রবিচক্রের “বাংলার শারদ অর্ঘ্যের গান” বিষয়ক সংখ্যাটিতে (১ অক্টোবর ২০২৪) ‘বাংলা গানের উজ্জ্বল কারিগরদের কথা লিখেছিলাম। প্রকাশ-পরবর্তী অনুভবে ও পর্যালোচনায় বুঝেছিলাম, লেখাটির প্রতি পূর্ণ সুবিচার করতে পারিনি, কারণ এই আলোচনায় যাঁদের উপস্থিতি অনিবার্য ছিল, তাঁদের নিয়ে যথাসাধ্য আলোচনা করার চেষ্টা সত্ত্বেও লেখাটি দীর্ঘায়ত হয়ে যাবার আশঙ্কায় উল্লেখযোগ্য কতিপয় আমার পূর্ববর্তী লেখায় অন্তরালে বা অনালোচিত থেকে গেছেন। সুতরাং তাঁদের নিয়েই আমার দ্বিতীয় পর্বের অবতারণা।
এই পর্বের প্রথমেই আসি গীতিকার মিল্টু ঘোষের কথায়। বাংলা গানের স্বর্ণযুগে উনিও গীতিকার হিসাবে বেশ কিছু অবদান রেখে গেছেন। ওই সময়কার সঙ্গীত জগতের সব মানুষের মধ্যে সম্ভবত সব থেকে বেশী দিন আমাদের মধ্যে ছিলেন। এই বছরের ২৯শে ফেব্রুয়ারি (২০২৪) ওঁর জীবনাবসান হয়।
১৯৩৬ সালের ১লা অক্টোবর বেলেঘাটার এক যৌথ পরিবারে মিল্টু ঘোষের জন্ম হয়। বঙ্গবাসী কলেজ থেকে স্নাতক হবার পর রাজ্য সরকারের পরিবহণ দপ্তরে চাকরি করতেন। স্কুল কলেজে পড়ার সময় চুটিয়ে ফুটবল খেলেছেন। যদিও ছোটবেলা থেকে গান, কবিতা লেখার অভ্যাস ছিল, কোনদিন গীতিকার হবেন এমন ভাবনা কিন্তু স্বপ্নেও ছিলনা। ১৯৫৬ সালে গানের এক প্রতিযোগিতার আসরে পরিচয় হয়েছিল বিচারক সুধীন দাশগুপ্তর সঙ্গে। তখন ওঁকে কয়েকটা গান লিখে তাঁর সিঁথির বাড়িতে পৌঁছে দিতে বলেছিলেন সুধীন বাবু। চারটে গান লিখে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন, তার মধ্যে সুধীন বাবুর একটি গান পছন্দ হয়েছিল। সেই ‘কাজল কাজল কুমকুম’ গানটি সুধীনবাবু গীতা দত্তকে দিয়ে রেকর্ড করিয়েছিলেন। সেই থেকে গান লেখা শুরু হল। তার কিছুদিন পরেই যোগাযোগ হয় গ্রামোফোন কোম্পানীর সঙ্গে। প্রায়ই যেতেন বাঁশদ্রোণীতে অপরেশ লাহিড়ীর বাড়িতে। সেখানে সঙ্গীত জগতের অনেক গুণী মানুষদের আড্ডা বসতো। সেখানে নানা আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে উঠে আসত নতুন নতুন আইডিয়া। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কাছে অনেক কিছু শিখেছিলেন। ষাঠের দশকে হেমন্ত বাবুর সঙ্গীত পরিচালনায় ‘অজানা শপথ’ ছবির জন্য গান লিখেছিলেন। সেইসব গান খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। অসীমা ভট্টাচার্য ‘চৌরঙ্গী’ ছবির সংগীত পরিচালনা করেছিলেন। সেই ছবিতে ওঁর লেখা মান্না দে’র কণ্ঠে ‘বড় একা লাগে’ এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘কোনদিন হবেনা সুদূর’ গান দুটিও অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল। এছাড়া উনি ‘রেঞ্জার সাহেব’ এবং ‘প্রথম প্রেম’ ছবির জন্যও গান লিখেছিলেন।
ওঁর লেখা পুজোর গানের তালিকায় রয়েছে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘সেই চোখ কোথায় তোমার’, ‘যদি আমাকে দেখ তুমি উদাসী’, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তোলপাড় তোলপাড় মনের কথা’, ‘দোল দোল চতুর্দোলায় চড়ে আহা’, ‘ম্যাগনোলিয়া আর ক্যামেলিয়ার ফুল’, মৃণাল চক্রবর্তীর ‘কেন জানিনা যে শুধু তোমার কথাই মনে পড়ে’, অমল মুখোপাধ্যায়ের ‘টগবগ টগবগ টগবগ টগবগ ঘোড়া ছুটিয়ে’, ইলা বসুর ‘বেলোয়ারি কাচের চুড়ি’, ’মধুর মুরলী কেন আর’, মুকেশের ‘মন্দ বলে লোকে বলুক না’, পিন্টু ভট্টাচার্যের ‘এক তাজমহল গড়ো হৃদয়ে তোমার’, ‘ফিরে যেতে চাই যেতে চাই’, ’জানিনা কখন যে সে’, মান্না দে-র ‘তুই কি আমার সেই পুতুল পুতুল মেয়ে’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘জীবনের অনেকটা পথ’ ইত্যাদি।
উপরের এই গানের তালিকা দেখলে বোঝা যায় ষাঠের দশকে বাংলা গানের সেরা গীতিকারদের সাথে পাল্লা দিয়ে মনে রাখার মত কম গান লেখেননি মিল্টু ঘোষ।
Photo – 2 (Miltu Ghosh ABP)
প্রসঙ্গত জানাই, মিল্টু ঘোষের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন শ্রী কৃশানু ভট্টাচার্য। আনন্দবাজার পত্রিকায় সেই সাক্ষাৎকার, ‘বড় একা লাগে’ প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৫ সালের ১৭ই অক্টোবর। মিল্টু বাবুর ব্যক্তিগত জীবনের প্রয়োজনীয় তথ্যটুকু আমি সেখান থেকে পেয়েছি। কৃশানু আমাদের রবিচক্রের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং আদরণীয় মানুষ। তাঁকে আমি অন্তরের কৃতজ্ঞতা জানাই।
এবার আমি আমার একজন অত্যন্ত প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় গীতিকারের কথায় আসব, যাঁকে নিয়ে তেমন কোন কৌতুহল প্রায় নেই সঙ্গীত জগতে। অথচ তাঁর লেখা খুব জনপ্রিয় গানের তালিকা পেশ করলে বোঝা যাবে তিনি কোন মানের গীতিকার ছিলেন। এই গানগুলি সৃষ্টি হিসাবে খানিকটা বোরোলিন বা ডেটলের মত, যাদের উৎপাদক কারা তা নিয়ে ব্যবহারকারীদের কোন মাথাব্যথা নেই। তারা নিজস্ব মহিমায় উজ্জ্বল।
একরকম নীরবে তিনি আধুনিক বাংলা গানকে তাঁর সৃষ্টি দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছেন কোন প্রতিদানের প্রত্যাশা না করে। তিনি হলেন পবিত্র মিত্র। তিনিও বাংলা গানের স্বর্ণযুগের একজন বিশিষ্ট গীতিকার হিসাবে স্বীকৃত হবার দাবি রাখেন।
ওঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে শুধু একটি বাক্য জানা যায় যে তিনি এইচ এম ভি কোম্পানীর রেকর্ডিং ম্যানেজার ছিলেন। এমন কি, অন্তর্জালে তাঁর ছবির সন্ধান করেও আমাদের হতাশ হতে হয়েছে। তাঁকে স্মরণ করার জন্যে একটিমাত্র অস্বচ্ছ ছবিই আমাদের সম্বল।
সে যুগে আপাদমস্তক সঙ্গীতানুরাগী এই মানুষটি গানের ব্যাপারে ছিলেন খাঁটি জহুরী। কোন গান কাকে দিয়ে গাওয়ালে ভাল হবে,এই পরামর্শ তিনি সুরকারদের প্রায়ই দিয়ে থাকতেন বলে শোনা যায়। সুরকাররা সেটা মেনেও নিতেন। ওঁর লেখা যেসব গান কালের সীমা পেরিয়ে চিরনতুন হয়ে রয়েছে তার একটা তালিকা নিচে দিলাম।
লতা মঙ্গেশকরের ‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে’, ‘কত নিশি গেছে নিদহারা ওগো’, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘শুধু অবহেলা দিয়ে বিদায় করেছ যারে’, আলেয়ার মত কেন তারে’, ‘পথে যেতে যেতে ফিরে ফিরে চাই ‘, ‘ক্লান্ত চাঁদের নয়নে ঘুম’, শ্যামল মিত্রের ‘সেদিনের সোনা ঝরা সন্ধ্যায়’, তুমি আর আমি শুধু জীবনের খেলাঘর’, ‘এই আঁধারে আমি চলে গেলে’, ‘এই পথে যায় চলে’, ‘কেন ডাকো তুমি মোরে’, ‘এই মন সেই গান গেয়ে যায়’, ‘ভালবাস তুমি শুনেছি অনেকবার’, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘গানের সুরে কাহারে ওগো’, ‘আমার হৃদয় নিয়ে আর কতকাল বল’, বারে বারে কে যেন ডাকে আমারে’, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ‘আমি তো তোমারি কাছে রয়েছি’, ‘কত বার আমি বলেছি তোমারে’, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কাজল নদীর জলে’, উৎপলা সেনের ‘সপ্ত রঙের খেলা আকাশ পারে’, গায়ত্রী বসুর ‘কেন এলে মধুরাতি’, ‘আঁধারে প্রদীপ মোর’, ‘এ মন কেমন করে জেনেছে’, ইলা বসুর ‘তোমারেই বেসেছি ভাল’, ‘এমন করে কেন সাজালে আমারে’, তালাত মামুদের ‘যে মালা শুকায় যে খেলা ফুরায়’, ‘তোমার আকাশ ভরে আলোর মাধুরী আছে ছড়ায়ে’, আশা ভোঁসলের ‘আমার জীবনে তুমি’, ‘আকাশের দুটি তারা’, ‘আমি সুখে আর দুখে যে মালা গেঁথেছি’, ‘তোমার মনের সুধা’, মহম্মদ রফির ‘ওই দূর দিগন্ত পারে’, ‘এ জীবনে যদি আর কোনদিন’ ইত্যাদি।
পবিত্র মিত্রের লেখা গানের সুরকারদের গন্ডীও খুব সীমিত। সুধীরলাল চক্রবর্তী, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র এবং শৈলেন মুখোপাধ্যায়। আর শেষ ছ’টি গানের সুরকার ছিলেন বিনোদ চট্টোপাধ্যায়, যিনি নিজেও খুব কম আলোচিত। এই ছ’টি গানের মধ্যে তিনটি গান, মনে হয়, অতি অল্পশ্রুত। আমার পাঠকদের আমি গানগুলি শোনার জন্য অনুরোধ করব। কথা, সুর এবং গায়কী, এই তিনের সম্পৃক্ত দ্রবণে কি অসাধারণ উপভোগ্য এই গানগুলি, আপনারা অনুভব করতে পারবেন আশাকরি। পবিত্র বাবুর গান খুঁজতে গিয়ে পুজোর গানের জগতে সুরকার শ্যামল মিত্রের কতটা ব্যাপ্তি, সেটাও জানতে পেরেছি।
হয়তো কোনদিন কোন অনুসন্ধানী মানুষ ওঁর ব্যক্তিজীবনের কথা খুঁজে বার করে সঙ্গীতপ্রেমী মানুষদের দরবারে পেশ করবেন। ততদিন ওঁর লেখা গানগুলিই ওঁর পরিচয় বহন করে চলবে।
এবার বাংলা বেসিক তথা পূজোর গানের জগতে এক বিস্ময়কর প্রতিভার কথায় আসব, যিনি তাঁর স্বল্প সময়ের জীবনে বাংলা গানকে বৈচিত্র্যময় নানা সৃষ্টি দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছেন। তাঁর সুরে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সঙ্গে ভারতীয় সঙ্গীতের বিভিন্ন ধারার মেলবন্ধন ঘটেছিল। তিনি হলেন সুধীন দাশগুপ্ত। গীতিকার হিসাবেও তাঁর অবদান বড় কম নয়।
১৯২৯ সালের ৯ই অক্টোবর দার্জিলিঙে সুধীন দাশগুপ্তের জন্ম হয়। তাঁর পোষাকী নাম ছিল সুধীন্দ্রনাথ। তাঁর বাবা মহেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত দার্জিলিং গভর্নমেন্ট স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তাঁদের আদি নিবাস ছিল যশোহরের কালিয়া গ্রামে। মা স্নেহময়ী দেবী ছিলেন একজন সমাজকর্মী। সুধীন বাবুর ভাই বোনদের প্রত্যেকেই গানবাজনার জগতের মানুষ। বড়দা ভায়োলিন বাজাতেন। মেজদা অবনীন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে গান শিখেছেন। সুধীন বাবু ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতে পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি সমান দক্ষতার সঙ্গে সেতার, সরোদ, হারমোনিয়াম, পিয়ানো, ম্যান্ডোলিন, গীটার, বেহালা, এস্রাজ প্রভৃতি এবং তবলা ও ড্রামের মত তালবাদ্য বাজাতে পারতেন।
৩০শের দশকের শেষ কিংবা ৪০শের দশকের শুরুতে জলপাইগুড়ির নবাব কন্যা বেগম জব্বার এক শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সন্ধ্যার আয়োজন করেছিলেন। অনুষ্ঠানের প্রথম দিনে বিখ্যাত সেতার বাদক উস্তাদ ওয়ালিউল্লাহ খান সাহেব তাঁর পছন্দের একটা রাগ বাজিয়েছিলেন। পরের দিন ওই রাগটিই হুবহু খান সাহেবের কায়দায় তাঁকেই বাজিয়ে শুনিয়ে দিল স্কুলের গন্ডী না পেরোনো এক অনামা শিল্পী। সেই অনামী শিল্পী ছিলেন সুধীন দাশগুপ্ত। খান সাহেব চমকিত। মুগ্ধ বেগম জব্বার। কী আশ্চর্য অনুকরণ! বাজানো শেষ। পুরস্কার পেলেন একটি রত্ন খচিত সেতার। সেটা তুলে দিয়ে বেগম বললেন, ‘আমি তোমার কাছে সেতারে তালিম নিতে চাই ‘।
অথচ সেই সময়ে সেতারে তাঁর প্রথাগত শিক্ষাই ছিলনা। উস্তাদ এনায়েত খান সাহেবের সেতার শুনে শুনে সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় নাকি তিনি সেতার শিখেছিলেন। ভাতখন্ডেজীর রাগ সঙ্গীত বিষয়ক গ্রন্থ অনুসরণ করে ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের চর্চা করেছিলেন কিছুদিন।
বিখ্যাত কীর্তনিয়া ভূপেন্দ্র বসু, রথীন ঘোষ দার্জিলিঙে গেলে ওঁদের বাড়িতেই উঠতেন। বাড়িতে কীর্তনের আসরে কীর্তন গাইতেন সুধীন বাবু। আবার দার্জিলিঙে থাকাকালীনই ক্যাপ্টেন ক্লিভার, জর্জি ব্যাঙ্কস, রবার্ট কোরিয়ার কাছে পিয়ানো শিখেছেন। ছেলের সঙ্গীতে এত আগ্রহ দেখে ওঁর বাবা ওঁকে লন্ডনের রয়াল মিউজিক স্কুলে পাঠিয়ে দেন। সেখান থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করে সুধীন বাবু দেশে ফেরেন।
১৯৪৯-৫০ সালে দার্জিলিঙে বিরাট ধ্বসের কারণে সুধীন বাবুদের পরিবারকে কলকাতায় স্থানান্তরিত হতে হয়। ওঁরা ভাইবোনেরা ব্রিটিশ দার্জিলিঙে আদ্যন্ত সাহেবী পরিবেশে বড় হয়েছিলেন। সুধীন বাবু অনেকদিন অবধি বাংলা জানতেন না মোটেই। কলকাতায় আসার পরেও ওঁরা ভাইবোনেরা কখনো একত্রিত হলে নিজেদের মধ্যে আড্ডা দিতেন নেপালী ভাষায়। সুধীন বাবুদের পরিবারের বহুদিনের সঙ্গী ছিলেন এক বাহাদুর। সুধীন বাবু তাঁর সঙ্গে কথা বলতেন নেপালী ভাষায়। আর বাহাদুর তাঁকে জবাব দিতেন বাংলায়। সুধীন বাবু বাংলা শিখেছিলেন রীতিমত শিক্ষক রেখে।
খেলাধুলায় তিনি সমান পারদর্শী ছিলেন। কলকাতায় আসার পর তিনি ভবানীপুর ক্লাবে হকি দলের সদস্য ছিলেন। ব্যাডমিন্টনে তিনবার রাজ্য চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। চোখের সমস্যার জন্য তিনি খেলার জগৎ থেকে সরে আসেন। না হলে হয়তো খেলার জগতেও সোনা ফলাতে পারতেন।
কলকাতায় আসার পর তিনি সোজাসুজি এইচ এম ভি র লিটন স্ট্রীটের দপ্তরে যোগাযোগ করেন। সেখানে তিনি কমল দাশগুপ্তর সহকারী হিসাবে কাজে যোগ দেন। এছাড়া আই পি টি এর উত্তর কলকাতার স্কোয়াডেও যোগ দিয়ে তিনি ওই শাখার জন্য গান তৈরীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এইচ এম ভি-র ক্ষিতীশ বসু তাঁকে আধুনিক বাংলা গান তৈরীর সুযোগ দেন। ১৯৫৩ সালে প্রথম বার তাঁর সুরে, বেচু দত্তের কণ্ঠে ‘কত আশা কত ভালবাসা’ ও ‘কোন আকাশ হতে’ শীর্ষক দুটি গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। ১৯৫৪ সালে সুবীর সেনের কণ্ঠে তাঁর লেখা প্রথম গান ‘এত সুর আর এত গান’ প্রকাশিত হয়।
এই প্রসঙ্গে বলি,কলকাতায় আসার পরে উনি অনেক স্বনামধন্য গীতিকারদের কাছে যেতেন। তাঁদের বাড়িতে চা খাওয়া চলত, আড্ডাও হত। কিন্তু গানের প্রসঙ্গ এলেই তাঁরা এড়িয়ে যেতেন। জেদ চেপে গিয়েছিল সুধীন বাবুর। অনেকটা এই জেদ থেকেই তাঁর গান লেখা শুরু হয়েছিল।সেই সময় প্রচুর কবিতার বই পড়া শুরু করেছিলেন। সলিল চৌধুরীর মত তিনিও প্রতিষ্ঠিত কবিদের কবিতায় সুর করেছিলেন। যতীন্দ্র মোহন বাগচীর ‘বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই’, যতীন্দ্র নাথ সেনগুপ্তর ‘থই থই শ্রাবণ এলো ওই’, বটকৃষ্ণ দে র ‘কৃষ্ণচূড়া আগুন তুমি’ কবিতাগুলিতে তিনি সুর করেছিলেন।
আই পি টি এর জন্য লিখেছিলেন ‘ওই উজ্জ্বল দিন,ডাকে স্বপ্নরঙীন’, স্বর্ণঝরা সূর্য রঙে’, ‘এই ছায়াঘেরা কালো রাত’ ইত্যাদি গান। ১৯৫৬ সালে সুবীর সেনের দ্বিতীয় রেকর্ডে উপরোক্ত প্রথম দুটি গান প্রকাশিত হয়। সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘ঠিকানা’ কবিতায় প্রথম সুর দিয়েছিলেন সুধীন দাশগুপ্ত। তাঁর গানের দল নিয়ে আই পি টি এর বিভিন্ন সম্মেলনে, মেডিক্যাল কলেজের সোশ্যালে, যুব উৎসবে, মার্কাস স্কোয়ারের বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে তিনি এই গানটি পরিবেশন করেছেন। পরে সলিল চৌধুরী ওই গানে সুর দিয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে রেকর্ড করান।
তাঁর নিজের কণ্ঠে গাওয়া একমাত্র রেকর্ডে লোক গানের সুরে ‘কোকিল কাঁদে কেন ফাগুনে’ এবং জ্যাজের সুরে ‘লাল লাল চোখে দেখি’ গান দুটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬১ সালে।
সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে প্রথম ছায়াছবি ‘ উল্কা ‘ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৭ সালে। ১৯৫৮ সালে মুক্তি পেয়েছিল দ্বিতীয় ছায়াছবি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘ ডাক হরকরা ‘। গান লিখেছিলেন স্বয়ং তারাশঙ্কর ‘ ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায় আমি বসে আছি ‘। সুধীন বাবুর সুরে মান্না দে সেই গান গেয়ে চিরস্মরণীয় করে দিয়েছেন। আজও সেই গান স্তব্ধ হয়ে শুনতে হয়। কিভাবে সেই হৃদয় মোচড়ানো সুর তৈরী করেছিলেন সুধীন দাশগুপ্ত তার উত্তর পেতে হলে তাঁর জীবনের একটি অধ্যায়ে যেতে হয়। ওঁর বন্ধু ও সহকারী প্রশান্ত চৌধুরী এক সময় কৃষ্ণনগর থেকে দমদম রোজ যাতায়াত করতেন। যাত্রাপথে অনেক বাউলের সাথে তাঁর পরিচয় হত। তিনি তাঁদের সুধীন বাবুর বাড়িতে নিয়ে আসতেন। সুধীন বাবু তাঁদের সারাদিন তাঁর বাড়িতে রেখে সারাদিন ধরে তাঁদের গান শুনতেন। সেই সব গানের প্রভাবে তিনি ‘ ডাক হরকরা ‘ ছবিতে সুর তৈরী করেছিলেন। অনেকদিন পরে ১৯৭৫ সালে একই ভাবে ‘হংসরাজ’ ছবিতে উনি তৈরী করেছিলেন ‘শহরটার এই গোলকধাঁধায় আঁধার হল মন ‘।
‘ডাক হরকরা’ ছবির সূত্রে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ওঁর অন্তরঙ্গতা তৈরি হয়। প্রতি বছর ২৪ শে জুলাই তারাশঙ্কর বাবু ওঁর জন্মদিনে ওঁর বাড়িতে একটি সঙ্গীত অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। তাতে অনেক বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পীরা আমন্ত্রিত হতেন। ওই ছবি তৈরি হবার পর থেকে সুধীন বাবুও সেখানে আমন্ত্রিত হতেন। সবার শেষে গান গাইতে বসে যখন উনি ‘ ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায়’ গানটি গাইতেন, তখন তারাশঙ্কর নিবিষ্ট মনে সেটা শুনতেন। ওঁর চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে জল পড়ত। উনি বলতেন,’ আমার সব গানের সুর যেন সুধীনই করে ‘।
১৯৫৯ সালে ‘গলি থেকে রাজপথ’ ছবিতে প্রথমে এবং পরে ১৯৬৬ সালে ‘শঙ্খবেলা’ ছবিতে উত্তম কুমারের লিপে মান্না দে-কে দিয়ে গাইয়ে উনি উত্তম কুমারের লিপে মান্না দের কন্ঠের গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত করেন।
পুজোর গানের জন্য উনি যত গান লিখেছেন তার চেয়ে বোধহয় ছায়াছবির গানের জন্য লিখেছেন বেশি।ওঁর সুরে গাওয়া পুজোর অসংখ্য গানের মধ্যে কোন গানগুলির জন্য উনি কথা লিখেছেন, সেটা খুঁজে বার করা বেশ কষ্টকর। তবু কিছু গানের তালিকা নিচে দিলাম।
সুবীর সেনের ‘ এত সুর আর এত গান ‘,’ এই উজ্জ্বল দিন ‘,’ স্বর্ণ ঝরা সূর্য রঙে ‘, আশা ভোঁসলের ‘ আকাশে আজ রঙের খেলা ‘, ‘ নাচ ময়ূরী নাচ রে’, তালাত মামুদের ‘তোমারে পারিনি যে ভুলিতে’, ‘এই রিম ঝিম ঝিম বরষায়’, আরতি মুখোপাধ্যায়ের ‘চিনেছি চিনেছি তোমারি মন’, ‘আরো কতদিন আমি খুঁজেছি তোমাকে’, ‘বলতে তুমি পারো’, ‘ও চোখে আমায় দেখো না’, ‘না বলে এসেছি তা বলে ভেবোনা’, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘এই ঝির ঝির ঝির বাতাসে’, ‘ওগো সুচরিতা ‘,বনশ্রী সেনগুপ্তের ‘অন্ধকারকে ভয় করি ‘, ‘ হীরা ফেলে কাঁচ ‘, ‘এক দিন সেই দিন সঙ্গীবিহীন পথে’, শ্যামল মিত্রের ‘নীল আকাশের ওই কোলে’, ‘চোখের নজর কম হলে’, ‘কার মঞ্জীর বাজে ‘, ‘নাম রেখেছি বনলতা’, ‘ভীরু ভীরু চোখে ‘, ‘কেন তুমি ফিরে এলে’, ‘তুমি চলে যাবার পর’, ‘কি নামে ডেকে’, ‘এই শহরে এই বন্দরে’, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পৌষালী সন্ধ্যা ঘুম ঘুম তন্দ্রা’, মান্না দে-র ‘একই অঙ্গে এত রূপ’, ‘মেঘলা মেয়ে মেঘেরই সাজ পরেছ’, ‘এক ঝাঁক পাখিদের মত কিছু রোদ্দুর’, ‘চার দেয়ালের মধ্যে নানান দৃশ্যকে ‘, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ‘ও কথা বলব না শুনব না রে’, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘ময়ূরকণ্ঠী রাতের নীলে’, ‘তার চুড়িতে রেখেছি মন সোনা করে’, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘সোনার হাতে সোনার কাঁকন ‘, ‘এলো বরষা সহসা মনে তাই’ ইত্যাদি।
সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে সব সমেত ৪৯ টি ছবিতে তিনি সুর করেছিলেন। সেরা সঙ্গীতকার হিসাবে ১৯৭২ সালে ‘পিকনিক’ ছবির জন্য বি এফ জে এ পুরস্কার পেয়েছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি খুব আত্মমগ্ন, স্নেহপ্রবণ মানুষ ছিলেন। সারাদিন তাঁর গানের ঘরে সঙ্গীতেই ডুবে থাকতেন। পরিবারের ছোটদের কাছে উনি খুব প্রিয় ছিলেন। নিপুণ ভাবে সবকিছু জোগাড় করে অসাধারণ রান্না করতে পারতেন। সেলাই বিষয়ে বিশেষ দক্ষতা ছিল। দারুন আলপনা দিতে পারতেন। আর নিজের ছাত্র ছাত্রীদের সন্তান স্নেহে গান শেখাতেন। কারো মধ্যে সম্ভাবনা দেখতে পেলে তাঁকে পরম যত্নে আরও এগিয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন। আরতি মুখোপাধ্যায় আর বনশ্রী সেনগুপ্ত ওঁর প্রিয় ছাত্রী ছিলেন। আরতি মুখোপাধ্যায়ের বিশিষ্ট শিল্পী হয়ে ওঠার পিছনে সুধীন দাশগুপ্তের বিশেষ অবদানের কথা অনেকেই জানেন। বনশ্রী সেনগুপ্ত প্রথম জীবনে সঙ্গীতানুষ্ঠানে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান গাইতেন। একদিন মৃণাল চক্রবর্তী বনশ্রীকে সুধীন বাবুর কাছে নিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে বলেছিলেন, ‘এই মেয়েটি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান করে। ওকে আপনি শিল্পী বনশ্রী সেনগুপ্ত করে দিন’। সুধীন বাবু সযত্নে তাই করে দিয়েছিলেন।
গান শেখানোর ব্যাপারে পেশাদারিত্ব থাকলেও অর্থোপার্জনের ব্যাপারে ওঁর তেমন পেশাদারিত্ব ছিলনা বলেই মনে হয়।মাত্র ৫২ বছর বয়সে আচমকাই ওঁর জীবনদীপ নিভে গেলে ওঁর পরিবারকে বেশ কিছুটা অর্থ সংকটে পড়তে হয়েছিল। ১৯৮২ সালের ১০ ই জানুয়ারি বিকেলে সেই অঘটনটি ঘটেছিল। বাণীচক্রে গান শিখিয়ে বাড়িতে ফিরলেন। স্ত্রী অসুখে শয্যাশায়ী। সবার জন্য চিকেন পকোড়া বানালেন। তারপর বাথরুমে গেলেন। কিছু পরে বাথরুমের দরজা ভেঙে বাথ টাবে আধশোয়া অবস্থায় তাঁর মরদেহ উদ্ধার হল। জীবনের অন্তিম মুহূর্তেও ওঁর পাশে সৃষ্টিরত একটি গানের চার লাইন লেখা একটি কাগজ পাওয়া গিয়েছিল। গানের মানুষ গানের ভুবনেই রয়ে গেলেন।
ওঁর লেখা প্রথম গানেই উনি লিখেছিলেন, ‘এত সুর আর এত গান যদি কোনদিন থেমে যায়, সেই দিন তুমিও তো ওগো, জানি ভুলে যাবে গো আমায় ‘। স্বল্প দিনের জীবনে এত সুন্দর সৃষ্টিসম্ভার, মনে হয়, উল্টো কথাই জানাচ্ছে শ্রোতাদের।
(ক্রমশ)