শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

প্রমথেশ বড়ুয়া : চলচ্চিত্রের এক প্রবাদ-প্রতিম ব্যক্তিত্ব

মহারাণী সরোজবালা প্রয়াত হয়েছেন। সারা প্রাসাদে জুড়ে শোকের ছায়া। ধুমধাম করে শ্রাদ্ধ হচ্ছে। মুন্ডিত মস্তকে শ্রাদ্ধে বসেছেন মহারানির জ্যেষ্ঠ পুত্র। দ্বাদশ পুরোহিত উচ্চকণ্ঠে মন্ত্রপাঠ করে চলেছেন অদুরে উপবিষ্ট স্বয়ং মহারাজ প্রভাতচন্দ্র।

এমন সময় বাইরে প্রচন্ড গোলমালের শব্দ। গ্রামবাসীদের ভয়ার্ত চিৎকার –‘ বাঘ বেরিয়েছে! বাঘ বেরিয়েছে! মুহূর্তে পরিবেশ বদলে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যে বন্দুক কাঁধে বেরিয়ে পড়লেন সবাই। সকলের পুরোভাগে রয়েছেন মহারাজার সেই মুন্ডিতমস্তক জ্যেষ্ঠপুত্র।

বাঘ মেরে ফিরে এসে আবার শুরু হল শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। আর ঐ মুন্ডিত মস্তক পুত্রটি হলেন এই পরিবারেরই জ্যৈষ্ঠ সন্তান, ভারতীয় চলচিত্রের কিংবদন্তী কুমার প্রমথেশচন্দ্র বড়ুয়া। দর্শকদের প্রিয় ‘বড়ুয়া’। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির তিনি দোর্দন্ডপ্রতাপ ‘বড়ুয়া সাহেব’।

হ্যাঁ, শিকারটা এমনই একটা ব্যাপার ছিল আসামের গৌরিপুর রাজ পরিবারে।

গৌরীপুর রাজবাড়ীতে লেখাপড়া করাটা প্রধান বলে মনে করতেন না কেউই। শিকারে কে কতটা পারদর্শী হয়েছেন সেটাই শিক্ষার মাপকাঠি বলে গণ্য হত। ওখানে লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হবার আগেই হত বন্দুকে হাতে খড়ি।

রাজারা বলতেন লেখাপড়া শেখার দরকার তোমার নেই। কলম তোমাকে শত্রুর হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না। বাঁচাবে বন্দুক। লেখাপড়া শিখবে তারা, যাদের চাকরী করে খেতে হবে।

মহারাজ প্রভাতচন্দ্র নিজের হাতেই রেখেছিলেন ছেলেদের বন্দুক ছোড়া শিক্ষার ভার। লক্ষভেদ শুরু হত গাছের ফল দিয়ে। পরে উড়ন্ত পাখি। তারই সঙ্গে চলত হাতির পিঠে ওঠা, ঘোড়ায় চড়া, গাছে চড়া, নৌকা চড়ার ট্রেনিং।

প্রভাতচন্দ্র বন্দুকে বিশ্বাসী হলেও, তিনি চাইতেন তাঁর তিন ছেলে প্রমথেশ, প্রকৃতীশ, প্রণবেশ এবং দুই মেয়ে নীহারবালা ও নীলিমাসুন্দরী শিক্ষিত হোক। সেজন্য বাড়ীতে শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া, গান বাজনা শিখিয়েছিলেন।

মহারাজের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় নি। রাজপরিবারের ছেলেমেয়েদের মেধা ও দীপ্তির কোন দারিদ্র ছিল না। কেউ চাইলে প্রত্যেকের জীবনকথার ইতিহাস লিখতেই পারেন।

‘দেবদাস’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য

বড় রাজকুমার প্রমথেশ চলচিত্র জগতের ইতিহাসে এক অবিস্মরীয় চরিত্র। প্রকৃতীশ (লালজী) হাতি বিশেষজ্ঞ ও শিকারী হিসাবে আন্তর্জাতিক খ্যতিসম্পন্ন।নীহার বড়ুয়া লোকসংস্কৃতির বিশিষ্ট গবেষিকা, লোকনৃত্য ও লোকগানের দিশারী চরিত্র। ছোট রাজকুমারী নীলিমা চিত্র শিল্পী কলাভবনে নন্দলাল বসুর ছাত্রী।

এক নাতনী প্রতিমা পান্ডে বড়ুয়া লোকগীতির রাজকন্যা বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা করে জীবিতকালেই কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছেন। আর এক নাতনী পার্বতী বড়ুয়াও ছিলে হস্তিবিশারদ।

জল জঙ্গলের জগৎ থেকে প্রমথেশ বড়ুয়া যেন খানিকটা ছিটকে বেরিয়ে এসে চলচিত্র জগতে এসে পড়লেন।

প্রমথেশের প্রথম বাঘ শিকার ১৩ বছর বয়সে। তাঁর মোট শিকারের হিসাব হল — পঞ্চাশটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার, তেইশটি চিতা বাঘ, একটি গন্ডার। ভাল্লুক, হরিণ এবং অন্যান্য প্রাণী অগুনতি। এই হিসাব অবশ্য রাজবাড়ির অন্যান্য শিকারীর তুলনায় অনুপাতে কম।

প্রমথেশের মনটি ছিল নরম। দয়া মায়া ক্ষমা সহিষ্ণুতা বিশিষ্ট গুণগুলি তিনি তাঁর মা সরোজবালার কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। আট বছর বয়স পর্যন্ত তিনি কেবল দুধ খেয়ে কাটিয়েছেন। ন ‘বছর বয়সে প্রথম ভাত খান। ভাতের সঙ্গে খেতেন ডাল, শাকভাজা এবং কড়া করে আলুভাজা। তখনকার দিনে আড়াই হাজার টাকা ভাতা পেতেন কিন্তু খাদ্য তালিকার বদল ঘটেনি!

এই স্বভাবের জন্যই একদিন শিকারে বিতৃষ্ণা এল । শিকারে যাওয়ার সময় প্রমথেশের সঙ্গে থাকত ছোট- বড় বিভিন্ন ধরনের পাথর, ইজেল, রং, তুলি, প্যালেট, কাগজ, পেনসিল। তাই নিয়ে বাবার সঙ্গে প্রচন্ড মন কষাকষি ঘটে গেল। আসলে প্রমথেশের চরিত্রটাই ছিল অদ্ভুত। তাঁর মতি ছিল অতি চঞ্চল জীবনের স্থির কোন লক্ষ্য ছিল না।

বাড়িতে শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে লেখাপড়া করার পর প্রমথেশকে কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয় ক্লাস নাইনে। কিন্তু ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিয়েছিলেন গৌহাটি থেকে। ১৯২৪ সালে ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে বি এস সি পাশ করেন। কিন্তু তার আগে ১৯২১ সালে তাঁর বিয়ে হয়ে গেল কলকাতার মেয়ে মাধুরী দেবীর সঙ্গে।

বিয়ের ব্যাপারে প্রমথেশের মানসিকতা ছিল বরাবরই রোমান্টিক। যাকে বিয়ে করব তাকে ভাল করে জানব বুঝব তবেই না বিয়ে! এই ধারণা থেকেই তিনি নিজেই জীবনসঙ্গিনীর খোজ করে বেড়াতেন। তিন চারটি মেয়ে দেখার পর একজনকে পছন্দ হয়ে গেল।

পছন্দের সেই পাত্রীর কথা বন্ধু মারফত বাবার কানে তোলালেন। ততদিনে রানি সরোজবালা মাধুরীকে নির্বাচন করে পাকা কথা দিয়ে দিয়েছ বসে আছেন । অগত্যা সব রোমান্টিসিজমের ইতি। মায়ের কথা রাখতে মাধুরীকে বিয়ে করলেন।

প্রমথেশ বাংলা নাটকের প্রতি আগ্রহী হন প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময় থেকে।গৌরীপুরে বন্ধুদের নিয়ে একটি নাটকের ক্লাব খুলে ফেললেন। ১৯১৯-১৯২৪ সাল পর্যন্ত তিনি গৌরীপুরে অন্তত ষোলখানি নাটকে মুখ্যভূমিকায় অভিনয় করেন। নাটকের সঙ্গে খেলাধূলা ও সমাজসেবার কাজে জড়িয়ে পড়লেন। এইসব কাজের সুত্রে গৌরীপুরের সাধারণ প্রজাদের দুঃখ দুর্দশা তাঁর নজরে আসে।

গরিব প্রজাদের প্রতি তিনি ছিলেন উদার। যারা দু’বেলা পেট পুরে খেতে পায় না, তাদের কাছ থেকে তিনি টাকা চাইতে পারবেন না। তাই মহারাজের মৃত্যুর পর রাজপ্রথা অনুযায়ী বড় রাজকুমার প্রমথেশচন্দ্রকে স্টেটের কাজের দায়িত্ব নেবার কথা বললে তিনি বলেছিলেন , এই কাবুলিওয়ালার কাজ আমি করতে পারবো না। করেননিও। ভাই প্রকৃতিশচন্দ্রের হাতে রাজ্যপাট তুলে দিয়ে কলকাতায় চলে এসেছিলেন।

কিন্তু তার চোখে তখন ভিন্ন আলো তিনি প্রকৃতীশচন্দ্রেের হাতে রাজ্যপাট তুলে দিয়ে কলকাতায় চলে এলেন।

এই মানসিকতাই বোধহয় প্রমথেশকে রাজনীতিতে এনে ছিল। যে মাকে এত ভালোবাসতেন সেই মা চলে গেলেন ১৯২৫ সালে। মনমরা হয়ে পড়লেন প্রমথেশ। এই সময়ে প্রমথেশ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসাম ব্যবস্থা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। যোগ দেন চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ পার্টিতে । রাজনীতি করেছিলেন ১৯২৯ সাল পর্যন্ত।

১৯২৯ সালেই প্রমথেশের জীবনে মোড় ঘুরে গেল অন্যদিকে। তাঁর চোখে তখন ভিন্ন আলো। তিনি চলচ্চিত্র জগতে এসে পড়লেন। চলচিত্রে অভিনয় ও চলচিত্র নির্মাণের নেশা তাঁকে টানছে।

ধীরেন গাঙ্গুলি ওরফে ডি.জির অনুরোধে একদিন শুটিং দেখতে গিয়েছিলেন ‘পঞ্চশর’ ছবির। দেখলেন নায়ক ঠিকমত বন্দুকের ট্রিগার ধরতে পারছেন না। ডি জির অনুরোধে প্রমথেশ দেখিয়েও দিলেন ট্রিগার ধরার প্যাঁচপয়জার। না তাতেও পারলেন না নায়ক।

শেষ পর্যন্ত পরিচালকের কথায় ওই দৃশ্যটিতে নায়কের জায়গায় প্রমথেশকেই অভিনয় করতে হল। ছবিতে তাঁর প্রথম আবির্ভাব হিসাবে ঘটনাটি চিহ্নিত হয়ে রইল। তখন থেকেই প্রমথেশের মাথার মধ্যে ফিল্ম সম্পর্কে নানা অাইডিয়া ঘুরপাক খেতে লাগল।

১৯৩০ সালে যকৃতে পাথর ধরা পড়ায় চিকিৎসার জন্য বিদেশে গেলেন প্রমথেশ। সুপ্ত বাসনা ছিল সুযোগ পেলে বিদেশে গিয়ে ফিল্ম সম্পর্কে হাতে কলমে শিক্ষা নেবেন। সুযোগও এসে গেল ।

ঠিক সেই সময় ইওরোপ ভ্রমণ করছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রমথেশ কবির সাথে দেখা করলেন। খুশি হয়ে তিনি প্রমথেশকে একটি পরিচয় পত্র লিখে দিলেন। সেই পত্র নিয়ে প্রমথেশ ফ্রান্সের ফক্স স্টুডিয়োতে মিঃ রোজার্সের সঙ্গে কাছে । হাতে কলমে শিখলেন সিনেমায় কৃত্রিম আলোর ব্যবহার। ভারতীয় সিনেমায় সে সব জিনিষ তখন অজানা। অনেক যন্ত্রপাতি কিনে দেশে ফিরে এলেন।

ইউরোপ থেকে ফিরে এসে ১৯৩১ সালের গোড়াতেই প্রমথেশ প্রতিষ্ঠা করলেন বড়ুয়া ফিল্ম ইউনিট। সঙ্গে রইলেন পরিচালক দেবকী বসু এবং ক্যামেরাম্যান কৃষ্ণগোপাল। তৈরী হল প্রথম ছবি ‘অপরাধী’। নির্বাক ছবি। এইটিই ছিল প্রথম ছবি যাতে কৃত্রিম আলোর ব্যবহার হল। শিল্পীর মুখের উপর রিফ্লেক্টার দিয়ে সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে দৃশ্য গ্রহণ করা হল। সেই সঙ্গে ব্যবহৃত হল বৈদ্যুতিক আলোর ফ্লাড লাইট।

কলকাতায় মুলেন স্ট্রিটের বিস্তীর্ণ অংশ নিয়ে বড়ুয়া স্টুডিয়োর প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রমথেশ চিরকালের বেহিসাবী মানুষ। স্টুডিয়ো তৈরীতে জলের মত অর্থ ব্যয় হল। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই অর্থের অনটন শুরু হয়ে গেল। স্টুডিয়ো তৈরীতে যে টাকা খরচ হওয়ার কথা ছিল তার দ্বিগুন টাকা খরচ হয়ে গেল। অ্যাকাউন্টের টাকা -যে টাকা রাজাবাহাদুরের কাছ থেকে এনেছিলেন তা যে কোথায় গেল তার আর খোজ পাওয়া গেল না।

স্টুডিয়ো তৈরীর কাজ বন্ধ হয়ে গেল। রাজা প্রভাতচন্দ্রও স্টুডিও তৈরীর জন্য আর টাকা দিলেন না। প্রমথেশ বুঝতে পারলেন , যাদের বিশ্বাস করেছিলেন তারাই টাকা পয়সা লুটে পুটে খেয়েছেন। তাঁর স্বপ্নের এই ভগ্নদশা তিনি আর সহ্য করতে পারছিলেন না। একদিন দেওয়ানজিকে কলকাতায় ডেকে পাঠালেন।এই দেওয়ানজি হলেন রবীন্দ্রনাথের একসময়ের একান্তসচিব অজিত চক্রবর্তীর পিতা দ্বিজেশচন্দ্র চক্রবর্তী। শেষ পর্যন্ত দেনার দায়ে স্টুডিয়ো বিক্রি হয়ে গেল। মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেন প্রমথেশ।

এইরকম মানসিক অবস্থায় এমন একটি ঘটনা ঘটল -যা প্রমথেশের জীবনের জটিলতা আরো বেড়ে গেল। প্রমথেশের জীবনে এল এক নারী ক্ষিতি দেবী। ভালো নাম অমলা। শিলং -এর মেয়ে। যেটা ছিল নিছক পরিচয় সেটাই একদিন পরিণত হল ভালোবাসায়। সংগোপনে, লোকচক্ষুর আড়ালে। হাজারো নিষেধ সত্বেও প্রমথেশকে জীবনের ধ্যানজ্ঞান করে ক্ষিতি চলে এসেছিলেন কলকাতায়। প্রমথেশ তাঁকে আর ফেরাতে পারেননি। অতএব ক্ষিতিকে আশ্রয় দিতেই হল।

এ ঘটনায় গৌরীপুরে পরিবারের সকলের মাথা হেঁট। ঘরে আছে লক্ষ্মীপ্রতিমার মত স্ত্রী, তার উপর দুই ছেলে। রাজাবাহাদুর হলেন ক্রোধে অগ্নিশর্মা। এই ঘটনা নিয়ে পিতা পুত্রের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় বা পত্র বিনিময়ের ফলে সম্পর্কে ফাটল ধরল। সেই সম্পর্ক আর জোড়া লাগেনি।

প্রমথেশ অভিমানের বশেই স্থির করলেন তিনি আর গৌরীপুর মুখো হবেন না, এবং এস্টেট থেকে একটি পয়সাও গ্রহণ করবেন না। এ ঘটনা থেকেই রটনা হয়েছিল প্রমথেশ ত্যাজ্য পুত্র হয়েছেন।

মানসিক ভাবে একটু স্থিত হয়ে প্রমথেশ যোগ দিলেন নিউ থিয়েটার্সে ১৯৩৩ সালে। তৈরী হল প্রমথেশের তোলা প্রথম সবাক চিত্র ‘রূপলেখা’। এই ছবিতেই প্রথম অভিনয় করেন যমুনাদেবী। প্রমথেশই তাঁকে অভিনেত্রী হিসাবে গড়ে তোলেন। সেই সুবাদে দুজনের মধ্যে তৈরী হল এক অন্য রসায়ন।

প্রমথেশ ও যমুনা বড়ুয়া

১৯৩৫ সালে প্রমথেশ হাত দিলেন শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ ছবির কাজে। এই ছবিতেই বিখ্যাত গায়ক অভিনেতা কে এল সায়গল প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন।

দেবদাসের চরিত্রে পরবর্তীকালে অনেকেই অভিনয় করেছেন কিন্তু কেউই প্রমথেশকে ছাড়িয়ে যেতে পারেননি। ‘ দেবদাস’ চলচিত্রটিকে পরবর্তীকালে কোনো ‘দেবদাস’ই অর্থ বিনিয়োগে ছাড়িয়ে গেলেও মহিমা ও মাধূর্যে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি।

উত্তমকুমারের মত বড অভিনেতাও দেবদাসের রোল করতে চাননি। বলেছিলেন, -পাগল হয়েছেন! ওই রোলে বড়ুয়াসাহেব যা করে গেছেন তার পরে কারও ওই রোলে অভিনয় করার কথা ভাবাই উচিত নয়।

কানন দেবী ও প্রমথেশ বড়ুয়া

দেবদাস’- প্রমথেশকে খ্যাতির শীর্ষে উঠতে সাহায্য করেছিল। বইতে শরৎচন্দ্র দেবদাস পার্বতীর মিলন ঘটাতে পারেন নি। কিন্তু বাস্তবে দেবদাস-পার্বতী চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে নায়ক নায়িকার মিলন ঘটল । ‘রূপলেখা’তে প্রমথেশ -যমুনাদেবীর যে রসায়ন তৈরী হয়েছিল তারই সফল রূপায়ন ঘটল ‘দেবদাসে’। ভালোলাগা ভালোবাসায় পরিনত হল। এত কান্ডের পরেও তিনি আবার যমুনা দেবীকে জীবনসঙ্গিনী করে নেন।

১৯৩৬ সালে প্রমথেশের ‘গৃহদাহ’ ও ‘মায়া’ও বেশ হিট করল। এর পরে আর এক ঐতিহাসিক ছবি ‘মুক্তি’। এক বোহেমিয়ান শিল্পীর জীবন। এই ছবিতেও শট নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন। শুটিং হয়েছিল গৌরীপুরের ‘মাটিয়াবাগ প্যালেসে’ এবং সংলগ্ন বনভূমিতে। এই ছবিতে প্রমথেশ বড়ুয়া ব্যবহার করেছিলেন তাঁর প্রিয় হাতি ‘জংবাহাদুর’কে।

‘মুক্তি’ ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছিল গোয়ালপাড়িয়া লোক সঙ্গীত। সম্ভবত রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল ‘মুক্তি’ ছবিতেই। এর জন্য সানন্দ অনুমতি দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ছবির নামকরণও তিনিই করেছিলেন। ‘মুক্তি’ প্রমথেশ ও কাননদেবীর জুটিকেও হিট করে। ছবিটিও সুপারহিট হয়।

প্রমথেশ বড়ুয়া আপাদমস্তক শৌখিন মানুষ ছিলেন। সব সময় পরিপাটি থাকতেন। একাধারে তিনি অভিনেতা, আবার পরিচালকও। প্রমথেশ চৌদ্দটি বাংলা ও সাতটি হিন্দি ছবি পরিচালনা করেন। পরিচালক, অভিনেতা হিসেবে সফল হলেও ব্যবসায় তিনি টিকে থাকতে পারছিলেন না। বাধা হয়ে দাঁড়াত তাঁর মেজাজ। রাজরক্ত যে তাঁর শরীরে! তাঁর শেষ ছবি ‘মায়াকানন’। ‘

প্রমথেশ ছিলেন অত্যন্ত সুদর্শন। রূপ ও ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে তাঁর জীবনে এসেছেন একাধিক নারী। পিতামাতার দেওয়া বিয়ে ছাড়া তিনি আরো দুটি বিয়ে করেছিলেন। আগেই উল্লেখ করেছি, তার একজন দেবদাসের নায়িকা যমুনাদেবী। আর একজন ক্ষিতি দেবী কিন্তু রাজ পরিবার এদের স্বীকৃতি দেয়নি।

সর্বংসহা মাধুরীদেবী কিন্তু বন্ধুর মতো সারা জীবন পাশে থেকেছেন। সব রকম বিপর্যয়ে উদারতা দেখিয়েছেন। মেনে নিয়েছিলেন স্বামীর একাধিক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক।

প্রমথেশে জীবনে একাধিক প্রেমের প্রসঙ্গে ভাই লালজীকে কৈফিয়তের সুরে বলেছেন – ‘‘আমি তো এক-দু’জনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি। বাকিরা হুমড়ি খেয়ে আমার উপর পড়লে আমার কী দোষ?’’ আমি জীবনে কাউকে ঠকাইনি, ঠকাতে পারি না, ঠকাতে পারবও না। তাতে আমার ভগ্যে যা ঘটে ঘটুক।”

কথাটা সর্বাংশে সত্যি। না, তিনি কাউকে ঠকান নি। ভাগ্যের হাতে ঠকেছেন নিজেই। যে সব নারীরা তাঁর জীবনে এসেছেন, তাদের তিনি দিয়েছেন সামাজিক মর্যাদা। দিয়েছেন প্রচুর আর্থিক নিশ্চয়তা। রাজার ছেলে, ভিখারি হয়েছেন। জীবন সায়াহ্নে এসে বড়ই দুঃখ পেয়েছেন। একদিকে নিদারুণ আর্থিক কষ্ট, অন্যদিকে ছিল তীব্র রোগের যন্ত্রনা।

ডাক্তাররা সন্দেহ করেছিলেন তাঁর যক্ষা হয়েছে। চিকিৎসার জন্য ১৯৪৮ সালে যমুনাদেবীকে নিয়ে সুজারল্যান্ডে গেলেন। জানা গেল যক্ষা নয়, রক্তাল্পতা ও অন্যান্য কিছু রোগ আছে। শেষ তিন চার বছর এই অসুস্থতা তাঁর সঙ্গ ছাড়েনি। চিকিৎসা করেও রোগ সারেনি। অবশেষে ১৯৫১ সালের ২৯ নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হল। একটি দুরন্ত মানুষ এবং দুর্দান্ত প্রতিভার চিরকালের মত ইতি।

ইতির পরই তো শুরু হয় ইতিহাস। বাংলা চলচিত্র অাজ যে সক্ষমতা অর্জন করেছে , সেখানে তাঁর অবদান কম নয়। শুধু বাংলা নয়, একাধিক। ভাষায় তিনি ছায়াছবি নির্মান করেছেন। চলচিত্রের কলাকৌশলগত ক্ষেত্রে কিছু অবদান রেখেছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রাণভরা ভালোবাসা পেয়েেছেন। চলচিত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রয়োগ করে ইতিহাস তৈরী করে গেছেন।

বরেণ্য চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক বড়ুয়া পরিবারের সাংস্কৃিতিক অবদানকে বরাবরই শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। তিনি বলতেন, – ”পদ্ধতি টদ্ধতি বুঝিনা মশাই, আমার কাছে প্রমথেশ বড়ুয়াই ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ পরিচালক। আমরা কেউই তাঁর পায়ের নখের যোগ্য নই।”

প্রমথেশ বড়ুয়া পঞ্চাশ বছরেরেও কম বেঁচে ছিলেন। তবুও রেখে গেছেন বাংলা চলচ্চিত্রের একটি গৌরবজ্জল অধ্যায়। তাঁকে বাদ দিয়ে চলচিত্রের ইতিহাস আলোচনা করা যাবে না। বড়ই দুঃখের বিষয় আজ আমরা চলচিত্রের এই কিংবদন্তীকে প্রায় ভুলতে বসেছি।

ঋণ – বড়ুয়া সাহেব-রবি বসু। মাহুত বন্ধু রে শ্যামল বন্দোপাধ্যায়। ছবি -অন্তর্জাল।

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.