শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

মুকুটমণিপুর। কলেজ জীবনে আমার প্রথম ফীল্ড ওয়ার্কের জায়গা। প্রসঙ্গতঃ, আমার পড়াশুনো এমন একটা বিষয় নিয়ে যে, অন্য বিজ্ঞানের শাখার practical টা যেমন laboratory র চারদেওয়ালের মধ্যে হয়, আমাদের laboratory টা হয় উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে, মাঠে-পাহাড়ে, পাথর দেখে দেখে! তো সেই সুবাদে, কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে, ১৯৮২ সালে, আমাদের নিয়ে আসা হয়েছিল এই মুকুটমণিপুরে। তখনও এই জায়গা কোনো পর্যটকের নেকনজরে পড়েনি। থাকার জায়গা বলতে ছিল একটা সরকারী ইয়ুথ হোস্টেল, আর সেচ দপ্তরের একটা বিশ্রামাগার – যেটাতে অবশ্যই, সরকারী বড়কর্তাদেরই কেবল প্রবেশাধিকার থাকে। তেমনই অবস্থা ছিল পরিবহনের – দুর্গাপুর থেকে আমরা একটা বাসে এলাম বাঁকুড়া, সেখান থেকে আরেকটা, বোধহয় রাণীবাঁধ বা মেদিনীপুরগামী বাস ধরে এসে নামলাম খাতরা মোড়ে, মুকুটমণিপুর থেকে ৫/৬ কিমি দূরে। সেখান থেকে সাইকেল রিকশা নিয়ে পৌঁছলাম মুকুটমণিপুর, ইয়ুথ হোস্টেলে। জায়গাটা তখন দেখেই বেশ ভালো লেগে গেছিল। ছোটনাগপুর মালভূমির পূর্বদিকের শেষ প্রান্তে, ছোট ছোট টিলায় ঘেরা ভূপ্রকৃতির মধ্যে দিয়ে বয়ে আসা কংসাবতী নদীর ওপরে একটি ব্যারেজ বানিয়ে একটা জলাধার সৃষ্টি করা হয়েছে। ইয়ুথ হোস্টেলটা একটা ছোট টিলার ওপরে, আর সামনেই মুকুটমণিপুর জলাধার। পিছনে একটা উঁচু টিলা, সেখানে শাল-মহুয়ার জঙ্গল। চারিপাশে শান্ত নিরিবিলি একটা পুরোদস্তুর গ্রাম্য আবহাওয়া। আবার জলাধারে নৌকো করে মাঝের দ্বীপে বা ওপারের গ্রামেও যাওয়া যায়। তখন অবশ্য কেবলই মাছ ধরার ডিঙি নৌকোই ছিল! তার পর থেকেই শুনে আসছি যে এখানে পর্যটনশিল্পের প্রভূত উন্নতি ঘটেছে, অনেক হোটেল-রিসর্ট গড়ে উঠেছে, ইত্যাদি। তাই আরেকবার এখানে আসার বাসনা ছিল অনেকদিনের।

এখনও কলকাতা থেকে মুকুটমণিপুর যেতে গেলে একটাই পথ, সেটা হচ্ছে ট্রেনে বাঁকুড়া গিয়ে, সেখান থেকে বাস বা গাড়ী ধরা। আমি চাইছিলাম নিজের গাড়ি নিয়েই যেতে, তাই গুগল ঘেঁটে দেখলাম, পৌঁছানোর দুটি রাস্তা আছে, একটা খড়্গপুর হয়ে, শালবনীর জঙ্গল পেরিয়ে, গোয়ালতোড়, সারেঙ্গার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। আরেকটি যায় আরামবাগ-বিষ্ণুপুর হয়ে। এই দ্বিতীয় পথটি একটু ছোট। আমরা ঠিক করলাম যে একটি পথে যাবো, আর অন্য পথে ফিরব। যাওয়া আর আসার পথে, আরো কিছু কিছু জায়গা দেখে নেব।

সেইমত, ২৬/১২/২৪ বেশ সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম। কোলাঘাটে রূপনারায়ণ নদী পেরিয়ে খড়্গপুর যাওয়ার আগে আছে যাকে বাংলার valley of flowers বলা হয়, ক্ষীরাই নামের একটা গ্রামে। খড়্গপুর থেকে হাওড়া আসার সময় ট্রেন থেকে অনেকবার দেখেছি, কিন্তু সে কেবল একটা ঝলকমাত্র! এখানে কংসাবতী নদীর পাড়ে নানারকম ফুলের চাষ হয়। পুরো জায়গাটায় মনে হয় যেন কেউ নানাবর্ণের আলপনা দিয়ে রেখেছে! তবে জায়গাটা যে হাইওয়ে থেকে এতটা ভিতরে ঢুকতে হবে, আর এরকম সরু রাস্তা, তা বুঝিনি! পাঁশকুড়ার কাছে এক জায়গায় হাইওয়ে থেকে নেমে গ্রামের রাস্তায় প্রায় ১২-১৫ কিমি মত যেতে হয়। পরের দিকে আবার বেশ সরু, আর এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা। তবে পৌঁছনর পরে, দেখি গাড়ি পার্কিং এরও ব্যবস্থা আছে। ওপর দিয়ে রেললাইন গেছে, আর নীচে, নদীর পাড়ে বিস্তৃত জায়গা জুড়ে হয়ে রয়েছে ফুলের চাষ। খেতের আল দিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখলাম, একেকটা খেতে একেকরকম ফুল আর সব্জির চাষ। এই সময়ে দেখলাম বেশীরভাগ গাঁদাফুলেরই চাষ হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও ফুল/সব্জীর বীজ বা চারা বিক্রী হচ্ছে। ফুলের তোড়াও অনেক জায়গায় বিক্রী হচ্ছে। আরেকটা নতুন জিনিস দেখলাম। সাদা ডালিয়া ফুলের গোছা লম্বা ডাঁটি সমেত কেটে নিয়ে সেই ডাঁটি গুলো ডুবিয়ে রাখা হচ্ছে বালতিতে গুলে রাখা নীল, সবুজ বা গেরুয়া এরকম সব রঙের মধ্যে। খানিক পরে সেই রঙটা উঠে আসছে ফুলের পাপড়ি অবধি, আর সাদা-নীল বা সাদা-সবুজ এক অদ্ভুত মিশ্র রঙের ডিজাইন তৈরী হচ্ছে!

আমরা ব্রেকফাস্ট বাড়ির থেকে নিয়েই এসেছিলাম, ওখানেই গাড়ীতে বসেই খাওয়া সেরে, আবার রওনা দিলাম। খড়্গপুরের কিছু পরে এল শালবনীর জঙ্গল। দুপাশে সবুজ বনানীর মধ্যে দিয়ে সুন্দর রাস্তা, গাড়ীর ভীড়ও অনেক কম। মাঝে মাঝে আসছে ছোট ছোট গ্রাম, বাজার, আবার খেত, কখনো জঙ্গল। গোয়ালতোড় নামের একটা জায়গায় আমরা লাঞ্চ করলাম, পথের পাশের ছোট্ট দোকান, তবে বেশ ঘরোয়া ছিমছাম রান্না। মুকুটমণিপুর পৌঁছতে আমাদের প্রায় তিনটে বাজল।

আমাদের বুকিং ছিল ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের একটা রিসর্টে, সোনাঝুরি প্রকৃতি ভ্রমণ কেন্দ্র। ড্যামের পিছনে একটা বেশ উঁচু টিলার অনেকটা ওপরে, ধাপে ধাপে কয়েকটি আলাদা আলাদা কটেজ নিয়ে এই রিসর্ট। এদিকে-ওদিকে বেশ সযত্নে ফুল ও সব্জির বাগান করা। ওপর থেকে একটা সুন্দর view point ও আছে, সেখানে উঠলে জলাধারের অনেকটাই দেখা যায়। আমাদের ঘরটা দেখলাম বেশ বড়, সঙ্গে changing room ও রয়েছে। এদের খাবার জায়গায় তখনও লাঞ্চপর্ব চলছে, তাই চা পাওয়া গেল না! পায়ে পায়ে ড্যামের দিকে এগোলাম। অগুন্তি মানুষের ভীড়, বেশীরভাগই এসেছে দল বেঁধে পিকনিক করতে। ড্যামের পাশে ঢালু জমিতে যত্রতত্র বসে পড়েছে, আর যে যেমন খুশি আবর্জনা ছড়িয়ে যাচ্ছে – তার আবার বেশীটাই প্লাস্টিকের বোতল, থার্মোকলের প্লেট ইত্যাদি। যদিও, কিছু দূরে দূরেই ডাস্টবিনের ব্যবস্থা রয়েছে! বাঁধে ওঠার আগে অনেকখানি জায়গা জুড়ে গাড়ি পার্কিং – সেখানে তখন অন্তত ৫০/৬০ টা গাড়ি দাঁড়িয়ে। ওপরে উঠে এলাম ড্যামের ওপরে।

কংসাবতী ও তার শাখানদী কুমারী মিলে তৈরী করেছে এক বিশাল জলাধার, তাকে চারিদিকে ঘিরে যেন মুকুটের মত রয়েছে ছোট ছোট টিলার মত পাহাড় – ছোটনাগপুর মালভূমির শেষাংশ এগুলি। পাশ দিয়ে এই ড্যাম চলে গেছে এঁকেবেঁকে, বহুদূর অবধি। শুনেছি এটি ১১ কিমি লম্বা, এবং ভারতের দ্বিতীয় দীর্ঘতম earthen dam! বাঁধের ওপর প্রচুর মানুষের ভীড়, রয়েছে অটো/টোটোর লাইন, পুরো ড্যামের ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে। এখানে বড় গাড়ি উঠতে দেওয়া হয় না। তবে, মাঝে মাঝে কিছু পুলিশের জীপ ঘুরে বেড়াচ্ছে, নজরদারির জন্যে। ড্যামের ওপরটা সাধারণের জন্যে খোলা থাকে সকাল ছটা থেকে সন্ধ্যে ছটা অবধি। নীচে জলে বেশ কিছু মোটর-চালিত নৌকো, তাতে বোটিংএরও ব্যবস্থা রয়েছে। জলাধারের মাঝে একটা দ্বীপ রয়েছে, আর ওপারে, অনেকটা দূরে কিছু ঘরবাড়ি দেখা যাচ্ছে। মনে পড়ে গেল, আগেরবার ফীল্ড করতে এসে একদিন সাধারণ জেলে-নৌকো করে ওপারের গ্রামে গিয়েছিলাম। এবারে আর সারাদিন ড্রাইভ করে এসে টোটোর ঝাঁকুনি সইতে মন চাইল না। বাঁধের থেকে নেমে ব্যারেজের দিকে যেতে, পথের ওপর দেখলাম প্রচুর ছোট ছোট দোকান, একেবারে গিজগিজ করছে – মণিহারি, কিছু জামাকাপড়, আর বেশীরভাগ খাবারদাবারের দোকান। তারস্বরে মাইকে আওয়াজে কান পাতাই দায়! খানিকটা এগিয়ে ব্যারেজে উঠলাম, দেখলাম লকগেটগুলোর প্রায় সব কটাই বন্ধ রাখা হয়েছে এই সময়ে, ফলে নদীর downstream এ জল প্রায় নেই – এবড়ো-খেবড়ো পাথরগুলো মাথা বের করে রয়েছে! ফেরার পথে আবিষ্কার করলাম, সেই Youth Hostel টি এখনও যথাস্থানে রয়েছে, কিছু সংস্কার সমেত! সেই সেচ দপ্তরের বাংলোটিও একইরকম ভাবে রয়েছে, গেটে দরোয়ানও আগের মতই মজুত! সেখান থেকে একটা টোটো নিয়ে আমরা রিসর্টে ফিরলাম।

পরদিন সকালে এখান থেকে ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা রওনা দিলাম বিষ্ণুপুরের পথে। আমরা আগেরদিন মুকুটমণিপুর এসেছিলাম পশ্চিম দিক থেকে, আর আজকে বেরোচ্ছি উল্টোদিক দিয়ে – সেই ব্যারেজের ওপর দিয়ে, খাতড়া মোড় পার হয়ে, মোটামুটি পূর্বদিকে। দেখলাম ব্যারেজের এপাশে, প্রায় খাতড়া অবধি পরপর অনেক হোটেল, রিসর্ট ইত্যাদি রয়েছে। বলা বাহুল্য, আমার আগের বারের দর্শনের সময়ে, এখানে সবই ফাঁকা মাঠ বা ধানখেত ছিল! খাতড়ার পরে, পথের শোভা অনেকগুণ বেড়ে গেল – দুপাশে হলুদ গালচে বিছানো সর্ষের খেত, মাঝে মধ্যে ছোট গ্রাম, আবার কিছুটা শালের জঙ্গল। আর জায়গায় জায়গায় রাস্তার পাশেই খেজুর গাছ, তাতে হাঁড়ি বাঁধা। কিছু দূরে দূরেই ছোট ছোট ঝুপড়ির সামনে বসে গেছে রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরীর ব্যবস্থা। ঝুপড়ির সামনে ব্যানার লাগানো, এখানে গুড় বিক্রী হয়! বাঁকুড়ার খেজুরের গুড়ের নাম তো আছেই, এক জায়গা থেকে খানিকটা গুড় কেনাও হল। তবে, এই বিষ্ণুপুর পার হবার পরে, পরদিন আরামবাগের পথে কিন্তু আর আমরা এরকম কোনো গুড়ের আস্তানা রাস্তার ধারে দেখতে পাইনি!

বিষ্ণুপুর
মুকুটমণিপুর থেকে বিষ্ণুপুরের দূরত্ব ৭০ কিমি মত, আমাদের ঘন্টাদুয়েক সময় লাগল। বিষ্ণুপুর – নামটার মধ্যেই রয়েছে, এটা বিষ্ণুর পুর, বা বিষ্ণুর উপাসকদের আবাসস্থল। আজকে বিষ্ণুপুর বলতেই, কি মনে হয় আমাদের? অবশ্যই, সেই টেরাকোটার শিল্প ভরা একটি মন্দিরময় শহরের কথা? যেখানে আবার বালুচরী ও স্বর্ণচরী শাড়িও তৈরী হয়? কিন্তু এই টেরাকোটা শিল্পের উৎস আরো অনেক প্রাচীন। যদিও সরাসরি কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তবু মনে করা হয়, গুপ্ত সাম্রাজ্যের আমলে (খৃষ্টীয় ৪র্থ – ৬ষ্ঠ শতকে) এটি একটি উল্লেখযোগ্য জনপদ ছিল। বিষ্ণুপুরের কাছাকাছি অঞ্চল, যেমন চন্দ্রকেতুগড়, তমলুক ইত্যাদি জায়গায় গুপ্ত আমলের মোহর, টেরাকোটা সীল ইত্যাদি পাওয়া গেছে। গুপ্তদের সময় ভারতে টেরাকোটা শিল্পের এবং বিষ্ণু উপাসনার প্রসার ঘটে। আজকের বিষ্ণুপুরের টেরাকোটার শিল্পকর্মের মধ্যে গুপ্ত আমলের শৈলীর ছাপ স্পষ্ট। দুক্ষেত্রেই আমরা দেখতে পাই টেরাকোটার মাধ্যমে রামায়ণ, মহাভারত ও কৃষ্ণলীলার বিভিন্ন কাহিনী প্রদর্শিত হয়েছে। পরে, মল্ল রাজাদের আমলে এই জনপদের গুরুত্ব বাড়ে, এবং দীর্ঘদিন বিষ্ণুপুর ছিল মল্লভূমের রাজধানী। মল্ল রাজারা শিল্প ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, বিশেষ করে বীর হাম্বীর, রঘুনাথ সিংহ দেও, বীর সিংহ দেও ইত্যাদিরা। শ্রীচৈতন্যের ভক্তি আন্দোলনের (১৬শ শতক) একটি মুখ্য কেন্দ্র ছিল বিষ্ণুপুর। সেই সময়ে (১৬শ-১৭শ শতক) মল্ল রাজারা একাধিক মন্দিরের স্থাপনা করেন, এবং সেইসময়ের শিল্পীদের হাতে টেরাকোটা শিল্প অনেক পরিশীলিত ও উন্নত হয়।

এখানে আমাদের যে রিসর্টে বুকিং ছিল, সেটা হাইওয়ের কাছাকাছিই ছিল, কেবল গুগুলদাদু একজায়গায় আমাদের একটু পথভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পথের পাশের একজন স্থানীয় দাদু সেই ভ্রান্তি দূর করে আমাদের সঠিক দিকনির্দেশ দিয়ে দিলেন। আমাদের রিসর্টটি শহর থেকে একটু নিরিবিলিতে। বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে তৈরী হয়েছে রিসর্টটি। একটা চার বেডের ঘর নেওয়া হয়েছিল, আমাদের তিনজনের জন্যে। রিসর্টের এইদিকের ঘরগুলো দেখলাম সদ্যই তৈরী হয়েছে। এর পিছনদিকে এদের রেস্তোরাঁ। মালিকেরা মনে হল দুই ভাই, অনেকটাই একরকম দেখতে, একজন রিসর্টের অতিথিদের সামলান, অন্যজন এই রেস্তোরাঁ। সেখানেই আমরা লাঞ্চ সেরে, একটা টোটো নিয়ে বিষ্ণুপুর দর্শনে বেরিয়ে পড়লাম। এখানে আবার টোটোর ঘন্টাপিছু দর, প্রতি ঘন্টা ২০০/- করে। পরে দেখলাম, ভাগ্যিস এই টোটো নিয়েছিলাম, নইলে এখানের যা সরু সরু গলির গোলকধাঁধার মধ্যে দিয়ে আমাদের নিয়ে গেল, সেখানে গাড়ি নিয়ে যাওয়া তো দূরস্থান, আমরা কোনো এক জায়গা থেকে পায়ে হেঁটে গেলেও নিশ্চিত হারিয়ে যেতাম! সে এমনই গলি, কোথাও কোথাও উল্টোদিকের টোটোকে পথ দেবার জন্যেও অনেক কসরত করতে হচ্ছিল!

আমরা প্রথমেই দেখতে গেলাম দলমাদল কামান। মনে পড়ে গেল, আমাদের বাড়ির পুরনো অ্যালব্যামে দেখা, হয়ত ষাটের দশকের গোড়ার দিকে, আমার বাবার তোলা এই কামানের ছবি। মল্ল রাজা বীর হাম্বীরের আমলে, ১৭শ শতকে তৈরী, ১২ ফিট লম্বা আর ছয় ইঞ্চি (ভিতরের) ব্যাসের এই কামান সেই সময়ে বর্গী দমনে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল। এর পাশেই রয়েছে মদনমোহন মন্দির। ১৬৯৪ খৃষ্টাব্দে তৈরী এটি একটি একরত্ন (একক চূড়া বিশিষ্ট) মন্দির। মন্দিরের গায়ে এবং ভিতরের দেওয়ালে, গভীরভাবে খোদাই করা টেরাকোটার কাজ সমেত প্যানেল, যার মধ্যে রাধা-কৃষ্ণের গল্প, বিষ্ণুর অবতার, যোদ্ধা ও রথের ছবি দেখা যায়। এই কামান আর মন্দির সংলগ্ন চত্বরটা জুড়ে অনেক দোকান, সেখানে পোড়ামাটির কাজের নানারকম জিনিস বিক্রী হচ্ছে। এরপর গেলাম রাসমঞ্চ। বার্ষিক রাস উৎসবের সময় প্রতিমা রাখার জন্য মণ্ডপ হিসেবে ব্যবহৃত এই মন্দিরের নকশায় টেরাকোটা শিল্পের চেয়ে কাঠামোগত সৌন্দর্যের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। একটি অনন্য পিরামিডাল কাঠামো, যেখানে বাঙালি, ইসলামিক এবং হিন্দু শৈলীর মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। মন্দিরের খিলানে ও দেওয়ালে জ্যামিতিক নিদর্শন, ফুলের নকশা এবং সরল আলংকারিক উপাদান সহ টেরাকোটার কাজ রয়েছে। শ্যাম রাই মন্দির একটি পঞ্চচূড়া বিশিষ্ট মন্দির, এখানে খুব সূক্ষ্ম টেরাকোটার কাজ রয়েছে। জোড় বাংলা মন্দিরে আবার জোড়া চালার মত ছাদ। এখানেও সূক্ষ্ম টেরাকোটার কাজের মাধ্যমে রামায়ণ, মহাভারত ও কৃষ্ণের জীবনের নানা কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। টালির ধারগুলিতে ফুল, লতাপাতা ইত্যাদি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ছিন্নমস্তা মন্দিরে আবার বৈষ্ণব কাহিনীর পরিবর্তে তান্ত্রিক বিষয়বস্তুর আধিক্য বেশী। ভিতরে মা ছিন্নমস্তার প্রতিমা প্রতিষ্ঠিত। এখানে তান্ত্রিক দেবতা, প্রতীক এবং আচার-অনুষ্ঠানের বিরল চিত্রায়ণ দেখতে পাওয়া যায়।

এইভাবেই আরো কয়েকটি মন্দির ঘুরিয়ে আমাদের নিয়ে গেল এক তাঁতির বাড়িতে, যেখানে তাঁতে বালুচরী ও স্বর্ণচরী শাড়ী তৈরী হচ্ছে। রেশমের সূতোর তারতম্যে দুটি আলাদা তাঁতে দুরকমের বুনন চলছে। নকশাগুলো আগে থেকেই মেশিনে ফিট করে, সেইমত নানা রঙের সূতো লাগানো রয়েছে। তাঁত চলছে, আর ধীরে ধীরে নকশা ফুটে উঠছে। বলা বাহুল্য, পাশেই আরেকটি বাড়িতে সেইসব শাড়ী বিক্রিরও ব্যবস্থা রয়েছে। এইসব দেখে আমরা পৌঁছলাম বিষ্ণুপুর মেলা প্রাঙ্গণে। এখানের বাৎসরিক এই মেলা, আর এই জন্যেই শহর জুড়ে সব মেলা-মুখী রাস্তাতেই যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছে স্থানীয় পুলিশ। বেশ বড়সড় জায়গা জুড়ে মেলা, একদিকে বড় মঞ্চ বেঁধে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে, আর অন্য দিকে সারি সারি দোকান – বেশীরভাগই নানান খাবারদাবারের, কয়েকটা জামাকাপড় ও খেলনার দোকান চোখে পড়ল। কিন্তু এতই বেশী ভীড় যে আমাদের আর বেশীক্ষণ থাকা হল না, ফিরে এলাম রিসর্টে।

পরদিন সকালে বিষ্ণুপুর থেকে বেরিয়ে, এলাম জয়রামবাটি – শ্রীশ্রী মা সারদার জন্মস্থান। মন্দির সকাল ১১-৩০ অবধি খোলা থাকে, আমরা কপালক্রমে তার আগেই পৌঁছে গেছিলাম। দর্শন হল, প্রসাদের কুপনও পেয়ে গেলাম। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে প্রসাদ নিলাম, আশেপাশে একটু ঘুরে দেখে, চলে এলাম কামারপুকুর। কামারপুকুর পৌঁছে দেখি, মন্দিরের সামনের চত্বর বেশ খোলামেলা। চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। তবে দুপুরের মধ্যভাগে যাওয়ায় মন্দিরের দরজা বন্ধ। অনেকে মন্দির চত্বরে বসে আছেন, কেউ কেউ আশপাশের দোকান থেকে ফল-মিষ্টি কিনে নিচ্ছেন।

কামারপুকুর মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ নির্জন পরিবেশে সময় কাটালাম। আশ্রমের দেওয়ালের গায়ে লেখা বিবরণী পড়লাম। রামকৃষ্ণ পরমহংসের জন্মস্থান হিসেবে এই জায়গার গুরুত্ব অপরিসীম। রামকৃষ্ণ মিশনের সেবাকেন্দ্রও রয়েছে এখানে। ভেতরের দর্শন না হলেও, পুরো পরিবেশটা যেন এক ধরনের পবিত্রতা বহন করে। কিন্তু আমাদের আবার কলকাতায় ফেরার ব্যাপার ছিল, তাই বাইরে থেকে মন্দিরে প্রণাম সেরেই বাড়ির পথ ধরলাম। রাস্তাটা বেশ ভালো, তবে কলকাতার দিকে আসতে আসতে যানবাহনের ভিড় বাড়ছিল। সন্ধে নাগাদ আমরা বাড়ি পৌঁছলাম, ভ্রমণের ক্লান্তি মেশানো তৃপ্তি নিয়ে।

এই ভ্রমণ শুধু জায়গাগুলো দেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল স্মৃতি রোমন্থনের একটি নতুন অধ্যায়ও। মুকুটমণিপুরের গ্রামীণ পরিবেশ, বিষ্ণুপুরের ঐতিহাসিক মন্দির, বালুচরী শাড়ির সূক্ষ্ম শিল্পকর্ম, জয়রামবাটি আর কামারপুকুরের আধ্যাত্মিক পরিবেশ – সবকিছু মিলে যেন একসঙ্গে মনের ভেতর একটা মেলবন্ধনের অনুভূতি এনে দিল।

এবার ফেরার পথে মনে হল, জীবনের একটা অংশ হয়তো এখানে রয়ে গেল। তবে এটাই তো ভ্রমণের সৌন্দর্য, তাই না? যে পথের শেষ নেই, স্মৃতিতে তা আরও দীর্ঘায়িত হয়।

[লেখকের অন্য রচনা]

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x