরগনার বীজপুর বিধানসভা থেকে তিনি বিধায়ক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। স্বাধীন ভারতবর্ষে কৃষক এবং শ্রমিক আন্দোলনে সে সময় তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। 


শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নিষিদ্ধ উপন্যাস পথের দাবির সব্যসাচী চরিত্রের বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে বিপিনবিহারী গাঙ্গুলীর জীবনের বহু সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।  সম্পর্কে শরৎচন্দ্র ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়।  তাঁর সাহসিকতা মুগ্ধ করেছিল বাংলার বরেণ্য কথাসাহিত্যিককে। ব্রিটিশ প্রশাসনের চোখে তিনি ছিলেন এক আতঙ্ক।  ১৯১৮ সালে রাওলাট সাহেবের নেতৃত্বে গঠিত সিডিশন কমিটি তার প্রতিবেদনে বাংলার যে দুই বিপ্লবীর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (বাঘাযতীন) এবং বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী।  জীবনের একটা বড় সময় তিনি কাটিয়েছেন কারাগারের অন্তরালে কিংবা গৃহবন্দী হয়ে।  দিন কেটেছে বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়ে।  কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য দেশমাতৃকার পরাধীনতার বন্ধন মোচন করার সংগ্রামের লক্ষ্য থেকে সরে আসেননি বিপিনবিহারী। তাঁর মতো বিপ্লবীদের আত্মত্যাগকে লক্ষ্য করেই ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড মাইকেল ‘দা লাস্ট ইয়ার্স অফ ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছিলেন , ভারতের রাজনীতিতে গান্ধীজীর উপস্থিতি অট্টালিকার মত। কিন্তু সেই অট্টালিকার অন্তরালে যে বৈপ্লবিক উগ্রতা এবং নেতৃত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাদের মধ্যে ছিলেন বাংলার বিপ্লবীরা।  যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী, সূর্য সেন বাংলার বিপ্লবীরা ছিলেন এই ধারারই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব। ইতিহাস এঁদের সঠিক মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে।  কিন্তু জাতীয় আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাস লিখতে গেলে এঁদের কথা কখনোই অস্বীকার করা যাবে না।

১৯৩৮ সালে মুক্তি পেলেন। সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে যখন আজাদ হিন্দ বাহিনী সক্রিয় হয়ে উঠছে, বিপিনবিহারী তার অনুগামীদের নিয়ে সেই আন্দোলনের সমর্থনে সংগঠিত করছেন বিপ্লবীদের। আগড়পাড়া গ্রাম থেকেই সেই সময়ে আজাদ হিন্দ বাহিনীতে যোগ দেবার জন্য গিয়েছিলেন ধীরেন পাল। এই ধীরেন পাল রামকুমার রাই ছদ্মনামে মনিপুর ফনট্রিয়ার রাইফেলস বাহিনীতে যোগদান করেন। পরে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করবার সময় উত্তরপূর্ব ভারতের কোন এক চেকপোস্ট এ তার মৃত্যু হয়। রামকুমার রাই-এর কর্মকাণ্ডের বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়ে ব্রিটিশ সরকার আগরপাড়া গ্রাম থেকে গ্রেফতার করলেন বিপ্লবী সুরেশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিপ্লবী নির্মল চট্টোপাধ্যায়, অধ্যাপক সাতকড়ি মিত্র সহ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের, যাদের অনেকের সঙ্গেই বিপিনবিহারী গাঙ্গুলীর ছিল নিবিড় যোগাযোগ।


পরিশেষে উল্লেখ্য, ১৯০২ সালে চৌঠা জুলাই স্বামী বিবেকানন্দের প্রয়াণের পর বিপিন বিহারীর যোগাযোগ হয় স্বামীজির ছোট ভাই বিপ্লবী ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে। সেই যোগাযোগ অবিচ্ছিন্ন ছিল বিপিন বিহারীর মৃত্যু পর্যন্ত। ১৯৫৪ সালের ১৪ই জানুয়ারি ৬৭ বছর বয়সে প্রয়াত হন বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী। বহু প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় আমরা পাই, পরলোক-গমণের পর বিপিন বিহারীর অন্তেষ্টির সময় নিমতলা শ্মশান ঘাটে ক্রন্দনরত আবেগ বিহ্বল ভূপেন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণের কথা।


তথ্যসূত্রঃ
১। আই বি, সি আই ডি বেঙ্গল রিপোর্ট ফর দ্যা উইক এন্ডিং ৪ আগস্ট, ১৯১৫, ১৮ আগস্ট, ২৫ আগস্ট, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২২ সেপ্টেম্বর, ১৯১৫.
২। বিপ্লবী মহানায়ক বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী – সত্যেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়
৩। অগ্নিযুগের অগ্নিহোত্রী- গৌরীপদ গঙ্গোপাধ্যায়

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.