অমৃতলালের বৈঠকখানায় বেতের সোফায় বসে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকা কালো মানুষটি লাবণ্য-কে দেখেছিলেন। সত্যানন্দ দাশের পুত্রকে বিদেশে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য অর্থ লগ্নি করতে প্রস্তুত থাকা জনৈক সম্ভাব্য কন্যার পিতাকে নিরাশ করে জীবনানন্দ লাবণ্যকে বিবাহ করাই মনস্থ করেন। যেমন জানা যায়, লাবণ্য বিবাহ করতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু জেঠামশাইয়ের আগ্রহে তিনি ১৯৩০ সালের ৯ই মে ঢাকার ব্রাহ্মসমাজে জীবনানন্দের সঙ্গে পরিণীতা হন। বিবাহ হয়ে গেলেও স্বামী হিসেবে জীবনানন্দ এ বিষয়ে লাবণ্যের প্রাথমিকতার নিরিখে কখনও উত্তীর্ণ হতে পারেননি। বহির্মুখী, সপ্রতিভ, রূপসী কলেজ ছাত্রী লাবণ্যের প্রত্যাশামতো এই অন্তর্মুখী, উদ্যোগহীন, ‘বাস্তব’ পৃথিবীর কুহকে অনভিজ্ঞ কবি উপযুক্ত জীবনসঙ্গী হয়ে উঠতে ব্যর্থ হন। শুধু স্বভাব লক্ষণ নয়, সাংসারিক যাপনে চূড়ান্ত আর্থিক অনিশ্চিতির জন্যও কবি তাঁর ভার্যার কাছে প্রথম থেকেই একজন ‘অসফল’ স্বামী হিসেবে গণ্য হতে থাকেন।
১৯২৬ সাল থেকেই কিশোর বুদ্ধদেব বসু জীবনানন্দের গুণগ্রাহী ছিলেন। সে সময় ঢাকাবাসী হবার সুবাদে তিনি জীবনানন্দের বিবাহসভায় আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে কবিতা সিংহকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে লাবণ্য স্বীকার করেছিলেন সপ্রতিভ, প্রাণচঞ্চল বুদ্ধদেবের সামনে স্বামীকে তাঁর নিষ্প্রভ মনে হয়েছিলো।
শুধুমাত্র ব্যক্তি হিসেবেই নয়, সামাজিক বা পেশাগত অবস্থানের ক্ষেত্রেও জীবনানন্দ বিষয়ে লাবণ্য নিজেকে বঞ্চনার শিকার বলে মনে করতেন। বিবাহিত জীবনের উন্মেষ থেকেই এজন্য তাঁর মনে বিক্ষোভের জন্ম হয়েছিলো।
মনে রাখতে হবে, জীবনানন্দ এবং লাবণ্যের মনোজগতের প্রাথমিকতাগুলি ভিন্ন হলেও লাবণ্য কোনও স্থূল, কুঁদুলে মানুষ ছিলেন না।
‘…লাবণ্য দাশ ছিলেন খুবই সুন্দরী মহিলা । নিজের রূপসৌন্দর্য সম্পর্কে তিনি সব সময় সচেতন থাকতেন। কিন্তু জীবনানন্দ দাশ সব সময়ই তাঁর স্ত্রীকে উপেক্ষা করতেন, এমনকি তাঁর স্ত্রীও। লাবণ্য দাশ মহিলা হিসেবে অসাধারণ ছিলেন। জীবনানন্দ দাশ উৎকৃষ্ট স্বামী ছিলেন না । উৎকৃষ্ট পিতাও ছিলেন না । কাব্য নিয়েই ছিল তার যত সাধনা , ধ্যান। কবিতার জন্যই, সাহিত্যের জন্যই তিনি তিক্ত জীবনযাপন করে গেছেন। তিনি তাঁর স্ত্রীকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে জীবনানন্দ দাশ সংসার চালাতে যে অক্ষম, এটা বোঝাতে তাঁর স্ত্রী ভালোবাসতেন।’
(ভূমেন্দ্র গুহ)
জীবনানন্দের সমসাময়িক তাঁর প্রধান বাংলা কবিবন্ধুরা ছিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে বা বুদ্ধদেব বসু। এঁদের পত্নীরা, যথাক্রমে, রাজেশ্বরী দত্ত, প্রণতি দে বা প্রতিভা বসু শুধুমাত্র বিবাহিত ভার্যা ছিলেন না। দৈনন্দিন নিছক দাম্পত্য সম্পর্ক থেকে উত্তীর্ণ হয়ে তাঁরা কবিদের মেধাসঙ্গিনী হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। কবিদের সৃজনলোকের আশ্রয় হয়ে দাঁড়াতে পেরেছিলেন। এই সব নারী ও তাঁদের সঙ্গীদের সৃষ্টি ও মেধাতরঙ্গের সঙ্গতি চিরকাল মিলেমিশে ছিলো। সংসার যাপনের গ্লানি সেই সুখকে ম্লান করতে পারেনি। তাঁদের কাব্যযাপনে হয়তো এজন্যই কোনও ‘মিউজ’-এর প্রয়োজন হয়নি। হয়তো এমন একটি ধারণা তৈরি করা ম্যাটিনিপ্রিয় বাঙালির প্রিয় ব্যসন। হয়তো এক যাচ্ছেতাই ছেলেমানুষি। ঘটনা হলো, জীবনানন্দ বা লাবণ্যের সম্পর্কের মধ্যে প্রথম থেকেই বৃহৎ ব্যবধান থেকে গিয়েছিলো। স্বামী-সন্তান নিয়ে একজন সপ্রতিভ নারীর স্বচ্ছল, সম্ভ্রান্ত সংসার যাপনের সাধ-কে কোনও যুক্তিতেই ‘অন্যায়’ বলা যায় না। অন্য দিকে জীবনানন্দের মাপের মেধা-উজ্জ্বল সৃজনশিল্পীর যাপনযাত্রাটি যে একজন কেরানি বা সাদামাটা বিদ্যা-ব্যবসায়ীর প্রাথমিকতার সঙ্গে মিলবে না, তাও যুক্তিগ্রাহ্য। ‘চাকরি’ করার গ্লানি জীবনানন্দ স্বীকার করতে চাননি। কারণ তিনি জানতেন,
‘পৃথিবীতে নেই কোনও বিশুদ্ধ চাকরি’। উভয়ের মুদ্রাদোষেই দুজনে একা, আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন। কার ‘দোষ’ বেশি, কার কম, তা নিয়ে ‘হাকিমি’ করতে যাওয়া নেহাত মূর্খতা। অনুরাগী হিসেবে আমাদের একটা কথাই জানার থাকছে, এই বিচ্ছিন্নতা কি কবি’র সৃজনশীলতাকে ট্রিগার করেছিলো? দাম্পত্য জীবনের ঘটনাক্রম থেকেই কি কবি’র মনোভূমিতে ‘বনলতা’, ‘মিউজ’ হয়ে অংকুরিত হয়েছিলো? অন্তর্জগতে সঙ্গিনী-বিমুখ কবি কি ‘বনলতা’র মধ্যে মেধার বিকল্প আশ্রয় খুঁজছিলেন?
‘বনলতা সেন’ নামক প্রতীকটি শুধু মাত্র একজন রমণীর নাম নয়। কবি হিসেবে জীবনানন্দের অশ্বমেধের ঘোড়া যে কবিতা, যে কাব্যসংকলন, তার নাম। মানুষের কাছে প্রত্যাশিত যে স্বীকৃতি একজন শিল্পীর অন্তিম অভিপ্রায়, এই কবির জন্য তার নামও বনলতা সেন। ‘রামী’ নামে কোনও নারী সত্যিই ছিলেন কি না, সেটা জরুরি নয়। কিন্তু চণ্ডীদাস জরুরি। সেভাবেই ‘বনলতা সেন’ । আদৌ তা কোনও বাস্তব নারীর রূপকল্প কি না তা নিয়ে অন্তহীন ‘ফাটাফাটি’ চলছে ২০০৬-০৭ সাল থেকে। একুশ শতকের গোড়ার দিকে ভূমেন্দ্র গুহ যখন বহু ‘কালো ট্রাংক’ থেকে জীবনানন্দের বিপুল গদ্য সৃষ্টি উদ্ধার করে বাঙালি পাঠকের কাছে পেশ করলেন, তখন থেকেই জীবনানন্দ-লাবণ্য সম্পর্ক নিয়ে ব্যাপক তর্ক-বিতর্কের সূচনা হয়। উপন্যাস ‘মাল্যবান’ বা গল্প ‘মাংসের ক্লান্তি’-র আধেয়-কে তাঁদের ব্যক্তিজীবনের আয়না হিসেবে প্রচার করার পালা সেই থেকে শুরু। ‘বনলতা’ প্রসঙ্গ তখন থেকেই আবার মানুষের কৌতুহলের তালিকায় শীর্ষস্থান দখল করে নেয়।
ভূমেন্দ্র গুহের মতে বিবাহের পূর্বে শোভনা বা বেবি-ই ছিলেন কবির প্রণয়পাত্রী এবং প্রধান অনুপ্রেরণা। তাঁর ছায়াতেই ‘বনলতা সেন’ উপমানটি তাঁর রচনায় এসেছিলো। অশোক মিত্র বলেছিলেন তিনিও গোপাল চন্দ্র রায়ের মতো কবির কাছে বনলতার পরিচয় জানতে চেয়েছিলেন। উত্তরে কবি বলেন আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে তিনি খবর পেয়েছিলেন রাজশাহি কারাগারে ‘বনলতা সেন’ নামে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী মহিলা বন্দী ছিলেন। নামটি তাঁর থেকেই পাওয়া। সেই মহিলা পরবর্তীকালে কলকাতার কলেজে গণিতের অধ্যাপনা করতেন। ব্যক্তিগত ভাবে জীবনানন্দের সঙ্গে তাঁর কোনও যোগাযোগ ছিলো বলে জানা যায় না। তৎকালীন একজন পূর্ব পাকিস্তানি আমলা আকবর আলী খান দাবি করেছিলেন ‘বনলতা সেন’ আসলে নাটোরে ‘বিনোদবালা’ নামের এক নগরবধূ। তিনি জীবনানন্দকে ‘দুদণ্ড শান্তি’ এনে দিয়েছিলেন। অধ্যাপক মো. আবু তাহের মজুমদার আকবর আলী খানের এই দাবিকে ‘বিরক্তিকর, স্থূল, দূরান্বয়ী, বিভ্রান্তিকর ও নান্দনিকতা বিযুক্ত’ বলে ভর্ত্সনা করেছিলেন। এছাড়াও কল্পকাহিনির অন্ত নেই। একবার ট্রেনে কবি’র সঙ্গে নাটোরের ভুবন সেন নামে এক ব্যক্তির বিধবা তরুণী ভগ্নীর সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনিই নাকি আসল বনলতা সেন। অথবা নাটোর রাজবাড়ির এক মহিলার সঙ্গে পরিচয় হবার পর তাঁর কথা মনে রেখে কবি ‘বনলতা সেন’-কে সৃষ্টি করেন।
ঘটনা যাই হোক, ‘জীবনানন্দ’ ও ‘বনলতা সেন’ বাঙালির মেধা জগতে দুটি নির্বিকল্প বিস্ময়। বনলতা কোনও শরীরী অস্তিত্ত্ব, না নিছক অলীক রূপকল্প, তা নিয়ে আগ্রহীজন তর্কমত্ত থাকুন। ক্ষতি নেই। কিন্তু ইতর গৌড়জনের কাছে বনলতা হয়তো লাবণ্য-জীবনানন্দের সঙ্গে বিষমবাহু ত্রিভুজের তৃতীয় কোণ হয়ে রয়ে যাবেন।
(প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন)
বনলতা সেন বাঙালি কাব্যপাঠকের কাছে এক অধরা মাধুরীর নাম। যুগে যুগে বাঙালির কাব্য জগতের শাশ্বত প্রতিমা। লেখকের অনুসন্ধানী লেখাটি অতীব মনোগ্রাহী।
বিশ্লেষণের প্রত্যেকটি কথাই গ্রহণযোগ্য বলে মনে হল।ইদানিং কবির ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অরুচিকর রকমের কাটাছেঁড়া চলছে।কবির সৃষ্টি নিয়ে যতখুশি আলোচনা হোক,ব্যক্তি মানুষটি নিয়ে আলোচনা হোক।কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত জীবনটা তাঁর ও তাঁর পরিবারের।সম্পর্কের জটিলতার জন্য আনন্দ দুঃখ যাই হোক,সেটা তাঁরাই ভোগ করেছিলেন।এই বিশ্লেষণটি নির্মোহ।খুব ভাল লাগল।