শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

“কী আইন বানাইয়া গেল, কী শাসন দেখাইয়া গেল
ব্রিটিশ সরকার
বেরেন খাটাইয়া বানাইছে জেলখানা-আআ
বেরেন খাটাইয়া বানাইছে জেলখানা-আআআ”
দিনিয়া নদীর পাড়ে একটা মোটা পাকুরগাছের নিচে বসে একমনে গান গাইছে রফিক।

রথের দিন গোপীনাথ সাহার আটচালায়, কাঠামো পুজো করে মূর্তি বানানো কাজ শুরু হয়েছে। এখন পুজো যত এগিয়ে এসেছে, মূর্তি ক্রমশঃ প্রাণ প্রতিষ্ঠার দিকে এগোচ্ছে। গ্রামের দুয়েকটা বাচ্চা প্রায় রোজ দিনই এসে দাঁড়িয়ে দেখে। মদন এসেছে ইন্ডিয়া থেকে, গোপীনাথের ভাগ্নে। সেও এবার মামাবাড়ির পুজো দেখে যাবে। সবাই মিলে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে, কেমন করে প্রশান্ত পালের হাতের ছোঁয়াতে একমেটে দোমেটে হয়ে অবয়ব তৈরী হয়ে যাচ্ছে। বাচ্চাদের মধ্যে মণিরুল, রতন, সাদেক সবাই রয়েছে। মনিরুল জিজ্ঞেস করে, “এতো যত্ন কইর‍্যা বানাইয়া, হ্যারে পানিতে ফেলাইয়া দ্যাও ক্যান?”

উত্তর শোনার জন্য, অন্যরাও উদগ্রীব হয়ে থাকে। প্রশান্তর বয়স হয়েছে, গোপীনাথের বাবা জগন্নাথ সাহা পুরানো মনিব, তাই এখনও এই বাড়ির কাজটা নিজেই করে, বাকি সবই ছেলেপুলেরা বুঝে নিয়েছে। মাটি ছানা দুইহাত মণিরুলের দিকে বাড়িয়ে বলেন, “বৈশাখ মাসে তর নানার এন্তেকাল হইলে, ওনারে কী ঘরে রাখছস না গোর দিছো?”
“তিনি তো জীবন্ত মানুষ। গোর না দিলে পইচ্যা যাবে না?”
“বোধনে এই মূর্তিরও প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়। আর বিসর্জনে…”
কথা শেষ হয় না, মণিরুল বলে, “মইর‍্যা যায়? পুতুল আবার মরে নাকি?”
প্রশান্ত হাসে, “বাপজান বোধনের পর চাইয়া দ্যাখবা, হ্যারে তহন মূর্তি লাগে? না জীয়ন্ত লাগে? আর জীবন যেমন আসে, তেমনি চইল্যাও যায়।”
প্রশান্ত ছোটদের মতো করে মূর্তিপুজোর গূঢ় তত্ত্ব বোঝাচ্ছে, তখন উঠোনের দরজা ঠেলে সাইকেল নিয়ে সেলিম মাস্টার ঢোকে। প্রশান্তর দিকে তাকিয়ে বলে, “কী চাচা ওদেরকে সনাতন ধর্মে দীক্ষা দিতেছেন নাকি?”
প্রশান্ত নিজের কাজে মন দেয়, আলগোছে বলে, “পোলাপানদের দৃষ্টি স্বচ্ছ। হেইখানে কোন দ্বেষ নাই, দোষও নাই। সমেস্যা তো আমাগো নিয়া।”
সেলিম উঠোনের একপাশে থাকা বেলগাছটায় সাইকেল ঠেস দিয়ে রাখতে রাখতে ডাকে, “গোপীদা আছেন নাকি?” [Bengali short story]

দিনিয়ার উঁচু পাড় ছুঁয়ে ফেলেছে বর্ষার ভরভরন্ত নদী। নরম হাওয়া ঝুঁকে পড়া জারুল, কাঁঠাল পার করে সাহা বাড়ির আঙিনা সুশীতল করে রেখেছে। দুপুরের খাওয়ার পর বিশ্রাম নিচ্ছিল গোপীনাথ। সেলিমের ডাকে বেরিয়ে আসে। বছর চল্লিশের গোপীনাথের শক্তসমর্থ চেহারা। বাবা জগন্নাথ সাহা মারা যাবার পর অল্প বয়সেই এই ছোটখাটো সাম্রাজ্যর অধিপতি হয়েছে। আলমপুরের একদিকে দিনিয়া নদীর চর অন্যদিকে কেশবপুর যাওয়ার হাইওয়ে। এই দুইয়ের মাঝে প্রায় একশো ঘর হিন্দুদের বাড়ি। সেইখানকার সরকারি স্কুলের শিক্ষক সেলিম।

গোপীনাথ বলে, “আরে সেলিমভাই, বয়েন বয়েন।” ঘরের দিকে হাঁক পেড়ে চা-য়ের কথা বলে।
বেলগাছ আর কলতলার মাঝখানে খানকতক বেঞ্চিপাতা। তার ওপাশে কাছারি ঘর, এখানেই গোপীনাথের বাবা জগন্নাথ, তার বৈষয়িক কাজকর্ম দেখতো। এখন গোপীনাথের বৈঠকখানা।
সেলিম গুছিয়ে বসে, গলার স্বর একটু নামিয়ে বলে, “গোপীদা খবর মোটে সুবিধার ঠেহে না।”
“হে তো, সারা জনমই শোনলাম। অসুবিধা আর অসুবিধা।”
“এবারে আরও ঘোঁট পাকাইছে। কিছু কিছু হুজুরেরা, বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলারে খেপাইতেছে। অগো তো বোধভাস্যি হয় নাই। যোশে ভর দিয়া খেদাইয়া বেড়ায়।”
“তা, তোমরা এত শিক্ষিত মাস্টার, আছো কী লইগ্যা।”
“জানিনা দাদা, আমরা ক্রমশঃ সংখ্যালঘু হইতেছি।”
গোপীনাথ বড় করে হেসে ওঠে, “হা রে ঈশ্বর! এই কথাও শুনতি হল। এই দ্যাশে তোমরা সংখ্যালঘু?”
“হাসির কথা না দাদা। ধর্মীয় কারণে সংখ্যালঘু না। মুক্তচিন্তাকারীরা এই দেশে অহন সংখ্যালঘু।”

গোপীনাথের স্ত্রী আরতি চা আর বাটিতে মুড়ি নারকেল দিয়ে যায়। গোপীনাথ প্রশান্তকে হাঁক পেড়ে বলে, “কাকা হাত ধুইয়া আয়েন। চা দিছে।”
ঠাকুর দালানে দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চাদের জন্য বাটি ভরে নাড়ু, বাতাসা, নিমকি সাজিয়ে দেয়। বাচ্চারা খাবার খেয়ে দৌড় দেয়, ওদের আসর-এর নমাজের সময় হয়ে গেছে।

গোপীনাথ বাচ্চাদের ওইভাবে যেতে দেখে সেলিমকে বলে, “তুমি যাবা না?”
“কনে?”
“ওই যে পোলাপান মসজিদে যায়।”
“তুমি আমারে এই চিনলা? পরবের দিন ছাড়া আমার মসজিদ যাওয়া হয় না।”
গোপীনাথ একটু গম্ভীর গলায় বল, “যাও না কেন? তোমরা শিক্ষিত মানুষ। তোমরা যদি মেইন স্ট্রিম থিক্যা নিজেগো ফারাক কইর‍্যা ফেলাও, মাইনষ্যে তোমাগো ভরসা করবে ক্যামনে?”
“কিন্তু, আমার শিক্ষাই তো বাধা হইয়ে যায় দাদা। না বুইঝ্যা ভবিতব্যের পায় মাথা ঠেহাইতে ইচ্ছা করে না।”
“হুজুরেরা এই সুযোগই নেয়। ওইহানে তোমরা নাই। তোমাগো নামে যা খুশি কইতে পারে। অগো আটকানোর কেউ নাই।” [Hindu Muslim relationship]

সংগ্রহ করতে ওপরের ছবিতে ক্লিক করুন

চা মুড়ি খেয়ে সেলিম সাইকেল বার করে, “দাদা চোখ কান খোলা রাইখেন। আপনি মুরুব্বি মানুষ। আপনারে আর কী কব!”
“তুমিও নিয়ম কইর‍্যা মসজিদ যাবা। নিজেরে ভেন্ন করে রাখলে, বেশি নজরে পড়বা।”
“আমায় কেউ দ্যাখলো কি না দ্যাখলো, তাইতে আমার কলা!”
সেলিম সাইকেলে প্যাডেল করে এগিয়ে যায়। গোপীনাথ ওর চলে যাওয়ার পথে, চোখ পেতে থাকে।

সাইকেল করে যেতে যেতে দিনিয়ার চরের কাছে পৌঁছে যায়। এই সময়টা বড় ভালো লাগে। বর্ষার পর গাছপালা কেমন প্রাণবন্ত হয়ে থাকে। নদীর ধারের ঘাসগুলোও যেন লকলক করে ঢেউএর সাথে কথা বলে। সাইকেল থামিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে যায়। তখন খেয়াল করে, কয়েকজন অল্প বয়সী ছেলে সেখানে বসে আড্ডা দিচ্ছে। একটু এগিয়ে দেখে মণিরুল সাদেক সহ আরও দুই একজন। সেলিম ওদের উদ্দেশ্যে বলে, “কী বাপজানেরা? কী খবর?”
ছেলেরা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, দুজন বলে ওঠে, “আসলাম আলেকুম, ছ্যার।”
“আলেকুম সেলাম। সবাই কি পড়তে গেছিলা?”
“আজ তো ছুটি আছে।”
“তাহলে, তোমাগো সঙ্গে একটু বই? গল্প শোনবা?”
ছেলেদের নিয়ে সেলিম বসে পড়ে। মুক্তচিন্তার বীজ বপনের চেষ্টা করে। বঙ্গবন্ধুর কথা বলে, মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের কথা বলে। অনতিদূরে রফিক দরবেশ ওর ডেরায় বসে গুনগুন করে গলা সাধে। দুইদিকের দিগন্ত ছোঁয়া ফসলের ক্ষেতের সবুজ রঙ মন ভাল করে দিয়ে যায়।

মিজান ইলেকট্রিক মিস্ত্রী। প্রতিবারের মতো এবারেও গোপীনাথ ডেকে পাঠিয়েছে। পুজোর আলোকসজ্জার ভার মিজানের ওপর। আজ মিজানের শহরে কাজ ছিল, ফিরতে সন্ধে হয়ে গেছে। আটটার পর গ্রামের মানুষ সজাগ থাকে না। আজকাল টেলিভিশনের দৌলতে, অনেকে অবশ্য জেগে থাকছে। সাহা বাড়ির আটচালায় প্রশান্ত সারাদিনের পর একটু কারণ-বারি নিয়ে বসেছে। একদিকে অসমাপ্ত প্রতিমা, তার সামনে ছড়িয়ে থাকা মাটি রঙ তুলির নানা সরঞ্জাম। দুটো কাঠের বেঞ্চ। একটার ওপর আরতি রাতের খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে গেছে। প্রশান্ত এই সময়টা রাজার মতো থাকে।
“চাচা, একা একাই চার্জ করবা?”
প্রশান্ত বিরক্ত হয়, ভেজাল পছন্দ করে না। চোখ তুলে মিজানকে দেখে বলে, “এইহানে কী চাই? সাহাবাবু ঘরে আছেন। ওইহানে যাও।”
মিজানের মজা লাগে, “ঠাহুরের সামনে মাল টানছো? তোমার ধম্মে সইবে?”
প্রশান্তের এইসব কথা এখন ভাল লাগে না। সকালে হলে, সোমরসের সাথে পুজোর সম্পর্ক নিয়ে পাল্টা জ্ঞান দিয়ে দিত। এখন শুধু চোখ তুলে তাকায়, ইশারায় ভেতর বাড়ি যেতে বলে।”
মিজানের আজ প্রগলভতা পেয়ে বসেছে, “আমি কই কী, ওই তুলসী মঞ্চ থিকা দুইডা পাতা ছিঁড়া আনো। গেলাসে তুলসী পাতা দিলি দোষ কাটি যায়। এমন কী লিভারও গঙ্গাজল ভাইবা শর্টসার্কিট কইরা ফেলায়।”
প্রশান্ত এবার রেগে ওঠে, হাতের কাছে মাটি ঢেলা ছিল, ছুঁড়ে মারে “দূর হ! হালার পুত।”
মিজান হাসতে হাসতে গোপীনাথের ঘরের দিকে চলে যায়।

নেশা ফেটে যাওয়ার দুঃখে, প্রশান্ত গেলাস নামিয়ে ভাতের থালার দিকে যায়। সাহাবাড়ির ভিটের পিছনে বাঁশবাগান থেকে শেয়াল ডেকে ওঠে। দিনিয়ার চরের চতুর্দিক থেকে সেই ডাকে প্রতিধ্বনি শোনা যায়। শেয়ালের ডাকের মধ্যে দিয়ে আরও কয়েকটা আওয়াজ ভেসে আসে। মিজান আর গোপীনাথের কথাকাটাকাটি হচ্ছে।
রাগতঃ স্বরে গোপীনাথকে বলতে শোনা যায়, “মিঞাগো বাড়ি তে মাগনা কাজ করায়। আর আমার এখানে আইলেই, তর দর বাইড়া যায়?”
মিজান প্রত্যুত্তর দেয়, “সেই হানে আমি ব্যাগার দিই, না কী করি? তাই তে আপনের কী? এবছর আমার ওই ট্যাহা লাগবে। নইলে আপনার কাজ আপনি কইরা নেন।”
হন হন করে মিজান চলে যায়। গোপীনাথ একা একা গজগজ করতে থাকে, “দ্যাশে আর ইলেক্ট্রিশিয়ান নাই? কিসু কই না বলে, গলা কাটবো।”
মদন ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। গোপীনাথকে বলে, “মামা, আমি একটা কথা বলব?”
“কও।”
“তোমার ইলেক্ট্রিকের কাজ আমি করে দেবো?”
গোপীনাথ অবাক হয়ে যায়। মদন পাশ করা ইঞ্জিনিয়ার, তাকে দিয়ে মিস্ত্রির কাজ করানো ঠিক হবে না, “না না, তর করা লাগবে না। বেড়াইতে আইস, বেড়াইয়া যাও। আমি এইহান থিকা জোগাড়া কইরা নিমু।”

কিন্তু অদ্ভুতভাবে কোন মিস্ত্রি গোপীনাথের পুজোর কাজ করতে রাজি হল না। এত বছরের পুজোতে কখনও এমন হয়নি। মহালয়া পার হয়ে গেছে, এখনও যদি বাতি না জ্বালানো যায়, তবে তো পুজো হবে না। শেষে, বাধ্য হয়ে মদনকে বলে, “দ্যাহো তো, তুমি কিছু করতে পারো কিনা?”
মদন বলে, “চিন্তা করো না মামা, আমি আজই শহর থেকে জিনিসপত্র সব কিনে আনছি। এতে একটা সুবিধা হবে, প্রতি বছর আর এইসব ভাড়া করতে হবে না।”
তা না হয় হবে না, তবুও গোপীনাথের মনের মধ্যে কু গাইতে থাকে, এমন ভাবে একঘরে হয়ে যেতে হবে কেন?

চতুর্থীর দিন রাতে, প্রশান্ত মূর্তির কাজ শেষ করে হাত পা ধুতে দিনিয়ায় গেছে। মৃন্ময়ী মূর্তি আস্তে আস্তে তার চিন্ময়ী রূপ পেয়েছে। মদনের আলোকসজ্জাও প্রায় সম্পূর্ণ। আলোয় উদ্ভাসিত মন্ডপে মাতৃমূর্তি পুজো শুরু অপেক্ষায় রয়েছে।

হঠাৎই আলো নিভে যায়। দূর থেকে দিনিয়ার জলের শব্দ ছাপিয়ে আরও কিছু আওয়াজ তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হতে থাকে। কারা কারা যেন তাদের ইষ্টের নামে জয়ধ্বনি দিতে দিতে এগিয়ে আসছে। সেই শব্দের মধ্যে এক বিকৃত উল্লাসধ্বনি রয়েছে, সেখানে কোন হৃদয়গ্রাহী আনন্দ নেই। গোপীনাথ শব্দের উৎস সন্ধানে বাইরে আসে। কয়েক মিনিটের মধ্যে বান ডাকার মতো সেই আওয়াজটা সাহা বাড়ির ওপর আছড়ে পড়ল। হাতে লাঠিসোটা, দা, তরোয়াল। প্রত্যেকের মুখ গামছা দিয়ে আড়াল করা। হঙ্কার দিতে দিতে লোকগুলো আটচালায় দাপিয়ে বেড়ায়। গোপীনাথ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখতে পায়, দুর্গামূর্তির হাত মাথা ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে। বানের জল যেমন দ্রুত এসেছিল, সব লন্ডভন্ড করে দিয়ে, তেমনই উল্টো স্রোতে চলে যায়। হয়তো ওদের পরের লক্ষ্য, গ্রামের মধ্যে অন্য কোন পুজো মন্ডপ বা মন্দির। নদী থেকে ফিরে আসে প্রশান্ত। তিলে তিলে গড়ে তোলা মাতৃপ্রতিমার হাল দেখে মাটিতে বসে পড়ে। আরতি, মদন সহ অন্যান্য সদস্যরা বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। দুষ্কৃতীদের চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ অত্যন্ত নৈশব্দে ঢেকে যায়, তারপরেই চীল চিৎকারে বিলাপ করে ওঠে সকলে। সেই আর্তনাদ মিশে যায় ঘন অন্ধকারে ঢাকা দিনিয়ার চরে। আওয়াজ পেয়ে একে একে প্রতিবেশীরা এসে জড়ো হয়। কেউ কেউ থানায় ফোন করে, কেউ ফোন করে তাদের প্রভাবশালী কোন বন্ধু বা আত্মীয়কে।

ধীরে ধীরে রাত পাতলা হয়ে আসে। রফিকের গলায় ভোরের গান, কোথাও ফজরের আজান শোনা যায়। পাখিগুলো যেন একটু বুঝেশুনে ডাকছে। সেই সবের মধ্যে দিয়ে দুটো পুলিশের গাড়ি এসে থামল, সঙ্গে সেলিম মাস্টার, মিজান সহ আরও অনেকে।

দারগো সহ পুলিশ কর্মীরা পুরো জায়গাটা ঘুরে দেখতে থাকে। সেলিম এসে গোপীনাথের পাশে বসে. “দাদা, সেদিনই বলেছি, অবস্থা ভালা না।”
গোপীনাথ অবাক হয়ে বলে, “ক্যান? ভালা না, ক্যান? আমি কারও ধানে মই দিসি?”
“তোমারে তো কইলাম, এরা সব পোলাপানের কান ভরে দেয়।”
“তইলে, আমি কী করব? কও? পলাইয়া যাব? যাব কনে?”
মদন এসে বলে, “মামা তুমি আমার সঙ্গে যাবে?”
“ক্যান? তগো কাছে যাব ক্যান? ওইহানে বেড়াইতে যাইতে পারি। রিফ্যুজি হইয়া থাকতে যামু না। আমার ঘর নাই? এই মাটিতে তর মায়ের দিকের চোদ্দ পুরুষ বাস কইরা গেসে। এইডা আমার দ্যাশ না? আমি ওগো ডরাই নাকি? অরা কী করবে?”

চারিদিকে লোকজন ঘিরে আছে। দারোগা সব ঘুরে দেখে, একটা চেয়ার টেনে গোপীনাথের সামনে বসে, “দ্যাখেন, যা ঘটনা ঘটে গেসে। তারে তো ফিরাইতে পারবো না। আপনি আমাদের বলেন, কারও সাথে আপনার শত্রুতা আছিল?”
গোপীনাথ হাসে। ওর চারপাশে গোল হয়ে ঘিরে থাকা সকলের দিকে দেখে। মিজানের চোখে চোখ পড়ে, মিজান চোখ নামিয়ে অন্যদের পিছনে লুকোতে চায়। প্রশান্ত গোপীনাথের চোখ লক্ষ্য করছিল। গতরাতে নদীর ঘাট হাত-পা ধোয়ার সময়, ওই ভয়ঙ্কর দলটি আসছিল, সেখানে মিজান থাকলেও থাকতে পারে। নিজের প্রাণ বাঁচাতে প্রশান্ত জলের ভেতর চুপ করে লুকিয়ে ছিল। তার আগেরদিন মিজানের ঔদ্ধত্য প্রশান্ত ভোলেনি। গোপীনাথের সঙ্গেও কষে ঝগড়া করছিল। সাহাবাড়িতে এসে কেউ এমন গলা তুলে কথা বলে না। খুব মনে হচ্ছিল, গোপীনাথ মিজানের নাম বলুক, ওর ভেতরটা যেন ঠান্ডা হয়।
প্রশান্তর মতো মদনও ভাবছিল মামা মিজানের নামটা বলুক। পুজোর আলোকসজ্জা নিয়ে কী অশান্তি করেছে! নিজে কাজ করেনি অন্যকে করতেও দেয়নি।

গোপীনাথ বলে, “ছ্যার, কার নাম কবো? ভিড়ের কোন নাম হয়?”
দারোগা অভয় দেয়, “আপনি ভয় পাবেন না। মৌলবাদীদের ঠান্ডা করতে, সরকার বদ্ধপরিকর। আপনি নাম না বললেও, আমরা ঠিক খুঁজে বার করব।”
গোপীনাথ হাসে, “আমরা যতক্ষণ নিজেকে প্রকাশ করতাছি, ততক্ষণ আমরা একক। যেই কোন মত বা ঝাঁকে মিশতাছি, তখন আমাগো কোন বৈশিষ্ট্য নাই। তখন শুধু ভিড়ের একজন। তাই ভিড়ের কোন নাম হয়না। আফনে খোঁজেন। আমি পূজার জোগাড় দেখি।” এই বলে প্রশান্তকে ডাকে, “আপনি আপনার ছেলেদের কাছে দেহেন, একটা ছুডোখাডো মূর্তি পাওয়া যায় কিনা? কাল মায়ের বোধন, ফাঁকি তো দেওয়া যাবে না।”

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.