শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

স্মৃতির আলোয় এক অসামান্যা

আজ প্রচারের আলোর বাইরে থাকা এক মহীয়সীর কাহিনি শোনাব আপনাদের।

সালটা ছিল ১৯৯৯। আমার মা গুরুতর অসুস্থ হয়ে সল্টলেকের আনন্দলোক হাসপাতালে হৃদরোগের কারণে চিকিৎসাধীন। পরিবারে আমি ছাড়া হাসপাতালে যাতায়াত করার মত আর কেউ ছিল না। এই কারণে মা যে কদিন হাসপাতালে ছিলেন, সে কদিন প্রায় সারাদিনই আমি হাসপাতালে পড়ে থাকতাম। রোগীর পরিজনদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গাতে বসে থাকতাম প্রায় সকাল থেকে ভিজিটিং আওয়ার শুরুর আগে পর্যন্ত।

সেখানে থাকতে থাকতে একরকম অপ্রত্যাশিতভাবেই একজন অতি বিশিষ্ট মানুষের দেখা পেলাম এবং তাঁর সম্বন্ধে এমন কিছু কথা জানলাম যা আমাকে মুগ্ধ করেছিল।

হাসপাতালে মা’র থাকার দ্বিতীয় দিনে একজন মহিলা হৃদযন্ত্রের সমস্যা নিয়ে ভর্তি হলেন। ওঁর বাড়ি থেকে তিনজন বয়স্ক মানুষ ওঁর সঙ্গে এসেছিলেন। তার মধ্যে দুজন আমার মত প্রায় সবসময়ই ওখানে থাকতেন। অন্যজন নিয়মিত এসে খবরাখবর নিয়ে যেতেন। কিছুক্ষণ থেকে অন্য দুজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন। একই জায়গায় অতক্ষণ একসঙ্গে থাকার জন্য আমাদের মধ্যে আলাপ পরিচয় হয়ে যায় ধীরে ধীরে। যাঁরা সবসময় থাকতেন, তাঁদের থেকে জানতে পারি অসুস্থ মহিলা ওনাদের বড়দিদি। উনি একজন ডাক্তার এবং উনি ভারতের প্রথম মুসলিম মহিলা ডাক্তার, নাম আনোয়ারা খাতুন। পার্ক সার্কাস অঞ্চলে ওঁর একটি নার্সিং হোম আছে যেখানে উনি গাইনোকলজির চিকিৎসা করেন। ওনাদের মধ্যে যিনি মহিলা তিনি জানান, দিদিই তাঁদের সবার বড় এবং পরিবারের সকলের আদর্শ। দিদি অবিবাহিতা থেকে ওঁর ডাক্তারি পেশায় জীবন উৎসর্গ করেছেন। ওঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে উনিও বিয়ে না করে সারাজীবন নার্স হিসাবে দিদির পাশে আছেন। অন্যজন ভাই, বিদেশ থেকে হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট পড়ে এসে দিদির নার্সিং হোমের সঙ্গে যুক্ত আছেন। ওঁর স্ত্রীও ওই নার্সিং হোমেরই একজন ডাক্তার।


তাঁদের এই দিদিটি একজন প্রচণ্ড আদর্শবাদী মহিলা। অত্যন্ত অনাড়ম্বর জীবন যাপন করেন। জীবনে কোনদিনও তাঁতের শাড়ি ছাড়া অন্য কোন পোশাক পরেননি। আর একটি কথা শুনে আমি খুব অবাক হয়ে যাই। উনি জানান, দিদি প্রতিদিন রাতে শোবার আগে নিয়ম করে রামায়ণ বা মহাভারত থেকে কিছু অংশ পড়েন। আমি একটু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি দেখে উনি জানান, আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম দিদিকে, ‘রোজ রোজ ওই বইগুলি তুমি পড় কেন?’ দিদি উত্তরে জানিয়েছিলেন, জীবনে চলতে চলতে ওঁর মনে যে সব প্রশ্ন আসে তার উত্তর নাকি উনি ওই বই দুটির মধ্য থেকে পান। বোন তারপর যা জানান সেটা শুনে আমার মনে যে প্রতিক্রিয়া হয় তা আমি ভাষায় বোঝাতে পারব না। উনি জানান, দিদিকে পূর্ব পাকিস্তান সরকার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে কোনও উচ্চ পদে যোগদানের আমন্ত্রণ জানালে সেই প্রস্তাব অবিলম্বে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে যে দেশের জন্ম হয়েছে সেই দেশে তিনি পা-ও দিতে চান না।

এমন একজন মানুষের সম্পর্কে বিশদভাবে জানার আগ্রহ আমার মধ্যে ছিল। কিন্তু তখন আমার মনের অবস্থা স্বাভাবিক ছিলনা বলে ওঁরা নিজে থেকে যতটুকু বলেছিলেন সেটুকু ছাড়া খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করে আর কিছু জেনে নিতে পারিনি। সংকটজনক অবস্থা কেটে যাবার পর অসুস্থ অবস্থাতেই মাকে আমার দিদির কাছে রেখে আমি আমার কাজের জায়গায় ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম।

তৃতীয় যিনি ডাক্তার অনোয়ারা খাতুনের বাড়ির পরিজন, তিনি প্রতিদিনই মাঝে মাঝে এসে ওঁর খবর নিয়ে যেতেন, তিনিও একজন বিশিষ্ট মানুষ। তিনি ওঁর আর এক ভাই। তাঁর নাম হোসেনুর রহমান। তিনি ইতিহাসের অধ্যাপক এবং স্বনামধন্য চিন্তাবিদ ও প্রবন্ধকার। আমি এঁদের দুজনের কারও নামই তখনও জানতাম না। অধ্যাপক হোসেনুর রহমানের কিছু প্রবন্ধ পত্র পত্রিকায় পড়ে আমি তাঁর মুক্তচিন্তা ও পান্ডিত্যের পরিচয় পরে জেনেছি।

কিছুদিন পরে শ্রীমতী চিত্রা দেবের লেখা “মহিলা ডাক্তার: ভিন গ্রহের বাসিন্দা” শীর্ষক অসাধারণ বইটি আমার হাতে আসে। চিকিৎসা জগতে মেয়েদের প্রবেশ এবং প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য দীর্ঘ সংগ্রামের আনুপূর্বিক সংক্ষিপ্ত ইতিহাস সংগ্রহ করে আকর্ষণীয় ভাবে পাঠকের সামনে পেশ করার জন্য কি পরিশ্রম ও যত্নের ছাপ তিনি এই বইটিতে রেখেছেন তা ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়। ডাক্তার আনোয়ারা খাতুনের পরিচয় সন্ধানে আমি অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে বইটি পড়ে ফেলি প্রায় এক নিঃশ্বাসে। বইয়ের ভূমিকায় লেখিকা খুব সুন্দর একটি কথা লিখেছেন, “চিকিৎসক আমাদের পৃথিবীর আলো দেখান এবং শেষ বিদায়ের দিনে চোখদুটি বন্ধ করে দেন। মানুষের এই দীর্ঘ জীবনযাত্রায় তাঁরা অন্যতম শরিক হয়ে ওঠেন, কারণ শরীর ব্যাধির মন্দির।” কিন্তু মেয়েদের ডাক্তার হতে চাওয়ার এবং ডাক্তার হয়ে ওঠার দীর্ঘ যাত্রাপথে কত উপেক্ষা, অবহেলা, বঞ্চনা ও অবিচারের ইতিহাস আছে তা জানতে হলে এই বইটি পড়তে হবে। তাই আপাতত ডাঃ আনোয়ারা খাতুন প্রসঙ্গে কি জানা গেছে তাই লিখি।

“বেশ কয়েকজন সাহসী এবং সপ্রতিভ ছাত্রী মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন তিরিশের দশকের শেষে, এঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল আনোয়ারা খাতুনের মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়া। মুসলিম মেয়েদের মধ্যে তাঁকেই পথিকৃৎ বলা হয় যদিও মহিলা হাকিম আগেও ছিলেন, মেডিক্যাল স্কুলে পড়তে এসেছিলেন দুটি একটি দুঃসাহসী নারী। আগ্রা মেডিক্যাল স্কুলেও পড়েছিলেন কয়েকজন তবু আনোয়ারার সঙ্গে কারও তুলনা চলে না।

অবরোধ ও পর্দাপ্রথা মুসলিম নারীকে লোকচক্ষুর অন্তরালে রেখেছিল দীর্ঘদিন এবং অভিজাত মুসলিম পরিবারে সামাজিক বিধিনিষেধ অত্যন্ত বেশি ছিল। সাধারণ ঘরে ধর্মীয় নিয়মের কড়াকড়ি থাকলেও তা বোধহয় কোনোদিনই বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায়নি। তাই তুলনায় সাধারণ পরিবারের মেয়েরা চিকিৎসাবিদ্যার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পেরেছিলেন। তা না হলে বহুসংখ্যক মহিলা হাকিম গত শতকে গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসা করতেন না, হোমিপ্যাথি চিকিৎসকরূপেও মুসলিম মহিলাদের পাওয়া যাচ্ছে একই সময়ে আনোয়ারা যখন পড়তে এলেন। আনোয়ারা খাতুন কলকাতায় ছিলেন এবং একরকম জোর করেই মনে সাহস এনে ভর্তি হলেন মেডিক্যাল কলেজে। অধ্যাপক হোসেনুর রহমান লিখেছেন, “আমার দিদি ডাঃ আনোয়ারা খাতুন ত্রিশের দশকের মাঝখানে প্রথম মুসলিম ছাত্রী হিসেবে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি (১৯৩৭) হয়েছিলেন। কিন্তু আমার বাবাকে তার জন্য মুচলেকা দিতে হয়েছিল ধর্মগুরুদের কাছে যে, তাঁর মেয়ে রোজ ঘোমটা দিয়ে কলেজে যাবে।” আজ মাতৃসমা আনোয়ারা অবশ্য সেসব বাধাবিপত্তিকে মূল্য দিতে চান না। বললেন, “কেউ হয়তো বাবাকে মৃদু আপত্তি জানিয়েছিল, কেউ বা বলেছিল পর্দা করার কথা। বিয়ে করিনি বলেও কেউ কেউ আপত্তি জানিয়ে চিঠি লিখেছিল। কিন্তু এসব ছোটখাটো বাধা এমন কিছু নয় যে তা নিয়ে ভাবতে হবে। অগ্রাহ্য করেছি অনায়াসে। ডাক্তার হবার পরে প্র্যাক্টিস করতে কোন বাধা পাইনি।” বাস্তবিকই আনোয়ারার মতো সফল গাইনোকলজিস্ট কমই আছেন। কত শিশু যে তাঁর হাতে জন্ম নিয়েছে, কত প্রসূতি পেয়েছে যন্ত্রনার হাত থেকে মুক্তি তা কেউ জানেনা, আনোয়ারারও কিছু মনে নেই। বাঙালী মায়েদের মত আটপৌরে ধরনের শাড়ি পরেন, সেই কলেজ জীবন থেকেই, সহজ-সরল-সুমিষ্ট ব্যক্তিত্ব নিয়ে এই ঘরোয়া পোশাকে তিনি যখন এসে দাঁড়ান তাঁর নার্সিং হোমে যন্ত্রণাকাতর প্রসূতির শিয়রের কাছে, তখন সে যেন আপনিই অনেকটা মনোবল ফিরে পায়। আনোয়ারার সঙ্গে আছেন তাঁর সহপাঠিনী ডাঃ সরস্বতী মিত্র। সঙ্গে মানে নার্সিং হোমের কাজের সঙ্গে। প্রত্যক্ষভাবে সমাজসেবার কাজ সমিতির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও সরস্বতী জড়িত আছেন নানা সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। ফুটপাথ থেকে প্রায় কুড়িয়ে আনা এক মৃতপ্রায় নারীকে জীবন ফিরিয়ে দিতে পেরে খুশিতে উচ্ছল হয়ে ওঠেন তিনি। চিকিৎসা জগতে আনোয়ারা, সরস্বতী এবং এতদিনকার অধিকাংশ মহিলার ক্ষেত্রটি কিন্তু গণ্ডিবদ্ধ, প্রধানত সকলেই মেয়েদের চিকিৎসা করেন এবং মেয়েরা তাঁদের কাছে প্রসব সংক্রান্ত ব্যাপারে সবচেয়ে স্বস্তি পায়। আনোয়ারা বললেন, “তবে মনোভাব যে বদলাচ্ছে তার প্রমাণ পেয়েছি। আজকাল মেয়েরা সবরকম চিকিৎসা করছে, হাসপাতালে রোগী ও পাচ্ছে। আমার কাছে এক ভদ্রলোককে আনা হয়েছিল, তিনি বোধহয় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বা আর কিছু, ঠিক মনে পড়ছে না তবে আমি তাঁকে আগে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমার কাছে তিনি অস্বস্তি বোধ করবেন কি না। কিন্তু ভদ্রলোক বললেন, তাঁর কাছে ডাক্তারের একটাই পরিচয় এবং আমার কাছে মেডিক্যাল চেক আপ করাতে বা ট্রিটমেন্ট করাতে কোন আপত্তি নেই।” আনোয়ারাকে দেখে আপাতদৃষ্টিতে সেকেলে মানুষ মনে হলেও অত্যন্ত আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী তিনি। একবার এক সাক্ষাৎকারে তাঁকে বলতে শুনি, “প্রাণের জন্মমাত্রই আমার কাছে শুভ। তাই জারজ বলে সমাজ কিংবা আইন কাউকে অপাঙক্তেয় করলেও, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি এবং মানুষের মন নিয়ে বিচার করে আমি প্রতিটি শিশুকেই স্বাগত জানাই। যে কোন দুটি নরনারীর আকাঙ্ক্ষার ফসলই তো সেই সন্তান। স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বাবা-মার স্বীকৃতি না থাকার দায় তার ওপর বর্তাবে কেন?” তিনি পরিবার পরিকল্পনায় বিশ্বাসী কিন্তু ভ্রূণ হত্যায় তাঁর সায় নেই।” গর্ভপাতের মাধ্যমে জন্মনিয়ন্ত্রণ না করে যদি স্বাভাবিভাবেই জন্মের হার কিছুটা কমে যায় তাতে লাভ ছাড়া ক্ষতি তো কিছু নেই। একটা প্রাণের জন্ম দেওয়া কত কষ্ট। সেখানে এই ব্যাপকহারে ভ্রূণ হত্যায় আমার বিন্দুমাত্র সায় নেই।” টেস্ট টিউব বেবির সাফল্য নিয়ে আনোয়ারা বেশী ভাবতে চান না, “আমাদের গরীব দেশে তার প্রয়োজনই বা কি? তার চেয়ে নিঃসন্তান দম্পতি যদি অনাথ শিশুকে দত্তক নেন তবে সমাজের সমস্যা অনেকটা কমতে পারে তবে বৈজ্ঞানিক গবেষণার দিক থেকে টেস্ট টিউব বেবির জন্ম নিশ্চয়ই উল্লেখযোগ্য সাফল্য।”

ডাঃ আনোয়ারা খাতুনের জীবন বিষয়ে আর কিছু জানা যায় কি না ভেবে আন্তর্জালের শরণাপন্ন হবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তেমন কিছুই জানতে পারিনি। তবে কোনও এক স্বাধীনতা দিবসে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় শ্রীমতী অদ্রিজা রায় চৌধুরী ‘ভয়েস অফ পার্টিশন’ শিরোনামে সাক্ষাৎকার ভিত্তিক প্রতিবেদনে যা জানিয়েছিলেন, তার একটা অংশ পরোক্ষভাবে এখানে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বলে তার কিছু কথা এই লেখাতে সংযোজন করছি। ওই প্রতিবেদনে থাকা দুজনের সাক্ষাৎকারের মধ্যে একটি ছিল অধ্যাপক হোসেইনুর রহমানের। দেশ ভাগের দিনগুলিতে নিজের আবাল্য পরিচিত পরিবেশ কয়েক দিনের মধ্যে কিভাবে বদলে গিয়েছিল, সেকথা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ভাবে তিনি এই সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন। তার কিছু সারাংশ এখানে লিখছি।

হোসেনুর রহমান

অধ্যাপক রহমানের বাবা সক্রিয় ভাবে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন। তিনি কংগ্রেসের মধ্যে পুরাতন পন্থী অংশে ছিলেন যাঁরা দেশভাগের প্রবল বিরোধী ছিলেন। বাড়িতে মহম্মদ আলি জিন্নার নাম উচ্চারণ নিষিদ্ধ ছিল। দেশভাগের অব্যবহিত পরে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে যে হানাহানি হয়েছিল তাতে উনি হিন্দু প্রতিবেশীদের নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে রক্ষা করে রেখেছিলেন। মুসলমানরা যখন ওনাদের বাড়ির পিছনে অবস্থিত একটি মন্দির ধ্বংস করার পরিকল্পনা করে, সেই খবর পেয়ে তিনি নিজের রাইফেল হাতে নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে মন্দিরটি রক্ষা করেছিলেন।
সেই পরিবারের সদস্য হিসেবে কিশোর বয়স থেকেই অধ্যাপক রহমান নেহরু ও নেতাজির চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং বাড়িতে ‘নেতাজী গ্রন্থাগার’ নাম দিয়ে একটি তথ্য ভান্ডার গড়ে তুলেছিলেন যেখানে গান্ধীজী ও অন্যান্য নেতাদের রচনা সংগ্রহ করে রাখতেন। কিন্তু জীবনে কোনদিন রাজনীতিতে যোগ দেননি। সারাজীবনে একমাত্র দেশভাগের দিনটিতে তিনি সারাদিন অভুক্ত ছিলেন। তিনি দেখেছিলেন কয়েক দিনের মধ্যে তাঁর আবাল্য পরিচিত হিন্দু পরিবার বেষ্টিত এলাকা মুসলমানদের অধিকারে চলে গিয়েছিল এবং ওঁর হিন্দু বন্ধুবান্ধবরা এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।

ওঁর দিদি ডাঃ আনোয়ারা খাতুন তখন কলকাতা শহরে এক অত্যন্ত পরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। দেশভাগের পরে ব্রাবোর্ন কলেজে একটি ত্রাণ শিবির তৈরী হলে এলাকার একমাত্র মহিলা ডাক্তার হিসেবে তিনি প্রতিদিন সারাদিন ধরে সেখানে মহিলাদের চিকিৎসা করতেন। অধ্যাপক রহমান প্রতিদিন তাঁর দিদিকে সেখানে পৌঁছে দিয়ে সারাদিন কলেজের বাইরে দিদির ফেরার অপেক্ষায় থাকতেন। রায়টের পরবর্তী সময়ে এলাকা ছেড়ে চলে যাবার জন্য ওঁর বাবার উপর অনেক চাপ এলেও তিনি তাঁর নিজের আবাসেই থেকে যান। ওঁর দিদিকে ঢাকায় এবং এক ভাইকে করাচিতে উচ্চ পদে চাকরির প্রস্তাব এলেও ওঁরা কখনও ভারত ছেড়ে চলে যাবার কথা একবারও ভাবেন নি। তাঁরা কখনও হিন্দুদের দ্বারা আক্রান্ত হননি। কারণ, তাঁর দিদি জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকলের কাছেই গ্রহণযোগ্য এবং অপরিহার্য্য ছিলেন।

এই সাক্ষাৎকার থেকে আমরা পুরো পরিবারটির আদর্শ ও মূল্যবোধের উৎস মানুষটির একটা পরিচয় পাই যিনি তাঁর পাঁচ মেয়ে ও চার ছেলের মনে দেশপ্রেম, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং আদর্শবাদের বীজ সার্থকভাবে বপন করতে পেরেছিলেন। অনুমান করা যায়, তাঁরা সকলেই নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে কমবেশি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এঁরা সকলেই হয়ত কর্তব্যবোধে নিজের নিজের কাজ অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে করে গেছেন বলেই কোনরকম প্রচারের কথা ভাবেননি। কিন্তু তার ফলে এই অসামান্যা নারীর সম্পূর্ণ জীবনপঞ্জী আমাদের কাছে অধরা হয়ে আছে। হিসেবমত ডাঃ আনোয়ারা খাতুনের জন্ম শতবর্ষ আমাদের অগোচরে বেশ কিছুকাল আগে পেরিয়ে গেছে।

তাঁর উদ্দেশ্যে আমার বিনম্র প্রণাম জানাই।

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Shouvik
Shouvik
3 months ago

সম্বৃদ্ধ হলাম, আপ্লুত হলাম। এ রকম লেখা আরো প্রকাশ পাক।

Sulata Bhattacharya
Sulata Bhattacharya
3 months ago

ডাক্তার আনোয়ার খাতুনের কর্মময় জীবনসম্বন্ধে আলোকপাত করে এক মহৎকাজ করেছেন।কারণ আমার মত অনেক মানুষের কাছেই তাঁর মহান্ ত্যাগ, ধর্মনিরপেক্ষ জীবন যাপন ও ভারতবর্ষের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা অপরিজ্ঞাত।যদিও হোসেইনুর রহমন সম্বন্ধে চিরদিনই মনের মধ্যে গড়ে উঠেছিল এক আন্তরিক শ্রদ্ধা বোধ।তাঁর পান্ডিত্য, বাগ্মিতা বিস্ময়জনক ভাবে বিদ্বৎসমাজকে প্রভাবিত করেছিল। আপনার লেখায় তাঁর পারিবারিক সংস্কৃতিও মূল্যবোধ জানতে পেরে
ভাল লাগল। বিস্মরণের পারথেকে তাঁরা প্রাত্যহিক আলোচনার বিষয় হয়ে উঠুন।ভালো লাগলো আপনার প্রয়াস।