শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

বাংলা সাহিত্যে গদ্যের পথচলা

সাম্প্রতিক বাংলা কথা-সাহিত্যের প্রসার ও প্রভাব নিঃসন্দেহে বেড়ে চলেছে- এ বিষয়ে কোনো ভুল নেই। গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনি, প্রবন্ধ, নাটক, রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনি লেখার ও পড়ার দিকে বাঙালির মনোযোগ বেশি। বস্তুত, এই শাখা বর্তমানে সর্বাধিক ফলবান ও সবল। বিশ্ব সাহিত্যেও বাংলা ভাষা স্থান করে নিয়েছে -এটা বাঙালি জাতির পক্ষে গৌরবের বিষয়।

কীভাবে হয়েছিল বাংলা গদ্যের সূত্রপাত ? কী করে শুরু হল তার পথচলা ? সেসব কথা জানতে হলে বুঝে নিতে হবে এর জন্ম, বিভিন্ন বয়ঃসন্ধি বা মোড়, প্রতিভবান সাহিত্য শিল্পীদের সাধনায় এর ক্রমবিবর্তনের কথা । তবেই গদ্যের পথচলার রহস্য আমাদের কাছে কিছুটা উদ্ঘাটিত হবে।

বাংলায় বা ভারতবর্ষে কোন জাতির উদ্ভব ঘটেনি। যুগে যুগে কালে কালে এদেশে বিভিন্ন জাতির আগমন ঘটেছে এবং সেই জাতিসত্তার মিশ্রণেই বাঙালি জাতির উদ্ভব ঘটেছে। ভাষার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ভাষাতাত্ত্বিক পন্ডিতদের মতে আনুমানিক দু’শো খ্রিস্টাব্দে এ দেশে মাগধী প্রাকৃতের চল ছিল। খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতে এই মাগধী অপভ্রংশ প্রাচীন বাংলায় রূপান্তরিত হয়। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বাংলা ভাষা পরিচয়’ গ্রন্থের ভূমিকায় এই মাগধী ভাষার কথাই উল্লেখ করেছেন-

“নদী যেমন অতি দূর পর্বতের শিখর থেকে ঝরনায় ঝরনায় ঝরে ঝরে নানা দেশের ভিতর দিয়ে নানা শাখায় বিভক্ত হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পৌঁছয়, তেমনি এই দূর কালের মাগধী ভাষা আর্য জনসাধারণের বাণীধারায় বয়ে এসে সুদূর যুগান্তরে ভারতের সুদূর প্রান্তে বাংলা দেশের হৃদয়কে আজ ধ্বনিত করেছে…”

দুঃখের বিষয় বাংলা ভাষার জন্মের পর প্রায় হাজার বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলা সাহিত্যে গদ্যের স্থান হয়নি। অবশ্য আমরা যদি পৃথিবীর সকল ভাষা ও সাহিত্যর ক্রমবিকাশের ধারার দিকে লক্ষ্য রাখি তাহলে দেখব যে গদ্যর আবির্ভাব হয়েছে পদ্যের পরে। লেখনীমুখে ভাষার প্রথম প্রকাশ ছন্দ ও মিলকে আশ্রয় করেই। আমাদের বাংলা সাহিত্যেও গদ্যভাষা এসেছে অনেক পরে। আর কোন দেশেই পদ্য থেকে গদ্যের আবির্ভাব হতে এত সময় লাগেনি । এর অন্যতম কারণ বাঙালি জাতির গীতিপ্রবণতা। গদ্য মনে রাখার সুবিধে নেই, তাই গদ্য রচনার দিকে লোকের আস্থাও ছিল না। প্রাচীনতম চর্যাপদ রচনার কাল ৯৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি। এগুলি ছন্দোবদ্ধ রচনা। এ চর্যাপদের পর দীর্ঘকাল পরে রচিত হয়েছে শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন, বৈষ্ণব পদাবলি, রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবতের অনুবাদ, মনসা-চন্ডী-ধর্মঠাকুরের মাহাত্ম্যসূচক বিভিন্ন মঙ্গলকাব্য। এসবই গীতিপ্রধান পদ্যছন্দে রচিত । তৎকালীন বাঙালির অবক্ষয়িত জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রাচীন বাংলা সাহিত্য হয়ে উঠেছিল সংকীর্ণ, অনুদার, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও ভাবালুতাগ্রস্ত। দশম থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত সুদীর্ঘকালে বাংলা সাহিত্যে কোন বৈচিত্র্য আসেনি । আসেনি গদ্যভাষাও।

অষ্টাদশ শতকের সমাপ্তি এবং ঊনবিংশ শতকের শুরুতেই ঘটে ছিল সেই অভাবনীয় কান্ড।

হঠাৎ সাগরপারের সওদাগরেরা অর্থাৎ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এদেশের রাজা হয়ে বসল। ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্য তাদের সঙ্গে এল ধর্মযাজকেরা।মূলত ধর্ম প্রচারের জন্য এবং শাসন কার্যের সুবিধার জন্য ইংরেজ সিভিলিয়ানদের দেশীয় ভাষা শেখানোর প্রয়োজন হয়ে পড়ল। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরে মুদ্রণযন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হল। এই বছরেই তাঁরা নিজেদের গরজে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করলেন ‘ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ’।

উইলিয়াম কেরি

এই দুটি ঘটনা বাংলা গদ্য সৃষ্টির ইতিহাসে এবং বাঙালির চিন্তাধারায় নবযুগের সূচনা করে। মহামতি কেরি সাহেবের প্রচেষ্টায় এবং কলেজের বাঙালি পন্ডিত ও মুন্সীদের সহায়তায় বাংলা গদ্য সাহিত্যের সূত্রপাত ঘটে। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় বাঙালি রামরাম বসুর ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’। কিন্তু সেও উল্লেখযোগ্য গদ্য না হলেও গবেষকরা ‘প্রতাপাদিত্য চরিত্র’-কেই মুদ্রিত প্রথম মৌলিক বাংলা গদ্যগ্রন্থ বলে থাকেন।

অবশ্য গদ্যের ব্যবহার যে একেবারে ছিল না ,তা নয়। বাঙালি চিরকাল কথাবার্তা, আলাপ আলোচনা, বাকবিতণ্ডা , এমনকি কলহ-মারামারিতেও গদ্য ব্যবহার করে এসেছে। সে সব কেউ ধরে রাখেনি ,কোন দেশেই কেউ বড় একটা রাখে না। এছাড়া ,চিঠিপত্র দলিল-দস্তাবেজ , তাম্রশাসন ও তন্ত্রশাসন উপদেশ ,বৈষ্ণব কড়চা প্রভৃতিতে একধরনের বাংলা গদ্য ব্যবহার হয়ে আসছিল। তবে তাকে সাহিত্য বলে না।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ

শতক শুরুতে আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটল । ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত হল হিন্দু কলেজ। এই কলেজ বাংলার নবযুগের সাহিত্যিক সৃষ্টিতে এবং বাঙালির মানস-জগতে পাশ্চাত্য ভাবধারার উদ্বোধনে যথেষ্ট সহায়তা করেছিল। হিন্দু কলেজ সৃষ্টির ফলে সাধারণ বাঙালি ঘরের ছেলেরাও ইংরেজি সাহিত্যের সংস্পর্শে এল। ‘বাঙালির মনের আগল ঘুচে গেল, সে যুগের বাংলা সাহিত্যে বিশাল বিশ্বের ছায়া পড়ল, বিচিত্র জীবনের কল্লোল ধ্বনিত হল, পশ্চিম সমুদ্রপার থেকে মুক্তির ঝোড়ো হাওয়া এসে খাঁচার পাখির দুর্বল পাখার মধ্যে সাগর সঙ্গীত শুনিয়ে গেল।’

মধ্যবিত্ত বাঙালির সামনে নতুন জগতের দরজা খুলে গেল। ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে একদিকে তাঁরা যেমন ইউরোপীয় ক্লাসিক, রোমান্টিক ও আধুনিক সাহিত্যের স্বাদ পেলেন, অন্যদিকে তেমনি পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শনের সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ পেলেন। আধুনিক চেতনায় প্রাণিত বাঙালি সাহিত্যের উপকরণরূপে আর গান-গাথা ,দেবতা ও ধর্মের প্রয়োজন বোধ করলেন না।

এই আত্মচেতনায় প্রাণিত হওয়ার ইতিহাসও বেশ রোমাঞ্চকর। রামরাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, গোলক শর্মা, রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়, তারিণীচরণ মিত্র, রামমোহন রায়, রামকমল সেন প্রমুখ বঙ্গসন্তানেরা মিলে এক ধরণের পাঠ্য-কেতাবি বাংলা গদ্য সৃষ্টি করলেন। বাংলা গদ্য তখন সবেমাত্র ভূমিষ্ঠ হল, তখনও তা দুর্বল ও অপটু । ডানাও হয়তো গজিয়েছে, কিন্তু বিশ্বের উদার আকাশে ডানা মেলে উড়বার শক্তি তখনও সে অর্জন করেনি। না করলেও আশ্চর্যজনক দ্রুত উন্নতি করল।

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলা সাহিত্যে এই গদ্যের যুগ- চিন্তা ও জ্ঞানের, বুদ্ধির ও যুক্তির, মনন ও বিশ্লেষণের, বিচারের ও তর্কের যুগ। রামমোহন ,মৃত্যুঞ্জয়, কাশীনাথ প্রভৃতি নৈয়ায়িক তর্ক ও শাস্ত্র আলোচনার মধ্য দিয়ে সেই গদ্যে চিন্তাশীলতার প্রলেপ দিলেন; ভবানীচরণ, জয়গোপাল, গৌরমোহন, ঈশ্বর গুপ্ত প্রভৃতি সংবাদপত্রের মারফৎ সেই গদ্যকে করে তুললেন দৈনন্দিন ব্যবহারের উপযোগী; কৃষ্ণমোহন, গোপাললাল, গোবিন্দচন্দ্র তাতে দিলেন পাশ্চাত্য পান্ডিত্যের ভাবনা; অক্ষয়কুমার, কৃষ্ণমোহন, রাজেন্দ্রলাল প্রমুখেরা সেই গদ্যকে বিজ্ঞানের বাহন করে তার পরিধি বিস্তৃত করলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ভাষার জড়দেহে করলেন চৈতন্য সঞ্চার। মাত্র পঞ্চাশ বছরেরর মধ্যে ঘটে গেলএই বিস্ময়কর ঘটনা।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নিজের হাতে মাটি খুঁড়ে, আগাছা পরিষ্কার করে বাংলা ভাষার নীরস জমিকে করে তুললেন সরস, উর্বরা। বাংলা গদ্য রচনায় যথাযথ ছেদ বা যতি চিহ্নের ব্যবহার করে যান বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগরের ভাষার মনোহারিতায় মুগ্ধ হল সকলে। এমন সুশ্রাব্য, সরস, ছন্দোময় অথচ গাম্ভীর্যপূর্ণ রচনা এর আগে দেখা যায় নি।

রবীন্দ্রনাথের কথায় -“বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যভাষার উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সুবিভক্ত, সুবিন্যস্ত, সুপরিচ্ছন্ন এবং সুসংযত করিয়া তাহাকে সহজ গতি এবং কার্যকুশলতা দান করিয়াছেন…।” বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যকে প্রয়োজনের সীমা ছাড়িয়ে রসের রাজ্যের ছাড়পত্র দিয়েছেন । তিনি ভাষা নির্মাণ করেছেন, কাহিনি সৃষ্টির ভার পরবর্তীদের উপরে দিয়ে গেছেন।

বাংলা গদ্যের ভাষা ও বিষয় তখনও পর্যন্ত মৌলিকত্ব অর্জন করতে পারেনি। ভাষা ছিল সংস্কতের ছায়ামাত্র আর বিষয়ও তেমনি সংস্কৃত ও ইরেজির ছায়ামাত্র ছিল। সংস্কৃত, ইংরেজি বা ধর্মীয়গ্রন্থের সারসংকলন বা অনুবাদ ছাড়া বাংলা সাহিত্যে আর কিছুই পাওয়া যেত না। বিদ্যাসাগরের ভাষা সংস্কৃত অনুসারী হলেও দুর্বোধ্য ছিল না। তিনি প্রতিভাশালী লেখক ছিলেন সন্দেহ নাই, কিন্তু তাঁর শকুন্তলা ও সীতার বনবাস সংস্কৃত থেকে, ভ্রান্তিবিলাস ইংরেজি থেকে এবং বেতাল পঞ্চবিংশতি হিন্দি থেকে সংগৃহীত । সে যুগের বাঙালি লেখকেরা গতানুগতিকের বাইরে কেউই যাবার চেষ্টা করেন নি।

প্যারীচাঁদ মিত্র ওরফে টেকচাঁদ ঠাকুর

সংস্কৃতপ্রধান রীতিকে আশ্রয় করে বাংলা গদ্যে সাহিত্যরস সৃষ্টি হল বটে, কিন্তু আধুনিক প্রগতিশীল মনের একদল ইয়ংবেঙ্গল বাংলা রচনায় সংস্কৃতের প্রাধান্য মেনে নিতে চাইলেন না। প্যারীচাঁদ মিত্র, রাধানাথ শিকদার, কালীপ্রসন্ন সিংহ প্রভৃতি এই দলের। তাঁরা বিদ্রোহী হয়ে চলতি ভাষার আদর্শে আলালী ও হুতোমী রীতির প্রবর্তন করলেন। প্যারীচাঁদ মিত্র ওরফে টেকচাঁদ ঠাকুরই প্রথম ইংরেজি বা সংস্কৃত ভান্ডারে ঢুঁ না মেরে সকল বাঙালির বোধগম্য এবং সকল বাঙালির ব্যবহৃত ভাষাতেই লিখলেন ‘আলালের ঘরের দুলাল’। গতানুগতিকতার বাইরে স্বভাবের অনন্ত ভান্ডার থেকেই নিজের রচনার উপাদান সংগ্রহ করলেন। আর কালীপ্রসন্ন সিংহ লিখলেন ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’-যাতে তৎকালীন সমাজ জীবনের সুন্দর চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে।মৌলিকতার দিক দিয়ে সেটিও অনন্য।

এই দলাদলির বাইরে একদল লেখক সংস্কৃত বা অসংস্কৃত কোনও একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিকে অবলম্বন না করে নিজেদের রুচিমত রসবিচার করে চমৎকার গদ্যে সাহিত্য রচনা করে গেছেন। দুঃখের বিষয় দু’-একজনের সমুজ্জ্বল প্রতিভার প্রখর দীপ্তিতে তাঁরা আড়ালেই থেকে গেছেন; তাঁরা যোগ্য সম্মান পাননি। অথচ বাংলা গদ্যের উন্নতি বিকাশে এঁদের অবদান সামান্য নয়। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসু , রামকমল ভট্টাচার্য ,কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য , নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি এই দলের অন্তর্ভুক্ত । এঁদেরকে নিষ্প্রভ করার মূলে আছে প্রধানত বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিভা।

বাংলাসাহিত্যে বিদ্যাসাগরের সময় থেকে বঙ্কিমচন্দ্রের সময় পর্যন্ত কালকে সাহিত্যের স্বর্ণযুগ বলা যেতে পারে। কারণ এই সময়েই অনেক সাহিত্যরথী বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বাংলা সাহিত্যের রঙ্গমঞ্চে হাজির হয়েছিলেন। গদ্যভাষা তৈরির ফলে বাংলাসাহিত্যে নতুন নতুন ধারার প্রবর্তন ঘটল। প্রথমেই এল সাময়িক পত্রিকা। দেশ- বিদেশের সাহিত্যের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে বিশিষ্ট লেখকেরা সাময়িক পত্র-পত্রিকার পাতাতেই সাহিত্যের রূপ-রীতি নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সাহিত্যের ভান্ডারকে নব নব ক্ষেত্রে বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ করে তুলেছেন।

বাংলা গদ্যের শ্রেষ্ঠ লেখকদের বাহন হয়ে সংবাদ প্রভাকর-তত্ত্ববোধিনী- বিবিধার্থ সংগ্রহ-মাসিক পত্রিকা-সোমপ্রকাশ-বঙ্গদর্শন-ভারতী-জ্ঞানাঙ্কুর-আর্যদর্শন-বান্ধব-নবজীবন-সাধনা- প্রবাসী-ভারতবর্ষ ও সবুজপত্রের নাম বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। এসব পত্রিকার পাতায় যে সাহিত্যচর্চা হয়েছিল, তা কেবল বাংলা সাহিত্যকেই সমৃদ্ধ করেনি; বাংলা গদ্যকেও সবল বলিষ্ঠ, দ্রুতগতি ও সাবলীল করে তুলেছিল।

গড়ে উঠল প্রবন্ধ সাহিত্যের শাখা। বৈজ্ঞানিক ও ধর্মবিষয়ক প্রবন্ধ নিয়ে অক্ষয়কুমার দত্ত ও অন্যান্যরা,সামাজিক ও পারিবারিক প্রবন্ধ নিয়ে ভূদেব মুখোপাধ্যায ,ধর্ম ও ভাষা বিষয়ক প্রবন্ধ নিয়ে রাজনারায়ণ বসু প্রভৃতি, ধর্মগ্রন্থ থেকে অনুবাদ ও ইতিহাস ও ঐতিহাসিক প্রবন্ধ নিয়ে রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়,রজনীকান্ত গুপ্ত ,অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে রাজেন্দ্রলাল মিত্র; পদ্যকাব্য, নাটক, সামাজিক শ্লেষাত্মক কবিতাদি নিয়ে মাইকেল মধুসূদন, দীনবন্ধু মিত্র, রাজকৃষ্ণ রায়, গিরীশচন্দ্র ; ভাষাতত্ত্ব নিয়ে রামগতি ন্যায়রত্ন ,গবেষণাপূর্ণ প্রবন্ধ নিয়ে কালীপ্রসন্ন ঘোষ, বিদ্রুপাত্মক সামাজিক সমালোচনা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে হাজির হলেন ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ।

বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাসে ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দ যুগান্তকারী বছর। বিদ্যাসাগরী রীতি ও আলালী রীতির সার্থক সমন্বয় ঘটিয়ে বাংলা সাহিত্যের আসরে অবতীর্ণ হলেন বঙ্কিমচন্দ্র। আর সব বিষয় নিয়ে রচনার ডালি সাজিয়ে বাংলা ভাষায় অঞ্জলি দিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। বাংলা ভাষার স্তরে স্তরে যে রূপরাশি এতদিন লুকিয়ে ছিল বঙ্কিমচন্দ্র একে একে তা উদ্ঘাটিত করলেন। বাংলা সাহিত্যে বিপুল সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হল। বঙ্কিমচন্দ্রের লোকোত্তর প্রতিভার সংস্পর্শে বাংলা গদ্যসাহিত্য-সৌধৈর যে ভিত্তি স্থাপিত হল, সেই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে বাংলা গদ্যের এতদিনের যে জড়তা ও অনভ্যাসের সংশয় ছিল–তা কেটে গেল। রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পর্কে বলেছেন-

” বঙ্কিম বঙ্গসাহিত্যে প্রভাতের সূর্যোদয় বিকাশ করিলেন, আমাদের হৃৎপদ্ম সেই প্রথম উদ্ঘাটিত হইল। পূর্বে কী ছিল আর পরে কী পাইলাম, তাহা দুই কালের সন্ধিস্থলে দাঁড়াইয়া আমরা এক মুহূর্তেই অনুভব করিতে পারিলাম। কোথায় গেল সেই অন্ধকার, সেই একাকার, সেই সুপ্তি..কোথা হইতে আসিল এত আলোক, এত আশা, এত সঙ্গীত,এত বৈচিত্র্য…”

শশাঙ্কমোহন সেন লিখেছেন- ” রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার বঙ্গভাষার পদগৌরব বৃদ্ধি করিয়াছিলেন কিন্তু ওই পদগৌরবে বঙ্গভাষা যথেচ্ছ চলিতে পারিতেছিল না…বঙ্কিমচন্দ্রের কথা হাসিতে ,নাচিতে, ছুটিতে, কাঁদিতে জানিত; প্রেম করিতে, কলহ করিতে, যুদ্ধ করিতে জানিত; ঘৃণা করিতে, আস্ফালন করিতে, ভীত ওবিস্মিত, শান্ত ও স্তিমিত হইতেও জানিত; … রামমোহন তর্ক করিতে, নিরস্ত করিতে, ধ্যানস্থ করিতে জানিতেন; কেশবচন্দ্র উদ্দীপ্ত করিতে, অনুপ্রণিত করিতে পারিতেন; বিদ্যাসাগর বুঝাইতে ,কাঁদাইতে জানিতেন, সঞ্জীবচন্দ্র দেখাইতে, দীনবন্ধু হাসাইতে জানিতেন; বঙ্কিমচন্দ্র ন্যূনাধিক সমস্ত এবং তাহার অধিক জানিতেন। ..বঙ্গভাষায় বঙ্কিমের আবশ্যক ছিল..।” ভাষাকে চলার স্বাাধীনতা দিলেন বঙ্কিমচন্দ্র।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

ভাষার ব্যাপারে বঙ্কিমচন্দ্র যে খাত খনন করে দিলেন সেই খাত ধরেই বাংলা সাহিত্যর আসরে হাজির হলেন রবীন্দ্রনাথ। বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম থেকে আজকের দিন পর্যন্ত বাংলা গদ্য যেভাবে বিবর্তিত ও রূপান্তরিত হয়েছে এবং আজকের দিনে আধুনিক বাংলা ভাষা বলতে যা বোঝায়, তার সাক্ষ্য, প্রমাণ, উদাহরণের প্রধান ভান্ডার রবীন্দ্রনাথ ।

গদ্যরীতি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ক্লান্তিহীন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। ‘বৌঠাকুরানীর হাট’ থেকে ‘শেষের কবিতা’ বা ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’ থেকে ‘ছেলেবেলা’ এই গ্রন্থপর্যায় বাংলা গদ্যের ইতিহাসকে ধারণ করে আছে। বঙ্কিমী ও বীরবলী গদ্য, সাধু ও চলিত ভাষা, ঘরোয়া ও বৈঠকি ও দরবারি রীতি,প্রাচীন আধুনিক ও আধুনিকতর শৈলী -এই তাঁর পঞ্চাশ বছরের সাহিত্য সাধনাকে আমরা বাংলা গদ্যের অনুবিশ্ব বলতে পারি,হয়তো মহাবিশ্ব বললেও ভুল হবে না।

বাংলা ভাষা,বাংলা সাহিত্যকে অভূতপূর্ব শ্রী-সম্পদে ভরে তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ । তাঁর গদ্যশিল্পের এমন ঐশ্বর্য ,এমন বিচিত্র বৈভব আর কারো রচনায প্রকাশ পেয়েছে কিনা সন্দেহ। তাঁর পদ্যছন্দের ইন্দ্রজালের কথা আমরা জানি, কিন্তু তাঁর গদ্যের অভিঘাতও আমাদের অভিভূত করে মনের মধ্যে কেবলই ঢেউ তুলতে থাকে, কথা শেষ হলেও স্পন্দন থামে না। যাঁরা রবীন্দ্রনাথের সমগ্র গদ্য রচনা পড়বেন তাঁদের ধারণা হবে তিনি গদ্য শিল্পে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ পুরুষ এবং বিশ্ব সাহিত্যেও গরীয়ান।

রবীন্দ্র -সমসাময়িক বা রবীন্দ্র -পরবর্তী আরো অনেক কথাশিল্পীর আগমন হয়েছে বাংলা সাহিত্যে, যাঁদের কথা না বললে বাংলা গদ্যের পথচলার ইতিহাসটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, তাঁরা হলেন অবনীন্দ্রনাথ ,প্রমথ চৌধুরী ,শরৎচন্দ্র এবং তিন বন্দ্যোপাধ্যায়,বিভূতিভূষণ-মানিক-তারাশঙ্কর। এঁরা যে যার ক্ষমতা অনুযায়ী নানা আঙ্গিকে সাজিয়ে গুছিয়ে রূপে রসে ভরে বাংলা গদ্যের চলার পথটিকে করেছেন সহজ সুগম।

অবনীন্দ্রনাথের গদ্য রচনার মূলে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব থাকলেও পরবর্তী সময়ে তিনি সে প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন। তিনি সৃষ্টি করেছিলেন নতুন এক রচনারীতির। রূপচিত্র ও রূপকথা নিয়ে তিনি এক আশ্চর্য জগৎ সৃষ্টি করলেন। বিশুদ্ধ কথ্য ভাষা যথাসম্ভব তৎসম শব্দ বাদ দিয়ে এবং শিশু পাঠ্য করে লিখলেও তা যে কত মধুর ও মনোগ্রাহী হতে পারে তার অন্যতম উদাহরণ অবনীন্দ্রনাথ ।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ..”আজও শেষ হলনা তার প্রকাশলীলা। সমুদ্রের কাছাকাছি এসে সে বিস্তৃত হয়েছে, মিশ্রিত হয়েছে,গভীর হয়েছে তার প্রবাহ, দেশের সীমা ছাড়িয়ে সর্বদেশের আবেষ্টনের সঙ্গে এসে মিলেছে। সেই দূর কালের সঙ্গে আমাদের এই বর্তমান কালের নবজাগ্রত চিত্তের মিলনের দৌত্য নিয়ে চলেছে এই অতিপুরাতন এবং এই অতি-আধুনিক বাক্যস্রোত -এই কথা ভেবে আমি বিস্মিত হয়ে আছি।”

হ্যাঁ বিস্ময় বইকি!-‘এই অতিপুরাতন’ বাক্যস্রোত থেকে ‘এই অতিআধুনিক হয়ে ওঠা- এ এক যুগের বিস্ময়। মাত্র দেড়শ বছরের সময়সীমায় বাঙালি যেন হাজার বছরের ব্যবধানকে অতিক্রম করে এক নতুন যুগে প্রবেশ করল। আরম্ভ থেকে পরিণতির এমন বিদ্যুৎগতি পৃথিবীর ইতিহাসে ইতিপূর্বে কখনো দেখা যায়নি। ঐতিহাসিকের ভাষায় “Such a Renaissance has not been seen anywhere else in the world’s history,”

বাংলা গদ্যের ক্রমবর্ধমান এই ধারাটি শতমুখী গতিতে বহমান রইল বিশ শতকের প্রথমার্ধ কাল পর্যন্ত। আরও কত শিল্পী তাঁদের নিপুণ হাতে গড়ে-পিটে বাংলা গদ্যের চলমান ধারাটিকে বজায় রেখেছেন তাঁদের সকলের কথা এই অল্প পরিসরে বলা সম্ভব হল না।

তারপর এই শতকের প্রথম প্রহরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও মন্দা, দ্বিতীয় প্রহরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ ও মন্বন্তর, বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্কট, রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ, দেশের স্বাধীনতা লাভ, সেইসঙ্গে দেশভাগ, সমস্ত দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা এবং ফলস্বরূপ লক্ষ কোটি উদ্বাস্তু -এই সমস্ত ঘটন-দুর্ঘটনা বাঙালির সমাজজীবনের সামগ্রিক ভারসাম্যে সাময়িক অবনতি দেখা দিয়েছিল। সাহিত্যের অঙ্গনেও তার প্রভাব পড়েছিল এবং তার চলার গতি কিছুটা ব্যাহত হয়েছিল।

দুর্যোগ কিছুটা সামলে ১৯৫০-এর পর থেকে কবি সাহিত্যিকেরা আবার নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে নতুন জীবনবোধ নিয়ে সাহিত্য রচনায় এগিয়ে এলেন । ষাট-এর দশকে কিছু দুঃসাহসিক তরুণের অনুপ্রবেশ ঘটল বাংলা সাহিত্যে। জন্ম হল ক্ষুধিত প্রজন্মের। এঁরা নতুন যুগের নতুন ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নতুন আঙ্গিক, ভাষা ও ভাব নিয়ে সাহিত্য রচনায় ব্রতী হলেন । বাংলা সাহিত্যে এখানে কিছুটা পটপরিবর্তন ঘটল। সে আর এক ঘটনা, আর এক পর্ব।

————————————————

গ্রন্থঋণঃ-

বাঙলা গদ্যের চার যুগ-মনমোহন ঘোষ। বঙ্গালা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাস -জহরলাল বসু বাঙলা সাহিত্যে গদ্য -সুকুমার সেন। সমগ্র বাঙলা সাহিত্যের পরিচয়-? রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ ও গদ্যশিল্প- বুদ্ধদেব বসু । বাংলা গদ্যের পদাঙ্ক প্রমথনাথ বিশি ও বিজিত কুমার দত্ত। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস – গদ্যের প্রথম যুগ- সজনীকান্ত দাস। বাংলা গদ্যের শিল্পীসমাজ-অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়। বাংলা গদ্যের আদর্শ -শনিবারের চিঠি ফাল্গুন ১৩৪৮।

চিত্রঋণঃ- আন্তর্জাল


(বিঃ দ্রঃ পাঠকদের অবগতির জন্য জানাই যে সুপ্রাবন্ধিক সুজয় কর্মকারের কিছু মনোজ্ঞ প্রবন্ধ কয়েক বছর আগে রবিচক্রের ফেসবুকের পাতায় বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছিল, যেগুলি আমরা রবিচক্রের আন্তর্জালিক পত্রিকায় পুনঃপ্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দুঃখের বিষয়, রবিচক্রের স্বজন এই সুলেখক ইতিমধ্যে প্রয়াত হয়েছেন এবং তাঁর স্মৃতির প্রতি এটি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য। – সম্পাদকদ্বয়)

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Sulata Bhattacharya
Sulata Bhattacharya
3 months ago

অতি মনোজ্ঞ ও সহজ স্বাচ্ছন্দ্যে বাঙলা সাহিত্যের ক্রমবিবর্তনের

ধারা ও তার পরিণত রূপনির্মানের রূপকারদের অবদানের ঐতিহাসিকতাকে তুলে ধরার জন্য লেখক ধন্যবাদার্হ।
আমাদের দুঃখ যে তিনি আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু অমর্লোকের দ্বারে আমাদের শুভেচ্ছা তাঁকে স্পর্শ করুক এই প্রার্থনা।

ডঃ তাপস কুমার আচার্য্য
ডঃ তাপস কুমার আচার্য্য
3 months ago

অনেক অজানা তথ্য পেয়ে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ পেলাম। 🙏