শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

রাঙিয়ে দিয়ে যাও

“রঙ্গ বরষে ভিগে চুনার ওয়ালি রঙ্গ বরষে” – মাইকে তারস্বরে বেজে চলেছে। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে রুকু দেখল নিচে সবাই খুব রঙ খেলছে। এতো রঙ মেখেছে সব যে চেনাই মুশকিল কোনটা কে। সেদিকে তাকিয়ে রুকুর মুখটায় যেন আষাঢ়ের মেঘ নেমে এল। প্রত্যেকবার সে বাবার সাথে রঙ খেলতে বেরোয়।

কিন্তু এবার যে কি হয়ে গেল সব। কমলা মাসির শরীর খারাপ হয়ে গিয়ে সব ভেস্তে গেল। না, কমলা মাসি তার নিজের মাসি নয়, এমনকি তাদের পরিবারেরও কেউ নয়। কমলা মাসি তাদের বাড়ির সারাক্ষণের কাজের লোক। অনেক বছর ধরে এ বাড়িতে আছে। রুকু মায়ের কাছে শুনেছে যে কমলা মাসির বর রিকশা ভ্যান চালাত। বছর পাঁচেক আগে এক দুর্ঘটনায় কমলা মাসির বরের একটা পা কাটা পড়ে, তারপর বাধ্য হয়ে কমলা মাসিকে কাজের জন্য শহরে পাড়ি দিতে হয়। তাদের বাড়ি কাজ করে কমলা মাসি যে টাকা পায়, সেই টাকায় গ্রামে মাসির সংসার চলে। এমনিতে রুকু কমলা মাসিকে বেশ পছন্দ করে। মাসি সারা বছর তাদের বাড়িতেই থাকে, শুধু বছরে দুবার কয়েকদিনের জন্য তার গ্রামের বাড়িতে যায়। একবার দুর্গা পুজোর সময়, আর একবার এই দোলের সময়। কিন্তু এবার হঠাৎ দোলের কিছুদিন আগে মাসি ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়ল। সে কি জ্বর! তিনদিনেই মাসির চেহারা একেবারে খারাপ হয়ে গেছে। পরশু রাত থেকে জ্বরটা কম, কিন্তু কাল সকালে ডাক্তারবাবু মাসিকে দেখে বলে গিয়েছেন যে এই অবস্থায় মাসি কিছুতেই গ্রামের বাড়ি যেতে পারবে না। অন্তত আরো এক সপ্তাহ লাগবে পুরোপুরি ঠিক হতে। সেই শুনে কমলা মাসি কাল খুব কান্নাকাটি করেছে। মাসির জন্য ডাক্তার, ওষুধ, পথ্য এই সব ব্যাবস্থা করতে গিয়ে রুকুর বাবা এবার আর তাকে দোকানে নিয়ে গিয়ে রঙ পিচকারি কিনে দেবার সময় করে উঠতে পারে নি। অফিসেও নাকি বাবার কাজের চাপ খুব বেড়েছে। সে যাই হোক, রুকু ভেবেছিল যে বাবা ঠিকই সময় বের করে তার রঙ খেলার ব্যাবস্থা করে দেবে। কিন্তু কাল দুপুরে বাবা কি এক জরুরী কাজে বেরিয়ে গেছে, বলেছে ফিরতে ফিরতে আজ বিকেল হয়ে যাবে। তখনই রুকু বুঝে গিয়েছিলো যে এবার তার আর রঙ খেলা হবে না। তাও রুকু একবার আজ সকালে মায়ের কাছে বায়না করেছিল, কিন্তু মা বলে দিয়েছে যে সংসারের সব কাজ ফেলে এখন রুকুকে নিয়ে রঙ খেলতে বেরোতে পারবে না। ব্যাস, রুকুর সব রাগ গিয়ে পড়েছে কমলা মাসির ওপর। এই সময়েই শরীর খারাপ করতে হল? বছরে এক দিনই তো রঙ খেলা যায়, সেটাও মাসির জন্য এবার মাটি হল। আর বাবাকেই যে ঠিক এই সময়েই কেন চলে যেতে হল কে জানে? একবার ভেবেছিল মাকে জিজ্ঞাসা করবে, কিন্তু মায়ের মুখ দেখে আর সে সাহস হয় নি। সত্যিই তো, কদিন ধরে মায়ের যা ধকল যাচ্ছে। রুকুদের বাড়ির কাছেই গরীব বাচ্চাদের জন্য একটা থাকার জায়গা আছে, রুকুর মা সেখানে বাচ্চাদের বিনা পয়সায় লেখাপড়া শেখায়। যবে থেকে মাসি শরীর খারাপ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে, মা আর বাচ্চাদের পড়াতে যেতে পারছে না। এমনিতে কমলা মাসি রান্নাবান্না, বাসন মাজা, ঘর মোছা সব কাজই করে দেয়। এখন সে সবই মাকে একা সামলাতে হচ্ছে। তাই মায়ের মেজাজটা বেশ গরম এখন। তারপর কাল বাবার এভাবে হুট করে চলে যাওয়াটা মায়ের যে মোটেও পছন্দ হয়নি সেটা বেশ ভালই বুঝতে পারছে রুকু। তাই এ অবস্থায় মাকে আর বিরক্ত করার সাহস হল না রুকুর।

বেলা বাড়তে বাড়তে দুপুর হয়ে গেল। রুকুর মনে যে ক্ষীণ আশাটুকু ছিল যে বাবা হয়তো তাড়াতাড়ি ফিরে এসে তাকে নিয়ে রঙ খেলতে বেরোবে, সেটা এতক্ষণে কাচের গায়ে বাষ্পের দাগ যেমন আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়, সেরকম ভাবেই মিলিয়ে গেছে। এবার চান করতে হবে, নাহলে মা বকা দেবে। চান করতে গিয়ে রুকুর মনে পড়ে গেল, অন্যান্য বার দোলের দিন চান করাটা কি ভীষণ মজার ব্যাপার হয়। অত রঙ তুলতে গিয়ে পুরো বাথরুমটা রঙে ভরে যায়। আর মাথার চুল থেকে যে কত রকম রঙ বেরোয়! অনেক সাবান মেখে চান করার পরেও হাতে, পায়ে, মুখে রঙ থেকেই যায়। সেটা পুরোপুরি উঠতে আরো দু-এক দিন লেগেই যায়। দোলের পরের দিন সব বন্ধুরা মিলে দেখা হয় যে কার গায়ে কোন রঙ এখনও লেগে আছে। সে এক ভারী মজা! অথচ এইবার সেসব কিছুই হবে না। গায়ে যদি রঙ না লাগলো, তবে আর কিসের দোল? রুকুর খুব কান্না পেতে লাগলো। জানলা দিয়ে তাকিয়ে সে দেখলো, পাশের বাড়ির দেয়াল, এমনকি আম গাছের ডালটাতেও রঙ লেগে আছে। নিশ্চয় কারোর পিচকারি থেকে ছিটকে লেগেছে। রুকুর মনে হলো, আজ পৃথিবীর সব কিছুতেই রঙ, শুধু সেই একা বাদ পড়ল। মা খেতে ডাকল। ব্যাজার মুখে সে কোনরকমে খিচুড়ি আর বেগুনভাজা খেলো। অন্যান্য বছর এই দিনে তাদের বাড়িতে মাংস ভাত রান্না হয়। কি যে দারুন লাগে খেতে! কিন্তু এ বছর বাবা বাড়িতে নেই, তো মাংস আনবে কে? রুকুর মনটা আরো একবার নতুন করে খারাপ হয়ে গেল। দুপুরে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ার আগে বাবার কথা ভেবে রুকুর খুব অভিমান হল। সে ঠিক করলো বাবা ফিরে এলে আজ সে কিছুতেই বাবার সাথে একটাও কথা বলবে না। একদম আড়ি করে দেবে।

যখন রুকুর ঘুম ভাঙল, তখনও সন্ধ্যে হয় নি। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় তখনও সব কিছু বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অন্যদিন এই সময় সে বন্ধুদের সাথে খেলা করে। কত হুটোপাটি, হাসি, মজা হয় বিকাল বেলায়। তাই এই বিকেল বেলাটা রুকুর খুব প্রিয় সময়। কিন্তু আজ সেই বিকেলের আলোর দিকে তাকিয়ে রুকুর মনটা কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে গেল। আজ সারাটা দিন কি বিচ্ছিরি ভাবে কেটেছে সে সব কথা আবার তার মনে পড়ে গেল।

এইসব যখন সে ভাবছে, হঠাৎ সে বাবার গলা শুনতে পেল। বাবা তার নাম ধরেই ডাকছে। ডাকুক, আজ সে কিছুতেই সাড়া দেবে না। কিছুতেই একছুটে গিয়ে বাবার কোলে উঠে পড়বে না। ভীষণ অভিমানে রুকুর চোখদুটো ছলছল করে উঠল। একবার জানলা দিয়ে উঁকি মেরে সে নিচে তাকিয়ে দেখলো বাবা তার ঘরের দিকে তাকিয়ে তার নাম ধরে ডেকেই চলেছে। কিন্তু বাবার সঙ্গে এরা কারা? বাবার ঠিক একটু পেছনে দাড়িয়ে আছে একটি ছোট ছেলে আর একটি আরো ছোটো মেয়ে। রুকুর খুব কৌতুহল হল। একটু আগেই যে সে ভেবেছিল বাবার সাথে মোটেও কথা বলবে না, এখন এই দুটি বাচ্চার পরিচয় জানার অদম্য কৌতুহল তাকে সেইসব কথা ভুলিয়ে দিল। রুকু নিচে নেমে এলো। বাবা তার দিকে তাকিয়ে সুন্দর করে একটু হেসে বলল, “দ্যাখ তো রুকু মা, কাদের নিয়ে এসেছি? এরা তোর কমলা মাসির ছেলে মেয়ে রে। এদের আনতেই তো গেছিলাম। এখন চল দেখি আমার সাথে তোর মাসির ঘরে।” এই বলে বাবা পেছনে দাঁড়ানো ছেলে মেয়ে দুটিকে তাঁর সাথে আসতে বলে, রুকুকে সঙ্গে নিয়ে কমলা মাসির ঘরে গেল। কমলা মাসির এখন জ্বর ছিল না, মাসি জেগেই ছিল।
ছেলে মেয়ে দুটো ঘরে ঢুকতেই মাসি অবাক হয়ে তাদের দিকে চেয়ে রইল আর ছেলে মেয়ে দুটো দৌড়ে গিয়ে কমলা মাসিকে জড়িয়ে ধরল। রুকু দেখল, হঠাৎ মাসির শরীরটা যেন কেঁপে উঠল। ভালো করে চেয়ে রুকু দেখতে পেল যে মাসির দুচোখ দিয়ে জলের ধারা বইছে, অথচ মুখে একটুও দুঃখ নেই। সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ রুকুর চোখদুটো জ্বালা করতে লাগল। তার যেন কান্না পাচ্ছে। কিন্তু কই, তার মনে তো কোনো দুঃখ নেই, উল্টে সকাল থেকে যে মন খারাপটা তাকে ঘিরে রেখেছিল সেটা যেন কোথায় উধাও হয়ে গেছে। এমন সময়ে সে মাথায় একটা হাতের স্পর্শ পেলো, তার বাবার হাত।

বাবার দিকে ঘুরে তাকাতে বাবা তার চোখে চোখ রাখল আর তারপর এক অদ্ভুত শান্ত, সুন্দর কন্ঠে বলল, “শুধু গায়ে রঙ লাগলেই কি দোল খেলা হয় রে মা? হয় না। রঙ মনে লাগলে তবেই সে দোল খেলা সার্থক হয়।” ঘরের জানলা দিয়ে অস্তগামী সূর্যের রক্তিম আভা রুকুর চোখের নিচে জমে থাকা দু ফোঁটা মুক্তোর মত চোখের জলের ওপর পড়ে চিকচিক করে উঠল, ঠিক যেন দু ফোঁটা দোলের রঙ। পাড়ার মোড়ে লাগানো মাইক থেকে তখন ভেসে আসছে বিশ্বকবির গানের কলি –
“তেমনি আমায় দোল দিয়ে যাও
যাবার পথে আগিয়ে দিয়ে,
কাঁদন-বাঁধন ভাগিয়ে দিয়ে
রাঙিয়ে দিয়ে যাও”

[লেখকের অন্য রচনা]

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x