শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

হারিয়ে যাওয়া অভিজ্ঞান

ঋষি বিশ্বামিত্র ও অপ্সরা মেনকার কন্যা শকুন্তলা, জন্মলগ্নেই পিতা মাতার দ্বারা পরিত্যক্ত। আশ্রয় দিলেন আরেক ঋষি, কণ্ব। অনসূয়া, প্রিয়ম্বদা সহ আরও অনেক আশ্রমিকের সঙ্গে মনোরম তপোবনে বেড়ে ওঠে শকুন্তলা। আবাল্য লালিত মানবিকবোধ নিয়ে বহির্জগতের সঙ্গে তার সাক্ষাত ঘটে, রাজা দুষ্যন্তের হাত ধরে। প্রেমিক রাজার সাহচর্যে কিছুদিন তপোবনের পরিচিত স্থানেই দিন কাটে শকুন্তলার। অতঃপর রাজকার্যে দুষ্যন্তের প্রত্যাবর্তন। শকুন্তলা পড়ে রইলেন তাঁর পালিত পিতার আশ্রয়ে। বিরহিণী শকুন্তলার ভুল হয়ে যায় কাজে, অতিথি দুর্বাসাকে যথাযথ আপ্যায়নে অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি থেকে যায়। অগ্নিশর্মা ঋষির অভিশাপ মাথায় নিয়ে শকুন্তলা হারিয়ে ফেলেন রাজার দেওয়া অভিজ্ঞান, স্বর্ণ অঙ্গুরী। সময় বয়ে চলে, কণ্বমুনি মেয়েকে শ্বশুরালয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। মহাকবি কলিদাসের বর্ণনায় শকুন্তলার সঙ্গে প্রকৃতির বিচ্ছেদ বড় মর্মগ্রাহী। কিন্তু আরও বড় বেদনা অপেক্ষা করছিল, স্বর্ণ অঙ্গুরী ব্যতীত রাজা শকুন্তলাকে চিনতে পারলেন না।

এই গল্প অতি প্রাচীন। কবির কলমে, অমর হয়ে রয়েছে শকুন্তলার জীবন কাহিনী। উত্তরকাল এই গল্প পড়ে হাহাকার করে ওঠে। পাঠকের অন্তরে সাহিত্যের অভিঘাত সৃষ্টি হয়।

শিল্পী – রবি বর্মা

আজকের পাঠক শকুন্তলা পড়েন কিনা জানা নেই। তাঁরা হয়তো ওয়েব সিরিজ অথবা সিনামায় এই গল্প জানবেন। অথচ প্রতিদিনের খবরের কাগজ আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে, চিনতে না পারার রক্তক্ষয়ী গল্প।

এ গল্পগুলি গায়ে কাঁটা দেয়।

স্থান, হুগলির তারকেশ্বরে নাইটামাল পাহাড়পুর গ্রাম পঞ্চায়েতের রানাবাঁধ। সেখানে গাড়িচালক ২৩ বছর বয়সি বিশ্বজিৎ মান্নাকে স্থানীয় মানুষ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। তাদের সন্দেহ ছিল, বিশ্বজিৎ গাড়ি চুরি করেছে।

উত্তর দিনাজপুর জেলার চোপড়া-র লক্ষ্মীপুর পঞ্চায়েতের দিঘলগাঁও গ্রামে একটি ভয়ংকর ঘটনার ভিডিও সমাজমাধ্যমে প্রচারিত হল। এক নারী ও এক পুরুষকে পেটানো চলছে। দুজনেই রাস্তায় পড়ে আছেন।

বন্ধু অক্ষয়ের সঙ্গে সৌরভ সাউ স্কুটারে করে বেড়াতে গিয়েছিলেন ঝাড়গ্রামে। সেসময় তারা নির্মাণ সামগ্রী চুরি করেছে, এই অভিযোগে ব্যাপক পেটানো হয়। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সৌরভ পরে মারা যান।

কলকাতায় বৌবাজারের ছাত্রাবাসে ইরশাদ নামে এক যুবককে মোবাইল চোর সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়েছে। তিনি চাঁদনী চক এলাকায় একটি দোকানে কাজ করতেন। ছাত্রাবাসে ধরে নিয়ে গিয়ে বেধড়ক মারা হয়। তিনি যেখানে কাজ করতেন, সেই মালিককে ফোন করেন। তিনি পুলিশে খবর দেন। কিন্তু ইরশাদকে বাঁচানো যায়নি।

সল্ট লেকেও সম্প্রতি মোবাইল চোর সন্দেহে একজনকে পিটিয়ে মারা হয়েছে।

তার আগে শিশুচুরির অভিযোগে উত্তর ২৪ পরগনার বিরাটিতে দুই নারীকে মারধর করা হয়েছে।

ওপরের ঘটনাগুলি সাম্প্রতিক খবরের কাগজ থেকে সংগ্রহ করা। এই কথা জানলেই বুকের মধ্যে একটা আতঙ্ক গ্রাস করে। আমরা ক্রমে হারিয়ে ফেলছি মনুষ্যত্বের অভিজ্ঞান, যা আমাদের মানুষ হিসেব শনাক্ত করতে পারে। তাই অনায়াসে যেকোন সহ-নাগরিককে আমরা দেগে দিতে পারি ‘চোর’, ‘ছেলেধরা’ অথবা অন্য কোন অপরাধী হিসেবে।

এই হারিয়ে যাওয়া অভিজ্ঞানটি কোন স্বর্ণ অঙ্গুরী নয়, মানবিক বোধ। পশু থেকে উত্তীর্ণ হয়ে ওঠার যে প্রাথমিক শর্ত। কিন্তু কে খুঁজে দেবে হারানো বোধটি?

একমাত্র শিক্ষার হাতে রয়েছে সেই দীপদন্ড যা মনের অন্ধকার দূর করে খুঁজে আনতে পারে সেই দর্পন, যার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা নিজেদের চিনতে পারি। এই শিক্ষা ‘পাশ’ দেওয়ার প্রক্রিয়া নয়। এ হল পাশ ফিরে দাঁড়ানোর গল্প।

বাঙলা তথা ভারতের ছাত্রছাত্রীদের এখন গভীর হতাশা। নিট কেলেঙ্কারি, শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি ইত্যাদি আমাদের সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাকে গ্রাস করেছে। এভাবে চললে, ঠিক যে কারণে অন্যান্য প্রতিবেশী উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় আমরা নিজেদের একটু শ্রেয়তর ভাবতে শুরু করেছিলাম, সেখান থেকে অধঃপতন কেবল সময়ের অপেক্ষা।

ছাত্রদের সামনে আজ অনুসরণযোগ্য কোন পথ নেই, পথপ্রদর্শকও কালিমালিপ্ত। আমরা আশা করতে পারি, সুদিন আসবে, কিন্তু সে কবে, দূরদূরান্ত পর্যন্ত তার কোন আভাষ চোখে পড়ে না।

“ফটোগ্রাফিক অলংকরণ ও সামগ্রিক সজ্জায় যত্ন ও সাহিত্য-সংবেদী দক্ষতার ছাপ রয়েছে। বাকি অংশগুলোতে ভালো ডিজিটাল ম্যাগাজিনের মতো সপ্রতিভ উপস্থাপনা রয়েছে। সম্পাদক তন্ময়বাবু ও সম্পাদনা বিভাগের সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা।” — পল্লব গাঙ্গুলী, কলকাতা

রবিচক্র অনলাইন আপনাদের কেমন লাগছে? নিচের ঠিকানায় লিখে জানান। ইমেল-ও করতে পারেন। চিঠি অথবা ইমেল-এর সঙ্গে নাম, ঠিকানা এবং ফোন নম্বর থাকা বাঞ্ছনীয়।

রবিচক্র
‘প্রভাসতীর্থ’, ৭৬ ইলিয়াস রোড, আগরপাড়া, কলকাতা – ৭০০০৫৮, ভারত

editor@robichakro.com

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


4.8 4 votes
Article Rating
3 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Amit Banerjee
Amit Banerjee
6 months ago

অত্যন্ত মূল্যবান ও তথ্যসমৃদ্ধ একটি লেখা।

Smritish
Smritish
6 months ago

খুব ভালো লাগলো অনেক অনেক ধন্যবাদ । ঘটে যাওয়া সমাজের কথা এভাবেই জোরালো ভাষায় চোখে আঙুল দিয়ে না দ্যাখাতে পারলে বাংলার আগামী দিনে সমুহ বিপদ।

Bimal Kumar Chakraborty
Bimal Kumar Chakraborty
5 months ago

রাজা দুস্মন্ত দ্বারা পরিত্যক্তের সময় শকুন্তলা গর্ভবতী ছিলেন। অরণ্যে তাঁর যে পুত্র সন্তানের জন্ম হয়, তিনি পরবর্তী সময়ে রাজচক্রবর্তী ভরত নামে খ্যাতি লাভ করেন । আর তাঁর নামেই আমাদের দেশের নাম ভারতবর্ষ।
কিন্তু আমাদের বর্তমানের শকুন্তলারা অহরহ কামনার শিকার হচ্ছে, এবং গর্ভজাত সন্তানের অপমৃত্যু হচ্ছে। এর জন্য দায়ী আমাদের সামাজি শিক্ষা এবং নৈতিক অধঃপত। শকুন্তলার কাহিনী বর্তমান সমাজের কজনই বা পড়ে বা জানে !
অথচ এখনও মালিনী নদী বয়ে চলেছে তার পারে কণ্ব মুনির আশ্রমও কিন্তু অখ্যাত অপরিচিত।