
ঘোষেদের মজা পুকুর কচুরি পানায় আচ্ছন্ন । পার দিয়ে উঁচু নিচু মেঠো পথ। নিমাইয়ের বাড়ি । সে দাওয়ার ওপর বসে । মাথার ওপরে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পচা খড়ের চাল আর পাখিদের কিচিরমিচির। হাড়জিরজিরে শরীর, প্রায় ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোয়ালের হাড়, স্থির ঘোলাটে চোখ – নিথর বসে আছে অনেকক্ষন। নিমাই বোষ্টম।
ঘরের ভিতর থেকে তেড়ে আসছে চাপা গোঙানির আত্মরোল। তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে। পৃথিবীটা যেন আরো দ্রুত পাক খেতে খেতে বেসামাল। চৌকাঠ ডিঙিয়ে তার মনে হলো, চুলির মুঠি ধরে মাথাটা ঠুকে থেতলে দি, কিংবা মাগীর গালে কয়েকটা ভারী চড় মেরে একেবারে চিরতরে সাবাড় করে দি।

নিমাইয়ের কোনোটাই করা হলো না। ধীর পায়ে উঠে কুসুমের কাছে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসলো। মাথাটা কোলের ওপর টেনে নিয়ে বলতে থাকলো – চুপ কর হতভাগী চুপ কর। ওরা যদি একবার তোর গোঙানির শব্দ শুনতি পায় আর আস্ত রাখবেনি। ওয়ারা পলিসি কাউন্সিলারের নোক।’
কুসুম শুনলো না। সমস্ত সাবধানতার চুলোয় আগুন দিয়ে সে আরো জোরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। নিমাইয়ের বুকে ঝাপ্টা মেরে , তাকে ক্ষিপ্ত উন্মাদিনীর মতো সজোরে ঝাঁকিয়ে বললে – তুমি না বাবা ! ইরকম চুপ করি বসি থাকবে। কিচ্ছুটি করবে নি ?’
ওর আর্ত কণ্ঠস্বর আচমকাই থমকে গেলো সাইকেল ঘন্টির টুংটাং আওয়াজে। বাড়ির সামনে ওরা এসেছে । ওরা মানে – মালিপাড়ার দিলীপ , বিমল , সুকুল’রা। ওরা মানে শান্তি রক্ষা কমিটির সদস্যরা। ওরা মানে – এই সেদিন যারা নিমাইয়ের বাড়িতে মহাপ্রভুর মালসা ভোগের চিঁড়ে মুড়কি কলাপাতায় নিয়ে যত্নে চেটে খেয়েছিলো।
তখন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা। রজতের মোবাইল অতর্কিতে বেজে উঠলো। লীলা ডাকছে। লেখাটা থামিয়ে সে বললে, ‘ কি ব্যাপার, এই অসময়ে ?’
‘আরে একটা গুড নিউজ আছে ?’
‘প্রমোশন ? ‘
‘ধুশ ! শোনো কাজের কথা। একটু আগে উকিলের ফোন এসেছিলো। নেক্সট শুনানিতে প্রকৃত সাক্ষীর অভাবে জজ সাহেব কেস ডিসমিস করে দেবে।’
‘তাই ?’
‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট। এবার তুমি ঐটার একটা ব্যবস্থা করো।’
‘অবিনাশ কাল আসবে।ফোনে কন্ফার্ম করেছে।’
‘আবার অবিনাশ কেন ?’
‘চিন্তা কোরো না। সেদিনের আগুন আজ অকশন কোম্পানির দালাল।’
ফোন রেখে রজত সিগারেট ধরালো। ঘরের কোণে সাবেকি মেহগনি কাঠের দেরাজের দিকে তাকিয়ে কি একটা ভেবে কিচেন ক্যাবিনেট থেকে হুইস্কির বোতল নামালো। কড়া একটা পেগ না হলে মনের ইতস্তত ভাব কাটবে না। বাইরে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি। রুদ্রপলাশ একে একে ঝরে পড়ছে ,পাথরে। ইতিউতি হাওয়ায় পর্দারা আপন নিয়মে ঢেউ খেলছে। অবিনাশকে লীলা পচ্ছন্দ করেনা। একপ্রকার ঘেন্নাই করে। কিন্তু রজতের পক্ষে অবিনাশকে ভোলা কঠিন। ঠিক যেমন কঠিন ভোলা সেই প্রত্যয়ী ভোরের কথা।

আকাশ জুড়ে তখন কচি আলোর লালিমা। শিমুল গাছের কাঁটায় কাঁটায় নতুন পাতার কলতান। শালিকের কিচিরমিচির। ভক্তিশীলা কোনো অদূর চালাঘর থেকে ভেসে আসছে কীর্তনের আখর। চায়ের দোকানে ধোঁয়া কাটিয়ে আঁচ উঠবো উঠবো করছে। অন্যদিনের মতো ঝাড়ু রেখে পুলিনদা দোকানের সামনে বালতি থেকে আঁজলা করে জল ছিটোচ্ছে। মোটা কালো ফ্রেমের চশমার ওপর দিয়ে ওর মন যেন কাদের খুঁজছে। মুখে চাপা উদ্বেগের ঘনঘটা। ওরা যদি ফেল করে, না আসে, পুলিশের ভ্যান সারা রাত টহল দিয়েছে, ওরা কি সন্দেহ করছে, ইত্যাদি , ইত্যাদি।
সময় মতো ওরা এসেছিল। রজত আর অবিনাশ। এক মুখ দাড়ি, লম্বা চুল, ঢোলা বুশ শার্ট, চামড়ার স্যান্ডেল। দোকানের পিছনে কয়লার বস্তা থেকে পুলিনদা ওদের হাতে তুলে দিয়েছিলো মহিমের রেখে যাওয়া রিভলবারটা। সতর্ক করতে বলে ছিল – সাবধান ! ইটা কিন্তু ফুল লোডেড।
রজত মুচকি হেসে বলেছিলো – “আরে দাঁড়াও একটা চুমু খাই। তোমাকে নয় – একে।”
‘ তোগো আদিখ্যেতার শ্যাষ নাই। কবিতা না উগড়াইয়া আসল কাম কইরা দেখা।”
“একটুক চা দাও না। সকাল থেকে এক পাত্তরও হয় নি, কমরেড ।”
“ইখানে বইয়া থাক। লইয়া আইতাসি। আর শুনো, তোগো বাহির হইবার পথ ওই কাঁঠাল বাগানের ভিতর দিয়া। কিছুটা হাঁটলেই হাই রোড। বাস পায় যাবা। “
রজত, অবিনাশ দুজনেই একে ওপরের দিকে চাইলো। যেন বলতে চাইলো – ঝুঁকি , উত্তেজনা না থাকলে কোনো প্রয়াশই সত্য বলে বিশ্বাস হয় না। ওই সর্পসঙ্কুল কাঁঠালবনের মতো ওরা থাকলেই বেঁচে থাকার একটা মানে আছে , এগিয়ে চলার একটা উদ্দেশ্য আছে।
বাড়ির সামনে স্টেশনে ট্রেনের ভোঁ বাজতে রজত সম্বিৎ ফিরে পেলো। বৃষ্টি থেমে গিয়ে বাতাসে তখন আবগারি বার্তা। বারান্দার টবে গন্ধরাজ নির্বিকার চিত্তে আপন গন্ধে বিভোল ভোলা। পাশের ফ্ল্যাটের মাসিমা রাস্তার দিকে তাকিয়ে। আইবুড়ো মেয়েটা কখন বাড়ি ফিরবে। দিনকাল যা পড়েছে। কিছুই বলা যায় না।
অতঃপর বারান্দায় দাঁড়িয়ে রজতের চোখ পড়লো স্টেশনে বসে থাকা বুড়োটার দিকে। বেশ ক’মাস হলো এসেছে। একমুখ পাকা দাড়ি , মাথায় জটা , পরনে কালো কাপড় , লাল করমচার মতো অগ্নিবর্ষী চোখ , দু কাঁধে দুটো তেল চিটচিটে ব্যাগ নিয়ে তার আগমন ঘটেছিলো কয়েক মাস আগে। প্রথম দর্শনে লোকটাকে পাগল মনে হলেও রজত ওর রকম – সকম দেখে পরে বুঝেছিলো বুড়োটা কোনো এক সবুজ বনানীর মধ্যস্থলে দাঁড়িয়ে থাকা নিয়তির চরম বিদ্রুপ – অকিঞ্চিৎকর বাজে পোড়া তালগাছ।

সারাদিন গোঁজ হয়ে বসে থাকে , বিড়ি খায় আর সন্ধ্যে হলেই দু হাতে দুই বোচকা নিয়ে স্টেশনে ট্রেন ঢুকলেই এ -কামরা , ও-কামরা , প্রায় সব কামরা ছুটে বেড়াতো; কাকে বা কাদের যেন খুঁজতো; উর্দ্ধশ্বাসে বলতো – কোথায়, কোথায়, কোথায়। তারপর ট্রেন চলে গেলেই বিকট আস্ফালন করে হাঁক দিয়ে উঠতো – যাহ ! শালা যাহ ! এবারের মতো ছেড়ে দিলাম। আর কখনো আসবি নি। ধ্বংস করি দিবো। ধ্বংস ! ধ্বংস !
ইদানিং একদিন রজত কৌতূহলবশত ওর সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরিয়ে আপাদমস্তক স্টাডি করবার চেষ্টা করেছিল | ফল হয়েছিল ভয়ঙ্কর | বুঝতে পেরে বুড়োটা দাঁত মুখ খিঁচিয়ে তাড়া করে এসেছিলো|
“হারামজাদা , শুয়ারের বাচ্চা, পোঙা মাড়িয়ে মজা দেখছিস ? তবে তরে আমি চিনি – কিন্তু এখন না – মঙ্গল আসবে বেস্পতিতে , বেস্পতি আসবে শনিতে , শনি যাবে ফুররর। এখন যা বেজম্মা পোঙা মারা।”

বুড়োর চিৎকার চেঁচামেচি শুনে স্টেশনের লোকজন ওদের ঘিরে ধরেছিলো।ইজ্জত বাঁচাতে রজত তাড়াহুড়ো করে চম্পার চায়ের দোকানের পাশে তিন পাত্তির ঠেকের সামনে নিজেকে আড়াল করেছিল। হঠাৎ শুনতে পেলো কে যেন চম্পাকে খিলখিল করে হেসে বলছে – আরে দেখি যা! বুড়ো আজ হেব্বি মুডে। ব্যাগ থেকে শায়া শাড়ি বেলাউজ বের করি লাফায়ে লাফায়ে পরতিসে। খবরটা শোনা মাত্র রজতের শিরদাঁড়া দিয়ে হিমেল স্রোত বয়ে যেতে লাগলো। মাথাটা যেন ঝিম ঝিম করছে। সেই ছেলেবেলা থেকে কোনো এক অশুভ কিছু ঘটবার আগে থেকে তার মনের মধ্যে এই রকম একটা সংকেত পৌঁছুতে থাকে। তাহলে কি ওই বুড়োটা …। ঘামে জবজবে অবস্থায় বাড়ি ফিরে রজত সেদিন অনেকক্ষন শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজের উলঙ্গ বেশ নিরীক্ষণ করে বুঝেছিলো – সেদিনের সেই শৈশব – সেই নিষ্পাপ আদুর স্বচ্ছ পরিমণ্ডল থেকে সে এখন অনেক অনেক দূরে সরে এসেছে। ফিরবার পথ নেই।

আজও রজত যেন সেই অপ্রীতিকর বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছে। গেলাসের অবশিষ্ট হুইস্কি শেষ করে সে ঠাকুরদার মেহগনি কাঠের দেরাজ থেকে বাবল প্যাক করে রাখা রেভলভারটা বার করে পড়ার টেবিলে ফিরে এলো। প্যাকটা খুলতেই শীতল ইস্পাতের ওপর ফুটে উঠলো রজতের মুখাবয়ব। নিজেকে নিজের কাছে গালাগালির মতো নিকৃষ্ট মনে হলো। কোথাও কোনো একটা পাপবোধ যেন তাকে গভীর জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। চারিদিকে হিংস্র প্রাগৈতিহাসিক শ্বাপদরা তাকে ছিঁড়ে খেলো বলে। রেভল্ভরে এখনো একটা বুলেট অবশিষ্ট আছে। ওটা কি তাহলে নিয়তির অন্তিম উপহার ! রজতের চোখ পড়লো জানলার আলে রাখা বাহারি চিকন পাতার ওপর। দৃষ্টির তীক্ষ্ণতায় ধরা পড়লো নিরীহ চোখ, নির্বিকার হাসি, নিবিড় ভাব ; রজত ওদের ভালোবাসে, যত্ন করে , হিংসেও করে।
সিগারেট ধরিয়ে রজত লেখায় মনোনিবেশ করলো। ওটা শেষ করতেই হবে।
নিমাই বোষ্টম সেদিন সন্ধ্যায়, সাতটায়, ওই তিনজন রক্তমাংসের লম্বা, চওড়া, বিরাট সঙ্গীদের সঙ্গে সর্বাঙ্গ আড়ষ্ট শরীরে শ্মশান পৌঁছেছিল। ওর পাঁজরের ভিতর হৃৎপিন্ডটি ধুকপুক ধুকপুক করে নিয়ত জানান দিচ্ছিলো – টিকে যাচ্ছি, এখনো টিকে যাচ্ছি।
হে হতভাগ্য , ভাগ্যপিষ্ট হরিভক্ত বোষ্টম, ওই দেখো বাঁশের কঞ্চির ওপর নামাবলী জড়িয়ে, কেমন হরিনামের দোল খাইয়ে ওরা তোমার আদরের ছিন্নবসনা গৌরিকে চালান করছে চুল্লিতে ; ওই দেখো কেমন মোমের মতো গলে পড়ছে ওর ভরাট ওষ্ঠ-অধর , উন্নত বক্ষ , স্ফীতকায় নিতম্ব, কোমল জঙ্ঘা, এক রাশ কালো চুল। আরো গলে পড়ছে বিশেষত সেই সেই সব যার উন্মত্ত আকর্ষণে ওরা ওকে বন্ধু সেজে ফুঁসলে নিয়ে গিয়েছিলো। কোল্ড ড্রিঙ্কের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিলো ঘুমের বড়ি। তারপর জরাজীর্ণ , চামচিকে-বাদুড়ের মক্কাভূমি , প্রাচীন জমিদারবাড়ির অভিশপ্ত জলসাঘরে , সেই যেখানে এককালে চলতো আতরের বেলেল্লাবৃত্তি , সেই যেখানে ডাগর রজঃস্বলা বাতাসী আর্তস্বরে বলেছিলো , “বাবু আজ রাতে আমায় ছেড়ে দাও , আমার শরীর খারাপ ,”সেইখানে একজন , দু-জন , তিন-জন আরো কতজন কে জানে, দশ মিনিট , কুড়ি মিনিট, আরও কত মিনিট কে জানে … শেষে অনর্গল রক্ত গড়িয়ে পড়েছিল ভগ্ন পাথরের ফাটলে , অবাক অথচ উৎফুল্ল ইঁদুরেরা চেটে নিয়েছিল লোনা স্বাদ অকথ্য অত্যাচারের।
প্রায় উলঙ্গ, অসহ্য যন্ত্রনায় কাতরা মেয়েটি উঠে বসতে গিয়ে ধড়াস শব্দে মাটিতে পড়ে গেল। দমকা শ্বাস ছেড়ে অস্ফুট অথচ অনমনীয় স্বরে সে বললে, “তোরা আমার এই যে সব্বোনাশ করলি, তোদের আমি পুলিশে দোব। “হায় ! গৌরী হায় ! হতভাগিনী কাকে বলবি? পুলিশের ছেলে , কাউন্সিলারের ছেলেরাই তো তোর এই কান্ডটা করলো।কাকে বলবি রে ! এখন বলার মতো , প্রকৃত বিচার করার মতো কেউ কি আছে? সব শালা তো বেওয়ারিশ রাজনীতির কন্ডোম ফাটা বাচ্চা।

গৌরী যখন শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় প্রায় নিবু-নিবু , যখন চুলের মুঠি ধরে থেঁতলে দেয়া হচ্ছে মাটিতে , বিবর্ণ ঘরটির শিরায় উপশিরায় ছলকে উঠলো কড়া হ্যালোজেনের আলো। প্রথা অনুযায়ী জমিদার বাড়ির সামনে বাঁক কেটে ভ্যান রিক্সায় চড়ে হর-গৌরী চলেছে ভাসান যাত্রায়। চারিদিক আলোয় আলোময়। ঘুম ভাঙা পাখিরা , গোল গোল পিচুটি চোখে দেখতে লাগলো উদ্দাম, উন্মত্ত উৎসব , নরযাত্রা। কেউ মদ খেয়ে হিক্কা তুলছে , কেউ কপালে সিঁদুর লেপে নতুন গামছা জড়িয়ে ভিজে কাপড়ে দন্ডি কাটছে , কেউ কচি মেয়ের ডবকা বুক থেকে ওড়না কেড়ে ক্যাঁচাল বাধিয়ে কিস্তিমাৎ করছে। সবাই দেবতাকে অছিলা করে ডুব দিয়েছে আদিরস, ভক্তিরস, সোমরস’এর ত্রিবেণী সঙ্গমে।
দুষ্কৃতীদের কাছে এই সুযোগ। ওরা দুদ্দাড় করে ভগ্ন নড়বড়ে পাঁচিল টপকে জমে গেল ভিড়ে। পকেট থেকে অবশিষ্ট রাম গলায় ঢেলে সবার সঙ্গে দু হাত তুলে চিৎকার করে বললে – বোলো গৌরী মাইকী , জয় !!! হর হর বম বম !!
আরো একজন চিৎকার করেছিল। চূর্ণী নদীর তীরে , শ্মশানে| নিমাই বোষ্টম| নিজের মানসিক স্থিতাবস্থা আর রক্ষা করতে পারেনি|ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে গিয়েছিলো চুল্লির দিকে। দু’হাত শূন্যে তুলে, শোকপৃষ্ট , চেয়েছিলো নির্মম আবেগে সমস্ত কিছু চিরে ফেলে মেয়েকে ফিরিয়ে আনতে। বাঁধ ভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ে – বলেছিলো , ‘ ওরে গৌরীরে , তুই কোথায় গেলি রে ?’

হুটার বাজিয়ে রাতের শেষ ট্রেন ছাড়লো। সারাদিনের মজবুরির শেষে স্টেশন যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কয়েক ঘন্টা এখন উদ্ভ্রান্ত যাত্রীর বুটের ঠোক্কর খেতে হবে না। নিষ্কৃতি। এখন নির্বিকার চিত্তে একটু এলোমেলো কদম গাছের হাওয়া , বরখাস্ত শুকনো খরখরে বরখাস্ত পাতা কিংবা ভূলে ফেলে যাওয়া কোনো সুগন্ধি রুমালের সঙ্গে কয়েক ঘন্টা নিবিড় আলাপ জমানো যাবে।
লেখা থামিয়ে রজত পায়চারী করতে করতে বারান্দায় আলো নিভিয়ে বসলে। এই সময় ঘরের সমস্ত কাজ সেরে ফেলে লীলা ওকে ফোন করে। কই আজ করলো না তো ! তাহলে কি ঘুমিয়ে পড়েছে ? নাকি আজ রাতে সে আবার প্রেমপোয়াতি !
রজতের চিন্তার স্রোত থমকে গেলো স্টেশনের নির্দিষ্ট স্থানে চোখ পড়তেই। বুড়োটাকে সে দেখতে পেলো না। কোথায় গেলো ? অন্য রাতে এই সময়ে সে বোঁচকায় মাথা দিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে , আকাশ দেখে, উচ্চরবে তারাদের ডাকে, বকে ঝকে, তড়াক করে রেললাইনে নেমে চকচকে ইস্পাতের ওপর সোহাগী হাত বুলিয়ে বলে – তোর খুব ব্যথা না ? দাঁড়া টিপে দিচ্ছি। ইশ ! কি রক্ত !
‘ইশ! মাগো কি রক্ত !” শিঁটকে উঠে ছেলেটি মায়ের কোলে মুখ লুকোলো ভয়ে।
‘বেশ হয়েছে। যেমন গিয়েছিলি দেখতে।’
ভ্যানরিক্সা – পুলিশের বেষ্টনী পার করে, কৌতুহলী জনতার ভিড় পিছনে ফেলে যখন বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়েছে, রজত মুখের রুমাল ঈষৎ নামিয়ে রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলে – “হ্যাঁগো , কি ব্যাপার ওখানে?”
“ভোর রেতে ওই নিমাই বোষ্টমের পরিবার লাইনে গলা দেছে। অমন ভক্ত পরিবারটার আর কিছু রইলোনি গো। ভাগ্যের হাতে সব শ্যাষ হয়ে গেছে বাবু। আমাদের সঙ্গে কেন এমনটি হয়ে বলতি পারো গো ? অমন ডাগর মেয়েটা ভাষণের রাতে খুন হলো , বাপ্ ভর্তি হাসপাতালে বাঁচে কিনা আশা নাই , আর শ্যাষে ওর পরিবার। ভগবান বলি কিছু নাই বাবু – বিক্রি করি দেছে।’
“কি বললে ? ভাসানের রাতে ?”
“কুমোরবাড়ির হরগৌরীর যে রেতে ভাসন হলো।”
“কোথায় হয়েছিল খুনটা ?”
“ওই গড়ান পারের জমিদারবাড়িতে।’
সামনে আচমকা মোটরসাইকেল চলে আসার কারণে ভ্যানরিক্সাটা বিপুল ঝাঁকুনি দিয়ে ব্রেক কষলো।
সপাং শব্দে কে যেন চাবুক মারলো রজতের পিঠে। তড়িৎগতিতে সে উঠে দাঁড়ালো। একটা হেস্তনেস্ত এবার করতেই হবে। বারান্দার স্লাইডিং দরজা বন্ধ করে পড়ার ঘরের পর্দা সরাতেই চমকে উঠলো। চেয়ারে পা তুলে বসে ও কে ? কালিফোনির মতো মাথা দুলিয়ে , ফিক ফিক কে হাসছে আর হাতে রজতের রেভলভারটা ঘোরাতে ঘোরাতে বলছে, “মঙ্গল আসবে বেস্পতিতে, বেস্পতি আসবে শনিতে , শনি যাবে ফুররর”।
চাপা ঊত্তেজনার হাপরে গনগনে রজত জিগ্গেস করলে , ” তুমি এখানে কি করছো ?”
“রাইত তো অনেক হলো তবু গপ্পো শ্যাষ হয় না। তাই না ?” বুড়োর মুখে কৌতুকের হাসি।
“রেভলভারটা রাখো। রাখো বলছি !” রজত মরিয়া হয়ে বললে।
“চোপ শালা ! পিস্তল যার ক্ষমতা তার। তোরাই তো বলতিস। হারামজাদা , এখন গপ্পের পোঙা মাড়াচ্ছো ?” এই বলে বুড়োটা ডিগবাজি দিয়ে চেয়ার থেকে নেমে দাঁড়ালো। রেভলভারটা নির্দিষ্ট করে রজতের দিকে তাক করা।
“কি চাও , তুমি ?” ঝাঁজিয়ে উঠলো রজত।
“তোর গপ্পো শেষ করতে “।
“মানে ?”
“উত্তর চাই “।
“কিসের ?”
“সেই রাতের।”
“কোন রাতের। কি ভুল বোক্চ। বেরিয়ে যাও এখন থেকে “।
“ন্যাকা আর সেজো নি। নিয়তি অনিবার্য। প্রস্তুত হও।”
“তুমি কে ? “
“সেই রাতে তুই তো সব দেকছিলিস। তোর হাতে পিস্তল ছিল। তবু তুই …।”
“তুমি কে ?”
“উত্তর দে শালা।” বুড়োর হুঙ্কারে যেন বজ্রের সন্দেশ।

রজতের চোখে মুখে শরীরে গড়িয়ে পড়ছে এতো দিনের জমে থাকা পাপবোধের গ্যাঁজলা। মহাকাল যেন আজ রক্তগর্ভ চোখে ওকে ভস্ম করতে এসেছে। ভৈরবমূর্তি ধারণ করে কৃতকর্মের হিসেব চাইছে। বারম্বার তপ্ত ত্রিশূলের খোঁচা দিয়ে জানতে চাইছে সেদিন, সেই কাল রাতে, সেই অভিশপ্ত জমিদার বাড়িতে নির্দিষ্ট কি হয়েছিল। আসামির জবানবন্দি।
“ধর্মাবতার ! এই এজলাসে আমি কবুল করছি সেদিন রাতে অকুস্থলে আমার উপস্থিতির কথা। দোতালার ঘরে ভগ্নস্তূপের মধ্যে আমি গা ঢাকা দিয়েছিলাম। অসম্ভব চিৎকার শুনে আমি খড়খড়ি তুলে দেখি মাটিতে শুইয়ে উম্মত অবস্থায় … “
“ওখানে কি করছিলেন ?”
“বললাম যে গা ঢাকা দিয়েছিলাম। আমার এগেনস্টে শুট এইট সাইট অর্ডার ছিল। তবু ধর্মাবতার বিশ্বাস করুন আমি চেয়েছিলাম অন্তত একটা গুলি ছুঁড়ে ওদের ভাগিয়ে দিতে কিন্তু …”।
“কিন্তু কিরে শালা। কেন রে ? কেন পারিসনি বল ? “বুড়োটা তখন শত শার্দুলের ক্ষিপ্রতা নিয়ে রজতের ছাতির ওপর সওয়ার। মুখের মধ্যে গুঁজে ধরেছে রিভলভার। রজত চাইলে এক লহমায় ওকে নামিয়ে খতম করে দিতে পারতো। কিন্তু কি লাভ। সেটাও তো একরকমের ভনিতাই হবে। তার থেকে আত্মসমর্পণ, অক্ষমতাকে মেনে নেওয়া , সেই তো পাপমুক্তির শ্রেয় পথ।গল্পের ভারমুক্ত সমাপন।
আর তাই খানিকটা গুঙিয়ে অস্ফুট স্বরে সে বলে উঠলো – “আমি ভয় পেয়েছিলাম। ধরা পড়বার ভয়, মৃত্যুর ভয়। ক্ষমা করো। নিষ্কৃতি দাও”।
প্রতিশোধের রাত কাটিয়ে , ভোরে , গুলির শব্দে পাখির ঘুম ভাঙলো। তাদের স্খলিত জিজ্ঞাসু ডাক শোনা গেলো। রুদ্রপলাশের প্রতিটি ডাল সূর্যদেবকে আবাহন করার প্রস্তুতি শুরু করলে। নির্বিকার রক্তিম রশ্মিরেখায় দিগন্ত আলোকিত হতে লাগলো। চূর্ণী নদীর শীতল স্রোতে পায়ে পায়ে এগিয়ে ডুব দিলো নিমাই বোষ্টম। জলের ধারা যেন তার দেহের গভীরে প্রবেশ করে অন্তর-স্থল পর্যন্ত ধৌত করে দিলো। তার মন প্রাণ যেন এক আনন্দানুভূতিতে ভোরে উঠলো। অপেক্ষার অন্তে মুক্তিস্নান।