শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

যে জীবন ফড়িঙের…

‘বাবা আজ যদি তুমি বলতে না পারো ভদ্রলোকে – আমিই বলব’।
‘একদম না। তুমি কি বলতে কি বলবে। আমি বলব’।
‘ঠিক আছে । তুমি কিন্তু আগেও বলব বলে – বলনি। আজ…’।
‘ওরে বলার মত একটা পরিস্থিতি তৈরি হবে – তবে তো’।
‘তাহলে আর হয়েছে । ছাড়ো। আমি আজ …’।
‘কিছুতেই – না। ঠিক আছে বলছি তো … আজ বলে দেব’।
‘ও কে। আমি তাহলে বেরচ্ছি’।
‘হ্যাঁ। সাবধানে যাবে। মাথা ঠাণ্ডা করে বাইক চালাবে’।
‘ঠিক আছে বাবা। আসি তাহলে’।
‘হ্যাঁ। মানে … কাজু … বলছিলাম কি আজ নাহয় …’।
‘বাবা… আজ মানে ২৫শে মার্চ উনিশ শো ছিয়ানব্বুই, ব্যস’।
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। আজই’।

অফিসের ব্যাগ নিয়ে নিচে নামল কাজু ওরফে কিঞ্জল। বাইক স্টার্ট করতে করতে আপন মনে হাসল একটু। কত রকম বাবা ছেলের বিবাদের কথা ভরে থাকে দূরদর্শনে, সিনেমায়। কখনো কুচক্রী ছেলে বৌমা, কখনো বা পাইপের ধোঁয়ায় সংসার জ্বালিয়ে দেওয়া বাবা। কিন্তু তার – বা তার স্ত্রী কুরঞ্জি ওরফে কুঞ্জির সঙ্গে বাবার কোন বিবাদ হয় না। বাবার অবসরের পর কিঞ্জলরা সবাই দীর্ঘ দিনের ট্রাক কোম্পানির আবাস ছেড়ে ঠাঁই নাড়া হয়েছে । শহরের উপান্তে গড়ে ওঠা ফ্লাটের জঙ্গলে এখন তাদের দু-কামরার জমিদারী। সকলেই নিজের চক্রবৎ জীবনে বেজায় ব্যস্ত। কিঞ্জল দশটা পাঁচটা অফিসের পরে স্বল্প দৈর্ঘ্যের সংস্কৃতি চর্চা করে। ফাঁকে ফাঁকে তার শৌখিন যোগদান থাকে গণত-সংগঠনের মঞ্চে। কুঞ্জি তার আড়াই বছুরে বোম্বেটের সঙ্গে দিনে বারো ঘন্টার যুদ্ধ করে। তার নাম তাতার। স্ত্রী বিয়োগের পর বাবা – তার বই, খাতা আর ঝর্ণা কলম নিয়ে প্রায় গুহাবাসী। খাওয়া দাওয়া জাতীয় জাগতিক কর্মের জন্যে বাইরে আসেন। একটু আধটু গল্প গুজবের পরে আবার স্বেচ্ছা নির্বাসন, পুথি পত্তরের দ্বীপান্তরে। সন্ধে বেলা অবশ্য একবার ভূমিষ্ঠ হন। ঘন্টা খানেক হাঁটেন ছোট পার্কটিতে।

এই পার্কেই এক সন্ধেবেলা একজন চেঁচিয়ে উঠলেন ‘আরে ডঃ বাসু? আপনি এখানে’। আমি ডি বাসু – আমাকে চিনলেন না’। না চেনার কারণ নেই উনিও ট্রাক কোম্পানিতে ছিলেন। বেশ পদস্থ কর্তা হিসেবে অবসর নিয়েছেন গত বছর। কিঞ্জলের বাবা – চাকরি না করলে চলবে না তাই করেছেন। সারা জীবন সারা দিন লেখা পড়ার মধ্যে থাকতে পারলেই হয়ত তার অমিয় লাভ হত। তিনি ডঃ – তবে সাহিত্যের কারবারি, শরীরের নন। যাই হোক পুরোন পরিচিতরা পরস্পর সহর্ষ হাত ঘষাঘষি করলেন। ফ্ল্যাট নম্বর বিনিময় হল। ডি বাসুর ঘরে তখনো টেলিফোন লাগেনি। সে যন্ত্র নব্বুইয়ের দশকে ঘরে স্থাপন করা খুব সহজ ছিল না । কাজেই ম্যারিকা বাসী জুনিয়ার ডি বাসু – মা বাবার সাথে কথা বলবে ডঃ বাসুর টেলিফোনে তেমন ভদ্রলোকের চুক্তি সম্পাদিত হল। ডঃ বাসু দোতলায় থাকেন, ডি বাসু চার তলায়। হাঁটুর সুবিধের কথা ভেবে নিয়মিত আড্ডা-স্থল স্থির হল কিঞ্জলদের বাড়ি।

খুশিতে সামিল হল কিঞ্জল এবং কুঞ্জিও। মা চলে যাবার পর যে স্থান শূন্য হয়েছে তা শুধু ছেলে বৌ নাতি দিয়ে যেন অপূর্ণ থাকছিল। এক জন বন্ধু সেখানে আরেকটু আঠা আনতে পারেন। সুতরাং তারা মন খুলেই আমন্ত্রণ জানাল বাসু সাহেবকে। তিনি এলেন পরের দিন।

কুঞ্জি আনল গরম চা ও আনুষঙ্গিক টুকিটাকি। পরিচয়ের পর স্বাভাবিক সৌজন্য বশত বৈঠকখানা ছেড়ে তারা সেঁধোল পাশের এক চিলতে শোবার ঘরে, চরম অনিচ্ছুক তাতার সহ। আদ্ধেক ভাজাভুজি আর পুরো পেয়ালা চা শেষ করে বাসু সাহেব বললেন –

‘বাঃ। আচ্ছা ডঃ বাসু আপনি আচারিয়াকে চিনতেন’?
‘কোন আচারিয়া’?
‘ওই যে বিল সেকশনে কাজ করত। ঢ্যাপসা কালো, ঢুলু ঢুলু চোখ …’।
‘ও হ্যাঁ। ভদ্রলোক ভালো বাঁশি বাজাতেন’।
‘ওই ওই । ওতেই ধরাকে সরা দেখত। জিএম দুবার কি প্রশংসা করে দিয়েছিলেন… আর কি। নিজেকে কান্না-লাল ভাবত’।
‘কান্না-লাল? ও আপনি বোধহয় পান্নালাল মিন করেছেন, পান্নালাল ঘোষ। বাঁশির জাদুকর’।
‘ওই হবে। আমি আবার কালচার টালচার তেমন বুঝি না অনেকটা স্বনামধন্য ‘প্রকাশ’বাবুর মত। হে হে। তা সে একবার আমার পাঠানো একটা বিল পাস করতে চাইল না। ভাবতে পারেন – আমি পাঠিয়েছি, আর আটকে দিল’?
‘ও তাই । কেন’?
‘বলে কি না সাপর্টিং পেপারস সঙ্গে নেই। ফোনে বললাম তাড়াহুড়োয় লাগানো হয়নি , ছেড়ে দিন কাগজ পেয়ে যাবেন। ছাড়ল না। একমাসের মধ্যে ট্র্যান্সফার করে দিলাম বেল-পাহাড় অফিসে। দ্যাখা এবার নিয়ম কানুন আর বাঁশি বাজাগে জঙ্গলে জঙ্গলে’।
‘ও’।
‘কাউকে ছেড়ে কথা বলিনি মশাই। দাপটে কাজ করেছি। বলব সব আপনাকে আস্তে আস্তে। আজ উঠি। আসব কাল’।

বাসু সাহেব বিদায় হতে হড়পা বাণের মত মুক্ত তাতার ছুটে গিয়ে উঠল দাদুর পিঠে। ঈষৎ ব্যাজার কিঞ্জল বলল –

‘চাকরি ছাড়ার পরও চাবুক ছাড়ে নি। এদের জন্যেই মার্কস বলেছেন …’।
‘আরে যেতে দে। এখন তো আর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না কারু। অতীতেই ডুবে আছে। কুঞ্জিকে বল খাবার দিক। একটা লেখা …’।

পরের দিন সন্ধ্যে বেলা বাসু সাহেব কে দরজা খুলে কিঞ্জল আবার ঢুকল শোবার ঘরে, সঙ্গে মুখ চাপা তাতার। একটু পরে আতিথেয়তা সাঙ্গ করে এসে জুটল কুঞ্জিও। ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে বাসু সাহেবের আরেক কাসুন্দি।

‘আচারিয়ার গল্প তো কালকে বললাম । আজ বলি নারায়নস্বামীর। তেএঁটেপনার কথা। এ আবার বোম্বে অফিসে – কার যেন ধামাধারি ছিল। এক দিন আমার লেখা একটা নোট এনে রাখল টেবিলে। বলল মিস্টার বাসু এখানে একটা গ্রামাটিক্যাল মিস্টেক হয়েছে। শুধরে দেবেন। পিত্তি চটে গেল মশাই। আমি যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ার। আমার ভুল ধরছে ওই মদ্র। একটু চটর বটর ইংরেজি বলতে পারে বলে এত বড় আস্পর্ধা? আমি কিচ্ছুটি বললাম না তখন। তক্কে তক্কে থাকলাম। একদিন বেনামি একটা চিঠি ঝেড়ে দিলাম ওর বস-কে। নারায়নস্বামীর থেকে সাবধান । বম্বেতে বলে আপনার প্রমোশন আটকানোর ফিকির করছে। সঙ্গে লাগালাম একটা অস্পষ্ট টেলিগ্রামের জেরক্স। মূল বিষয় পড়াই যাচ্ছে না । শুধু প্রথমে হেড অফিস আর শেষে নারায়নস্বামীর নাম বোঝা যাচ্ছে। সন্দেহের বীজ ঢুকল। মাস তিনেকের মধ্যেই একদিন ফাটাফাটি ঝগড়া। নারায়নস্বামী গেল সপ ফ্লোরে, টাইম সুপারভাইজার হয়ে। রোজ এসিতে বসা গেল ভোগে। নীল জামা মজুরদের গাল খেতে খেতে নাভিশ্বাস উঠে গেল। শুধু গায়ের জোরে ওপরে ওঠা যায় না মশাই, বুদ্ধি খরচ আছে। আজ চলি’।

বিরক্তি আরো পনেরো ডিগ্রি বাড়িয়ে ঘর থেকে বেরল কিঞ্জল। সে কিছু বলার আগেই সহাস্য বাবা বললেন –

‘দেখেছিস কাজু। একে দেখলে আমার দয়ে পড়া হাতির কথা মনে হয়। বেরোতে পারছে না শুধু বৃংহণ। যাক গে … বলেই যদি আনন্দ পায়’।

কিঞ্জল টিভি খুলল। কুঞ্জি গেল রাত খাবারের জোগাড়ে।

এরপর দিন দুই কিঞ্জলের সংস্কৃতি চর্চা ছিল। সন্ধ্যে পেরিয়ে ঢুকেছে বাড়িতে। রাতে কুঞ্জি চাপা হাসিতে জানিয়েছে একদিন রাম ঠনাঠন, আরেক দিন আস্থানার পতনের কাহিনী সূক্ষ্ম খুঁটিনাটি সহ জানা গেছে। কিঞ্জল অল্প দাঁতের ব্যায়াম করে ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন রবিবার। শিথিল সময়। দেরিতে ঘুম থেকে ওঠা। সকালের নাস্তা হতে হতেই এসে পড়লেন বাসু সাহেব। সোফায় জমিয়ে বসতে বসতে বললেন –

‘আজ সকাল সকালই এসে পড়লাম ডঃ বাসু। বিকেলে আবার গিন্নীকে নিয়ে বাজারে যেতে হবে। গতকালের আস্থানার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ হবে না যদি সঙ্গে সঙ্গে পানিগ্রাহীর কেসটাও না বলি। তাই সময় নষ্ট করতে পারলাম না। শুনুন তা হলে একদিন পানিগ্রাহী …’।

ঘণ্টা খানেক সঙ্গে বাসু। কিঞ্জলের বাবা খোঁচা খোঁচা দাড়ি ভরা গালে হাত দিয়ে শুনতে লাগলেন। কিঞ্জল ও কুঞ্জি মানতে বাধ্য হল যে ভদ্রলোকের বলার ভঙ্গি যথেষ্ট নাটকীয় কারণ তাতার পর্যন্ত মুখে আঙুল দিয়ে শেষ পর্যন্ত শুনল পানিগ্রাহি পীড়ন কথা। বারোটা পনেরোয় যেন নেহাত অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠলেন বাসু সাহেব । কিন্তু জানিয়ে যেতে ভুললেন না তার পুঁটলিতে এমন কীর্তির সৌরভ আছে অনেক । ধীরে ধীরে সবই বিলিয়ে যাবেন। সে দিন স্পষ্টতই অসন্তুষ্ট কিঞ্জল বাবাকে বলল

‘কি তোমার রোজ এসব শুনতে ভালো লাগে, বলতো বাবা? চাকরি জীবনে তোমার নিজের কাজের জায়গার কথা আমরা কোনদিন শুনিনি তোমার মুখে । এখন নিত্য কে কাকে বাঁশ দিল সেই খত্যেন শুনে কি লাভ হচ্ছে’?
‘ওরে আমারই কি ভালো লাগে? কিন্তু ভদ্রলোককে কি বলি! কত আর গল্প থাকবে। নিজেই শেষ হবে একদিন। তোদের অসুবিধে হচ্ছে বুঝতে পারছি। ছোট ফ্ল্যাট , সন্ধেবেলা…’।
‘আমাদের নয়। তোমার হচ্ছে । আজ সকালে দাড়ি পর্যন্ত কামাতে পারলে না, কিন্তু …। একবার বলে দেখ না কত বিষয় আছে দুনিয়ায়, সে সব নিয়ে আলোচনা কর। কিছু তো ওনার শখ থাকবে’।
‘আচ্ছা দেখি সময় সুযোগ করে একবার …’।
‘কাল থেকে তিন দিন আমার অফিস ট্যুর আছে । এর মধ্যে একদিন মনে জোর এনে বলেই ফ্যালো’।
‘আচ্ছা দেখি। এবার কোথায় যাচ্ছিস’?

এরপর টুকটাক সাংসারিক কথা । বাবা দাড়ি কামালেন, তাতার দুটো খেলনা ভাঙল , কুঞ্জি তেড়ে আসাতে দাদুর কোলে অর্থাৎ অভয়ারণ্যে লুকাল। কিঞ্জল গেল সাপ্তাহিক পাঁঠার সন্ধানে। আড়াইটেতে সেই পাঁঠার সৌরভে মাতল ভুবন। রাতে সবাই গেল দোসা খেতে। রবিবার গেল, যেমন যায়।

সোমবার ভোরে বেরিয়ে গেল কিঞ্জল। ফিরল বৃহস্পতিবার সন্ধেবেলা। তাদের বৈঠকখানা গুলজার । হাঁটি হাঁটি পাপা সেরে দুই প্রবীণ নাগরিক বসেছেন চা সহ। রীতি মাফিক ‘ডঃ’ চুপ, বলছেন ‘সাহেব’। জনৈক মিস্টার মহাপাত্রর মহা প্রস্থান পর্ব শেষের মুখে। কিঞ্জল কিছু না বলেই ঢুকে গেল নিজের ঘরে। কুঞ্জি জল নিয়ে এসে সহাস্যে জানাল গত তিন দিনই বধ হয়েছেন কোনো না কোনো মহারথী । সবার নাম অবশ্য সে মনে রাখেনি। আলু সেদ্ধ খেতে গিয়ে নীম পাতা চিবিয়ে ফেলার মত মুখ করে কিঞ্জল গেল মাথায় জল ঢালতে। মনে মনে বলল অভ্যুত্থানের সময় হয়েছে। এই চেঙ্গিস কে দুরমুশ করা দরকার। পর দিনের কথা গল্পের শুরুতেই বলা হয়েছে।

বিকেলে তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরে বাঘ শিকারির মত মাচায় বসল কিঞ্জল। সঙ্গে গুলি নেই, আছে ‘দাস ক্যাপিটাল’থেকে সংগ্রহ করা শানানো বুলি। তার নাম কাজু হতে পারে, কিন্তু তার বাবার মত এত সহজে চিবিয়ে খাওয়া যাবে না। বৈঠকখানায় চরম অস্বস্তিতে বাবা । ঠিক যেন বাঘের টোপ। মাঝে মাঝে ‘ফাঁদে পড়া’ চোখে চাইছেন তার ‘কাজু’র দিকে। কিন্তু কাজু দেখেও দেখছে না। ঘড়িতে বাজল সাতটা। দোর ঘণ্টি বাজিয়ে সহাস্যে ঘরে এলেন বাসু সাহেব। বললেন –
‘আরে ডঃ বাসু। আজ হাঁটতে যাননি। শরীর ভালো তো’?
‘হ্যাঁ। এমনিই … মানে …’।
‘যাক । আমি ভাবলাম কি হল আবার। যা হোক। কালকে মহাপাত্রর শো কজের গল্পটা বললাম আপনাকে। কিন্তু ওইটিরই ল্যাজে ল্যাজে আরেকটা খুব ইন্টারেস্টিং ঘটনা আছে। বাড়ি গিয়েই মনে পড়ল। তখন দেরী হয়ে গেছে। আজ সকালে আবার টেলিফোনের লোক এসেছিল মাপ জোক করতে। ঘণ্টা দুয়েক একবার এই পোল একবার ওই পোল শেষে আবার একশো টাকা গুনাগার। সেই কবে আপ্লাই করেছি। এত দিনে বাবুদের টনক নড়ল। যন্ত্রটা বসে যাক, তারপর দেখছি এদের। যেতে দিন। যা বলছিলাম – ওই মহাপাত্রর পাশেই বসত মিলখা সিং। না না দৌড়বাজ নয় … বলা যায় কাঠি-বাজ। তো হয়েছে কি …’।

(উহুম উহুম, কিঞ্জলের গলা ঝাড়া শোবার ঘর থেকে। সে দিকে আর একবার করুন আঁখিপাত করে ‘ডঃ’কথা কাটলেন ‘সাহেব’এর -)

‘মিস্টার বাসু আমি বলছিলাম কি …’।
‘আরে হ্যাঁ বলুন না। আপনার জীবনেও নিশ্চয় এমন গল্প আছে । বলে ফেলুন। আমি ভাবি রোজ চুপটি করে শোনেন – আপনি কি অন্য গ্রহের লোক নাকি? বলুন বলুন ‘।
‘হ্যাঁ… না … মানে বলছিলাম আমরা দুজনেই তো রিটায়ার্ড। তাই না’?
‘হ্যাঁ। তো’?
‘না – সেই বলছিলাম আর কি। এখন আর সেই পুরনো অফিসের কথা আলোচনা করে কি হবে। নতুন কিছু আলোচনা করা যাক’।
‘পুরনো অফিস? নতুন কিছু’?
‘হ্যাঁ। ধরুন আপনার হবি কি’?
‘হবি ? হবি ই ই ই ই – না – তেমন কিছু নেই তো’।
‘অ্যাঁ! কিছু তো হবে। ধরুন যদি বই পড়া – আমার এই লাইব্রেরি থেকে …’।
‘দূর। আমি তো ইঞ্জিনিয়ারিং এর বই ছাড়া কোনো বই পড়িই নি কখনো’।
‘আচ্ছা গান? গান তো শোনেন । ওই দেখুন আলমারি ভর্তি আমার ছেলের ক্যাসেটের স্টক। সব পাবেন, শাস্ত্রীয় , লঘু শাস্ত্রীয়, আধুনিক, হিন্দি, বাঙলা – যেমন আপনার পছন্দ’।
‘জাতীয় সঙ্গীত ছাড়া আর কোনো গান …’।
‘হুম! তাহলে বাগান করেছেন কখনো? আমার অবশ্য বেশী গাছ নেই তবু ওই ধরুন – জবা, গোলাপ, গাঁদা এই রকম কয়েকটা …’।
‘আমার কোয়ার্টারে যে বাগান টা ছিল – সেতো মালী এসে করে যেত। ফুল ফুটত অনেক কিন্তু আমি কোনও দিন খেয়াল করে দেখিনি। শুধু একবার যাদবের গরুটা ঢুকে পড়েছিল বলে ওর নামে এফ আই আর করে দিয়েছিলাম। সেটা শুনুন না মজার গল্প …’।
‘না না থাক। আচ্ছা দীক্ষা নিয়ে ভেবেছেন কখনও? আমি নিয়মিত নানা রকম ধর্ম সংস্থানে যাই ভাষণ দিতে। যাবেন আমার সঙ্গে’?
‘ধর্ম ! ভাষণ! তাতে কি হয়’?
‘বুঝলাম। দাবা খেলা জানেন ? ওতে একাগ্রতা বাড়ে। কিম্বা পেসেন্স, তাস? আমি টুকটাক জানি । নাহয় আমরা দুজনে …’।
‘ওসব আমার বাবা ঘোর অপছন্দ করতেন। আমিও শিখিনি। সেই ইশকুল জীবন থেকে শুধু পড়াশোনাই করেছি। তবেই এতটা উঁচুতে চেয়ার পেয়েছিলাম’।
‘কিন্তু বাসু সাহেব – সেই চেয়ারটা তো আর আপনার নেই। ওটা ভুলতে হবে যে। সবাই তাই করে’।
‘ভুলব? কিন্তু আমি যে আর কিছুই জানিনা। এ বয়সে এ কি বিড়ম্বনা? এখানে কেউ তো আমার সঙ্গে কথাই বলতে চায় না। দেখলে পালায়। আপনার সঙ্গে তবু পুরনো কথা বলে কদিন খুব ফ্রেস লাগছিল। এখন আপনিও…’।
‘আপনি বোধহয় পাঠ্য ছাড়া রবীন্দ্রনাথও পড়েন নি। তাই কালের যাত্রার ধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন না। পরিবর্তনটাই শাশ্বত – বাসু সাহেব। আমাদের মুখ ফিরিয়ে থাকলে চলবে না। নিজেকে ভাঙতে হবে, নেমে দাঁড়াতে হবে সবার সঙ্গে। তাহলেই লোকে স্বীকার করবে আপনাকে। আপনি যাকে অতীতের গৌরব-চারণা বলে মনে করছেন সেটা আসলে অতীতকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা। সেটা আর সম্ভব নয়। নতুনকে স্বাগত জানান’।
‘কি কঠিন বাঙলা বললেন তেমন বুঝলামই না। আমার গল্প আপনার ভাল লাগেনি ? কিন্তু কি করব আমি? চাকরি ছাড়া আর কিছু …। ছেলে শোনে না, বৌ উঠে যায়, লোকজন … আজ আপনিও …। কি নিয়ে বাঁচবো আমি ডঃ বাসু? আজ … আজ তাহলে… আসি’।

ধীরে ধীরে – এক পা এক পা করে বাসু সাহেব বেরিয়ে গেলেন। আজ তার দ্বিতীয় বার চাকরি গেল বুঝি। অন্ধকার মুখে কিঞ্জলের বাবা চুপ চাপ বসে রইলেন । ফ্লাটের বারান্দা থেকে কিঞ্জল দেখল মাথা নিচু করে হেঁটে যাচ্ছেন এক পরাজিত সম্রাট, ঠিক যেন সেন্ট হেলেনায় ন্যাপোলিয়ান। বাইরের ঘরে গিয়ে বাবার পাশে বসল । বাবা অস্ফুটে বললেন ‘তোর জন্যে আজ ভদ্রলোককে … কি দরকার ছিল’। কাজু চুপ। স্বপক্ষে বিপক্ষে কিছুই বলল না। বরং দেওয়ালে ঝোলান রবীন্দ্রনাথ নীরবে গাইলেন ‘যখন থাকি অচেতনে হে চিত্ত আমার, আঘাত সে যে পরশ তব …’।

[লেখকের অন্য রচনা]

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
সৌরভ হাওলাদার
সৌরভ হাওলাদার
4 days ago

চমৎকার।

এইরকম মানুষ দেখতে পাই। সারা জীবন কাজ করার পর, নিজেকে একাউটেন্ট বা পার্চেস অফিসার বা অন্য কোন গম্ভীর পদ ছাড়া কিছু ভাবতেই পারেন না। আচ্ছা আপনি মানুষ তো? জিজ্ঞেস করলে মুশকিলে পড়ে যায়।

Chandan Sen Gupta
Chandan Sen Gupta
3 days ago

দারুণ বিষয় নিয়ে গল্প।সম্প্রতি এই রকমের দুটি মানুষের কব্জা থেকে মুক্তি পেয়েছি। সারা পৃথিবীতে নিজের কথা ছাড়া আর অন্য কোন বিষয় নিয়ে এদের বিন্দুমাত্র কৌতুহল থাকেনা।ভদ্রতার খাতিরে যেভাবে এদের থামানো দরকার,সেটা করা যায়না।একেবারে নিখুঁত বর্ণনা পেয়ে খুব উপভোগ করলাম।

2
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x