শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর (দ্বিতীয় পর্ব)

রবীন্দ্রনাথের গানের “তুমি”, যা অনেকের কাছেই তাঁর ঈশ্বর বা জীবনদেবতারূপে প্রতিভাত, তা অতিবড় নিরীশ্বরবাদীকেও আন্দোলিত করে, উদ্বেলিত করে।     নিরীশ্বরবাদীরা অবশ্য তাঁর গানের গীতসুধাতে উদ্বেলিত হয়ে ঈশ্বরে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন,  তা কিন্তু নয়।  তাঁর গানের ঈশ্বর বা তুমিকে তাঁরা আবিষ্কার করেন মানবহৃদয়ের সহায়ক সত্তা হিসেবে,  এবং এই সত্তার প্রয়োজন যে তাঁদের নিজেদের জীবনেও কিছুমাত্র কম নয় তা তাঁরা হৃদয় মন দিয়ে উপলব্ধি করতে পারেন। আসলে এই তুমি বা জীবনদেবতা, আমরা যে নামেই তাঁকে বলিনা কেন, তা হয়ত একটা মিথ বা কল্পনা,  কিন্তু জীবন সৃষ্টির সহায়ক বলে তা সত্য।  ক্রিয়েটিভ মানুষ,  তা তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাসী, কিংবা  নিরীশ্বরবাদী যা’ই  হোন না কেন, এ’ সত্যকে  অস্বীকার করবেন কোন সাহসে!!   

রবীন্দ্রনাথের প্রায় সব পূজা পর্বের গান এবং ব্রহ্মসঙ্গীত, যেখনেই ঈশ্বর বা একজন বৃহৎ ‘তুমি’র উল্লেখ আছে সেখানেই অমন একজন বৃহৎ ‘তুমি’র কাছে বিস্ময়াবিভূত ক্ষুদ্র ‘আমি’র অপার বিস্ময়ের প্রকাশ তথা আত্মনিবেদিত হয়ে নিঃশঙ্ক, নিশ্চিন্ত হবার বর্ণনা পাওয়া যায়। এটাই রবীন্দ্রনাথের কাঙ্ক্ষিত ঈশ্বর। এর বন্দনার মধ্যে আনন্দ আছে ভয় নেই, আপন করে কাছে টানবার আকুতি আছে, দূরে রেখে সম্ভ্রম করবার চেষ্টা নেই। আর এসবের ব্যত্যয় যেখানে আছে (অর্থাৎ পাপ-পুণ্যের পুঙ্খানুপঙ্খ হিসাব নেন যিনি, পান থেকে চুন খসলে খর্গহস্ত হন যিনি) সেখানে রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর নেই বা সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বর খুঁজে পাননা মোটেই। তিনি তাঁর নিজের ঈশ্বরে বিশ্বাসী বলেই  “বিসর্জন” নাটকের ক্ষুদ্র তুচ্ছ মানবী অপর্ণার আটপৌরে প্রেমের মহিমার কাছে পরাজিত হয়েছে মহাশক্তিধর দেবী প্রতিমা, (সেখানে জয়সিংহ অপর্ণাকে বলছে – সত্য আর মিথ্যার প্রভেদ শুধু এই-/ মিথ্যারে রাখিয়া দিই শুধু মন্দিরের মাঝে/ বহুযত্নে, তবুও সে থেকেও থাকে না।/ সত্যেরে তাড়ায়ে দিই মন্দির বাহিরে/ অনাদরে, তবু সে ফিরে ফিরে আসে।) বালিকা অপর্ণাকে বলা জয়সিংহের কথাতে রক্ত লোলুপ দেবী প্রতিমাকে অবলীলায়  “মিথ্যা” আখ্যায়িত করা হয়েছে।  এছাড়া অচলায়তনে সমাজের অন্ত্যজ বা দলিতদের কাছে পরাজিত হয়েছে মন্দির এবং দেবতাদের বহুযুগের পবিত্রতা, রবীন্দ্রসাহিত্যে  এমনি অজস্র উদহারণ আছে যেখানে  প্রচলিত ঈশ্বর অথবা তার শক্তিমান প্রতিভূরা পরাজিত অথবা ব্যঙ্গ বিদ্রুপের দ্বারা ধিকৃত হয়েছেন বারংবার। এমনিভাবে রবীন্দ্রনাথ অবলীলায় প্রথার কৌলীন্যের নিগড় ভেঙেছেন বারবার, এমনকি সে কৌলীন্য যদি প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসের, একই সঙ্গে প্রচলিত ঈশ্বর বিশ্বাসের অনুকুলাশ্রিতও হয়।  এ’ছাড়া ভেঙেছেন শাশ্বত প্রেম এবং মঙ্গলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক প্রচলিত ঈশ্বর ভাবনার অসারত্বকেও। আর এভাবেই তাঁর অজান্তেই নিজের মধ্যে তাঁর নিজের একটা ঈশ্বর সৃষ্টি হয়ে গেছে তাঁর প্রতিদিনের প্রেরণা হবার জন্য।    

“প্রভু আমার, প্রিয় আমার পরম ধন হে।

                                    চিরপথের সঙ্গী আমার চিরজীবন হে ॥

তৃপ্তি আমার, অতৃপ্তি মোর,   মুক্তি আমার, বন্ধনডোর,

                                    দুঃখসুখের চরম আমার জীবন মরণ হে॥

                                    আমার সকল গতির মাঝে পরম গতি হে,

                                    নিত্য প্রেমের ধামে আমার পরম পতি হে।

ওগো সবার, ওগো আমার,   বিশ্ব হতে চিত্তে বিহার–

                                    অন্তবিহীন লীলা তোমার নূতন নূতন হে॥“

ঈশ্বরের সর্বেশ্বরবাদী ধারণা,  একই সঙ্গে প্রকৃতিকে বিকল্প ঈশ্বর চিন্তা করার ধারণা,  মানুষের বহুকালের ঈশ্বর ভাবনার  প্রতিফলন সন্দেহ নেই, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর ভাবনাকে ধারন করবার মতো  কোন আভাস এসব ঈশ্বর জ্ঞান বা ঈশ্বরতত্ত্বে নেই। সবচে বড় কথা প্রকৃতির কথা, প্রকৃতির উপাদানের কথা, মানুষের কথা, প্রেমের কথা, নাচ-গানের কথা, পাখির কথা, নদীর কথা, অরণ্যের কথা, লতাপাতার কথা ইত্যাদি কথা বা  ধারণা  সমগ্রে বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে যতই  বিলীন হয়ে যাক না কেন (হোক সে সর্বেশ্বরবাদীদের বা বিকল্প-ঈশ্বরবাদীদের বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে বিলীন হওয়া), রবীন্দ্রনাথ যে ছাঁদে, যে ভঙ্গিমায়, যে  বৈচিত্র্যে  তার আভাস দেখেন, তা একান্তই রবীন্দ্রনাথেরই দেখা, আর আমরা রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতেই তাঁর এইসব ক্ষুদ্র তুচ্ছ অথচ মহৎ আয়োজনের মধ্যে তাঁর দেখানো ঈশ্বরকে দেখতে পাই, তাঁর সেই চিরচেনা “আনমনা ঈশ্বর” হিসেবে। 

অসঙ্গত সমাজের তথাকথিত  নিয়মকে  সবসময়ই একটা  “অনিয়ম” দিয়ে চ্যালেঞ্জ করতেন রবীন্দ্রনাথ। কী ধরনের অনিয়ম  সেটা? নিয়ম দিয়ে শৃঙ্খলা দিয়ে সামাজিক শৃঙ্খলা আনতে গিয়ে  যেখানেই মানবতা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে সেখানেই রবীন্দ্রনাথ সে নিয়মকে অগ্রাহ্য  করেছেন, প্রতিবাদ করেছেন, তাঁর সৃষ্ট, শিল্পিত ভঙ্গিমার ব্যঙ্গবিদ্রূপ দিয়ে, “অনিয়মের নিয়ম দিয়ে।“এর একটা উদাহরণ  দেখতে পাই আমরা, রবীন্দ্রনাথের প্রায় আনুল্লেখ্য একটি সঙ্গীত-নাটক, তাসের দেশের কাহিনীর বর্ণনার মধ্যে। যদিও প্রায় অনুল্লেখ্য একটি সঙ্গীত-নাটক বা নৃত্যনাট্য  তাসের দেশ, তবু  আমি রবীন্দ্রমননে তাসের দেশ  নৃত্যনাট্যের গভীর ছায়াপাত লক্ষ্য করি সবসময়। এত সূক্ষ্ম ব্যঙ্গবিদ্রূপ এবং হাসি-ঠাট্টার  মধ্য দিয়ে সামাজিক কুসংস্কার এবং বহুদিন থেকে চলে আসা  অচল প্রথাকে যে কীভাবে ভেঙে ফেলা হয়েছে এই নৃত্যনাট্যটিতে যা বলে শেষ করবার নয়। এই সঙ্গীত বা নৃত্যনাট্যটিকে  রবীন্দ্রসৃষ্টি হিসাবে  কান উৎসবে নেবার সময়  চিত্র পরিচালক কৌশিক মুখোপাধ্যায়ের যা বলেছিলেন তা প্রণিধানযোগ্য।  তিনি বলেছিলেন, “রবীন্দ্রনাথকে যেমন অনেক মানুষই  ঠিকমতো বুঝতে পারেননি, তেমনই তাঁর “তাসের দেশ”  নৃত্যনাট্যটিকেও প্রায় অনেক মানুষই বুঝতে পারেননি৷ সবাই চিরকাল এটিকে শিশুদের অভিনয়যোগ্য একটি নাচ-গান নির্ভর আখ্যান হিসেবে দেখেছেন৷

অথচ রবীন্দ্রনাথ ইউরোপ থেকে ঘুরে এসে ‘তাসের দেশ’ লিখেছিলেন৷  তিরিশের দশকের শেষভাগের ইউরোপ, যেসময় জার্মানিতে অ্যাডলফ  হিটলারের হাত ধরে এবং ইটালিতে মুসোলিনির হাত ধরে ফ্যাসিবাদ মাথা চাড়া দিচ্ছে।  

সেই প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের মতো চিন্তক এবং দার্শনিক যখন এক অবরুদ্ধ সমাজ এবং তা ভেঙে দেওয়ার কথা বলে একটা নাটক লেখেন, এবং সেই নাটক তিনি উৎসর্গ করেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সবথেকে সাহসী এবং পরাক্রান্ত পুরুষ সুভাষ চন্দ্র বসুকে, তখন গোটা ব্যাপারটাকে ছেলে ভুলনো বলে ভেবে নেওয়াটাই মূর্খামি।“   

রবীন্দ্রনাথ তাঁর তাসের দেশ নাটকটি প্রথমে লেখেন “একটি আষাঢ়ে গল্প নামে।“   কেন  লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর অন্যতম স্যাটায়ারধর্মী ওই নাটকটি অমন ছদ্মাবরনে, আমি তা বুঝতে পারিনা। খুব সহজ ভঙ্গীতে লিখা হলেও অবরুদ্ধ সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অমন ব্যঙ্গবিদ্রূপ খুব কমই দেখা যায়।                               

কী আছে তাসের দেশে? আর কী মহান দ্রোহেরই বা বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তাসের দেশের অবরুদ্ধ সমাজ ভেঙে দেবার মধ্য দিয়ে? তাসের দেশের কাহিনী শুরু হয়েছে গতানুগতিক জীবনে বীতশ্রদ্ধ এক রাজপুত্র এবং তার সওদাগর বন্ধুর বাণিজ্য যাত্রার মধ্য দিয়ে। বাণিজ্য যাত্রার মাঝ পথে তাদের তরী ডুবে যায়, তারা ভেসে ওঠেন গিয়ে এক নতুন দ্বীপে, নতুন দেশে। তাসেদের দেশ সেটি। সে দেশে যারা বাস করেন তারা মানুষ নন, তারা সবাই তাস-বংশীয়, তাদের উঠা বসা চলা ফেরা সকিছুই এক অলঙ্ঘনীয় অথচ অচল নিয়ম বা প্রথার নিগড়ে বাঁধা। সামান্য ব্যত্যয় হবার উপায় নেই সে নিয়মে বা প্রথায়। সে নিয়মকে  রক্ষা করতে নানান ধরনের ব্যবস্থাও বর্তমান  ছিল তাসবংশীয়দের দেশে। যেন  নিয়মগুলি  অনেকটা আমাদের  প্রচলিত প্রথাবদ্ধ  ধর্মদর্শনে  এবং প্রচলিত ঈশ্বরের আদেশ নির্দেশে  যেমন দেখা যায়, ঠিক  তেমন।  মানুষের দেশ থেকে যাওয়া রাজপুত্র এবং তার সওদাগর বন্ধুর চলা বলা উঠা বসা,  যা ছিল মানুষের মত, তা  সেখানে নিয়মের বাড়বাড়ন্তকে  দূরে সরিয়ে ইচ্ছার জয় ঘোষণা করতে  বা ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে ব্রতী হয়েছিল।  আর বিপত্তিটা বেধেছিল সেই ঘটনাতে। তাসবংশীয়দের যে আঁটসাঁট নিয়মের চলা ফেরা উঠা বসা  সেখানে শৈথিল্যের হাওয়া হয়ে ধাক্কা দিল মানুষের চলাফেরা বা চালচলন বা ইচ্ছার শক্তি।  আর  তাসবংশীয়রা,  বিশেষ করে তাদের মেয়েরা,  মানুষকে মানে রাজপুত্রদের  নকল করে চলতে চায়ল বা বলা যায়, তারা তাদের তাস জন্মের লেবাস থেকে বেরিয়ে এসে  মানুষ হতে চায়ল। তাস দেশের প্রচলিত  কোন শাস্তির ভয় তাদের বিরত রাখতে পারল না। সবশেষে ইচ্ছার মাতাল করা “ইচ্ছা-হাওয়া”র কাছে তাসবংশীয় রাজা রাণী প্রজা মন্ত্রী নারী পুরুষ সকলেই তাদের নিয়মকে বিসর্জন দিয়ে ইচ্ছার জয়গান গাওয়া মানুষ হয়ে উঠতে প্রয়াসী হল তাদের আজন্ম আচরিত “নিয়ম”কে নির্বাসনে পাঠিয়ে। 

যাইহোক, তাসের দেশের কাহিনীর উদাহরণ এটাই বলে যে, প্রচলিত প্রথাবদ্ধ ঈশ্বর, যে ঈশ্বর মানুষের সামান্য ভুলত্রুটির হিসাব নেন, শাস্তি বিধান করেন, সে ঈশ্বর প্রবর্তিত নিয়মের নিগড় টেঁকে না বেশিদিন, শিথিল হয়ে ভেঙে পড়ে এক সময়, ভেঙে পড়ে তাসেদের দেশের কঠিন  নিয়মের মত।

আর রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর, যে ঈশ্বর পাপপুণ্যের হিসেব নেন  না, যে ঈশ্বর সৃষ্টির আনন্দে মুগ্ধ হন না, বরঞ্চ  মুগ্ধ হন আনন্দের সৃষ্টিতে অবগাহন করতে, সে ঈশ্বরকেই কেবল  বলতে পারেন রবীন্দ্রনাথ এভাবে, কী অপূর্ব  চিরশান্তি পারাবারের এক  চিরনির্ভর বন্ধু তুমি, সখা তুমি, চিরনির্ভর বন্ধু হয়ে তুমি আস আমার  এ’  জীবনে, আমার এ ক্ষুদ্র, আমার এ তুচ্ছ  জীবনে, এ  জীবনকে আলোকময় করতে, জীবনকে ঋদ্ধ করতে, জীবনকে  অপার  আনন্দ  সাগরে অবগাহন করিয়ে  আনন্দময় করে  তুলতে,  তুমিই আমার একমাত্র বন্ধু, আমার হৃদয়েশ, আমার ঈশ্বর।  আসলেই  তোমার কাছে  আমি নিশ্চিন্ত হতে পারি, নির্ভার হতে পারি, আর  হতে পারি এক অশেষ  অন্তহীন  হবার মন্ত্রে দীক্ষিত এক “আনন্দচিত্ত”। 

চিরবন্ধু চিরনির্ভর চিরশান্তি

তুমি হে প্রভু –

তুমি চিরমঙ্গল সখা হে তোমার জগতে, চিরসঙ্গী চিরজীবনে ।।

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.