শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

বাবা কা নগরী- আমাদের সাড়ে তিন হাত জমি

Shibanshu Dey

অজগর করে না চাকরি পঞ্ছি করে না কাম
দাস মলুকা কহ গয়ে সবকে দাতা রাম ।।

সন্ত মলুকদাসের নামে প্রচলিত এটি একটি দোহামাত্র নয়। ভারত-মানসিকতার মূল শিকড়গুলো যেন দেখা যাচ্ছে। যেমন বনারস ঠিক একটা স্থান নাম নয়। ওটা একটা ধারণা এবং মানসিকতা। ভারত-সভ্যতার যে সব মিস্টিক লক্ষণ প্রতীচ্য সভ্যতার সঙ্গে মেলে না, তার প্রায় সব কিছুই বনারসি লক্ষণ। সংকীর্ণ গলি’র পর গলি। আবর্জনার স্তূপ দেখলে আছে, এড়িয়ে গেলে নেই। যদি লোকে নাইই তাকায় সেদিকে, তবে তার থাকা না থাকার কোনও তাৎপর্যও নেই। শাশ্বত প্রশ্ন… ‘জব দেখনেওয়ালা কো’ই নহি, জ্বল যাও তো ক্যা, বুঝ যাও তো ক্যা?’ তিনফুট চওড়া গলিপথে এগিয়ে যাচ্ছেন, অন্য দিক থেকে দেখলেন অতি বলশালী একটি শিবের বাহন সবেগে আপনার দিকে ধেয়ে আসছে। লাফিয়ে পাশের দোকানে আশ্রয় নিয়ে যখন ধাতস্থ হবার চেষ্টা করছেন, শোনা যাবে দোকানদারের সস্নেহ আশ্বাস, উওহ কুছ নহি করেগা। মন্দিরে যাবেন? সহস্র সহস্র লোকজন নিজস্ব ধরণে পুজোআচ্চা করে যাচ্ছে। কেউ দ্রুতবেগে, কারুর কোনও তাড়া নেই। ফুল, পাতা, জল, ধূপ, দুধ, ধুলো, কাদা, ঘন্টাধ্বনি, স্বেদবিন্দু, উচ্চরোল ভক্তির আকুতি। মনে হবে, মানুষ তার অসীম সহিষ্ণুতা নিয়েও টিকতে পারছে না এখানে, দেবতা কী করে থাকবেন? ঘাটের পর ঘাট । পোষাকের লজ্জাবিযুক্ত মানুষ । যাবতীয় বর্জ্যে ভাসমান গেরুয়া জল। তাও বিশ্বাসে পবিত্রতম। পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গে। রিকশার উপর রিক্শা, ষাঁড়ের উপর ষাঁড়, মানুষের উপর মানুষ, ফুটপাথ বদল হয়ে যায় মধ্য পথে। সন্ধে হলো। বাতি জ্বলে, নেভে, আবার জ্বলে, আবার নেভে। রিক্শা, অটো, সাইকেল, কুকুর, ভাঙা গলিপথ, চারদিকের মন্দির থেকে ভেসে আসা নানা ভজন আরতির কোলাহলে ভারি বাতাস,সব পেরিয়ে আজকের মতো আস্ত শরীরে আস্তানায় ফিরে যাওয়া। বাবা কা নগরী কি মহিমা অপার। সে হেন বাবা কা নগরী আজ যেন দুবাইয়ের গোল্ড স্যুকের প্রতিদ্বন্দ্বী। ঝলমল এবং ঝলমল। হাজার হাজার ওয়াট আলোর নিচে ভক্তির ‘ভব্য’ প্রদর্শনী। সাতশো পুরোনো মন্দির গুঁড়িয়ে দিয়ে বাবার ‘বিজয়রথ’ যাবার রাস্তা। ক্যা চওড়ি সড়ক বনায়া সরকার !!

বারাণসিতে গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীতে গড়ে ওঠে অসংখ্য প্রাসাদ, হাবেলি, মন্দির, চাতাল। ইংরেজ তোষণে সফল যেসব হিন্দু রাজা-বাদশা-জমিদার নিজেদের ধনসম্পদ বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিলো, তারাই অনেকে গড়ে দিয়েছিলো ইঁটকাঠের বিশাল সব নির্মাণ । নদীর গায়ে গায়ে গড়ে ওঠে ধনগর্বী রাজন্যের প্রতাপী নিদর্শন। স্থাপত্যের সঠিক নিয়ম না মেনে বসতি গড়ে তোলার তাড়ায় ঘাটের সিঁড়ির জন্য যথেষ্ট জায়গার কথা কেউ ভাবেনি। ফলত অব্যবস্থিত মাপ ও মাত্রার সিঁড়ির ধাপই ভবিতব্য। অন্যদিকে এই সব ঘাটে নদীর জল প্রায়ই অনেকটা উঠে আসে। ঘাট উঁচু না হলেও বেশ বিপদ।

সব ঘাটেরই নিজস্ব লিঙ্গদেবতা রয়েছেন। তাঁদের মন্দিরও রয়েছে। প্রাচীনতম লিঙ্গমন্দিরের মধ্যে একটি অসীসঙ্গমেশ্বর শিব রয়েছেন দক্ষিণতম এবং বিখ্যাত অসীঘাটে। এইখানেই গোস্বামী তুলসীদাস বাস করতেন। এখানেই তিনি লিখেছিলেন ‘রামচরিতমানস’। শুধু হিন্দি ভাষারই নয়, এখনও উত্তরভারতের সব চেয়ে জ্যান্ত কবিকৃতি তুলসীর ‘মানস’ । সমান গরিমায় উজ্জ্বল। একটু উত্তরে গেলে লোলার্ককুন্ড। সনাতনধর্ম প্রবর্তন কালের আদিতম সূর্যপীঠ। বস্তুত সনাতন ধর্মের অনেক আগেই এর উৎপত্তি। এখান থেকে উত্তরবাহিনী হলে পর পর শিবালা ঘাট, হনুমান ঘাট এবং কেদার ঘাট। কিংবদন্তি বলছে হনুমানঘাট পঞ্চদশ শতকের বিখ্যাত বৈষ্ণব সন্ত বল্লভাচার্যের জন্মস্থান। বারাণসীর দক্ষিণ ভারতীয়দের প্রধান উপনিবেশ এখানেই। এই ঘাটেই রয়েছে শৈবধর্মের এক আদিতম উপাস্য দেবতা রুরু’র বিগ্রহ । সঙ্গে বাহন সারমেয়, নাম ভৈরব।

এদেশের জাতক ও পুরাণকথার মধ্যে ভারত-ধর্মের মূল ছাঁদটি ধরা আছে। যার একমাত্র উপজীব্য নীতিকথা ও মূল্যবোধের প্রচার। তাদের মধ্যে একটি রাজা হরিশ্চন্দ্রের কিংবদন্তি । যাযাবর আর্য উপজাতিরা এদেশে মূল্যবোধের যে স্তরে নিজেদের উন্নীত করেছিলো, তার একটি নিখুঁত নমুনা হরিশ্চন্দ্রের লোককথা। তিন হাজার বছর পরে এখনও সততার শেষ কথা হিসেবে এই রাজার নাম নেওয়া হয়। গপ্পোটা সবার জানা, তাই পুনরুক্তি নয়। কিন্তু পটভূমি হিসেবে বারাণসীকেই কেন নির্বাচন করা হয়েছিলো? ভারতধর্মের শ্রেষ্ঠ পরীক্ষাগার বলে কি? সেই রূপকথার রাজার নামে একটা ঘাট আছে এখানে। হরিশ্চন্দ্র ঘাট। অনেক অন্ত্যেষ্টি হয় এই ঘাটে আর হয় মণিকর্ণিকা ঘাটের শ্মশানরক্ষক অর্থাৎ ডোমসম্প্রদায়ের সদস্যদের শেষ কৃত্য। তাঁরা নাকি মণিকর্ণিকায় নিজেদের শবদাহ করেন না। বারাণসীর এটাই প্রাচীনতম শ্মশানঘাট, তাই আদি মণিকর্ণিকাও বলা হয় একে। ১৭৪০ সালে পেশোয়াদের গুরু নারায়ণ দীক্ষিত এই ঘাটটি সংস্কার করে পাকা করে দিয়েছিলেন।

পাশেই কেদার ঘাট বেশ বড়ো ঘাট। এখানে ষোড়শ শতকে স্বামী দত্তাত্রেয়র শিষ্য কুমারস্বামী একটি মঠ নির্মাণ করেছিলেন। লাগোয়া চৌকি ঘাটে বৌদ্ধ ও পৌরাণিক যুগের নাগবংশীয়দের নানা পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। বারাণসীর বৃহত্তম নাগপঞ্চমীর উৎসব এখানেই যাপিত হয়। লাগোয়া মানসরোবর ঘাট স্থাপনা করেছিলেন জয়পুরের রাজা মানসিংহ ১৫৮৫ সালে। এই ঘাট পেরিয়ে এলেই রাজা ঘাট, বিশাল আর জমকালো। পেশোয়া বালাজি বাজিরাওয়ের তৈরি। পরে সংস্কার করেন পেশোয়া অমৃত রাও। পর পর খোরি ঘাট, পাণ্ডেয় ঘাট । আর তার পর একজন বাঙালি জমিদার নির্মিত বিশাল প্রাসাদ ও ঘাট চোখে পড়ে। ‘দিঘাপাতিয়া’ ঘাট। দিঘাপাতিয়ার রাজবংশকে মুর্শিদকুলি খান রায়রায়ান উপাধি দিয়েছিলেন। রাজশাহী জেলার এই রাজারা বরেন্দ্রভূমের একছত্র অধিপতি ছিলেন বহুকাল। ঘাট সংলগ্ন প্রাসাদটিতে এখন সীতারামদাস ওঙ্কারনাথ স্বামীর আশ্রম।

বারাণসীর প্রাচীন শক্তিসাধনার নিদর্শন রয়েছে চৌষট্টি ঘাটে। এক কালে এখানে চৌষট্টি যোগিনীর মন্দির ছিলো। ষোলো শতকে বিশ্রুত সংস্কৃত পণ্ডিত মধুসূদন সরস্বতী মন্দিরের পাশে এই ঘাটটির স্থাপনা করেন। সতেরো শতকে উদয়পুরের রানার পোষকতায় এই ঘাটটির সংস্কার হয়। এই মূহুর্তে চৌষট্টি দেবীর যে মন্দির রয়েছে, সেখানে ষাটটি দেবীবিগ্রহ বর্তমান। চারটি বিগ্রহ অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়ে গেছে। চৌষট্টি ঘাট পেরোলেই দ্বারভাঙার রাজা ও তাঁর মুন্সি শ্রীধর নারায়ণের নামে দ্বারভাঙা ও মুন্সি ঘাট। রানী অহিল্যাবাইয়ের নামাঙ্কিত ঘাটটিও রয়েছে পাশেই।

আবার ফিরে আসা দশাশ্বমেধে। প্রশ্ন উঠতে পারে এতো ঘাটের কথা জেনে কী হবে? উত্তরটি খুব সহজ। কিছুই হবেনা। কিন্তু ভারত ইতিহাসের একটা ধারা, যা সনাতনধর্মকে কেন্দ্রে রেখে গড়ে উঠেছিলো, তার পরম্পরা ও হালহকিকতে যাঁদের রুচি আছে, তাঁরা নিশ্চয় আগ্রহবোধ করবেন। ঘাটের কাছে নদীর জল কোন কথা শুধিয়ে যায় অনন্ত প্রহর। তারা তো মানুষের ভাষায় কথা বলে না ।

বারাণসীকে ভারতসভ্যতার নাভিকেন্দ্র কেন বলা হয় তার সদুত্তর সন্ধান আমার প্রিয় ব্যসন। দীর্ঘদিন ধরে নিজের মতো করে বোঝার প্রয়াস পেয়ে যাই। ভারতীয় সভ্যতাসংস্কৃতির চালিকাশক্তি হিসেবে গত দু’হাজার বছর একটি ব্রাহ্মণ্যবাদী, আর্যমুখিন, আভিজাত্যগর্বিত মনস্কতাকে প্রাধান্য দিয়ে আসার অভ্যেস আছে আমাদের । অথচ গভীরভাবে ঘটনাক্রম ও ইতিহাস বিচার করতে গেলে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত সামনে এসে দাঁড়ায়। ভারতবর্ষ চিরকালই সংখ্যাগরিষ্ঠ, নিপীড়িত, মৃত্তিকার সন্তানদের প্রধান আশ্রয়। গত হাজার পাঁচেক বছর ‘ভারতবর্ষ’ নামক ধারণাটিকে তাঁরাই ধরে রেখেছেন । পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে যাঁরা এই ভূখণ্ডটিকে অধিকার করতে, শাসন করতে, লুণ্ঠন করতে আবহমান কাল ধরে দখল করে রেখেছিলেন, তাঁরা বহিরাগত। ভূমি দখল করেছিলেন বটে, কিন্তু বারাণসীর সত্ত্বা অধরাই থেকে গিয়েছিলো। তাঁরা এসেছেন, ফিরে গিয়েছেন, থাকতে আসেননি। তাঁদের সুকৃতিগুলি এদেশের ইতর মানুষ নিজেদের মধ্যে ধরে রেখে দিয়েছেন। ভারত-চেতনা নামক একটি পুণ্য বারাণসীতে ক্রমাগত সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। ভারতবর্ষ সারা বিশ্ব’কে মানবিক সভ্যতার শ্রেষ্ঠ আদর্শ, সমন্বয়বাদের শিক্ষা দিয়ে এসেছে। চেতনাটির প্রয়োগশালা হিসেবে আমাদের ইতিহাসে বারাণসীর একটা অনন্য স্থান রয়েছে ।

পুরাণযুগের পর যখন এদেশে তুর্কি অভিযান শুরু হয়েছিলো, ভারতবর্ষের তৎকালীন সমাজব্যবস্থা প্রথম একটি সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর সভ্যতার আঘাতে টালমাটাল হয়ে যায়। নতুনধর্মের প্রেরণায় উজ্জীবিত নানা নৃগোষ্ঠী , যাঁদের মধ্যে ছিলো মরুভূমির উপজাতিক হিংস্র যুদ্ধমত্ত মানসিক প্রবণতা । সেই সব বহিরাগত শক্তির উত্তাল হিংসার প্লবতায় অন্তর্মুখী, শান্তিসন্ধানী, দোলাচলহীন ভারতীয় জনজীবনের ডায়নামিকসগুলি একেবারে ছিন্নমূল হয়ে পড়ে। ফলতঃ এদেশের সনাতনী সমাজের একটা বড়ো অংশ, নিজেদের অবস্থান শক্তিশীল না করে ক্রমশ একমুখী প্রতিক্রিয়াশীল সমাজে পরিণত হয়ে যায়। বহিঃশক্তির আক্রমণ প্রতিহত করার প্রয়াস না পেয়ে বিপরীত ক্রিয়ায় হিংসা ও ঘৃণাকে আঁকড়ে ধরেছিলো। বহুদিন পর্যন্ত পীড়নসাগর পেরোবার জন্য সনাতনীদের মানসিক ছল ছিলো তা। কয়েকশো বছর কাটার পর যখন মানুষ এই ভবিতব্যকে স্বীকার করতে শুরু করে, তখনই প্রথম ভারতবর্ষ অনুভব করে যে শুভবুদ্ধির সমন্বয়েই মানুষের মুক্তি। বিপরীত মুখে ধ্বংস ছাড়া কিছু পাবার নেই।

আদি ও মধ্যযুগ, এই দুই কালখণ্ডেই যে তিনটি মানুষ ভবিষ্যৎ ভারতচেতনার মানচিত্রটি এঁকে দিয়েছিলেন, তাঁদের তিনজনের সঙ্গেই বারাণসী ওতপ্রোত জড়িত। সন্ত কবির বলেছিলেন, ” জাতি না পুছো সাধুকা” । যে মানুষটি তার সমস্ত ঐহিক সম্বলকে বিসর্জন দিয়ে বহুজনহিতায় সাধু হয়েছে, সে তার জন্মগত জাতির পরিচয়ও বিরজাহোমের আগুনে পুড়িয়ে শেষ করে দিয়েছে। সংকীর্ণ পরিচয়ের মানুষটির মৃত্যু হবার পরই তার মধ্যে চিরকালীন মানব জন্ম নেয়। সমন্বয়ের শিক্ষা দেবার অধিকার শুধু তারই থাকে। শাশ্বত তিনজন ভারতীয়, শাক্যমুনি বুদ্ধ, কবিরসাঁই আর গোস্বামী তুলসীদাস, শাশ্বত চণ্ডালের শ্মশানভূমি বারাণসী ‘কেই তাঁদের কর্মভূমি হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। এ কী শুধু সমাপতন? না, নিপীড়িত ভারতাত্মার প্রতি মানুষের বিবেকের প্রত্যাশিত নিবেদন? সারনাথ, কবিরচৌরা আর অস্সিঘাট, বারাণসীর তিনপ্রান্তে তিনটি আলোকস্তম্ভ আমাদের চিনিয়ে দেয় বারাণসীর প্রকৃত আত্মপরিচয়।

এঁরা ছাড়া কাশীতে ছিলেন একজন গরিবের দেবতা। বাবা বিশ্বনাথ। থাকতেন একটা মন্দিরে । যেখানে পৌঁছোতে গেলে পেরোতে হতো সারি সারি কাশীর গলি। সে সব গলির বাহার কতো। যেন তিন হাজার বছরের ভারতবর্ষ জড়িয়ে-মড়িয়ে একাকার। পায়ে পায়ে গণ্ডা গণ্ডা দেবালয়। পাথরের লিঙ্গ, ফুল-বেলপাতা, খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা পুরোহিত, নদীতে স্নান সেরে ফেরত যাওয়া তীর্থযাত্রী বা শতচ্ছিন্ন, ভেজা চীরবস্ত্রে বনারসি সড়কছাপ জনতা। আপনার আমার মতো পাবলিক। সারা পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই ভারতবর্ষকে দেখতে ছুটে আসতো। টাইম মেশিনে সওয়ার একটা শহর। একটা চিরন্তন মেদুর সমর্পণ। যার টান কখনও ফুরায় না। নজরুলের বিখ্যাত গানের এই লাইনটা মনে পড়ে যায়। ‘তাহারা কোথায়, আজ তাহারা কোথায়?’ বাবা’র নতুন বাড়ি এখন সাহেবদের বানানো বিশ্বনাথ ম্যলে। পুরোনো সব চেলা, নন্দী-ভৃঙ্গী, ভূত-পিশাচ-গণদের সঙ্গে নিয়ে পাগলা বাবা গাঁজাখোর রাতের বেলা দূর থেকে মন্দিরের চূড়ার দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর কোনও আধার কার্ড নেই। টিকিট কাটার পয়সাও নেই। বিনা টিকিটে ঢুকতে গেলে দরওয়ান পথ আটকে দেয়। বলে, হুকুমদাররর….

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


4 1 vote
Article Rating
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Shouvik
Shouvik
3 months ago

বারাণসী সমতুল শুধুই বারাণসী। এ অবশ্যই কোনো tourist spot নয়, একটি নিজেকে খুঁজে পাওয়ার ঠিকানা। মনে পড়ে গেল বহু দিন যাওয়া হয় নি।

Alak Basuchoudhury
Alak Basuchoudhury
3 months ago

“জয় জয় বারাণসী!
হিন্দুর হৃদি-গগনের তুমি চির-উজ্জ্বল শশী।
অগ্নিহোত্রী মিলেছে হেথায় ব্রহ্মবিদের সাথে,
বেদের জ্যোৎস্না-নিশি মিশে গেছে উপনিষদের প্রাতে;
এই সেই কাশী ব্রহ্মদত্ত রাজা ছিল এইখানে,
খ্যাত যার নাম শাক্যমুনির জাতকে, গাথায়, গানে;-
যার রাজত্ব-সময়ে বুদ্ধ জন্মিল বারবার
ন্যায়-ধর্ম্মের মর্য্যাদা প্রেমে করিতে সমুদ্ধার।
এই সেই কাশী– ভারতবাসীর হৃদয়ের রাজধানী
এই বারাণসী জাগ্রত-চোখে স্বপন মিলায় আনি’!…”

কোন সে ছেলেবেলায় পড়া কবিতার এই ছত্র মনে পড়ে গেল লেখাটি পড়তে পড়তে। এ কথাও মনে হল, এই বারাণসী কি যুগে যুগে শুধু আমাদের মনোভূমিতে তৈরি হয়ে ওঠা এক কল্প-বারাণসী? যেসব রক্তমাংসের মানুষ আজকের এই বাস্তব বারাণসীতে বাস করে ও পাঁচ বছর পরে পরে আঙুলে কালি লাগিয়ে দূর দিল্লি নগরে একজনকে প্রতিনিধি হিসেবে পাঠায়, তাদের নিজেদের মনে বারাণসীর ছবিটি কেমন! তাদের কাছে হয়তো বা বারাণসী আজ শুধুই “হিন্দুর হৃদি-গগনের চির উজ্জ্বল শশী”!
অল্প বয়সে খুব ইচ্ছে থাকলেও আজ পর্যন্ত আমার বারাণসীতে যাওয়া হয়ে ওঠেনি।আমার কাছেও ভারতীয় মননের ওই শাশ্বত বারাণসী এক কল্পনগরী হয়ে রয়ে গেছে, যাকে শুধু পাওয়া যায় সেই শাক্যমুনির জাতকে -গাথায় বা পুরাণকথায়! একটি বইয়ের মলাটে একটি ছবি দেখেছিলাম মণিকর্ণিকা ঘাটে দাঁড়িয়ে আছেন জার্মান পন্ডিত মোক্ষমূলর, সেই ছবির বারাণসীও হয়তো বা বহুলাংশে সেই ধারণা, যা ভারতের প্রতিচ্ছবি হিসেবে ওই বিদেশী পন্ডিতের মনে গড়ে উঠেছিল, কারণ বাস্তবে আমার মতই তিনি কখনো কাশীতে যান নি (এমন কী ভারতেই আসেননি)।
এই চমৎকার লেখাটি পড়তে পড়তে হয়তো বা কিছুটা বেখাপ্পাভাবেই আমার মনে প্রশ্ন জেগে উঠল — সেই সারনাথের শাক্যমুনি, গঙ্গার ঘাটেঘাটে ঘুরে বেড়ানো জোলা কবিরদাস বা অন্নপূর্ণার মন্দিরের অদূরে বসে সানাই বাজানো বিসমিল্লাহ — এদেরকে কি আজ কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে বাস্তবের কাশীবাসীদের মনের ভূগোলে! বারবার যখন দেখি, এই বারাণসী-ছাপ ফরমান নিয়ে আধুনিক ভারতের সবচেয়ে বড় বিভাজক অদৃশ্য ছুরিকাঘাতে ফালাফালা করছে আমার (শুধু আমার নয়, সমানভাবে সত্যেন দত্ত থেকে ম্যাক্সমুলারের, এই রম্য প্রতিবেদনটির লেখকের এবং আরো অনেকের) স্বপ্নকল্পনার এই বারাণসীকে, যে-বারাণসী একটি শহর মাত্র নয়, যে-বারাণসী একটি ধারণা, যার কথা এই লেখায় বারবার এসেছে, তখন আমার অবুঝ মনে এই বেয়াড়া প্রশ্নগুলো কেন যে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে বুঝতে পারি না!