শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

বাংলা গানের উজ্জ্বল কারিগরেরা (পর্ব – ৪)

‘বাংলা গানের কারিগরেরা’ শিরোনামের পর্বান্তরের আলোচনার তৃতীয় পর্বে আমাদের আলোচ্য ছিলেন সলিল চৌধুরী ও অনল চট্টোপাধ্যায়। অতঃপর আমাদের আজকের আলোচনায় আসবেন সলিল চৌধুরীর ঘরানার বাকি দুই অনুসারী কিম্বদন্তীপ্রতিম গীতিকার-সুরকার প্রবীর মজুমদার ও অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায়।

প্রবীর মজুমদার

বাংলার এই উল্লেখযোগ্য সঙ্গীতপ্রতিভা প্রবীর মজুমদার। ওঁর জীবনকাল ৬ জানুয়ারি ১৯২৯ থেকে ১০ অক্টোবর ১৯৯০। পিতার নাম সুরবন্ধু মজুমদার। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে প্রায় তেমন কিছুই প্রায় জানা যায়নি। তাঁর স্ত্রী শ্রীমতী চিত্রা মজুমদার আকাশবাণী কলকাতার একজন বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন। প্রবীর বাবু সুরকার সলিল চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে বিকশিত হবার সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু সলিল চৌধুরীর প্রভাব থেকে বেরিয়ে বেশ কিছু গান সৃষ্টির মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত ঙ্করতে পেরেছিলেন। জীবদ্দশায় তাঁর অসংখ্য বন্ধু বান্ধব, ছাত্র-ছাত্রী এবং অনুরাগী মানুষ ছিল, একথা সহজেই অনুমেয়। অথচ তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়ায় তাঁর তেমন কোন উল্লেখ নেই দেখে বেশ অবাক ও হতাশ হয়েছি।

মনের এই অবস্থায় বাংলা গানের স্বর্ণযুগের একটি বিশেষ গান স্মরণে এল, যার গীতিকার কিংবদন্তী গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার এবং সুরকার ও শিল্পী সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। গানটি নিচে উদ্ধৃত করছি।

জানি একদিন আমার জীবনী লেখা হবে।
সে জীবনী লিখে রেখো

তোমাদের গানের খাতায়।।

যেদিন রব না আর তোমাদের মাঝে,
যদি এই তানপুরা আর নাহি বাজে।
তখন হঠাৎ যদি মনে পড়ে মোরে,
গেও শুধু মোর গান যতটুকু লেখা থাকে
তোমাদের স্মৃতির পাতায়।

এ জনমে আমি ওগো
তোমাদের শুনিয়েছি গান,
কখনো ভাবিনি তবু তোমাদের কাছে কভু পাব প্রতিদান।

যাদের মুখের হাসি মেঘে আছে ঢেকে,
জীবন কাহিনী যারা আঁখিজলে লেখে,
আমার প্রেরণা সে তো তাঁদেরি সে ব্যাথা
আমারি গানের সুরে তাঁদেরি সে ব্যাকুলতা
ঝড় হয়ে আকাশ মাতায়।

এই গানটি শুনলে মনে হয় যেন প্রবীর বাবুর জীবনের কথা। তাই মহাজনের পন্থা অনুসরণ করে এগোবার চেষ্টা করলাম গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজা করার। অনেক চেষ্টা করে ওঁর তৈরী করা যে গানগুলি খুঁজে বার করেছি তার তালিকা পরে জানাব। আগে পারিপার্শ্বিক কিছু ঘটনা দিয়ে ওঁর ব্যক্তিত্বের একটা ধারণা করা যায়। যেমন ওঁর বাবার নামটি শুনলে মনে হয়, উনি বেশ ভাল রকমের সাঙ্গীতিক উত্তরাধিকার নিয়ে জন্মেছিলেন। উনি খুব ঢিলেঢালা উদার মনের মানুষ ছিলেন। নিজের আখের গুছিয়ে নেবার চেষ্টা বোধহয় ওঁর মধ্যে একেবারেই ছিলনা। নিজের সাফল্যের চাইতে অন্যের সাফল্যেই উনি খুব খুশী থাকতে ভালোবাসতেন। শরীরে ও মনে স্নেহের আধিক্য ছিল। মনের স্নেহের উদাহরণ হিসাবে বলা যায়,বন্ধুর ভাই অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিভা বুঝতে পেরে উনি তাঁকে ভারতীয় গণনাট্য সংঘে নিয়ে গিয়ে সলিল চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। আবার ‘ছিপখান তিনদাঁড়’ কবিতায় অভিজিৎ বাবু সুর দেবার পর উনিই উৎসাহী হয়ে সলিল বাবুকে সে খবর পৌঁছে দেন। তার পরের ঘটনা তো সবার জানা। ওঁর জীবনে এ রকম ঘটনা হয়তো আরও অনেক ছিল। আর বাংলা গানের স্বর্ণযুগে ছোটদের জন্য যতগুলি গান তৈরি হয়েছিল, তার স্রষ্টা হিসাবে সলিল চৌধুরীকে বাদ দিলে প্রবীর মজুমদারের অবদান বোধহয় সবচেয়ে বেশী।

শরীরের স্নেহের বিষয়ে একটি মজার ঘটনা এক সাক্ষাৎকারে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় শুনিয়েছেন। একদিন হাজরার মোড়ে সলিল বাবু তাঁর তিন সহযোগীকে নিয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন। তখন সেখান দিয়ে একটি গাড়িতে করে অভিনেতা প্রদীপ কুমার যাচ্ছিলেন।তিনি তখন বম্বেতে অভিনয় করছেন। সলিল বাবুর ও তখন বোম্বে যাবার কথা চলছিল। তিনি একটু দোটানায় ছিলেন, যাবেন কি না সেই ভেবে।ছাত্ররা বললেন, ‘ সলিলদা,আপনি বোম্বে চলে যান। ওখান গেলে বেশ মোটা হয়ে যাবেন।দেখলেন না প্রদীপ কুমার কেমন মোটা হয়ে গেছেন’। সলিল বাবু সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলেন ‘হ্যাঁ ঠিক বলেছিস। তারপর বোম্বে থেকে যখন কলকাতায় আসব তখন তো তোরাই বলবি, কি প্রবীরদা, কেমন আছেন?’

লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, ওঁর দুই অন্তরঙ্গ সাথীদের চাইতে ওঁর সঙ্গীত সৃষ্টি তুলনায় বেশ কম। যথেষ্ট প্রতিভার অধিকারী হলেও ওঁর উদ্যম হয়তো কিছুটা কম ছিল। যাই হোক, ওঁর স্বল্পায়ু জীবনে ওঁর কাছ থেকে আমরা যতটা পেয়েছি, তা নিয়ে আমাদের কৃতজ্ঞতা কিছু কম হয়না। ১৯৯০ সালের ১০ ই অক্টোবর কলকাতায় ওঁর মৃত্যু হয়।

ওঁর কথা ও সুরে প্রকাশিত কিছু গানের তালিকা নিচে দিলাম
সমবেত কণ্ঠে, ‘আমরা এই বিশ্বের বুকে গড়ব রঙমহল’, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘মাটিতে জন্ম নিলাম’, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘অনেক রাত ঝিমানো চাঁদ’,’ তুমি এখন অনেক দূরে ‘, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের ‘মন ছুটেছে আজ তেপান্তরে’, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘এখনো এই রাত অনেক বাকী’, নির্মলা মিশ্রের ‘ও তোতা পাখি রে’, ‘কখন যে প্রজাপতি পাখা ভরা রঙ ছড়ায়’, সনৎ সিংহের ‘বলতে পারিস মা’, পিন্টু ভট্টাচার্যের ‘দরদী হারা মন আমার’, জপমালা ঘোষের ‘কাটুম কুটুম বুড়ো’, শরদিন্দু দাশগুপ্তের ‘সারা ক্ষণ দুটি মন’ ইত্যাদি।
প্রবীর মজুমদারের সুরে গাওয়া এবং অন্য গীতিকারের লেখা কিছু গানের তালিকা নিচে দিলাম।
দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের ‘জীবনের এই বালুবেলায়’, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কনক চাঁপা ধান’, বনশ্রী সেনগুপ্তের ‘আজ বিকেলের ডাকে তোমার চিঠি পেলাম’, সনৎ সিংহের ‘কে আমারে বলতে পারে’, ‘বুদ্ধির গোড়াতে জল দাও’, ‘ঝমা ঝম মল বাজে’, ‘এক এক্কে এক’, ‘না না না বাজে না’, ‘চলছে চাঁদের বাড়ী’, ‘যদি কেউ কোনদিন যাও’, তৃপ্তি মুখোপাধ্যায়ের ‘চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে’ ইত্যাদি।
আমার একটা ভ্রান্ত ধারণা ছিল, এই গীতিকার সুরকাররা সবাই বোধহয় শুধু নিজেদের লেখা গানেই সুর করেছিলেন। কিন্তু কোন গানের গীতিকার ও সুরকার কারা, সেটা খুঁজতে গিয়েই দেখলাম, তাঁদের অনেক জনপ্রিয় গানের গীতিকার কিন্তু নিজে বা বিখ্যাত গীতিকারদের কেউ নন। সত্যি বলতে কি, আমার এঁদের সম্পর্কে কোন ধারনাই ছিলনা। এ পর্যন্ত আমি এরকম যত জনের সন্ধান পেয়েছি তাঁদের নিয়ে পরবর্তী পর্বে কিছু আলোচনা করার ইচ্ছে রইল।

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

সলিল চৌধুরীর তিন অনুসারীর মধ্যে সব চেয়ে ছোট এবং সবচেয়ে উজ্জ্বল ছিলেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। একাধারে তিনি ছিলেন সুরকার, গীতিকার এবং সঙ্গীতশিল্পী। উত্তর কলকাতার এক ব্রাহ্ম পরিবারে ১৯৩১ সালের ২৪ শে জুলাই তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তবে তাঁর জীবনের প্রথম ভাগ কেটেছে দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়ায়। বাবা নিরাময় বন্দ্যোপাধ্যায় সহ পরিবারের সব সদস্যের সঙ্গে সঙ্গীতের যোগ ছিল। মেজো জ্যাঠা নিরুপম বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ধ্রুপদ গানের শিল্পী। মা লাবণ্য বন্দ্যোপাধ্যায় অর্গানের মত হারমোনিয়াম বাজাতেন। সঙ্গীতশিল্পী দাদা অরিন্দম বন্দ্যোপাধ্যায় গানও লিখতেন।

পিঠোপিঠি দুই ভাই অরিন্দম ও অভিজিৎ সব সময় একসাথে সব কাজ করতেন।যেমন ব্রাহ্মদের নগর সংকীর্তনের নকলে বাড়িতে খেলার কীর্তন অথবা বাড়ির পাঁচিল টপকে খেলা দেখতে বা গান শুনতে যাওয়া। এই দাদা আর তাঁর বন্ধু প্রবীর মজুমদার অভিজিতের সঙ্গীত জীবনের পথপ্রদর্শক। পড়াশোনার সাথে সাথে তাঁর সঙ্গীতের চর্চা চলেছিল। তিনি ঊষারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন। পিয়ানো শিখেছিলেন ভি বালসারার কাছে। ব্রাহ্ম পরিবারে জন্মসূত্রে বাড়িতে রবীন্দ্র চর্চা ও রবীন্দ্র সঙ্গীত ছিল তাঁর স্নায়ুতে আর রক্তে মিশে।

ঢাকুরিয়ার রেল স্টেশনের মাঠে অভিজিৎরা খেলাধুলা করতেন। মাঝেমধ্যে সেখানে সভা হত। একবার রেল ধর্মঘট উপলক্ষে এক সভায় অভিজিৎ দেখলেন পাজামা শার্ট পরা কৃষ্ণবর্ণ, ছিপছিপে এক মানুষ তাঁর বিস্কুট রঙের কোট খুলেই হারমোনিয়াম নিয়ে গাইতে শুরু করে দিলেন, ‘এক হো এক হো, হিন্দু মুসলিম বাবু মজদুর এক হো’। বলিষ্ঠ ভঙ্গীর উদ্দীপ্ত সেই গান শুনে অভিজিৎ বাক্যহারা। তখন কে জানত, এই মানুষটিই হয়ে উঠবেন অভিজিতের সঙ্গীত জীবনের অন্যতম ধ্রুবতারা! সেদিনের সেই মঞ্চগায়ক ছিলেন সলিল চৌধুরী। দাদার বন্ধু প্রবীর মজুমদার কিছুদিন পরে ওঁকে নিয়ে যান গণনাট্য সংঘে। সেখানেই সলিল চৌধুরীর সঙ্গে ওঁর পরিচয় ও ঘনিষ্টতা হয়। তাঁর অভিভাবকত্বেই অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভবিষ্যতের পথ চলা।

সরকারী চাকরীর সঙ্গে সঙ্গীত চর্চা চলছে, একদিন দাদা অরিন্দম একটা গান লিখে ওঁকে সুর দিতে বলেন। সুর দিলেন, কিন্তু সেটা রবীন্দ্র সংগীতের ধরনের হল। পরে দাদার জোরাজুরিতেই সুর দিলেন সত্যেন্দ্র নাথ দত্তের ‘দূরের পাল্লা’ কবিতায়। অভিজিৎ নিজেই অবাক নিজের সুরে।প্র বীর মজুমদার সেটা শুনে গিয়ে বললেন সলিল চৌধুরীকে। অভিজিতের তলব হল সলিলের দরবারে। গান শুনে সলিল বাবু ঠিক করলেন, এই গান রেকর্ড করাতে হবে। গ্রামোফোন কোম্পানিতে গিয়ে নিজেই সব ব্যবস্থা করলেন। উনিই শ্যামল মিত্রকে গানটি তোলালেন আর রেকর্ডিংয়ের সময়ে অর্গান বাজিয়েছিলেন। শ্যামল মিত্রের কণ্ঠে গানটি খুব জনপ্রিয় হয়ে গেল। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা গানের জগতে প্রবেশ করলেন।
অভিজিৎ কিন্তু গানটি কোন প্রবীণ শিল্পীকে দিয়ে গাওয়াবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু সলিল বাবুর যুক্তি ছিল, প্রবীণ শিল্পীর গায়কী প্রভাবিত করবে এই গানের সমসাময়িকতাকে। বরং শ্যামল মিত্রের কণ্ঠে নতুন চেহারা নেবে এই গান। অনেকের ধারণা, ‘ছিপখান তিন দাঁড়’ গানটি বোধহয় সলিলের ‘পাল্কী চলে’ গানের প্রেরণায় তৈরী হয়েছিল। আসলে কিন্তু তা নয়। ‘পাল্কী চলে’ গানের দু’বছর আগে ওই গানে সুর করেছিলেন অভিজিৎ।
গুরু শিষ্যের মধ্যে সম্পর্কটা ছিল এই রকম। সঙ্গীত পরিচালনা এবং সুরকার হিসেবে অভিজিতের প্রচারবিমুখতা নিয়েও খানিকটা অখুশী ছিলেন সলিল বাবু। সরকারী চাকরীর জন্য গানে মনোনিবেশ করতে পারেন না অভিজিৎ, এমনটাই অভিযোগ ছিল সলিল বাবুর।
সলিল চৌধুরীর উল্লিখিত তিন সহকারী প্রায়ই সলিল বাবুর সঙ্গে মিলিত হতেন। তাঁদের মধ্যে সঙ্গীত নিয়ে চর্চা হত।একবার একটা ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান সুর শুনিয়ে সলিল বাবু বললেন, ‘আমি একটা করছি, তোরাও কর’।সলিল বাবু করলেন ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’। গাইলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। অভিজিৎ করলেন ‘পারুল পারুল শিমূল শিমূল’। গাইলেন গায়ত্রী বসু। আর অনল চট্টোপাধ্যায়ের কথায় প্রবীর মজুমদার করলেন ‘জীবনের এই বালুবেলায়’। গেয়েছিলেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়।

গণনাট্য পর্বে ১৯৪৯ সালে অনল চট্টোপাধ্যায়ের কথায় ও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে ‘ কোথায় সোনার ধান ‘ রেকর্ডে প্রকাশ হওয়ায় জনমানসে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি হয়।১৯৭৪ সালে প্রথম বার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়,অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় জুটিতে তৈরী প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ তোমার দু চোখে আমার স্বপ্ন আঁকা ‘ গানটি আধুনিক বাংলা পূজোর গানের জগতে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্থায়ী আসন প্রতিষ্ঠা করে। এই গানটি ‘ তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান ‘ বলে পরিচিত হয়।

সলিল চৌধুরী, অভিজিৎ

একবার পুজোর গানের জন্য বন্ধু অমিয় দাশগুপ্তর লেখা ‘হংস পাখা দিয়ে’ গানটিতে সুর করে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এইচ এম ভি তে গেলেন তদানীন্তন রেকর্ড ম্যানেজার পবিত্র মিত্রকে শোনাতে। তিনি মন দিয়ে গানটি শুনলেন। তারপর উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘ আপনি তো এই গান হেমন্তরে ভাইব্যা করছেন। এইডা আপনি শ্যামলরে দ্যান, দ্যাখেন তারপর কি হয়’। অভিজিৎ সেই মত শ্যামল মিত্রকে দিয়ে গাওয়ালেন। গানটি ইতিহাস গড়ে দিয়েছিল।
সুবীর সেনের অনেক জনপ্রিয় গান অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায়ের সুরে। দুজনেই বিদেশী গানের ভক্ত, একসঙ্গে বসে গান শুনতেন, মতের আদানপ্রদান হত। তারই ফসল জিম রিভসের ‘আই হিয়ার দ্য সাউন্ড অফ ডিস্ট্যান্ট ড্রামস’ থেকে ‘সারাদিন তোমায় ভেবে’, স্নো ফ্লেক্স থেকে ‘এ যেন সেই চোখ’ বা ন্যাট কিং কোলের ‘মোনালিসা’ থেকে ‘মোনালিসা’। পাশ্চাত্য প্রভাব থেকেই ‘সন্ধ্যা লগনে স্বপ্ন মগনে’ বা ‘নগর জীবন ছবির মতো’। রোমান্টিক কণ্ঠে দুর্দান্ত পরিবেশন করেছিলেন সুবীর সেন।

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ছায়াছবিতে খুব কম কাজ করেছেন। কিন্তু যেসব ছবিতে তিনি সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন সেসব ছবির গানে অভিজিতের সুরবৈচিত্র‍্যের পরিচয় পাওয়া যায়। অনেক গানই দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ‘জীবন রহস্য’ ছবিতে আশা ভোঁসলের দুটি গান ‘ও পাখী উড়ে আয়’ ও ‘যদি কানে কানে’ এবং মান্না দে র ‘পৃথিবী তাকিয়ে দেখ’ ও ‘কে তুমি কে তুমি শুধুই ডাকো’, ‘সেলাম মেমসাহেব’ ছবিতে মান্না দে র ‘ঝর্ণা ঝর ঝরিয়ে’, ‘হারায়ে খুঁজি’ ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘সে ভাবে সবুজ পাথর’, আরতি মুখোপাধ্যায়ের ‘টুং টাং পিয়ানোয় সারাটি দুপুর’, ‘ঝননন তননন’, অনুপ ঘোষালের ‘ফুলে ফুলে বঁধু’ ইত্যাদি গান তারই উদাহরণ।
ছায়াছবিতে সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে ১৯৬৮ সালে তাঁর প্রথম ছবি ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’। ২০০০ সালে ‘ঋণমুক্তি’ তাঁর শেষ ছবি।

তাঁর সুরারোপিত জনপ্রিয় গান গুলির তালিকায় আমি তাঁর লেখা গানগুলি (*) চিহ্নিত করে দিলাম। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের (*)’অনেক অরণ্য পার হয়ে’, ‘তোমার ও মন মহুয়া যদি হয়’, ‘সোনালি চম্পা আর রূপালী চন্দ্রকলা’, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তোমার দুচোখে আমার স্বপ্ন আঁকা’, ‘ওই আকাশে ক্লান্তি নেই’, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘যদি আমাকে দেখ তুমি উদাসী’, ‘সেই চোখ কোথায় তোমার’, ‘মুক্তো ছড়া নেইকো কন্যা’, উৎপলা সেনের ‘এত মেঘ এত যে আলো’, ‘এই রিম ঝিম ঝিম বৃষ্টি’, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘তুমি মেঘলা দিনের নীল আকাশের’, ‘দুটি ওই কাঁকনের ছন্দ’, গায়ত্রী বসুর (*)’দূর বনপথে ছায়াতে আলোতে’, ‘পারুল পারুল শিমূল শিমূল’, ‘মেঘ মেঘ মেঘ কত মেঘ’, ‘তুমি আমার নিত্য কালের’, সুবীর সেনের ‘নয় থাকলে আরো কিছুক্ষন’, (*) ‘এ যেন সেই চোখ ‘, ‘(*) মোনালিসা ‘ , (*)’সারাদিন তোমায় ভেবে’, (*) ‘হয়তো তোমার অনেক ক্ষতি করেছি’ , ‘নগর জীবন ছবির মত হয়তো’, ‘তুমি বলেছিলে কোন মনের মুক্তো’, ‘সন্ধ্যা লগনে স্বপ্ন মগনে’, ‘যদি ভুল কিছু করে থাকি’, নির্মলা মিশ্রের ‘কেন এই গান গাওয়া’, ‘বলোতো আরশি তুমি’, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের ‘কপালে সিঁদুর সিঁদুর টিপ পড়েছ’, ‘সাতনরী হার দেব’, ‘হাজার মনের ভিড়ে’, ইলা বসুর ‘কি যেন আজ ভাবছ বসে’, ‘একটি দিনের চেনা’, (*)’বনে বনে বসন্ত আসে’, (*)’শাওন ঘন বরষায়’, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দোল দোল চতুর্দোলায়’, ‘তোলপাড় তোলপাড় মনের কথা’, সনৎ সিংহের ‘রথের মেলা বসেছে’ হৈমন্তী শুক্লার ‘এখনো সারেঙ্গীটা বাজছে’ ইত্যাদি। এছাড়া যদিও পুজোর গান নয়, তবুও খুব উল্লেখযোগ্য হিসাবে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা ও সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘সবাই চলে গেছে’ ও ‘এমন একটা ঝড় উঠুক’ গান দুটিও যোগ করলাম।

ওঁর প্রকাশিত রচনাঃ গানের ইতিবৃত্ত ‘কিছু গান কিছু কথা’, কাব্য গ্রন্থ ‘ঝড়ের রাতের পাখী’, গান নিয়ে ভাবনা ‘বাংলা গানের পথচলা’, ও ‘জীবন বীণার রাগ রাগিণী’ এবং অন্য লেখা ‘অকিঞ্চনের কড়চা’।

১৯৫৯ সালে আনন্দ মুখোপাধ্যায়ের কথায় মৃণাল চক্রবর্তীর জন্য সুরারোপ করেছিলেন ‘যদি দূরে চলে যাই কোন ফাগুনের ভোরে/ফুলের আখরে,সবুজ বনছায়ে স্বাক্ষর রেখে যাব’। কি সুর! কি অসাধারণ গেয়েছিলেন মৃণাল চক্রবর্তী! সেই গানের শেষ ভাগে ছিল, ‘কণ্ঠ আমার ক্লান্ত যেদিন হবে/ জানিনা আমায় মনে রবে কি না রবে/ শুধু সুরের আখরে আমার এ গীতিকায়/ স্বাক্ষর রেখে যাব’। মৃণাল চক্রবর্তীর অন্য গানের তুলনায় এই গানটি স্বল্পশ্রুত বলে আমার মনে হয়। পাঠকদের আমি এই গানটি শোনার অনুরোধ রাখলাম।

সত্যিই এক ফাগুনের, ঠিক ভোরে নয় একটু পরে, বেলা এগারোটায় চিরতরে দূরে চলে গেলেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, ২০২২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসের দিনে। কথা আর সুরে বাংলা গানের জগতে উনি যে স্বাক্ষর রেখে গেছেন, কণ্ঠ থেমে গেলেও বাংলার সঙ্গীতপ্রেমী মানুষরা সেটা মনের খাতায় ধরে রাখবেন বলেই আমার বিশ্বাস।

[লেখকের অন্য রচনা]

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
5 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Tanmay Banerjee
Tanmay Banerjee
1 month ago

অসম্ভব পরিশ্রমী ও তথ্যনিষ্ঠ রচনা। বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া স্বর্ণযুগের বাংলা গানের কারিগরদের এবং তাঁদের কাজগুলিকে যে নিষ্ঠা নিয়ে আপনি উদ্ধার করে চলেছেন, তার জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়।

Chandan Sen Gupta
Chandan Sen Gupta
Reply to  Tanmay Banerjee
1 month ago

অনেক ধন্যবাদ।

Himadri Kumar Das Gupta
Himadri Kumar Das Gupta
1 month ago

আপনার লেখা আমি পড়ি, মন দিয়ে পড়ি। ভাল লাগে, বিশেষ করে বিষয় যদি হয় গান। তবে আপনি কম লেখেন। যাক্, প্রবীর মজুমদারের কথা উঠলেই আমার ধনঞ্জয় ভট্টচার্যের কণ্ঠে মনে পড়ে – ‘মাটিতে জন্ম নিলাম, মাটি তাই রক্তে মিশেছ’। আহা ! সুর তো বটেই, সম্ভবত কথাও প্রবীরবাবুর। আরও লিখবেন বলেছেন। লিখুন।

Chandan Sen Gupta
Chandan Sen Gupta
Reply to  Himadri Kumar Das Gupta
1 month ago

আপনার মত কয়েকজন শুভানুধ্যায়ীদের প্রশ্রয়ে আমি এই লেখাটি এগিয়ে নিয়ে যাবার সাহস পেয়েছি। ‘ মাটিতে জন্ম নিলাম ‘ গানটির কথা ও সুর প্রবীর বাবুর।আমার মনে হয়,এই গানটিই প্রবীর বাবুর সবসেরা সৃষ্টি।এর পরে ওঁর কথা ও সুরে ‘ ও তোতা পাখি রে ‘।আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

Himadri Kumar Das Gupta
Himadri Kumar Das Gupta
Reply to  Chandan Sen Gupta
1 month ago

আচ্ছা ।

5
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x