শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

মনোরম বা রোমাঞ্চকর ভ্রমণকাহিনী লেখার ইচ্ছে বা মন কোনোটাই এখন নেই। যখন জানলাম, লেখা দেওয়ার একটা সাদা দেওয়াল আমার জন্য বরাদ্দ,তাই একটু মনের কথা বলি।

৯ই অগাস্ট থেকে আজ ১৭ দিন (২৬শে আগস্ট) হয়ে গেল অভয়ার নারকীয় হত্যাকান্ডের। আমরা পথে পথে মিছিল করছি, প্রতিবাদ, ধরনা… আমরা মেয়েরা দিশেহারা। ঠিক কী করলে যে শান্তি পাবো, কী করলে যে ভালো হয় আমরা দিশেহারা। আমার অবস্থা আরো অসহ্য, একে মহিলা সরকারি ডাক্তার, তায় আর. জি. কর-এর প্রাক্তনী। আমাদের জীবনের প্রায় অর্ধেকটা এই কলেজের আনাচে কানাচে কেটেছে। সেই কলেজে ঘটে গেল এমন নারকীয় ধর্ষণ আর হত্যাকান্ড আমাদেরই জুনিয়রের। এ দুঃখ, যন্ত্রণা যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। সারা পৃথিবী জুড়ে আমাদের প্রিয় কলেজটার এত বদনাম যেন আর প্রাণে সইছে না। ৯০ দশকের ব্যাচ আমি,আর জি কর-এ একবার ঢুকে পড়লে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়তো। মনে করতাম আমরা এখানে সম্পূর্ণ নিরাপদ, রাত দুটোর অপারেশন শেষে অনায়সে নিচে গিয়ে ম্যাগিতে পেট ভরিয়েছি। রাত বিরেতে ট্রাম লাইন পেরিয়ে কয়েক জন মিলে ধাবা তে গিয়ে খেয়ে এসেছি। কখনওই নিরাপত্তার অভাব বোধ হয়নি। হোস্টেল থেকে আলো আঁধারি সরু প্যাসেজ পেরিয়ে ওয়ার্ড এ গেছি একাই। কখনও রেপ বা খুন হয়ে যাওয়ার ভয় পিছু তাড়া করেনি।

আজ সেখানে নিশ্ছিদ্র ঘেরাটোপে পূর্ব পরিকল্পিত অভয়ার খুন এবং ধর্ষণ আমাদের পেশা এবং মহিলা ডাক্তারদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা টা একটা প্রশ্নচিহ্নে এনে আমাদের পথে এনে ফেলেছে। শুধু ডাক্তার নয় প্রত্যেকটি মেয়ে আজ অস্থির এবং নিজেকে অসুরক্ষিত মনে করতে বাধ্য হচ্ছে। ‘রাত দখল’-এর দিন সারা রাজ্যের মহিলারা পথে নেমেছেন, বাড়িতে কেউ থাকতে পারি নি আমরা। এমন অভাবনীয় প্রতিবাদ কেউ কখনও দেখেনি এর আগে। তার আগে পরে প্রতিদিন অসংখ্য মিছিলে মানুষ পথে নেমেছেন, কাউকে ভয় দেখিয়ে মিছিলে আনতে হয়নি।অভয়ার মৃত্যু এক বিরাট অপরাধ চক্রের, দুর্নীতির উৎসমুখ যেন খুলে দিল। যারা অন্যায় দেখে,সহ্য করেও চুপ করে ছিলেন এতদিন, তারাও যেন আস্তে আস্তে সাহস পেয়ে মুখ খুলছেন। তাও বলবো,আমাদের ডাক্তারদের এক সিংহভাগ এখনও ভয়ে, নিরাপত্তাহীনতায়, প্রচ্ছন্ন হুমকির কালোছায়ায় অন্ধকারে। কারণ এখনও দোষীদের নামই জানা যায়নি। ৯০% প্রমাণ নষ্ট এবং সেই বিরাট সিন্ডিকেট চক্র গোটা বিষয়কেই ধামাচাপা দেওয়ার প্রবল প্রচেষ্টারত।


আমাদের প্রিয় কলেজটা পুরো খাঁ,খাঁ শ্মশানে পরিণত। জুনিয়র ডাক্তাররা সবাই হোস্টেল খালি করে বাড়ি চলে গেছে, কিছু আন্দোলনরত জুনিয়র ছাড়া আর কেউই নেই। সিনিয়র ডাক্তাররা হাল ধরেছেন, সমস্ত পরিষেবা চালু রেখেছেন। কিন্তু অপপ্রচার চলছে যে হাসপাতাল বন্ধ।
ছাপা, ছাপা পোশাক পরা জওয়ানরা (সি আই এস এফ) হাসপাতালের দখল নিয়েছে। ঘন ঘন সিবিআই-এর টিম পরিদর্শনে আসছেন। ভয়েই আর সাধারণ মানুষ আর জি কর থেকে শতহস্ত দূরে। এই চিত্র আমাদের মত প্রাক্তনীদের কাছে বেদনাদায়ক। জুনিয়র ছেলেমেয়েরা রাস্তায়, মিছিলে, ধরনায়। ওদের চোখের আগুনের ভাষা আর থামার নয়, যতদিন না দোষীদের শাস্তি হচ্ছে এই আগুনে-প্রতিবাদ, মিছিল চলতে থাকবে, কোনো বিশেষ পতাকার আড়ালে আর নয়, সব পতাকার রঙ সরিয়ে রেখে মানুষ আজ পথে নেমেছে। আমরা সিনিয়র প্রাক্তনীরা জুনিয়রদের পাশে আছি, জানিয়ে এলাম ওদের। রাষ্ট্রের ওপর এই চাপটা বজায় রাখতে হবে নইলে এত মানুষের ঘামেভেজা প্রতিবাদ কোনো মূল্য পাবে না। কয়েক লাইন ছন্দ দিয়ে শেষ করি-

মিলব আমরা রাতগভীরে
নিশির মত মধ্যযাম
রাত দখলের লড়াই হবে
শাসন হাতে মেয়ের জাত

অনেক রাতই জুড়বে আজ
পথের ওপার অন্ধকার
ঝড়ো হাওয়া বুঝিয়ে দিক
মেয়ে মানেই দিগন্তকার

সাত সহস্র পদক্ষেপে
রাত্রিভাঙা প্রতিবাদ
খোলা আকাশ হাতে হাত
হতে পারে মুক্তবাদ

যোগ বিয়োগের হিসেবমত
আমরা আজ দীর্ঘ স্বর
শরীর শুধু মেয়ের নয়
মেয়ের মান মায়ের জঠর

দখলকার ও মেয়ে তুই
ফুটপাথে দ্যাখ আমিও আছি
মধ্যরাতে আমরা হব
একেকজন দখলিদার

এই তো সময় সব ছেড়ে আজ
আকাশ ছোঁওয়ার মন্ত্র বলি
এই তো সময় মাঝরাতে আজ
কন্ঠ ছাড়ার সব আজাদী

রাতের পাশে বৃষ্টিধারায়
লক্ষ আলোর বিন্দুরা
শরীর ছাড়া মেয়ের দায়
মেয়ের ক্রোধের সিন্ধুরা।

[ছবি- লেখক]

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.