শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

বাংলা গানের উজ্জ্বল কারিগরেরা

আমাদের বেড়ে ওঠার সময়ে আমরা রোদ, জল, হাওয়ার মত যে জিনিসটা অনায়াসে আর অফুরন্ত ভাবে পেতাম, সেটা হল বাংলা গান শুনতে পাওয়া। তখন আমরা প্রধানত যে সব গান শুনতাম, তার দুটো ভাগ ছিল। একটা হোল বেসিক ডিস্কের গান, আর অন্যটা হল সিনেমার বা চলচ্চিত্রের গান। বলা বাহুল্য, পুজোর গানগুলি বেসিক বাংলা গানেরই অন্তর্গত। তবে বেসিক গানের কোনগুলি যে পুজোর গান, সেটা নিশ্চিত করে বলার মত তথ্যাদি আমার সংগ্রহে নেই। তবে আমি সামগ্রিকভাবে ওই সময়কালের বাংলা গানের প্রবল অনুরাগী। এমতাবস্থায় আমার আলোচনা আকাশবাণীর অনুরোধের আসরে যেসব গান শুনতাম এবং যার মধ্যে একটা বিরাট সংখ্যক গান পুজোর গান হিসেবে প্রকাশিত হোত, সেগুলোকেই কেন্দ্র করে আবর্তিত হবে। আমার আলোচনা সেই স্বর্ণ সময়ের প্রখ্যাত কিছু গীতিকারদের নিয়ে।


পুজোর গানের প্রস্তুতি যে সারা বছর ধরে চলত, সেটা নিশ্চয়ই অনুমান করা যায়। গান তৈরী হতে গেলে তিনজনকে অবশ্যই দরকার হয়। একজন, যিনি গান বাঁধবেন বা লিখবেন অর্থাৎ গীতিকার। দ্বিতীয়, যিনি সেই গানের বাণীতে সুরারোপ করবেন অর্থাৎ সুরকার। আর পরিশেষে, যিনি গানটিকে শ্রোতার দরবারে উপস্থাপিত করবেন অর্থাৎ গায়ক-গায়িকা বা সঙ্গীতশিল্পীরা। কিন্তু আসলে তিনজনই তো শিল্পী। তিনজনের সমবেত চেষ্টার ফলে একটা গান শেষ পর্যন্ত নির্মিত হয়। কিন্তু গান প্রকাশিত হয়ে গেলে সেটা কোন বিশেষ গায়ক বা গায়িকার গান হয়ে যায়। অন্তত শ্রোতারা তাই মনে করেন। সুরকার যদিও বা কখনো নিজ গুনে পরিচিত বা আদরণীয় হয়ে ওঠেন, শ্রোতাদের আগ্রহের অভাবে গীতিকারদের মোটামুটি আড়ালেই থেকে যেতে হয়।

সে একটা সময় ছিল বটে! পূজোর সময় পুজোর মন্ডপ থেকে মাইকে পুজোর গান ছড়িয়ে পড়ে নিজেদের আবির্ভাব ঘোষণা করত আর আমাদের কান খাড়া হয়ে থাকত সেগুলো শোনার জন্য। প্রাথমিক পরিচয়টা তখনই হয়ে গিয়ে মনে কৌতুহল জমে থাকত পরে বারবার শোনার জন্য। বছরের বাকি সময়টায় সেই সব গান বারবার শোনার জন্য একটাই জায়গা ছিল। তা হল, আকাশবাণীর অনুরোধের আসর। সেখানে ভিড়ে গিয়ে যা হয়েছিল সেটা হল, আমাদের জন্মের বহু আগে থেকে যে সব গান শ্রোতাদের দরবারে এসে গিয়েছিল, সেই সব গানের সাথে পরিচয় হতে লাগল ধীরে ধীরে। সে সব গানের কথা ও সুরে আভিজাত্যের সাথে কেমন যেন একটা স্নিগ্ধ অনুভূতি জাগাত মনে।

সুধীরলাল চক্রবর্তীর ‘মধুর আমার মায়ের হাসি’, ‘খেলাঘর মোর ভেসে গেছে হায়’, ‘ও তোর জীবন বীণা আপনি বাজে’, রবীন মজুমদারের ‘এই কি গো শেষ দান’, যুথিকা রায়ের ‘সাঁঝের তারকা আমি পথ হারায়ে’, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘যদি ভুলে যাও মোরে’, জগন্ময় মিত্রের ‘তুমি আজ কত দূরে’, গায়ত্রী বসুর ‘আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলবে আঙিনায়’, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ‘মধুমালতী ডাকে আয়’, ‘আর ডেকো না সেই মধুনামে’, তালাত মামুদের ‘নত মুখে কেন’ ইত্যাদি গান বারবার শুনে মুগ্ধ হয়ে অনুসন্ধান করে বিশদে জানার চেষ্টা করেছি এই সব গানের গীতিকারদের বিষয়ে। এঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি নিয়েই আমার এই নিবন্ধের আলোচনা।

প্রণব রায়


প্রথমে প্রণব রায়ের কথা।
১৯১১ সালের ৫ ডিসেম্বর কলকাতার সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন প্রণব রায়। বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় ও চতুর্থ দশকের আধুনিক ও চিত্রগীতির সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রবাদ প্রতিম গীতিকার ছিলেন তিনি। কাজী নজরুল ইসলামের সংস্পর্শে এসে তাঁর গীতিকার জীবনের শুরু। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, গীতিকার, কাহিনী ও চিত্রনাট্যকার, চলচ্চিত্র পরিচালক এবং অভিনেতা। ১৯৬৫ সালে সেরা গীতিকার হিসেবে বি এফ জে এ পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ৭ই আগস্ট তাঁর জীবনাবসান হয়। কালের সীমানা পেরিয়ে তাঁর গানের আবেদন কতটা রয়েছে, তার প্রমাণ উপরে উল্লিখিত গানগুলো। এর প্রায় সবগুলোই পরবর্তীকালের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরা নতুন করে গেয়েছেন এবং নতুন করে এই গানগুলিকে শ্রোতারা সাগ্রহে গ্রহণ করেছেন।

শ্যামল গুপ্ত ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে হেমন্ত, পাশে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়
আর এক অসামান্য গীতিকার ছিলেন শ্যামল গুপ্ত।

শ্যামল গুপ্তর সঙ্গে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মধ্যে ছিল অন্তরঙ্গ সখ্য। তাঁদের জুটিতে যে সব গান তৈরী হয়েছিল তার অনেকগুলির সাথেই বেশ মজার গল্প জড়িয়ে আছে। ১৯৫৭ সালে একদিন মানবেন্দ্র গেছেন গারস্টিন প্লেসের রেডিও স্টেশনে গান গাইতে। সেদিন ওঁর দুটি অনুষ্ঠান ছিল।একটা অনুষ্ঠান শেষ করে পরের অনুষ্ঠানের অপেক্ষায় উনি রেডিও স্টেশনের ছাদে অন্ধকারে পায়চারি করতে করতে গুন গুন করে গান গাইছিলেন। রেডিও স্টেশনের ওই বাড়িটির একটা ভয়মিশ্রিত খ্যাতি ছিল ভূতের আনাগোনার জন্য। হঠাৎ মানবেন্দ্র শুনতে পেলেন তার নাম ধরে কেউ ডাকছে। বেশ ভয় পেয়ে ‘কে’ ‘কে’ বলে পিছন দিকে তাকিয়ে দেখলেন অন্ধকারে এক জোড়া চোখ জ্বলজ্বল করছে। উত্তর এল, ‘আমি শ্যামল’। একটা গান লিখেছি,শুনবি? অন্ধকারেই মানবেন্দ্র গানের প্রথম স্তবকটা শুনতেই তাঁর শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। বন্ধুর হাত ধরে সোজা নিয়ে গেলেন পাঁচ নম্বর স্টুডিওতে। যার দরজা বিকেল পাঁচটার পরে বন্ধ থাকার কথা, সেদিন সেটা খোলা পাওয়া গেল। পিয়ানোর ডালাটাও বন্ধ থাকার কথা ছিল, সেটাও খোলা পাওয়া গেল। পিয়ানোতে মানবেন্দ্র সেই গানের সুর তৈরী করে ফেলে সেদিনের পরবর্তী অনুষ্ঠানে সেটি পরিবেশন করেছিলেন। গানটি হল, ‘আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি’। উনি বলতেন, এটা ওঁর ভূতে পাওয়া গান।

এছাড়া মান্না দে’র গাওয়া ‘আমি নিরালায় বসে বেঁধেছি আমার স্মরণবীণ’, ও ‘আমার মন যমুনার অঙ্গে অঙ্গে’, ‘আমি আজ আকাশের মত একেলা’। আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মন বলছে, আজি সন্ধ্যায় কিছু বলতে তুমি আসবে কি’, মৃণাল চক্রবর্তীর ‘ঠুং ঠাং ঠুং ঠাং চুড়ির তালে’, তালাত মামুদের ‘যে আঁখিতে এত হাসি লুকানো’, ‘এই তো বেশ এই নদীতীরে বসে গান শোনা’, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ‘আমি তার ছলনায় ভুলব না, চন্দন পালঙ্কে শুয়ে’, ‘ঝরা পাতা ঝড়কে ডাকে’ ইত্যাদি অনেক জনপ্রিয় গানের গীতিকার ছিলেন শ্যামল গুপ্ত।

১৯২২ সালের ৩ রা ডিসেম্বর তিনি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন।পৈতৃক আবাস ছিল বিহারের জামালপুরে। ওঁর পিতা ও পিতামহ মুঙ্গের কোর্টের আইনজীবী ছিলেন। স্কটিশ চার্চ স্কুল কলেজের পাঠ শেষ করে ১৯৪৫ সালে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে রসায়ন শাস্ত্রে স্নাতক হন। এরপর পুণায় ভারত সরকারের এক্সপ্লোসিভ ল্যাবরেটরিতে কেমিস্ট হিসাবে কাজে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে সেই চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে কলকাতায় ফিরে এসে উনি পুরোপুরি লেখালেখির কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। গায়ক হিসেবে এইচ এম ভি থেকে তিনটি রেকর্ড বার করার পর গান গাওয়া ছেড়ে গান লেখা এবং ছায়াছবির কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লেখা শুরু করেন। প্রায় দু হাজার গান লিখেছেন, যার মধ্যে ছায়াছবির গান প্রায় তিনশো। ১৯৬৩ সালে ওঁর গানের সংকলন ‘ আধুনিক গান ‘ প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে আর একটি সংকলন, ‘বেঁধেছি আমার স্মরণবীণ’ প্রকাশিত হয়। ১৯৭৭ সালে হারমোনিয়াম ছবির জন্য সেরা গীতিকারের পুরস্কার পান। ওঁর জীবনাবসান হয় ২০১০ সালের ২৮ শে জুলাই, কলকাতায়।

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার

এবার স্বনামধন্য গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথা।
‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’ গানটি গীতিকার, সুরকার এবং শিল্পী তিনজনেরই সঙ্গত আত্মপ্রত্যয়ের ফসল। সুরকার নচিকেতা ঘোষ বন্ধু গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারকে একদিন এমন একটি গান লিখতে বলেছিলেন, যে গানটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। খুব দেরি না করে গৌরীপ্রসন্ন লিখে ফেলেছিলেন এই গান। নচিকেতা ঘোষ গানটিতে সুর দিয়ে গাওয়ালেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে। গৌরীপ্রসন্ন মনে করতেন এই গানটিই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গায়ক জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ গান।

আধুনিক বাংলা গানের আকাশে সফল গীতিকার হিসেবে এক বিশাল এলাকা জুড়ে উদ্ভাসিত গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার । ১৯২৪ সালের ৫ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের পাবনা জেলার গোপালনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা গিরিজাপ্রসন্ন মজুমদার প্রেসিডেন্সি কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞানের খ্যাতনামা অধ্যাপক ছিলেন। বাড়িতে ছিল বাংলা, ইংরেজী এবং সংস্কৃত সাহিত্যের বিশাল সম্ভার। কলকাতার জগবন্ধু ইনস্টিটিউশন থেকে প্রবেশিকা উত্তীর্ণ হয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজী সাহিত্যে স্নাতক হন গৌরীপ্রসন্ন। ছেলেবেলা থেকেই কবিতা লিখতেন দুটি ভাষাতেই। কলেজে পড়তে পড়তেই তিনি কালিদাসের মেঘদূত কাব্যের ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন। কলেজে পড়া শেষ করার আগেই তিনি তাঁর খুব পছন্দের শিল্পী শচীন দেব বর্মণের সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁর গান লেখা শুরু হয়ে যায়। পরে তিনি ইংরেজী ও বাংলা, দুটি ভাষাতেই স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন।

খুব অল্পদিনের মধ্যেই শচীন দেব বর্মণের খুব প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন গৌরীপ্রসন্ন। একবার শচীন কর্তা গৌরীপ্রসন্নকে বোম্বেতে নিয়ে গিয়ে কলকাতার মজরু সুলতানপুরী বলে পরিচয় করান। বাস্তবিকই কলকাতার এবং বোম্বের যে সব শিল্পী বাংলা গান করেছেন, তাঁদের প্রায় সবাই ওঁর লেখা গান গেয়েছেন। ওঁর লেখা গানের বিশাল সম্ভার থেকে ধরে ধরে সব গানের উল্লেখ করা কষ্টসাধ্য কাজ। তাই সামান্য কিছু গানের তালিকা এখানে দিলাম।
শচীন দেব বর্মণের ‘ও জানি ভোমরা কেন কথা কয়না’, ‘ঘুম ভুলেছি নিঝুম এ নিশীথে জেগে থাকি’, ‘দূর কোন পরবাসে তুমি চলে যাইবা রে’, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘তোমার আমার কারো মুখে কথা নেই’, ‘আর কত রহিব শুধু পথ চেয়ে’, ‘একটি দুটি তারা করে উঠি উঠি’, ‘আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি’, ‘এক গোছা রজনীগন্ধা’,সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ‘অনেক দূরের ওই যে আকাশ নীল হল’, ‘হয়তো কিছুই নাহি পাব’, তালাত মামুদের ‘আলোতে ছায়াতে দিনগুলি ভরে রয়’, ‘রূপের ওই প্রদীপ জ্বেলে’, আশা ভোঁসলের ‘কথা দিয়ে এলেনা’, ‘যেতে দাও আমায় ডেকো না’, মান্না দে র ‘কত দূরে আর নিয়ে যাবে বল’, ‘ওগো বর্ষা তুমি ঝরো না গো’, ‘যদি কাগজে লেখ নাম’, ‘এই কূলে আমি আর ওই কূলে তুমি’, উৎপলা সেনের ‘ময়ূরপঙ্খী ভেসে যায়’, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘এলো না সে তো এলোনা’, ‘চল রীনা ক্যাসুরিনার ছায়া গায়ে মেখে’, ‘নীলাঞ্জনা রে’, ‘বেশ তো নাহয় সপ্তঋষির’, দীপক মৈত্রের ‘এতো নয় শুধু গান’, ‘কত কথা হল বলা’, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘বাসরের দীপ আর আকাশের তারা গুলি’, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘বনে নয় মনে মোর’, শ্যামল মিত্রের ‘যদি ডাকো এপার হতে এই আমি আর ফিরব না’, ‘ওই ঝিরি ঝিরি পিয়ালের কুঞ্জে’, ‘সারা বেলা আজি কে ডাকে’, ভূপেন হাজারিকার ‘ও মালিক সারা জীবন কাঁদালে যখন’, পিন্টু ভট্টাচার্যের ‘শেষ দেখা সেই রাতে’, লতা মঙ্গেশকরের ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’, ‘ও পলাশ ও শিমুল’ ইত্যাদি কত যে কালজয়ী গান বেরিয়েছিল গিরিজাপ্রসন্ন মজুমদারের কলম থেকে!

গৌরীপ্রসন্ন ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জুটিতে ছায়াছবিতে এমন সব গান তৈরী হয়েছিল যে শুধুমাত্র গানের জন্যই ছবিটি লাভ করেছিল অসামান্য সাফল্য।

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ও মান্না দে

মান্না দে র সঙ্গে গৌরীপ্রসন্নর পরিচয় হয়েছিল বোম্বেতে। উনি তখন হিন্দী ছবিতে প্লে ব্যাক করতেন। গৌরী প্রসন্ন ওঁকে বাংলা গান গাইতে অনুরোধ করেন। যে কারণে মান্না দে’র বেসিক গানের প্রথম পর্বের গানগুলির অধিকাংশই ওঁর লেখা।

ওঁর লেখা বিশাল গানের ভান্ডারের যত গান উনি লেখার পরে সুর বসেছিল তার চেয়ে অনেক বেশি গানের সুরে ওঁকে কথা বসাতে হয়েছিল। সুরকার অনুপম ঘটককে এ ব্যাপারে উনি গুরু মানতেন গৌরীপ্রসন্ন। ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’ গানটির সুরে কথা বসাবার সময় অনুপম বাবু ধরে ধরে ওঁকে শিখিয়েছিলেন কি ভাবে গানের সুরে কথা বসাতে হয়।

ব্যক্তিগত জীবনে ওঁর মধুর স্বভাবের জন্য উনি অনেক মানুষেরই প্রিয়পাত্র ছিলেন। মহানায়ক উত্তম কুমারের সাথে ওঁর বিশেষ অন্তরঙ্গতা ছিল। উত্তম কুমারের বাড়ীর যে কোন অনুষ্ঠনই ওঁর অনুপস্থিতিতে পূর্ণতা পেতনা। আত্মভোলা স্বভাবের মানুষ ছিলেন। বাড়ির বাইরে বেরোনোর সময় উনি প্রায়ই পকেটে টাকা পয়সা নিয়ে বেরোতে ভুলে যেতেন। কিন্তু কখনোই ভুলতেন না দুটো ফাউন্টেন পেন পাঞ্জাবির পকেটে নিয়ে বেরোতে। প্রায় সময়ই পাঞ্জাবির বুক পকেট ফাউন্টেন পেনের কালিতে কালিমালিপ্ত থাকত এবং সে ব্যাপারে ওঁর কোন ভ্রুক্ষেপ থাকত না। কলকাতায় গানের জগতের অনেক মানুষ ওঁকে দিয়ে কাজ করিয়ে ঠিক মত সম্মানদক্ষিণা দিতনা। নিঃসন্তান ছিলেন। বন্ধুবান্ধবদের সন্তানদের প্রতি প্রকাশ পেত ওঁর অপরসীম অপত্য স্নেহ।

সুরকার নচিকেতা ঘোষের ছেলে সুপর্ণকান্তি ঘোষ ছেলেবেলা থেকে ওঁর স্নেহধন্য ছিলেন গৌরী প্রসন্নর। উনি একদিন দাবি করলেন আড্ডা নিয়ে একটি গান লিখে দিতে। গৌরী প্রসন্ন রাত জেগে লিখলেন ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আর নেই’ গানটি। কিন্তু গানটির শেষ স্তবকটি ঠিক পছন্দ হল না সুপর্ণকান্তির। এনিয়ে দুজনের মধ্যে একটু মনোমালিন্য হল। কদিন পরে নিদারুণ অসুস্থ অবস্থায় গৌরী প্রসন্ন যখন চিকিৎসার জন্য চেন্নাই যাবেন বলে হাওড়া স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন, তখন ওই গানটির শেষ স্তবকের জন্য লেখার বিষয় ওঁর মনে এল। উনি একটা সিগারেটের প্যাকেটের মধ্যের সাদা কাগজে সেটি লিখে ওঁর পরিচিত এক ব্যক্তিকে দিয়ে সুপর্ণকান্তির কাছে পাঠিয়ে দিলেন। বাংলা গানের শ্রোতামাত্রেই জানেন, কি অসাধারণ এক সৃষ্টি সেদিন হয়েছিল। মজার কথা হচ্ছে, এই গানটির গীতিকার বা সুরকার কেউই কোনদিন কফি হাউসে যাননি।

প্রায় দু মাস ধরে তাঁর ক্যান্সারের চিকিৎসা হয়েছিল। কিন্তু সেই চিকিৎসায় ওঁর শরীর সাড়া দেয়নি। শেষ পর্যন্ত ১৯৮৬ সালের ২০শে আগস্ট ওঁর জীবনাবসান হয় গৌরী প্রসন্নর। শরীর ক্রমশ খারাপ হতে থাকলেও ওঁর কলম থেমে থাকেনি। রোগশয্যায় শুয়েও তিনি দুটি গান লিখেছিলেন, ‘যেতে দাও আমায় ডেকোনা’ আর ‘এবার তাহলে আমি যাই/সুখে থাক ভাল থাক/মন থেকে এই চাই’।

সেরা গীতিকার হিসেবে বি এফ জে এ পুরস্কার পেয়েছেন গৌরী প্রসন্ন ১৯৬২ সালে স্বরলিপি, ১৯৬৪ সালে পলাতক, ১৯৬৮ সালে এন্টনি ফিরিঙ্গি, ১৯৭৪ সালে বন পলাশীর পদাবলী, ১৯৭৬ সালে সন্ন্যাসী রাজা ছায়াছবির জন্য। মৃত্যুর পরে ১৯৮৭ সালে সেরা গীতিকার হিসেবে বি এফ জে এ পুরস্কারের জন্য তাঁর নাম ঘোষিত হয় ‘অনুরাগের ছোঁয়া’ ছায়াছবির জন্য।

১৯৬২ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে একটি অভিনব পুজোর গান প্রকাশিত হয়েছিল। ‘তার আর পর নেই, নেই কোন ঠিকানা’।গানটির শুরুতে আর দুটি অন্তরার শেষে একটি নারী কন্ঠের সংলাপ ছিল। নারী কণ্ঠটি, জানা গিয়েছিল, হিন্দী ছবির একজন অভিনেত্রী চাঁদ ওসমানীর। গানটি অসাধারণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। গানটির গীতিকার ছিলেন মুকুল দত্ত, সুরকার নচিকেতা ঘোষ। এই চাঁদ ওসমানী ছিলেন মুকুল দত্তর সহধর্মিণী।

মুকুল দত্ত

এই মুকুল দত্ত ছিলেন তদানীন্তন বাংলা গানের আর একজন উল্লেখযোগ্য গীতিকার।
মুকুল দত্ত বিংশ শতাব্দীর ষষ্ঠ থেকে নবম দশক পর্যন্ত বাংলা আধুনিক গান ও ছায়াছবির গানের জগতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। ১৯৩০ সালের ২৭ শে নভেম্বর মধ্যপ্রদেশের রেওয়ায় জন্মগ্রহণ করেন।কৈশোর খড়গপুরে। পড়াশুনা সেখানকার ইন্ডিয়ান (বর্তমান রেলওয়ে) হাই স্কুলে। ইন্টারমিডিয়েট মধ্যপ্রদেশের বিলাসপুরে। স্নাতক বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে। এম. এ.কলকাতায়। প্রথমে খড়গপুর সিলভার জুবিলি হাই স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। তারপর ছায়াছবির জগতে আসেন। বিমল রায় ও হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের সহকারী পরিচালক হিসাবে কাজ করেন। গীতিকার হিসেবে একসময় উনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের খুব ঘনিষ্ঠ হন। উল্লিখিত গানটি প্রকাশিত হবার কিছু পরে ওই রকমই আর একটি গান উনি লিখেছিলেন, যেটি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে গেয়েছিলেন তালাত মামুদ সঙ্গে সহশিল্পী ছিলেন অভিনেত্রী রাখী বিশ্বাস।
মুকুল দত্তর কথায় কিছু পুজোর গানের তালিকা নিচে দিলাম।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘ফেরানো যাবেনা আর চোখ তার নীল চোখ থেকে’, ‘বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও’, ‘হাজার বছর ধরে, কোন পাখী ধরা দিতে চায়’, ‘তুমি এলে অনেক দিনের পরে যেন বৃষ্টি এলো’, লতা মঙ্গেশকরের ‘ভালোবাসার আগুন জ্বেলে’, কিশোর কুমারের ‘একদিন পাখী উড়ে’, ‘বাবা ও খোকা’, ‘আমার পূজার ফুল’, ‘সে যেন আমার পাশে’, ‘চোখের জলের হয়না কোন রঙ’, ‘কেন রে তুই চড়লি ওরে’, ‘নয়ন সরসী কেন’, ‘এই যে নদী’, ‘সে তো এলোনা’, ‘চলেছি একা’, ‘আমি নেই’, ‘তার আমি চোখে দেখিনি’, ‘তোমায় পড়েছে মনে’, ‘আজ থেকে আর ভালবাসার’, ‘জড়িয়ে ধরেছি যারে, ‘মন জানলা খুলে দে না’ ইত্যাদি।

সেরা গীতিকার হিসাবে ফুলেশ্বরী ছায়াছবির জন্য ১৯৭৫ সালে বি এফ জে এ পুরস্কার পেয়েছেন মুকুল দত্ত।

বাংলার বাইরে জন্ম,পড়াশুনা এবং জীবনের বেশীর ভাগ সময় বাংলার বাইরে কাটানো সত্বেও বাংলা গানের জগতে তাঁর ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়


এরপর আধুনিক বাংলা গানের জগতে যাঁর কথা আসবে তাঁর নাম পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়।
কিছুটা পরে বাংলা গানের জগতে এলেও পুলক বাবুর অগ্রজ রীতিমত প্রতিষ্ঠিত অনেক গীতিকার, বিশেষ করে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের সাথে পাল্লা দিয়ে অসংখ্য গান লিখে তিনিও একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে উঠেছিলেন। ওঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায়না।কিন্তু অসংখ্য গল্প জানা যায় ওঁর গান রচনার পটভূমি নিয়ে।

১৯৩১ সালের ২রা মে হাওড়া জেলার সালকিয়ার এক সংস্কৃতিমনস্ক পরিবারে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম। পরিবারে সাহিত্য, নাটক আর গানের বিশেষ চর্চা ছিল। ছোট বেলা থেকেই কবিতা লেখার অভ্যাস ছিল। পঞ্চম বা ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময়েই একটা কবিতা লিখে পাঠিয়েছিলেন আনন্দমেলায়। সেটা মনোনীত হয়েছিল এবং উনি পাঁচ টাকা সম্মান দক্ষিণা পেয়েছিলেন মানি অর্ডারে। ১৭ বছর বয়সে দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় ‘অভিমান’ নামের এক ছায়াছবির জন্য গান লিখেছিলেন। উনি হাওড়ার অ্যাংলো স্যান্সক্রিট স্কুলে পড়তেন। পরে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বাংলা অনার্স নিয়ে স্নাতক হয়েছিলেন।

পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, মান্না দে ও অন্যান্যরা

গানের জগতে আসার খুব অল্প দিনের মধ্যে তিনি অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, নচিকেতা ঘোষ, সুধীন দাশগুপ্ত, রতু মুখোপাধ্যায় প্রমুখ সুরকারদের সঙ্গে ওঁর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। সুরকার ও শিল্পী হিসেবে মান্না দে’র সঙ্গে প্রগাঢ় ঘনিষ্ঠ একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ওঁর। শঙ্খবেলা ছবির সুরকার ছিলেন সুধীন দাশগুপ্ত। তিনি নায়কের কন্ঠের গান কিশোর কুমারকে দিয়ে গাওয়াতে চেয়েছিলেন। পুলক বাবু মান্না দে’র নাম প্রস্তাব করেছিলেন। সেই সূত্রে নায়ক উত্তম কুমারের কণ্ঠে প্রথম মান্না দে’র গান ব্যবহার করা শুরু হয়। মান্না দে’র আধুনিক বাংলা গানের দ্বিতীয় পর্বে প্রায় সব গানেরই গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। এক সময় গীতিকারদের নিয়ে আকাশবাণী এবং এইচ এম ভি’র মধ্যে বিতর্ক হয়েছিল। তখন পুলক বাবু প্রিয়ব্রত ছদ্মনামে কিছুদিন গান লিখেছিলেন। ক্ষণিক মুহূর্তের কোন ঘটনার অভিঘাতে ওঁর কলম থেকে গান বেরিয়ে আসত। প্রায় চার হাজার গান লিখেছিলেন।

পুলক বন্দ্যোপাধ্যাযয়ের লেখা পূজোর গানের অল্প কিছু গানের তালিকা নিচে দিলাম।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘কোনদিন বলাকারা’, ‘কত রজনীর ভুল ভাঙাতে’, ‘ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলোনা’, ‘সেদিন তোমায় দেখেছিলাম ভোরবেলা’, লতা মঙ্গেশকরের ‘রঙ্গিলা বাঁশিতে’, ‘আমার মালতী লতা’, অখিলবন্ধু ঘোষের ‘তোমার ভুবনে ফুলের মেলা’, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তোমায় কেন লাগছে এত চেনা’, ‘মেঘলা ভাঙা রোদ উঠেছে’, তোমার দুচোখে আমার স্বপ্ন আঁকা’, ‘বড় সাধ জাগে একবার তোমায় দেখি’, মান্না দে’র ‘জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই’, ‘সেই তো আবার কাছে এলে’, ‘তুমি অনেক যত্ন করে’, ‘দরদী গো’, ’ললিতা ওকে আজ চলে যেতে বলনা’, ‘কথায় কথায় যে রাত হয়ে যায়’, ‘যখন কেউ আমাকে পাগল বলে’, ‘আমার ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে’, ‘ও নদী এমন নদী’, ‘দীপ ছিল শিখা ছিল’, ‘রাত জাগা দুটি চোখ’, ‘একি অপূর্ব প্রেম দিলে বিধাতা আমায়’, ‘ছয় ঋতুর গান’, ‘সে আমার ছোট বোন’, ‘মাগো আমি এলাম তোমার কোলে’, ‘আমায় একটু জায়গা দাও’, হৈমন্তী শুক্লার ‘আমার বলার কিছু ছিলনা’, নির্মলা মিশ্রের ‘এ মন মোর জানিনা’, ‘উন্মনা মন স্বপ্ন মগণ’ ইত্যাদি।

অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে মানসিক অবসাদে ১৯৯৯ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর তিনি আত্মবিসর্জন দেন।

শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়

বাংলা গানের আর এক উল্লেখযোগ্য গীতিকার শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিংশ শতাব্দীর পঞ্চম দশকে আকাশবাণীর অনুরোধের আসরে বিখ্যাত গায়ক অপরেশ লাহিড়ীর কণ্ঠে একটি গান প্রায়ই বাজত। ‘হাট বাজারে পথে ঘাটে, ইস্টিশনে শ্মশান ঘাটে,যেখানে যাও লাইন লাগাও’। ছোট বয়সে গানটা শুনে বেশ মজা লাগত। পরে জেনেছি, খাদ্য আন্দোলনের পরে দেশের মানুষকে সর্বত্র লাইন দিতে হত, যেটা তাদের কাছে একটা নতুন অভিজ্ঞতা ছিল। সেই সময়ের মানুষের মনের বিরক্তির প্রকাশ ওই গানে করেছিলেন গীতিকার শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।

১৯৩২ সালের ২৭শে ডিসেম্বর বাংলাদেশের ভৈরব নদ ও রূপসা নদী পরিবেষ্ঠিত খুলনা শহরে শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শচীগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন পুলিশ অফিসার এবং মা রাধারাণী দেবী ছিলেন স্বদেশী আন্দোলনের একজন যোদ্ধা। দেশভাগের অস্থির সময়ে শরণার্থী হয়ে কলকাতায় আসেন। আশ্রয় পেয়েছিলেন দিদি শিবানী চট্টোপাধ্যায়ের কলকাতার বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে। দিদি ছিলেন প্রতিষ্ঠিত প্রাবন্ধিক ও চিত্রগ্রাহিকা। কলকাতার আশুতোষ কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে শিবদাস কিছুদিনের মধ্যে খানপুর স্কুলে সামান্য মাইনের শিক্ষকতার চাকরি পান। দিদির অনুপ্রেরণায় লেখালেখি শুরু করেন আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয়, দেশ, বসুমতী প্রভৃতি বিভিন্ন পত্রিকায়। বিভিন্ন সময়ে তিনি নানা রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন।

গীতিকার হিসাবে তাঁর প্রথম অবদান ছিল অপরেশ লাহিড়ীর অনুরোধে আর এস পি দলের একটি অনুষ্ঠানের জন্য উদ্বোধনী সঙ্গীত লিখে দেওয়া। লিখলেন, ‘এই কি পৃথিবী সেই? যেথায় আশার আলো ছলনা করে’। গানটি সেই অনুষ্ঠানে গাওয়া হয়েছিল অপরেশ লাহিড়ীর সুরে। পরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গানটি রেকর্ড করেন। পঞ্চাশের দশকে দমদম মতিঝিলের এক সাহিত্য সভায় কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের সাথে শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলাপ হয়। প্রেমেন্দ্র মিত্রই তাঁকে নিয়ে গিয়ে আকাশবাণীর তালিকাভুক্ত গীতিকার করে দিয়েছিলেন।

এরপর এইচ এম ভি থেকে তাঁর কথায় এবং অনল চট্টোপাধ্যায়ের সুরে সনৎ সিংহের কণ্ঠে ‘সরস্বতী বিদ্যেবতী’ গানটি প্রকাশিত হয়।১৯৫৫ সালে ভি বালসারার সুরে শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় অপরেশ লাহিড়ীর কণ্ঠে ওই বিখ্যাত গান ‘লাইন লাগাও লাইন লাগাও’ গানটি প্রকাশিত হয়।

ভূপেন হাজারিকা ও শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়


জীবনের গভীর মূল্যবোধ থেকে ভূপেন হাজারিকার জন্য লিখেছিলেন ‘মানুষ মানুষের জন্যে’, ‘হে দোলা হে দোলা’, ‘আমি এক যাযাবর’, ‘বিস্তীর্ণ দুপারে’, ‘গঙ্গা আমার মা’, ‘আজ জীবন খুঁজে পাবি’, ‘সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ’ ইত্যাদি গান। ক্যালকাটা ইউথ কয়ারের জন্য লিখে ছিলেন, ’ভারতবর্ষ সূর্যের এক নাম, যে গানটিতে সুর দিয়েছিলেন ওয়াই এস মুলকি।

তাঁর সুরে কিছু পুজোর গানের তালিকা নিচে দিলাম।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ‘মায়াবতী মেঘে এল তন্দ্রা’, ইলা বসুর ‘আকাশের সিঁড়ি বেয়ে যখন সন্ধ্যা-মেয়ে’, ‘একটি গল্প লিখো আমায় নিয়ে তুমি’, ‘কত রাজপথ জনপথ ঘুরেছি’, কিশোর কুমারের ‘প্রেম বড় মধুর কভু কাছে কভু সুদূর’, ‘সেই রাতে রাত ছিল পূর্ণিমা’, রুমা গুহ ঠাকুরতার ‘একখানা মেঘ ভেসে এল আকাশে’, সনৎ সিংহের ‘যদি কেউ কোনদিন যাও রেলগাড়ি চড়ে’ ইত্যাদি।

একদিকে তাঁর গানে যেমন সাধারণ মানুষের সমস্যার কথা উঠে এসেছে, তেমনি রোমান্টিক গানেও তিনি সমান স্বচ্ছন্দ ছিলেন। ২০০৯ সালের ৮ ই আগস্ট তাঁর জীবনাবসান হয়।

বাংলা আধুনিক গানের গীতিকারদের মধ্যে আর যাঁদের অসামান্য ভূমিকা আছে তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য হলেন সলিল চৌধুরী এবং সুধীন দাশগুপ্ত। এঁরা দুজনেই একাধারে সুরকার ও গীতিকার। এরপরেই নাম আসে সলিল চৌধুরীর ভাবশিষ্য তিনজন – অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, অনল চট্টোপাধ্যায় এবং প্রবীর মজুমদার। এঁরাও ছিলেন গীতিকার – সুরকার। এঁদের সম্বন্ধে পরে কখনো আলোচনার ইচ্ছে রইল।

[তথ্যসূত্র- আন্তর্জাল]

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x