শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

তুমি সুর আমি কথা:পুজোর গানের অবিস্মরণীয় জুটি মান্না দে-পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়

স্মৃতিমেদুর বাঙালির পুজোর গানের প্রসঙ্গ উঠলেই কিছু নাম যেন Q আর U-এর মতো অবিচ্ছেদ্য বলে মনে হয়।
যেমন মনে পড়ে লতা মঙ্গেশকর-সলিল চৌধুরীর নাম আর ডি-আশাও যেমন স্মৃতিতে ভেসে ওঠেন, তেমনই বাঙালি ভুলে যেতে পারে না মান্না দে-পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় জুটিকে।

মান্না দে ও পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়


আটাত্তর পাক রেকর্ডের যুগ পেরিয়ে EP, SP, লং প্লে-র কাল অতিক্রম করে ক্যাসেটের রমরমার যুগেও এই জুটি সার্থক ভাবে নির্মাণে-সৃষ্টিতে মগ্ন থেকেছেন। এই দুটি নাম বাদ দিয়ে বাঙালির পুজোর গানের কথা চিন্তা করলে পুজা-উপচারে বুঝি বা অঙ্গহানি হয়।

তৎকালীন বম্বে প্রবাসী মান্না দে হিন্দি ছবির গানে পা রেখেছিলেন চল্লিশের দশকে কিন্তু উত্তর কলকাতার আদি বাসিন্দা প্রবোধ চন্দ্র দে বাংলা আধুনিক গানের জগতে এলেন ১৯৫৩ সালে।

পুলকও ততদিনে গীতিকার হিসাবে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। তবে মান্না দে-র সঙ্গে তাঁর প্রথম কাজ ১৯৬০ সালের পুজোয় ।
৬৪ বছরের পুরনো সে গান দু’টি ছিল ‘আমার না যদি থাকে সুর’ এবং ‘জানি, তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই’।
এর আগে মান্না গেয়েছেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, শ্যামল গুপ্ত প্রমুখ গীতিকারের লেখা গান। তাঁদের কলমও কম শক্তিশালী নয়। কিন্তু পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যে দীর্ঘ এবং নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ তৈরি হয়েছিল তাঁর, তা তুলনারহিত।

মান্না দে ও পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়

পুজোর গানে যখন মান্না এলেন, তত দিনে হেমন্ত, শ্যামল,তরুণ,মানবেন্দ্র,সতীনাথ তো বটেই, সুবীর সেন, মৃণাল চক্রবর্তীও গুরুত্বপূর্ণ নাম।

কথার জোগানদার পুলক এঁদের সকলের জন্যেই পুজোর গান লিখেছেন কমবেশি, কিন্তু মান্না দে-র সঙ্গে তাঁর পথচলা থামেনি।

দুজনে দুজনকে বুঝে নিতে পেরেছিলেন বলেই হয়তো তারে তারে এমন চমৎকার বেজেছিল। পুলক স্বীকার করতেন, মান্না তাঁর গীতিকার জীবনের অন্যতম স্তম্ভ, উল্টোদিকে মান্না বলেছিলেন, পুলকের মতো গান লেখার প্রতিভা তিনি দেখেননি ।

দস্তুরমতো তালিম নিয়ে বাংলা গান গাইতে এসেছিলেন মান্না দে, কিন্তু জানতেন, গিলে ভাল লাগে পাঞ্জাবির হাতাতেই, তাই কোথাও পরিমিতি বোধ বিসর্জন না দিয়েই বজায় রেখেছিলেন নিজস্বতা। পুলকও বুঝতেন পুজোর গান নিয়ে বাঙালির আবেগ, উদ্দীপনা। জানতেন বাঙালির দুঃখবিলাসের কথা। ১৯৬৩-র পুজোয় তাই সেই তো আবার কাছে এলে-র মতো লিরিক এল তাঁর কলম থেকে। উল্টো দিকের গানটি, অর্থাৎ শোনো ও গরবী সুরে-তালে-স্ফূর্তিময় গায়নে অনুপম হলেও শ্রোতারা ততটা পছন্দ করেননি।
পুজোর গানে মান্না নিজে সুর করতেই পছন্দ করতেন। কিন্তু কখনও কখনও তার অন্যথাও হয়েছে। ১৯৬৪ এবং ‘৬৫ সালের পুজোয় পুলকবাবুর লেখায় মান্না দের জন্য সুর করেন রতু মুখোপাধ্যায়।
খুব যে সময়ের চেয়ে এগিয়ে-থাকা কথা, তা নয়, কিন্তু বাঙালির মনোমতো কথা। ৬৪-তে আবার হবে তো দেখার মতো করুণ বিলাপগীতি যেমন ছিল, তেমনই ছিল দেখি ওই হাসির ঝিলিকের মতো প্রেমের গান। ‘৬৫ সালে হৃদয়ের গান শিখে তো হইহই করে বেজেছে রেডিওয়, পুজো প্যান্ডেলে, তুলনায় কম শোনা গেছে পারো যদি ফিরে এসো গানটি।

১৯৬৬-র দুটি গানেও মান্না-পুলক জুটির জয়যাত্রা অব্যাহত থাকে। দুটিই করুণ আবেগের সুরে-কথায় সাজানো। এই তো সেদিন তুমি আর দরদী গো, কী চেয়েছি আর কী যে পেলাম।
এই জুটি ১৯৬৭-র পুজোর গানে আবার এলেন রতু মুখোপাধ্যায়ের সুর নিয়ে। তুমি আঁধার দেখো গানটি প্রবল জনপ্রিয় না হলেও রিমঝিমঝিম বৃষ্টি গানটি হয়েছিল জনচিত্তজয়ী।

মান্না দে ও পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়

১৯৬৯ থেকে মান্না দের পুজোর গানের সুরে-গায়নে একটা বদল এল। যেন তিনি পেলেন একটা অন্য মেজাজ।

রঙ্গিনী কত মন বা ললিতা গো, ওকে আজ চলে যেতে বল না-র মতো গানে উধাও সেই করুণ সুর। রাগ সঙ্গীতে তাঁর যে দখল, তা যেমন এই দুটি গানের আবহ নির্মাণ করে দেয়, তেমনই নতুন এক মান্না দে-কে যেন পান বাঙালি শ্রোতা। পরের বছরও এর এদিক-ওদিক হয়নি।
সুন্দরী গো, দোহাই দোহাই-এর মতো শৃঙ্গাররস মিশ্রিত কথায় সন্ধ্যার রাগ ইমন ছড়িয়ে দেন মান্না দে ।পুজোয় প্রকাশিত সে গান যেমন শ্রোতা-মন পায়, তেমনই এ তো রাগ নয় গো, এ যে অভিমান-এর মতো ‘অন্য রকম প্রেমের গানের’ লিরিকও শ্রোতাদের আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত হয়নি।

এসব গান যে চাইলেই গলায় তুলে নেওয়া যেত, তা হয়তো নয়, কাজেই গুনগুন করে গেয়ে মুখে মুখে ছড়িয়ে দেওয়ার গান ছিল না এগুলি ।

কিন্তু বেশ কঠিন এই গানগুলিকে ভালবাসতে বাঙালি শ্রোতারা দ্বিধা করেননি। যেমন তাঁরা মেনে নিতে পেরেছিলেন মান্না-কণ্ঠে শ্রীরাধিকার বয়ানে সখী ললিতার প্রতি তাঁর অনুরোধ।

১৯৭২ সালের পুজোয় আজ আবার সেই পথে এবং অপবাদ হোক না আরও, দুই চালের দুটি গানই শ্রোতারা আগ্রহ নিয়ে শোনেন। দুটিই আনখশির প্রেমের গান, কিন্তু প্রকাশ ভিন্নধর্মী ।
সত্তর দশকের মধ্যপর্ব অবধি মান্না-পুলক জুটির পুজোর গান সবই হিট। কয়েকটা উদাহরণ দিই :
তুমি অনেক যত্ন করে
অভিমানে চলে যেয়ো না (১৯৭৪)

ও চাঁদ, সামলে রাখো জোছনাকে
আমার একদিকে শুধু তুমি (১৯৭৬)

১৯৭৫-সালের পুজোয় কাওয়ালি ভেঙে মান্না দে বানিয়েছিলেন যখন কেউ আমাকে পাগল বলে’-র মতো গান। সে গানের গীতিকারও পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়।
এই ফাঁকে একটা গানের কথা বলে দিই। নিজে পুজোয় গাইবেন বলেই পুলকবাবুর কথায় দুটি গান সুর করেছিলেন মান্না দে।
ঘটনাচক্রে সে গান মান্না দে দিয়ে দেন হৈমন্তী শুক্লাকে, বিশেষ অনুরোধ ছিল পুলকবাবুরই।

হৈমন্তী শুক্লা


একটি ছিল কেন নয়নে আবির ছড়ালে, আর অন্যটি হৈমন্তীর জীবনের অন্যতম সেরা নিবেদন আমার বলার কিছু ছিল না।

পুজোয় বেশ কিছু নিরীক্ষামূলক কাজ করেছেন মান্না দে। সুপর্ণকান্তি ঘোষের সুরে সারা জীবনের গান, অথবা প্রভাস দে-র সুরে সারা বছরের গান-দুটি এলপি রেকর্ডই বিপুল জনপ্রিয় হয়েছিল।

মা, মা গো মা, আমি রাজি, রাখো বাজি অথবা গহন মেঘের ছায়া ঘনায় সে আসে, না, না, যেয়ো না বাঙালির পুজোকে রঙিন করেছিল একদিন।

মান্না দে ও সুপর্ণ কান্তি ঘোষ

১৯৭৮-এর পুজোয় সুপর্ণকান্তি ঘোষের সুরে সে আমার ছোট বোন (মার স্নেহ কাকে বলে জানি না)-এর জনপ্রিয়তা নজির সৃষ্টি করেছিল। পুলক যদিও চাননি, তরুণ সুপর্ণ (তাঁদের আদরের খোকা), এই গানে সুর করুন, তাঁর মনে হয়েছিল, অনভিজ্ঞ কোনও সুরকার এ গানের সুরের প্রতি সুবিচার করতে পারবেন না।
যদিও তাঁকে ভুল প্রমাণিত করেন বাঙালি শ্রোতারা।

১৯৮১ সালের পুজোয় প্রভাস দে-র সুরে দীপ ছিল, শিখা ছিল গানে যেন পুরনো সেই বিরহ-কথারই অনুবর্তন পুলকের কলমে। শ্রোতারা কিন্তু বিমুখ করেননি তাঁদের।

এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে একটা ব্যতিক্রমী গানের কথা। ১৯৯০ তে দশ বছরের বংশী মুচির ছেলে গানটি গাইতে প্রথমে সম্মত হননি মান্না দে। বলেছিলেন, “চিরকাল প্রেমের গান গেয়েছি, ও সব মুচি-ফুচি গাইব না।“ শেষ অবধি অবশ্য সুপর্ণকান্তির সুর শুনে মন গলে মান্নার। পুজোর ক্যাসেটে এ গান জনপ্রিয় হয়। নানা অনুষ্ঠানেও এ গান গাইতেন মান্না দে।

১৯৯৮ সালে মা, আমার মা ক্যাসেটে মান্না দে মাতৃসঙ্গীত গেয়েছিলেন পুলকবাবুর কথায়। সুর করেছিলেন মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়। পুজোয় এই ক্যাসেট যে কত বিক্রি হয়েছিল, তার হিসাব নেই। বিশেষ করে ‘আমায় একটু জায়গা দাও’ গানটি তো জাতীয় সঙ্গীতের মতো ঘরে ঘরে বেজেছে, প্যান্ডেল মাত করে দিয়েছে।

সুরকার মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও মান্না দে

প্রায় চারটি দশকের সফর মান্না-পুলকের পুজোর গানে। নানা ছোট ছোট ঘটনা থেকে গানের মুখ পেয়ে যেতেন পুলক, তাঁর এই বিরল গুণের তারিফ করতে ভুলতেন না মান্না।
আজ দুজনের কেউ নেই, পুজোর গান বলেও কিছু আজ নেই আর।
আছে স্মৃতি, আছে ভাল লাগা। পুজোর গান যদি কোনও নদীর সঙ্গে তুলনীয় হয়, মান্না-পুলক সেই নদীর সুসজ্জিত একটি ঘাট। বার বার আমাদের স্মৃতির নৌকা সেই ঘাটে ভেড়াতেই হবে।

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x