শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

ভাগ্যতাড়িত এক কবি ও সমকালীন বিদ্বৎসমাজ

বাংলা সাহিত্যের হাজারো বিষয় নিয়ে মতদ্বৈততা থাকলেও একটা বিষয় বোধহয় সংশয়াতীত ভাবে প্রতিষ্ঠিত সত্য –রবীন্দ্রবলয় উত্তীর্ণ কবিদের ভিড়ে সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং স্বতন্ত্র স্বর কবি জীবনানন্দ দাশ এর।সমকালে নিন্দিত, বৃহত্তর পাঠক সমাজের কাছে অচ্ছ্যুৎ এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রত্যাখ্যাত জীবনানন্দ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনিবার্য করেছেন নিজের উপস্থিতি।তাঁর কাব্যভুবনের রহস্যময় অলিগলির ধূসর নির্জন বাঁকে বাঁকে সঞ্চিত যে অপার বিস্ময়,অমিত ঐশ্বর্য,তাঁর মৃত্যুর পর দশকের পর দশক ধরে রসিক পাঠক তাকে মুগ্ধ বিস্ময়ে ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করতে গিয়ে সে নিজেকেই আবিষ্কার করেছে এই চেনা পৃথিবীর মধ্যেও এক অন্য পৃথিবীর মানুষ হিসেবে। জীবনানন্দের এই মনন-ঋদ্ধ নির্মিতি একদিনে হয়নি।এর পিছনে ছিল তাঁর দীর্ঘ,অনলস,নিভৃত,একক প্রস্তুতি।

জীবনানন্দের কবিতায় হাতেখড়ি তাঁর মা কবি কুসুমকুমারী দাশের হাত ধরে।মায়ের উৎসাহেই ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকার নববর্ষ সংখ্যায় ‘বর্ষ আবাহন’ নামে যখন প্রথম ছাপা অক্ষরে কবিতা প্রকাশিত হয় তখন জীবনানন্দের বয়স কুড়ি বছর।কেমন ছিল সে কবিতার ভাষা?
ওই যে পূর্ব তোরণ আগে
দীপ্ত নীলে, শুভ্র রাগে
প্রভাত রবি উঠল জেগে
দিব্য পরশ পেয়ে ।

নাই গগনে মেঘের মায়া
যেন স্বচ্ছ স্বর্ণ কায়া !
ভূবণ ভরা মুক্ত মায়া
মুগ্ধ হৃদয় চেয়ে।

অতীত নিশি গেছে চলে
চির বিদায় বার্তা বলে,
কোন আঁধারের গভীর তলে
রেখে স্মৃতি লেখা।

এসো এসো ওগো নবীন,
চলে গেছে জীর্ণ মলিন
আজকে তুমি মৃত্যু-বিহীন
মুক্ত সীমা রেখা।

কবিতার শরীর জুড়ে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব স্পষ্ট।এরপর দীর্ঘ বিরতি। পরবর্তী পাঁচ ছয় বছরের মধ্যে জীবনানন্দ একটি কবিতাও লিখলেন না। দ্বিতীয় কবিতা লিখলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর (১৯২৫) পর ‘দেশবন্ধু প্রয়াণে’।ছাপা হল বঙ্গবাণী পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় (শ্রাবণ,১৩৩২ বঙ্গাব্দ)।সে কবিতাও গতানুগতিক।এই কবিতাটি লিখে যদিও তিনি কিছু প্রশংসা পেয়েছিলেন,যেমন কবি কালিদাস রায় বলেছিলেন,” কবিতাটি পড়ে মনে হয়েছে প্রতিষ্ঠিত কোনো প্রবীণ কবি ছদ্মনামে কবিতাটি লিখেছেন।” কিন্তু জীবনানন্দের ভিতরে তখনও প্রকৃত জীবনানন্দের জন্ম হয়নি, খুঁজে পাননি তাঁর নিজস্ব কাব্যভাষা।

১৯১৯ খ্রীঃ’র পর পরবর্তী পাঁচ বছরে জীবনানন্দ একটি কবিতাও না লিখলেও তাঁর ডায়েরি থেকে জানা যায়,সে সময়ে তোলপাড় করে পড়ছেন বিশ্বসাহিত্য,চোখ রাখছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল অন্ধিসন্ধির দিকে। কবিতা না লিখলেও কবিতা লেখার মনোভূমি প্রস্তুত হচ্ছে একটু একটু করে। পারিপার্শ্বিক স্থূলতার প্রতি মানুষের আগ্রহ, মোহগ্রস্থতা ব্যথিত করছে তাঁকে। পছন্দের একটা class তৈরি হচ্ছে তাঁর ভেতর।ডায়েরিতে তিনি লিখছেন, “we have no test for enjoyment…not have we any instinct for aesthetics…We are content with forth hand men and materials…We gained our daily rounds of topics on nothing but matter, material, prosperity is the vision of our brains, matter and materialism.” আমরা দেখব স্থূল বৈষয়িক বিষয়ের প্রতি এই অনাগ্রহ তাঁকে পরবর্তী জীবনে করে তুলবে সংসারে একা সন্ন্যাসী। তন্নিষ্ঠ কবিতার চর্চা করতে গিয়ে জীবনানন্দ তার পারিবারিক এবং একান্ত দাম্পত্য জীবনকে করে তুলবেন তিক্ত এবং চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ।

এই ১৯২৫এই জীবনানন্দ লিখলেন তাঁর তৃতীয় কবিতা ‘নীলিমা’, যা প্রকাশিত হলো ‘কল্লোল’ এর তৃতীয় বর্ষ একাদশ সংখ্যায় (ফাল্গুন ১৩৩২ বঙ্গাব্দ)। এই কবিতাটি ছিল তাঁর আগের দুটি কবিতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের ।এই কবিতার মধ্যে দিয়েই তিনি প্রথম চোখে পড়লেন সেই সমস্ত কবিদের যাঁরা রবীন্দ্র প্রভাবিত ভূখণ্ডের বাইরে গিয়ে তৈরি করার চেষ্টা করছেন এক নতুন দ্বীপ ভূমি ।ততদিনে জীবনানন্দ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি ভাষা সাহিত্যে এম.এ পাস করে(১৯২১) কলকাতার সিটি কলেজের ইংরেজি বিভাগের ‘টিউটর’ পদে চাকরি শুরু করেছেন (১৯২২)।থাকছেন হ্যারিসন রোড এর প্রেসিডেন্সি বোর্ডিংএ।নিঃসঙ্গ এক জীবন তখন জীবনানন্দের। কলেজে পড়ান, কলকাতার রাস্তায় একা একা ঘুরে বেড়ান, ধোঁয়া ধুলো ধূসরিত এ ব্যস্ত নগরী তাঁর কাছে এক কারাগারের মতো ।মানুষ ছুটছে, কোথায়? কেন? কোন লক্ষ্যে? এই অন্তহীন ছুটে চলা তাঁকে ক্লান্ত করে । তাঁর মন আশ্রয় খুঁজে বেড়ায় আকাশের সুদীর্ঘ সুনীলে। ‘নীলিমা’ কবিতায় তিনি লিখলেনঃ

রৌদ্র ঝিলমিল;
উষার আকাশ,মধ্য নিশীথের নীল,
অপার ঐশ্বর্যবেশে দেখা তুমি দাও বারে-বারে
নিঃসহায় নগরীর কারাগার-প্রাচীরের পারে !
— উদ্বেলিছে হেথা গাঢ় ধূম্রের কুন্ডলী,
উগ্র চুল্লিবহ্নি হেথা অনিবার উঠিতেছে জ্বলি,
মরিচীকা ঢাকা!
অগণন যাত্রিকের প্রাণ
খুঁজে মরে অনিবার, পায় নাকো পথের সন্ধান:
চরণে জড়ায়ে গেছে শাসনের কঠিন শৃঙ্খল,–
হে নীলিমা নিষ্পলক,লক্ষ বিধি-বিধানের এই কারাতল
তোমার ও মায়া দন্ডে ভেঙ্গেছে মায়াবী ।
জনতার কোলাহলে একা ব’সে ভাবি।

কোন দূর যাদুপুর রহস্যের ইন্দ্রজাল মাখি
বাস্তবের রক্ত তটে আসিলে একাকী!
স্ফটিক আলোকে তব বিথারিয়া নীলাম্বরখানা
মৌন স্বপ্ন-ময়ূরের ডানা!
চোখে মোর মুছে যায় ব্যাধবিদ্ধ ধরণীর রুধির-
লিপিকা
জ্বলে ওঠে আকাশে গৌরী দীপশিখা!
ঊসুধার অশ্রু-পাংশু আতপ্ত সৈকত,
ছিন্নবাস নগ্ন শির ভিক্ষুদল, নিষ্করুণ এই রাজপথ,
লক্ষ কোটি মুমূর্ষের এই কারাগার,
এই ধূলি-ধূম্রগর্ভ বিস্তৃত আঁধার
ডুবে যায় নীলিমায়–স্বপ্নায়ত মুগ্ধ আঁখিপাতে,
শঙ্খ শুভ্র মেঘপুঞ্জ ,শুক্লাকাশে , নক্ষত্রের রাতে;
ভেঙে যায় কীটপ্রায় ধরণীর বিশীর্ণ নির্মোক,
তোমার চকিত স্পর্শে ,হে অতন্দ্র দূর কল্পলোক!

এই কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পর অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত থেকে বুদ্ধদেব বসু বয়সে নবীন কিন্তু জীবনানন্দের থেকে সুপরিচিত কবিদের প্রশংসা পাওয়ায় জীবনানন্দের কাব্যচর্চায় যেন এক নতুন জোয়ার আসে ।১৯২৫ থেকে ১৯২৭ এ ক’বছর তিনি প্রবাসী ,বঙ্গবাণী ,কালি কলম এবং প্রগতি ও কল্লোলে কবিতা লিখে গেছেন ।সামান্য প্রশংসা আর বৌদ্ধিক সমাজের একটু স্বীকৃতি জীবনানন্দের মননের বীজতলায় কার্যকরী জল সিঞ্চনের কাজ করলো ।জীবনানন্দ স্থির করলেন, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত লেখা গুলোকে একত্র করে একটি বই প্রকাশ করবেন। তাঁর মত অখ্যাত কবির জন্য কোন প্রকাশক খরচ করবেন? তাই নিজের খরচেই ১৯২৭ সালে জীবনানন্দ প্রকাশ করলেন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’।
কাব্যগ্রন্থে কবিতার সংখ্যা ৩৫ ,দাম এক টাকা। এভাবেই বাংলা কাব্য ইতিহাসের প্রবাহমানতায় প্রথম পা রাখলেন জীবনানন্দ। যদিও সে পা কে রক্তাক্ত করতে একাধিক কুঠার নেমে আসবে অচিরেই কিন্তু বাংলা কবিতা পেতে শুরু করবে তার আগামীর নতুন দিকচিহ্ন।

১৯২৭ এ ঝরাপালক যখন প্রকাশিত হলো সে সময়টা বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে কেমন ছিল যদি আমরা একটু দেখি তাহলে দেখব ,এই বছর রবীন্দ্রনাথের ‘লেখন’ ও ‘ঋতুরঙ্গ’ প্রকাশ পায়। বিচিত্রায় ধারাবাহিকভাবে বেরোতে থাকে ‘যোগাযোগ’ ।জসীমউদ্দীনের প্রথম কাব্য ‘রাখালী’ প্রকাশিত হয়‌ ,প্রকাশিত হয় কাজী নজরুলের ‘ফনিমনসা’ ‘ সিন্ধু-হিন্দোল’, ‘বাঁধনহারা’। শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ কে ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন ।বাংলা পত্রপত্রিকার জগতে সচিত্র মাসিক পত্রিকা হিসাবে ঢাকা পুরানা পল্টন থেকে প্রকাশিত হল ‘প্রগতি’ (আগে এটি হাতে লেখা পত্রিকা ছিল )। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ‘শনিবারের চিঠি’র নবপর্যায়ে পুনঃ প্রকাশ( ১৩৩৪বঙ্গাব্দের ৯ই ভাদ্র থেকে )। যোগানন্দ দাস সম্পাদক হলেও এর প্রকৃত পরিচালক ছিলেন সহ-সম্পাদক সজনীকান্ত দাস। যে সজনীকান্ত পরবর্তীকালে কবি জীবনানন্দের কাছে হয়ে দাঁড়াবেন এক মূর্তিমান বিভীষিকা।

‘ঝরা পালক’ জীবনানন্দকে কাঙ্খিত কবিখ্যাতি এনে দিতে পারল না। কিছুটা প্রশংসা মিশ্রিত সমালোচনা বের হল ‘কল্লোল’ পত্রিকায়। লেখা হল “… তরুণ কবির সমস্ত কবিতাতেই তারুণ্যের উল্লাস ধ্বনিত। তাঁর ছন্দ ,ভাষা, ভাব সবেতেই বেশ বেগ আছে। ত্রুটি যা কিছু আছে তা কখনও কখনও সেই বেগের অযথা আতিশয্য। নজরুল, মোহিতলালের প্রভাব তিনি এড়াতে পারেননি বটে কিন্তু সেই প্রভাবকে নিজের বৈশিষ্ট্যের পথে ফেরাতে পেরেছেন বলে মনে হয় ।” কিন্তু এছাড়া কিছু উপেক্ষা আর তিরস্কারই জুটলো তাঁর কপালে। সেই সময়ে সাহিত্য সমালোচক হিসেবে বেশ নামী ছিলেন ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। জীবনানন্দ এক কপি ‘ঝরাপালক’ পাঠালেন তাঁর কাছে সঙ্গে একটি অনুরোধ পত্র, ধূর্জটি বাবু যদি বইটি পড়ে কিছু মন্তব্য লিখেন।ধূর্জটিপ্রসাদ বইটির প্রাপ্তি স্বীকার করে চিঠি লিখলেন “… ঝরা পালক উড়তে উড়তে আমার গায়ে কি করে এলো ভেবে পাই না।… যাইহোক সময় পেলেই আপনার পুস্তিকা সম্বন্ধে কিছু মতামত জানাব…” যদিও সেই ‘সময়’ ধূর্জটিপ্রসাদ আর পাননি। জীবনানন্দ বেশ বুঝতে পারলেন ধূর্জটিপ্রসাদ বইটিকে কোন গুরুত্বই দেন নি । ইতিমধ্যে জীবনানন্দের জীবনে নেমে এলো নতুন সংকট। সিটি কলেজের চাকরিটাও হারালেন । নিশ্চিত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা সঙ্গে কাব্যচর্চা– এভাবেই যখন জীবনটাকে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন জীবনানন্দ তখনই এই আচমকা বেকারত্ব তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিল। কবিতার কক্ষপথ থেকে খসে পড়ার এই যন্ত্রণার আভাস পাওয়া যায় এই সময়ে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত কে লেখা জীবনানন্দের চিঠিতেঃ
‘প্রিয়বরেষু,
…. স্পষ্ট হাদিস পাচ্ছি আমার এই টিমটিমে কবি জীবনটি দপ্ করেই নিবে যাবে,যাক গে — আফসোস কিসের? চারিদিকে বেদরদির ভীড়।’ এসব কিছু সত্বেও কবি আকাঙ্ক্ষা করছেন যেন অচিন্ত্যর মতো বন্ধুর সঙ্গ সুখ থেকে বঞ্চিত না হন। লিখছেন, ‘আমাদের তেমন পয়সাকড়ি নেই বলে জীবনে creature comforts জিনিসটি হয়তো চিরদিনই আমাদের এড়িয়ে যাবে। কিন্তু একসঙ্গে চলার আনন্দ থেকে আমরা যেন বঞ্চিত না হই– সে পথ যতই পর্ণমলিন, আতপক্লিষ্ট বাত্যাহত হোক না কেন…’। কিন্তু ইতিহাস বলছে কবির সবিশ্বাস আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়নি। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের যখন অনেক নামডাক, তখন সমালোচনায় দীর্ণ জীবনানন্দকে তিনিও চিনতে চাননি।


চাকরি হারিয়ে জীবনানন্দ ফিরে এলেন বরিশালে তাঁর পৈত্রিক ভিটেয়। ভেবেছিলেন যেভাবেই হোক একটা চাকরি ঠিক জুটিয়ে নেবেন কিন্তু কাজটা সহজ হলো না। প্রথম কাব্যগ্রন্থের ব্যর্থতা, কলকাতার সাহিত্য সমাজে নিজেকে মেলে ধরার ইচ্ছের অপমৃত্যু তার সঙ্গে আচমকা দীর্ঘ বেকারত্ব– সব মিলিয়ে জীবনানন্দ বেসামাল হয়ে পড়ছিলেন। তাঁর তো অনেক কথা বলার আছে, কবিতার মধ্যে দিয়ে পৌঁছনোর আছে অন্য জগতে। কিন্তু এ ব্যর্থ, অসফল জীবনে তাঁর বেঁচে থাকার সত্যিই কি কোন প্রয়োজন আছে? নির্জন, একান্তচারি মানুষটার মধ্যে উঁকি দিচ্ছে মৃত্যুচিন্তা। ১৯২৯ এ ডায়েরির পাতায় তিনি লিখছেন,’A man, all things considered should not be in this scheme. But why does he not die? A man like me thinks he may be misunderstood and leave his message real unsaid by an early death…’মানসিক ভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত জীবনানন্দ আশ্রয় খুঁজতে চাইছিলেন কবিতার মধ্যেই। ধ্বস্ত এ সময়ে লিখলেন অসামান্য এক কবিতা ‘বোধ’। কবিতার ভাষা উপস্থাপনা সবটাই তার আগের কবিতাগুলোর থেকে আলাদা। শুধু তাঁর আগের লেখার থেকেই নয় পূর্বসূরী, সমসাময়িক সমস্ত কবিদের কবিতা থেকেই এ লেখা ভিন্নস্বাদের ,ভিন্নমাত্রার। ‘প্রগতি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হলো এ কবিতা
‘ আলো অন্ধকারে যাই–মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়,–কোন এক বোধ কাজ করে!
স্বপ্ন নয়–শান্তি নয়–ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!
আমি তারে পারিনা এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে ;
সব কাজ তুচ্ছ হয়,– পন্ড মনে হয়;
সব চিন্তা —প্রার্থনার সকল সময়
শূণ্য মনে হয়,
শূণ্য মনে হয় ! …’

অদ্ভুত এক বোধের কথা শোনালেন এ লেখায়। নিজেকে খুঁড়ে খুঁড়ে কোন অতলস্পর্শী রহস্যময়তার জগতে বিচরণ করলেন জীবনানন্দ– তা অবশ্য সাধারণ পাঠক তো দূর, নামজাদা কবিদেরও অনেকের বোধগম্য হলো না। এর আগে কবিতা লিখে জীবনানন্দ পেয়েছিলেন উপেক্ষা, এবার জুটল বিদ্রুপ। যা আমার বোধগম্যতার বাইরে তা নেহাতই ফালতু — এই অহং থেকে কবি এবং সাহিত্য সমালোচকরা সমালোচনা করলেন এই কবিতার। কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত সেই সময়ে নামজাদা কবি। তিনি লিখলেন ,’…বহুবার একা একা পড়ে… কবির এই ‘বোধ’ আমার বোধগম্য হলো না– ইহা লজ্জার কথা হলেও সত্য কথা। সুতরাং আমাদের নিকট এ কবিতা সমগ্র ভাবে অর্থহীন বলে নিরর্থক।’ এরকম ধোঁয়াশাময় কবিতা কবি কখন লেখেন? তার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে যতীন্দ্রনাথ সিদ্ধান্তে এলেন, ‘এরকম হবার তিনটি কারণ হতে পারে ঃ
১. কবি কি বলছেন তা নিজেই সম্যক জানেন না। অর্থাৎ তিনি sincere নন।
২. কবি যা বলতে চান তা প্রকাশ করার ক্ষমতা তার মোটেই নেই অর্থাৎ তিনি কবি নন।
৩. পাঠকের বোঝবার মতো শক্তি নেই।

জীবনানন্দের এই নতুন কাব্যভাষা কে ‘প্রলাপ’ বলে দেগে দিতেও হাত কাঁপলো না তাঁর ।কোমর বেঁধে আসরে নেমে পড়লেন সজনীকান্ত দাসও। শনিবারের চিঠিতে ব্যাঙ্গে-বিদ্রূপে ক্ষত-বিক্ষত করে দিলেন কবিকে। কবিতার বিভিন্ন স্তবকের উল্লেখ করে করে তাঁর সজনীকান্তীয় ব্যাখ্যায় পাঠকের কাছে হাস্যস্পদ করে তোলার চেষ্টা করলেন জীবনানন্দকে। যেমন, “জীবনানন্দ দাশের কিছু বাণী আমাদের মর্ম স্পর্শ করিয়াছে। এই সকল বাণী প্রচার আবশ্যকঃ
‘…. চোখে কালশিরার অসুখ,
কানে যেই বধিরতা আছে,
যেই কুঁজ — গলগন্ড মাংসে ফলিয়াছে
নষ্ট শশা — পচা চালকুমড়ার ছাঁচে
যে সব হৃদয় ফলিয়াছে
— সেই সব।
কবির হৃদয়ে মাংসে যে গলগন্ড ফলিয়াছে তাহা স্বীকার করা বাণী বৈকি। কবিতাটির নামকরণে বোধহয় কিছুটা ভুল আছে — ‘বোধ’ না হইয়া কবিতাটির নাম ‘গোদ’ হইবে।” ইত্যাদি।

জীবনানন্দ এই সময় পাশে পেয়েছিলেন একমাত্র বুদ্ধদেব বসুকে এবং পরবর্তী কালে ‘পূর্বাশার’ সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্য কে। বুদ্ধদেব ‘প্রগতি’র সম্পাদকীয়তে (২য় বর্ষ,আশ্বিন ১৩৩৫) লিখলেন,”জীবনানন্দ বাবু বাঙলা কাব্য সাহিত্যে একটি অজ্ঞাতপূর্ব ধারা আবিষ্কার করেছেন বলে আমার মনে হয়। তিনি এ পর্যন্ত মোটেই পপুলারিটি অর্জন করতে পারেননি বরঞ্চ তাঁর রচনার প্রতি অনেকেই বোধহয় বিমুখ ;… তার কারণ বোধহয় এই যে, জীবনানন্দ বাবুর কাব্যরসের যথার্থ উপলব্ধি একটু সময় সাপেক্ষ ; তাঁর কবিতা একটু ধীরে সুস্থে পড়তে হয় ,আস্তে আস্তে বুঝতে হয়।” জীবনানন্দের কাব্যরসের রসাস্বাদন কেন সবার কাছে সম্ভব হচ্ছে না তার যথার্থ কারণ বিশ্লেষণ করলেন বুদ্ধদেব। চারিদিকের বিদ্রুপ আর অবহেলার মাঝখানে কিছুটা হলেও মানসিক আশ্রয় এই পর্বে জীবনানন্দ পেয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসুর কাছে।

এই সময় একের পর এক বাংলা কাব্য সাহিত্যে মোড় ঘোরানোর সব কবিতা সৃষ্টি হতে লাগল জীবনানন্দের কলম থেকে।কবিতা লেখার সময় একটা ঘোরের মধ্যে থাকেন জীবনানন্দ কিন্তু তারপরেই রক্তক্ষরণ শুরু হয় তার চেতনায়। একটা সুস্থির উপার্জনের সুব্যবস্থা কিছুতেই করে উঠতে পারছিলেন না। বরিশালে থাকাকালীন কিছুদিন বাগেরহাটের পি.সি কলেজে চাকরি করলেন। কাকা অতুলানন্দের ডাকে আসামে গেলেন বনবিভাগে কাঠের ব্যবসার মাধ্যমে কিছু উপার্জনের আশায় কিন্তু সেখানেও বিশেষ সুবিধা করতে পারলেন না। ব্যবসা করার থেকে তাঁর ঘরে বসে বই পড়তে কবিতা লিখতেই ভালো লাগে বেশি। তিনি কী করবেন ?বাবা সত্যানন্দ এক সূত্র মারফত দিল্লির রামযশ কলেজে তার জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করলেন। বাংলার মাঠ ঘাট নদী ছেড়ে দিল্লির কলেজে বেশিদিন মন বসাতে পারলেন না তদুপরি সেখানকার শিক্ষকদের সঙ্গেও তিনি সহজভাবে মেলামেশা করতে পারলেন না। ছাত্র মহলেও জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারলেন না তিনি। সবাই প্যান্ট, শার্ট, টাই পরলেও জীবনানন্দ ধুতি পাঞ্জাবি পরেই কলেজে আসতেন। তিনি যথেষ্ট স্মার্ট নন বলে ছাত্রমহলে তাঁর একটা নেগেটিভ ইমেজ তৈরী হয়ে গিয়েছিল। ইতিমধ্যে জীবনানন্দের বিবাহ হয়(৯ ই মে,১৯৩০) কিন্তু বিবাহের পরপরই এই রামযশ কলেজের চাকরিটি তিনি হারালেন সঠিক সময়ে কলেজে জয়েন করতে না পারার জন্য। বিবাহিত জীবনের শুরুতেই আবার এই দ্বিতীয় বেকারত্বের আঘাত জীবনানন্দের দাম্পত্য জীবনকে ক্রমশঃ বিষময় করে তুলেছিল। ১৯৩২ এ ডায়েরিতে তিনি লিখছেন,” Our marriage is scram… সারাদিন কাঁদে …আমায় ধুলোয় মিশিয়ে দেয়…মুক্তি চায়…কী করব? আত্মহত্যা? শীতের রাতে অন্ধকার পুকুরে ডুবে মরব?”

কিছু একটা করে উপার্জনের জন্য জীবনানন্দ এইসময় কলকাতার মেসে চলে এলেন ।শুরু করলেন টিউশনি আর কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে বিভিন্ন জায়গায় চাকরির দরখাস্ত করা। বরিশালের সংসার চলতে লাগল আবহাওয়া দপ্তরের নতুন কাজ পাওয়া ভাই অশোকানন্দের পাঠানো টাকায়। তাঁর দিন লিপি থেকে পাওয়া যাচ্ছে, একটা কাজের আশায় পায়ে হেঁটে হেঁটে কলকাতা চষে ফেলছেন তিনি। প্রত্যাখ্যাত হচ্ছেন। ছাতার বাঁট তৈরীর জন্য যে মোটা বেত লাগে সেই বেতের ব্যবসা করা যায় কিনা ভাবছেন। ভাবছেন বাড়ি মর্টগেজের দালালি করা যায় কিনা। কাগজের ফেরির কথাও ভাবছেন কখনো। তিনটে পয়সা হাতে আছে, কি করে নিজের খাওয়া-দাওয়া চলবে ? চা খাওয়াও বন্ধ করেছেন। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, স্ত্রীর কাছে অপদার্থ স্বামীর তকমা,অসংখ্য মানুষের প্রত্যাখ্যানের হতাশা ফাঁস হয়ে গলায় আঁট হয়ে চেপে বসছে। কবিতা লেখার প্রেরণাও হারিয়ে ফেলছেন যেন। সব পত্রিকা তো তাঁর লেখা ছাপবে না। যে দুটো পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন তার একটি, ‘কালিকলম’ ,আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ‌এই সময় বন্ধ হয়ে যায় বুদ্ধদেব বসুর ‘প্রগতি’ও ।জীবনের এই জটিলতম আবর্তের দিনগুলোতে জীবনানন্দ শুরু করলেন গদ্য রচনা। গল্প উপন্যাসের চরিত্রদের মধ্যে ধরা থাকলো তাঁর এই সময়ের ধ্বস্ত জীবন আর জীবনবোধের চালচিত্র।

ভাবতে অবাক লাগে, লজ্জাও, সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে থাকা এক বিশুদ্ধ কবি, যিনি জীবনের সমস্ত উত্থান-পতনের মধ্যেও শুধু কবিতা লেখা কে আঁকড়েই বাঁচতে চেয়ে ছিলেন, তাঁকে আমরা সেটুকু মানসিক সাহচর্যও দিয়ে উঠতে পারি নি। বরং ভাগ্য তাড়িত এই কবির অকারণ ভাগ্য বিড়ম্বনার কারণ হয়েছিলেন আমাদের তৎকালীন বিদগ্ধ বিদ্বৎসমাজ । কতটুকু চেয়েছিলেন’ জীবনানন্দ? একটু স্বীকৃতি। প্রশংসা যদি নাও পেতেন অযথা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ আর কখনো উদাসীন উপেক্ষাও কি তাঁর প্রাপ্য ছিল? যে মানুষটা নিজের বিয়েতে পাওয়া আংটির জন্যও কুণ্ঠিত থাকতেন সেই নির্জন, প্রচারবিমুখ, আত্মমগ্ন সাহিত্য সাধক কতটুকুই বা চাইতে পারতেন?

জীবনানন্দ ও তাঁর সমকাল নিয়ে যাঁদের কথা বলেছি তাঁদের মধ্যে এতক্ষণ সযত্নে একজনের কথা এড়িয়ে গিয়েছি। তিনি সেই সময়ের (চিরকালীন সময়ের) বাঙালীর সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জীবনানন্দের প্রতি কেমন ছিল রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি ? রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ক্রান্তদর্শী পুরুষ। সমস্ত স্থুল সমালোচনার ঊর্ধ্বে। যেমন শান্তিনিকেতনে একটা সময় রামকিঙ্কর বেইজকে তাঁর জীবনযাপন ,শিল্পসৃষ্টি সবকিছু নিয়েই ভয়ঙ্কর বিরূপ সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ যদি সেই সমালোচকদের শরিক হতেন রামকিঙ্কর রামকিঙ্কর হয়ে উঠতে পারতেন কিনা সন্দেহ থেকে যায়। শুধু রামকিঙ্কর বলে নয় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সমস্ত শিল্প ও শিল্পী র এক বড় আশ্রয়স্থল।তাঁকে পাঠানো সমকালীন কবি সাহিত্যিকদের নতুন লেখা হাজারো ব্যস্ততার মধ্যেও কবি অত্যন্ত যত্নসহকারে পড়তেন মন্তব্য করতেন চিঠি লিখে উৎসাহ দিতেন — এ কথা আমরা সবাই জানি। রবীন্দ্রনাথের সৌজন্য ছিল প্রবাদপ্রতিম। কিন্তু জীবনানন্দকে তিনি কীভাবে নিয়েছিলেন?

জীবনানন্দের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ যখন বেরোলো প্রথমদিকে সমালোচনা মিশ্রিত হলেও দু-একটি প্রশংসা বাক্য যখন তিনি পাচ্ছেন তখন সাধ করে জীবনানন্দ এক কপি ‘ঝরাপালক’ ডাকযোগে পাঠিয়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে, মন্তব্যের অনুরোধ জানিয়ে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সংক্ষিপ্ত পাঠ প্রতিক্রিয়ায় লিখলেনঃ
“কল্যানীয়েসু,
তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাতে সন্দেহমাত্র নাই। কিন্তু ভাষা প্রভৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি কর কেন বুঝতে পারিনে। কাব্যের মুদ্রাদোষটা ওস্তাদিকে পরিহাসিত করে।
বড় জাতের রচনার মধ্যে একটা শান্তি আছে, যেখানে তার ব্যাঘাত দেখি সেখানে স্থায়িত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ জন্মে। জোর দেখানো যে জোরের প্রমাণ তা নয় বরঞ্চ উল্টো।
ইতি
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।”

যেটা লক্ষণীয় সেটা হলো জীবনানন্দের কবিত্বশক্তিকে মেনে নিলেও রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যভাষা নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। না-ই হতে পারেন, কিন্তু যে ভাষায় সমালোচনা করলেন তা যথেষ্ট রূঢ়ই বলা যায়। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ ভাষা নিয়ে যে ওস্তাদির কথা বললেন জীবনানন্দের প্রকৃত ওস্তাদি শুরু হয়েছিল এরপর থেকে। জীবনানন্দের নিজস্ব কাব্যভাষা তখনো পরিণত হয়নি দু-একটা লাইনে আভাস পাওয়া যাচ্ছে মাত্র। ‘সরস্বতীর বরপুত্র’ কি গোষ্পদের মধ্যেই সিন্ধুর আভাস পেয়েছিলেন? তাহলে তাঁর প্রশ্রয়ের হাত জীবনানন্দের মাথায় রাখতে পারলেন না কেন? যেমনটা তিনি অন্য অনেকের ক্ষেত্রেই অকাতরে করেছেন এমনকি রবীন্দ্র বিরোধী বলে চিহ্নিত কল্লোল গোষ্ঠীর কবি-সাহিত্যিকরা, রবীন্দ্রনাথের তীব্র সমালোচনা করার পরও রবীন্দ্র স্নেহ থেকে যেখানে বঞ্চিত হন নি সেখানে কল্লোলদের মধ্যে থেকেও কখনও প্রকাশ্য রবীন্দ্র বিরোধিতায় সরব না হয়েও (পাশাপাশি এটাও ঠিক কখনও ভক্তিরসে আপ্লুত রবীন্দ্রস্তুতিও তিনি করেননি) জীবনানন্দ কেন সেই সামান্য প্রশ্রয়টুকুও পেলেন না? সেদিন যদি তিনি রবীন্দ্র আশীষ ধন্য হতে পারতেন জীবনানন্দের কবি জীবনের লাঞ্ছনাময় অধ্যায় হয়তো অন্যভাবে লেখা হলেও হতে পারতো। কারণ রবীন্দ্র স্বীকৃতি কে অস্বীকার করার ক্ষমতা বিংশ শতাব্দীতে কারোর ছিল কি?

ঝরা পালক এর পর্ব পেরিয়ে বহুদিন পর যখন বেকার, মেসবাসি, কক্ষচ্যুত ব্যর্থ কবি জীবনানন্দ গল্প আর উপন্যাস রচনায় মুখ লুকিয়েছেন তখন ১৯৩২ সালে কবি বিষ্ণু দে ‘র আমন্ত্রণে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘পরিচয়’ পত্রিকায় লিখলেন ‘ক্যাম্পে’ নামে অনন্যসাধারণ একটি কবিতা। ততদিনে জীবনানন্দ পেয়ে গেছেন তাঁর একক নির্জন দ্বীপের খোঁজ। তাঁর আশ্চর্য শব্দচয়নে মায়াবী রহস্যময়তায় মোড়া স্বতন্ত্র স্বরে শোনালেন মর্মস্পর্শী গভীর মননশীল এক শিকারের কাহিনী। যেখানে তাঁর মনে হলো, আমরা সবাই আসলে বসন্তের জ্যোৎস্নায় মৃত হরিণদের মতো। কবিতাটা এইরকম:

ক্যাম্পে

এখানে বনের কাছে ক্যাম্প আমি ফেলিয়াছি ;
সারারাত দখিনা বাতাসে
আকাশে চাঁদের আলোয়
এক ঘাইহরিণীর ডাক শুনি,–
কাহারে সে ডাকে !

কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার ;
বনের ভিতরে আজ শিকারীরা আসিয়াছে,
আমিও তাদের ঘ্রাণ পাই যেন,
এইখানে বিছানায় শুয়ে শুয়ে
ঘুম আর আসে নাকো
বসন্তের রাতে।

চারিপাশে বনের বিস্ময়,
চৈত্রের বাতাস,জ্যোৎস্নার শরীরের স্বাদ যেন !
ঘাইমৃগী সারারাত ডাকে ;
কোথাও অনেক বনে — যেইখানে জ্যোৎস্না আর নাই
পুরুষ-হরিণ সব শুনিতেছে শব্দ তার ;
তাহারা পেতেছে টের,
আসিতেছে তার দিকে !
আজ এই বিস্ময়ের রাতে
তাহাদের প্রেমের সময় আসিয়াছে ;
তাহাদের হৃদয়ের বোন
বনের আড়াল থেকে তাহাদের ডাকিতেছে জ্যোৎস্নায়,–
পিপাসার সান্ত্বনায় –আঘ্রাণে –আস্বাদে !
কোথাও বাঘের পাড়া বনে আজ নেই আর যেন !
মৃগদের বুকে আজ কোনো স্পষ্ট ভয় নাই ,
সন্দেহের আবছায়া নাই কিছু ;
কেবল পিপাসা আছে ,
রোমহর্ষ আছে ।
মৃগীর মুখের রূপে হয়ত চিতারও বুকে জেগেছে বিস্ময় !
লালসা -আকাঙ্ক্ষা-সাধ-প্রেম-স্বপ্ন স্ফুট হয়ে উঠিতেছে সব দিকে
আজ এই বসন্তের রাতে ;
এইখানে আমার নকটার্ন –।

একে একে হরিণেরা আসিতেছে গভীর বনের পথ ছেড়ে,
সকল জলের শব্দ পিছে ফেলে অন্য এক আশ্বাসের খোঁজে
দাঁতের নখের কথা ভুলে গিয়ে তাদের বোনের কাছে অই
সুন্দরী গাছের নিচে — জ্যোৎস্নায় ! —
মানুষ যেমন করে ঘ্রাণ পেয়ে আসে তার নোনা মেয়েমানুষের কাছে,
হরিণেরা আসিতেছে।
–তাদের পেতেছি আমি টের
অনেক পায়ের শব্দ শোনা যায় ,
ঘাইমৃগী ডাকিতেছে জ্যোৎস্নায় ।
ঘুমাতে পারিনা আর ;
শুয়ে শুয়ে থেকে
বন্দুকের শব্দ শুনি ।
চাঁদের আলোয় ঘাইহরিণী আবার ডাকে ;
এইখানে প’ড়ে থেকে একা একা
আমার হৃদয়ে এক অবসাদ জমে ওঠে
বন্দুকের ডাক শুনে শুনে
হরিণের ডাক শুনে শুনে।

কাল মৃগী আসিবে ফিরিয়া ;
সকালে –আলোয় তারে দেখা যাবে–
পাশে তার মৃত সব প্রেমিকেরা প’ড়ে আছে।
মানুষেরা শিখায়ে দিয়াছে তারে এইসব ।
আমার খাবার ডিশে হরিণের মাংসের ঘ্রাণ আমি পাব,
…মাংস খাওয়া হল তবু শেষ ?
…কেন শেষ হবে ?
কেন এই মৃগদের কথা ভেবে ব্যাথা পেতে হবে
তাদের মতন নই আমিও কি?
কোন এক বসন্তের রাতে
জীবনের কোন এক বিস্ময়ের রাতে
আমারেও ডাকেনি কি কেউ এসে জ্যোৎস্নায় –দখিনা বাতাসে
অই ঘাইহরিণীর মতো ?

আমার হৃদয় –এক পুরুষ হরিণ —
পৃথিবীর সব হিংসা ভুলে গিয়ে
চিতার চোখের ভয় — চমকের কথা সব পিছে ফেলে রেখে
তোমারে কি চায় নাই ধরা দিতে ?
আমার বুকের প্রেম ঐ মৃত মৃগদের মতো
যখন ধূলায় রক্তে মিশে গেছে
এই হরিণীর মতো তুমি বেঁচেছিলে নাকি
জীবনের বিস্ময়ের রাতে
কোনো এক বসন্তের রাতে ?

তুমিও কাহার কাছে শিখেছিলে !
মৃত পশুদের মতো আমাদের মাংস লয়ে আমরাও পড়ে থাকি ;
বিয়োগের–বিয়োগের–মরণের মুখে এসে পড়ে সব
ঐ মৃত মৃগদের মতো –।
প্রেমের সাহস-সাধ-স্বপ্ন লয়ে বেঁচে থেকে ব্যাথা পাই,ঘৃণা মৃত্যু পাই ;
পাই না কি?

দোনালার শব্দ শুনি।
ঘাইমৃগী ডেকে যায়,
আমার হৃদয়ে ঘুম আসে নাকো
একা একা শুয়ে থেকে ;
বন্দুকের শব্দ তবু চুপে চুপে ভুলে যেতে হয় ।
ক্যাম্পের বিছানায় রাত তার অন্য এক কথা বলে;
যাহাদের দোনলার মুখে আজ হরিণেরা মরে যায়
হরিণের মাংস হাড় স্বাদ তৃপ্তি নিয়ে এল যাহাদের ডিশে
তাহারাও তোমার মতন ;–
ক্যাম্পের বিছানায় শুয়ে থেকে শুকাতেছে তাদেরো হৃদয়
কথা ভেবে–কথা ভেবে–ভেবে ।
এই ব্যথা,–এই প্রেম সবদিকে রয়ে গেছে,–
কোথাও ফড়িঙে-কীটে,–মানুষের বুকের ভিতরে,
আমাদের সবের জীবনে।
বসন্তের জ্যোৎস্নায় ঐ মৃত মৃগদের মতো আমরা সবাই।

আসলে এ লেখার মধ্যে দিয়ে জীবনানন্দ আমাদের সর্বব্যাপী অসহায়তার কথাই শোনালেন যেন।ঐ মৃগরা যেমন ঘাইহরিণীর ডাকে প্রেমের আবেশে ছুটে এসে শিকারীর গুলিতে নিহত হয় ,আমরা সবাই তেমনি কোন না কোন স্বপ্নের মোহে ঘুরতে ঘুরতে জীবনের কোন এক পর্বে এসে কোন একসময় অদৃশ্য নিয়তির হাতে শিকার হই।

কিন্তু অসাধারণ সংবেদী এ লেখা কে ‘অশ্লীল’ বলে নোংরা সমালোচনায় বিদ্ধ করতে আবার কোমর বেঁধে নেমে পড়লেন সজনীকান্ত দাস। শনিবারের চিঠিতে তিনি লিখলেন,”কবি বলিতেছেন যে বনের যাবতীয় ঘাইহরিণীকে ‘তাহার হৃদয়ের বোন’ ঘাইহরিণী ‘আঘ্রাণ’ও ‘আস্বাদের’ দ্বারা তাহার ‘পিপাসার সান্ত্বনার’জন্য ডাকিতেছে।…ভাইয়েরা নাহয় তাদের বোনের কাছে আসিল… কিন্তু ‘মেয়েমানুষ’ কি করিয়া নোনা হইল? নোনা ইলিশ খাইয়াছি বটে কিন্তু কবির দেশে মেয়েমানুষেরও কি জারক প্রস্তুত হয়?কবি যে এতদিনে হজম হইয়া যান নাই ,ইহাই আশ্চর্য।…”

যে সংখ্যায় জীবনানন্দের ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল ওই একই সংখ্যায় বেরিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ‘মাঘের আশ্বাস’কবিতাটি। যে পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ লেখেন সেরকম একটা পত্রিকায় এরকম অশ্লীল কবিতা কী করে ছাপা হয় তা নিয়ে শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন সজনীকান্ত। শাহাদুজ্জামান তাঁর ‘একজন কমলালেবু’ গ্রন্থে উল্লেখ করছেন, “রবীন্দ্রনাথ পত্রিকাটি পড়েছিলেন এবং পড়েছিলেন ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটাও। রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠজন প্রশান্ত চন্দ্র মহালানবিশ তাঁর ডায়েরির পাতাতে লিখছেন ,তিনি একদিন রবীন্দ্রনাথের ওখানে গিয়ে দেখেন রবীন্দ্রনাথ সুধীন্দ্রনাথের সাথে কথা বলছেন, ‘জীবনানন্দ দাশের ঐ ঘাইহরিণী কিচ্ছু হয়নি ।’ সুধীন্দ্রনাথ দত্তও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বললেন ‘হ্যাঁ ওর কোন স্টাইল নেই, কেমন পাঁচমিশালী’।” রবীন্দ্রনাথের এই সামান্য অপছন্দের দাম জীবনানন্দকে দিতে হয়েছিল। ক্যাম্পের মতো ঘোর লাগানো একটা কবিতা লেখার পর পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে পরিচয় এ তাঁর আর কোন লেখা ছাপানো হয়নি।

‘ক্যাম্পে’ কবিতা পর্বের বেশ কয়েক বছর পর রবীন্দ্রনাথ ‘বাংলা কাব্য পরিচয়’ নামে একটা সংকলন প্রকাশ করেন (শ্রাবণ,১৩৪৫বঙ্গাব্দ)।সেই সংকলনে তিনি জীবনানন্দকে একটু জায়গা দিয়েছিলেন ,কিন্তু যেভাবে জায়গা দিয়েছিলেন তা বিতর্কের ঊর্ধ্বে যেতে পারেনি। কারণ ‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রকাশিত জীবনানন্দের ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতাটির প্রথম, পঞ্চম সম্পূর্ণ এবং শেষতম অষ্টম স্তবকের প্রথম চারটি পঙতি বাদ দিয়ে খন্ডিত অংশ তাঁর সংকলনে গ্রহণ করেছিলেন। কোন একজন কবির কবিতার ওপর এভাবে যথেচ্ছ ছুরি-কাঁচি চালানো যায় কি?বিষয়টা কি সেই কবির পক্ষে যথেষ্ট অমর্যাদাকর নয়? যদি তিনি নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথও হন তিনিও কি পারেন? বিষয়টা নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু। ক্ষোভের সঙ্গে তিনি লিখলেন “…অঙ্গহানিতে কবিতাটির ক্ষতি হয়েছে… এই যত্নহীনতা অবজ্ঞাসূচক ।আমি তো মনে করি যে সব কবির উপর রবীন্দ্রনাথের আন্তরিক শ্রদ্ধা নেই , তাঁদের বাদ দেওয়ার অধিকার নিশ্চয়ই তাঁর আছে এবং বাদ দেওয়াই যথার্থ কবি ধর্ম ও মনুষ্যধর্ম। সাহিত্য ক্ষেত্রে কেউ কারো কৃপা প্রার্থী নন। দয়ার গ্রহণের চাইতে স্পষ্ট উপেক্ষার বর্জন অনেক সম্মানের।”(কবিতা।আশ্বিন,১৩৪৫)।

এভাবেই রবীন্দ্র-উত্তর যুগের বাংলা কবিতার সর্বশ্রেষ্ঠ রূপ- শিল্পী সমকালের কাছে বারবার উপেক্ষিত আর অবহেলিত হয়েছেন ।ধূসর পান্ডুলিপির কবি তাঁর জীবদ্দশায় ক্রমশ ধূসর থেকে ধূসরতর হয়ে গিয়েছেন । জীবনানন্দের মতো আন্তর্জাতিক মানের অক্ষর শিল্পী আমাদের বাংলা ভাষায় কবিতা লিখেছেন — আজ নিঃসন্দেহে এ আমাদের আত্মশ্লাঘার বিষয়। কিন্তু বেঁচে থাকতে এই নির্বিবাদী আত্মমগ্ন মননশীল মানুষটাকে আমরা কী দিতে পেরেছিলাম? হৃদয়ের অবিশ্রান্ত রক্তক্ষরণ ছাড়া !


তথ্য ঋণঃ
১.’একজন কমলালেবু’। শাহাদুজ্জামান।
২.’জীবনানন্দ ও তাঁর কাল’। হরিশংকর জলদাস।

চিত্রঋণঃ আন্তর্জাল

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


5 1 vote
Article Rating
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Chandan Sen Gupta
Chandan Sen Gupta
5 months ago

লেখাটি আগেও পড়েছিলাম।আবারও পড়লাম।সেদিনের সেই পরিস্থিতিতে কবির অসহায় মর্মবেদনার কথা জেনে মন রক্তাক্ত হয়ে যায়।সাথে আর একটা ভাবনা মনকে ভাল করে এই ভেবে যে,নিজের কবিতার প্রতি তিনি কতটা প্রত্যয়ী ছিলেন যে,সমস্ত রকমের প্রতিকূলতা সত্বেও তিনি আর সবকিছুর বিনিময়ে তাঁর কবিতাগুলোকেই আগলে বেঁচেছিলেন।লেখককে আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ধন্যবাদ জানাই।