শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

সত্যজিতের মননে রবীন্দ্রনাথ

দুজনেই বৈশাখের জাতক I যদিও রবীন্দ্রনাথের অচিন্তনীয় প্রতিভার সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের রসসৃষ্টির অসাধারণত্ব ও স্বকীয়তা কোনোভাবেই তুলনীয় নয়, তবুও দুজনেই ছিলেন তাঁদের সমকালে বাংলার সাংস্কৃতিক জগতের শীর্ষে। এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে তাঁদের খ্যাতি ও পরিচিতির মধ্যে সাদৃশ্যও চোখে পড়ার মতো।

১৯৫৫ সালে সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্রকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার চোদ্দ বছর আগে চলে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। শান্তিনিকেতন কলাভবনের এই প্রাক্তন ছাত্রটির মধ্যে যে এতখানি সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে সেকথা নিশ্চয়ই কবি অনুমান করেন নি। কারণ সত্যজিৎ ছিলেন যাকে বলে late bloomer – তাঁর অসামান্যতা প্রকাশিত হয়েছে দেরিতে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে এড়িয়ে যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। সত্যজিতের পিতামহ প্রসিদ্ধ শিশুসাহিত্যিক, বিজ্ঞানমনস্ক, সংগীতজ্ঞ উপেন্দ্রকিশোর রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক ও প্রিয় বন্ধু । হয়তো ব্রাহ্ম ধর্মমত সম্বন্ধে উপেন্দ্রকিশোর তুলনায় কিছুটা অনমনীয়। বন্ধুপুত্র এবং বাংলার আর এক উদীয়মান সাহিত্যিক সুকুমার রায়কে যথেষ্ট স্নেহ করতেন রবীন্দ্রনাথ। উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে গিয়ে সুকুমারের অনেকটা সময় কেটেছে রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে। সেখানকার Quest পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অতি মনোজ্ঞ একটি প্রবন্ধও লিখেছিলেন তিনি। কিন্তু এসব ঘটনার কোনোটাই সত্যজিৎ রায়ের প্রত্যক্ষ স্মৃতির অংশ নয়। তাঁর জন্মের আগেই প্রয়াত হন ঠাকুর্দা উপেন্দ্রকিশোর; পিতা সুকুমারকেও তিনি হারিয়েছিলেন আড়াই বছর বয়সে। এবং সুকুমার রায়ের অকালমৃত্যুর পর রায় পরিবারের প্রকাশনালয়টি নিদারুণ ঋণগ্রস্ত হবার ফলে সত্যজিৎ শৈশবেই তাঁর মায়ের সঙ্গে চলে আসেন মামার বাড়ি বকুলবাগানে।

কোলাজঃ শিশু সত্যজিৎ, মা সুপ্রভার সঙ্গে কিশোর সত্যজিৎ, তরুণ সত্যজিৎ

এই কারণে সাময়িক ভাবে তাঁর বংশগত সাহিত্যিক ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত হলেন সত্যজিৎ। আর্থিক ভাবে সচ্ছল মামার বাড়িতে ছেলেবেলায় ইংরেজি গান শোনার ও ইংরেজি ছবি দেখার অভ্যাস ছিল বেশি, সেই তুলনায় বাংলা সাহিত্য বা গানের সঙ্গে প্রথম দিকে তাঁর পরিচয় কম। এই সরস, আবেগবর্জিত, কলকাতা-কেন্দ্রিক পরিবেশের প্রভাব আজীবন সত্যজিতের মধ্যে থেকে গেছে।

তবে সুখের বিষয়, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর মামার বাড়ির কয়েকজনের রীতিমতো সুসম্পর্ক ছিল। সত্যজিৎ রায়ের মা সুপ্রভা দেবী ও ছোটো মাসি কনক দাশ ছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের অসাধারণ গায়িকা, কন্ঠলাবণ্যের জন্য কবির বিশেষ প্রিয়। ছোটোদের জন্য লেখা তাঁর স্মৃতিকথায় সত্যজিৎ জানিয়েছেন, মায়ের সঙ্গে মাঝে মাঝে বালক বয়সে শান্তিনিকেতনে যাবার কথা। চাঁদের আলোয় খোয়াইতে বেড়াতে গিয়ে মায়ের খোলা গলার গান মনে রেখেছিলেন তিনি। আর সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন নিজের অটোগ্রাফ খাতায় নন্দলাল বসুর আঁকা একটি বাঘের ছবি।

এভাবেই একদিন অটোগ্রাফ খাতা নিয়ে মায়ের সঙ্গে উত্তরায়ণে গিয়েছিলেন কবির কাছে। সেই বয়সে রবীন্দ্রনাথকে দেখার এই একটি স্মৃতির কথাই তাঁর লেখা থেকে আমরা জানতে পারি। সত্যজিতের খাতায় সেই বিখ্যাত কবিতা ‘বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে’ লিখে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “এর মানে আর একটু বড় হয়ে বুঝবে।” হয়তো কথাটি নিতান্ত সাধারণ ভাবেই বলা। তবে এর অনেক বছর পরে “পথের পাঁচালি” ছবিতে যেভাবে পরিচিত, অবহেলিত জীবনকে অলৌকিক সৌন্দর্যে রূপান্তরিত হতে দেখি আমরা, তাতে এই কবিতাকে বেশ ইঙ্গিতবাহী মনে হয়। সত্যজিৎ নিজেও স্বীকার করেছিলেন সে কথা।

পথের পাঁচালীর দৃশ্য – সত্যজিতের মানস-চক্ষে

তাঁর শান্তিনিকেতনে পড়তে যাবার ইতিহাসও কম চিত্তাকর্ষক নয়। রবীন্দ্রনাথ পরিণত বয়সে প্ল্যানচেটের নেশায় মেতেছিলেন তা অনেকেই জানেন। এরকম একটি প্রেতচক্রে তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে অকালপ্রয়াত সুকুমার রায় এসেছিলেন বলে জানা যায় এবং তাঁর পুত্রকে শান্তিনিকেতনের ছাত্র হিসেবে গ্রহণ করার জন্য রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেন। সে কথালাপের বিবরণও আছে। তাই প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক হবার পরে বেশ অনিচ্ছায় মায়ের কথায় শান্তিনিকেতনের কলাভবনে যোগ দিলেন সত্যজিৎ, শিল্প শিক্ষার জন্য।

এতকাল তাঁর কাছে কেউ কোনো বিশেষ কৃতিত্বের আশা করেন নি, যদিও বুদ্ধিমান ও ভালো ছাত্র ছিলেন। বলা যেতে পারে শান্তিনিকেতনেই সত্যজিতের ভাবুক সত্তার প্রথম বিকাশ ঘটল। কলাভবনে নন্দলাল বসু ও বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের মতো আচার্যের সান্নিধ্যে এবং সুযোগ্য সতীর্থদের সাহচর্যে সেখানকার জীবনধারার প্রতি এক অপ্রত্যাশিত আকর্ষণ বোধ করলেন তিনি। শান্তিনিকেতনের শিক্ষাই যে প্রাচ্য শিল্পকলার মহৎ সৌন্দর্য ও গৌরবের প্রতি তাঁর দৃষ্টি খুলে দিয়েছিল এবং সেই প্রভাব যে তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাণে অপরিসীম , একথা সত্যজিৎ অকপটে উল্লেখ করেছেন । বেশ কয়েক দশক পরে ১৯৮২ সালে দেওয়া একটি অসাধারণ ভাষণে তিনি বললেন, ” It was a world of vast open spaces , vaulted over with a dustless sky, that on a clear night showed the constellations as no city sky could ever do. The same sky, on a clear day , could summon up in moments an awesome invasion of billowing darkness that seemed to engulf the entire universe….If Santiniketan did nothing else, it induced contemplation, and a sense of wonder, in the most prosaic and earthbound of minds. “

অতএব শান্তিনিকেতনের আকাশ বাতাস আদ্যোপান্ত নগরপ্রেমী তরুণ সত্যজিৎকে প্রকৃতিমগ্ন হতে শেখাল। আর তাঁর অবসর সময় কাটত Alex Aronson নামে এক জার্মান ইহুদী, তরুণ ইংরেজির অধ্যাপকের সঙ্গে পাশ্চাত্য সঙ্গীত শুনে।

পরবর্তী জীবনে শিল্পী বিনোদবিহারীর সঙ্গে সত্যজিৎ

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ- যদিও বৃদ্ধ ও অসুস্থ, তিনি তো তখনও জীবিত আছেন, তাঁর ব্যক্তিগত সংসর্গে আসার কোনো আগ্রহ আমরা দেখি না সত্যজিতের মধ্যে। এই নির্লিপ্ত মনোভাবের কিছুটা হয়তো তিনি পৈতৃক সূত্রে পেয়েছিলেন। পিতা সুকুমারের ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রতি গভীর অনুরাগ, কিন্তু তিনি কখনো ভক্তিতে অভিভূত হন নি। সত্যজিৎ তাঁর জীবনীকার Andrew Robinson এর কাছে এ বিষয়ে কিছু মন্তব্য করেছিলেন, যা আমাদের ঔৎসুক্য জাগায়। বয়সের স্বাভাবিক দূরত্ব তো ছিলই, এ ছাড়াও এতই সম্ভ্রম জাগানো রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্ব , তাঁর মুখের ভাষা এতই মার্জিত ও শুদ্ধ, আশ্রমবাসীদের কাছে তিনি এমনই উপাস্য দেবতার মতো ছিলেন, যে সত্যজিৎকে তা প্রতিহত করেছিল । আমাদের মনে পড়তে পারে যে যুবক রবীন্দ্রনাথের অতিরিক্ত মার্জিত, পরিশীলিত স্বভাবে কিছুটা এমনই অস্বস্তি বোধ করেছিলেন কবি নবীনচন্দ্র সেন।

রবীন্দ্রনাথ

কিন্তু মনে মনে রবীন্দ্রনাথের অস্তিত্বের মূল্য সত্যজিৎ নিশ্চয়ই বুঝেছিলেন । কবির প্রয়াণের পরে তিনি খুব বেশিদিন শান্তিনিকেতনে থাকেন নি। সেখানকার জীবন থেকে অনেকখানি সৌন্দর্যরস আহরণ করে কলাভবনের শিক্ষা অসমাপ্ত রেখেই ফিরে আসেন কলকাতায়।

D.J Keymer সংস্থায় সত্যজিৎ রায়ের Commercial artist হিসেবে যোগদান, এবং ক্রমশঃ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক হয়ে ওঠার ইতিহাস বহু -আলোচিত । তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছিলেন চলচ্চিত্রের মতো একটি মাধ্যমে যার ইতিহাস খুব পুরোনো নয়, এবং যার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ একেবারেই ক্ষীণ। সারা জীবনে মাত্র তিনটি ছবি রবীন্দ্রনাথের কাহিনী অবলম্বনে পরিচালনা করেছেন সত্যজিৎ- ” তিন কন্যা ” ( ১৯৬০ ) , ” চারুলতা ” (১৯৬৪), এবং “ঘরে বাইরে ” (১৯৮৪) । তবে তিনটি ছবিই সমালোচকদের দ্বারা উচ্চ প্রশংসিত , আবার শেষের দুটি কিছুটা বিতর্কিতও বটে । একথাও উল্লেখযোগ্য যে নিজের পরিচালিত ছবির মধ্যে সত্যজিৎ “চারুলতা”কেই সবচেয়ে “ত্রুটিহীন” বলে মনে করতেন।

রবীন্দ্রনাথের ছবি হাতে সত্যজিৎ

বরং তাঁর সিনেমায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রয়োগ অপেক্ষাকৃত বেশি। ” কাঞ্চনজঙ্ঘা ” র পর থেকেই মাঝে মাঝে রবীন্দ্রনাথের গান এসেছে সত্যজিতের ছবিতে – একেবারে শেষের ছবিগুলিও তার ব্যতিক্রম নয়। এখানেও লক্ষণীয় , যে প্রসিদ্ধ, সুপরিচিত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের দিয়ে তিনি কখনোই ছবিতে গান গাওয়ান নি। তাঁর পছন্দ ছিল কিছুটা আড়ালে থাকা, অচেনা বা ভিন্নধারার শিল্পীর কন্ঠ। এ নিয়ে বিতর্কও হয়েছে। কেন যে তাঁর এই পক্ষপাত , তা বলা কঠিন। এটুকু শুধু নির্দ্বিধায় বলা যায়, তাঁর নির্বাচন কখনো ব্যর্থ হয়নি।

যে ধ্রুব ও শুভ মূল্যবোধের প্রতীক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ – প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতির সমন্বয়, ধর্মীয় সংস্কারের বিরুদ্ধাচরণের মতো যে সব ভাবনা তাঁর বহু সৃষ্টির অন্তরে নিহিত, উত্তরাধিকার সূত্রে তার সঙ্গে সত্যজিতের পরিচয় ছিল স্বাভাবিক এবং অতীব ঘনিষ্ঠ। ঊনবিংশ শতকের সেই চেতনার জাগরণের প্রতি তাঁর নিবিড় শ্রদ্ধা ছিল । “দেবী” ও “গণশত্রু” ছবির বিষয় নির্বাচনে সেই শ্রদ্ধার প্রতিফলন দেখা যায়। কিন্তু চিরায়ত মূল্যবোধের বাইরে রবীন্দ্রনাথের বিশাল প্রতিভার সবটুকু তিনি নির্বিচারে গ্রহণ করেন নি। হয়তো যতটা অনুরাগী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের গানের, কাব্যের ততটা নন। যত মনোযোগ দিয়ে রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্প বা উপন্যাস পড়েছিলেন, রবীন্দ্র-নাটক নিয়ে ঠিক সেই মাত্রায় উৎসাহ দেখান নি। সত্যজিৎ রায়ের রুচিবোধে ছিল নানা সংস্কৃতির মিশ্রণ, তার মধ্যে পশ্চিমী সাহিত্য-সঙ্গীত-শিল্পকলার প্রভাব বিশেষ ভাবে দেখা যায় । তাছাড়া তাঁর সৃষ্টি ও খ্যাতি বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের সঙ্গে জড়িত। সেই সময়ের আধুনিক চিন্তার তরঙ্গ তাঁকে অবশ্যই স্পর্শ করে গিয়েছিল। সেই আধুনিকতা মূলতঃ প্রযুক্তি -নির্ভর , তার প্রকাশ শুধু ভিতরে নয়, জীবনযাত্রার বহিরঙ্গে। তাকে সম্পূর্ণ সমর্থন না জানালেও সত্যজিৎ কোনোভাবেই বাস্তববিমুখ বা অতীতচারী ছিলেন না। কল্পবিজ্ঞান এবং রহস্যকাহিনী – সাহিত্যের দুই নতুন শাখার প্রতি মুগ্ধ আকর্ষণ ছিল তাঁর, এই দুই বিষয়েই তিনি বাংলায় বহু সার্থক কিশোরপাঠ্য গল্প লিখেছেন- যাদের ভাষা সাবলীল, ধারালো ও আভরণহীন ।

তবুও তাঁর মনের ভুবনে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন খুব কাছের মানুষ। শিল্পীর অন্তর্দৃষ্টি ও প্রখর বুদ্ধি দিয়ে তাঁকে লক্ষ্য করেছেন সত্যজিৎ, অন্যের মূল্যায়নে তেমন আস্থা না রেখে। বুঝতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির অফুরন্ত ঐশ্বর্য, তাঁর দুর্বলতা ও মুদ্রাদোষ । দৃষ্টান্ত হিসেবে সত্যজিতের একটি সাহসী ও মৌলিক মন্তব্যের উল্লেখ করা যেতে পারে, যার সঙ্গে সবাই হয়তো একমত হবেন না – “রবীন্দ্রনাথের চরিত্রের একটা বিশেষত্ব বেশ লক্ষ করা যায় যে, তাঁর সহজাত ক্ষমতার বাইরে কোনও কিছু শিখে আয়ত্ত করায় তাঁর চিরকালই একটা আপত্তি ছিল। তাঁর শিক্ষায়তনের বিরুদ্ধে আপত্তিটা অ্যাকাডেমিক সবকিছুর বিরুদ্ধেই প্রযোজ্য ছিল। তাঁর শিল্পবোধ ছিল সহজাত, instinctive । চিত্রপটে তার আশ্চর্য প্রকাশ তাঁর শেষ বয়সে আমরা দেখেছি।

সংগীতের বেলা রবীন্দ্রনাথ অ্যাকাডেমিক পদ্ধতির অনেক কিছুই গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তান জিনিসটা তিনি বাদ দিয়েছিলেন, তার একটা কারণ বোধহয় এই যে সেটা তাঁর আয়ত্ত ছিল না।” আবার শ্রেষ্ঠ রবীন্দ্রসঙ্গীতের নিদর্শন সম্বন্ধে সশ্রদ্ধ অভিমত জানিয়ে লেখেন, ” এখানে রাগরাগিণীর প্রশ্ন আসে না, বাউল -কীর্তনের প্রশ্ন আসে না , বাদীসম্বাদীর প্রশ্ন আসে না। …এমনকী এখানে কথা ও সুরের সামঞ্জস্যের বিচারটাও অবান্তর বলে মনে হয়, কারণ সব শ্রেষ্ঠ শিল্পরচনার মতোই এ গানও বিশ্লেষণের ঊর্ধ্বে। এসব গানের আদর্শ গীতরূপ আজ স্বপ্নের বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানাবার শ্রেষ্ঠ সুযোগ সত্যজিতের কাছে এল ১৯৬১ সালে, কবির শতবর্ষের শুভক্ষণে । ভারত সরকারের পক্ষ থেকে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হল। এমন একজন মনীষীর প্রতিভাকে সীমিত সময়ের মধ্যে প্রকাশ করার দুরূহ কাজটি প্রথম দিকে তাঁকে বেশ সমস্যায় ফেলেছিল। এর জন্য তিনি অশেষ পরিশ্রম করেছিলেন, বিদেশেও গিয়েছিলেন তথ্য অনুসন্ধানের জন্য। এবং যথারীতি এই ছবিতেও আমরা দেখি সত্যজিৎ রায়ের অসাধারণত্বের স্বাক্ষর। স্বকন্ঠে বলা মন্ত্রের মতো সংযত, মনোগ্রাহী ভাষ্যে, সংগীত ও চিত্রের অনুপম ব্যবহারে তিনি জীবন্ত করে তুললেন কবি, কর্মী ও সত্যদর্শী রবীন্দ্রনাথকে। ছুঁয়ে গেলেন তাঁর জীবনের প্রতিটি শিখর । সত্যজিতের “রবীন্দ্রনাথ ” যে সর্বকালের সেরা তথ্যচিত্রের অন্যতম, তাতে বোধহয় কোনো সংশয় নেই।

রবীন্দ্রনাথের শেষ ভাষণ ” সভ্যতার সংকট ” এবং সত্যজিতের শেষ ছবি “আগন্তুকে”র মধ্যে ভাবের আশ্চর্য মিল লক্ষ্য করা যায়। দুজনেই বিশ্বাস হারিয়েছিলেন সভ্যতার ক্ষমতালিপ্সু নির্মমতায়। রবীন্দ্রনাথের হতাশার কারণ ছিল সাম্রাজ্যবাদ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বর্বর রূপ, তিনি প্রতিকার খুঁজেছিলেন প্রাচ্যদেশের অনাগত উদ্বোধনে । অর্ধশতাব্দী পরে সত্যজিৎ সম্ভবতঃ হতাশ হয়েছিলেন সারা বিশ্বে বামপন্থার শোচনীয় পরাজয়ে, আর মূল্যবোধের গভীর সংকটে। তাঁর শেষ নায়ক মনোমোহন মিত্র তাই ফিরে যেতে চান পৃথিবীর বন্য, সরল আদিম অধিবাসীদের কাছে।

দুজনেই মূলতঃ আশাবাদী, কিন্তু তাঁদের শেষ রাগিণীতে বিষাদের সুরটি বড় কাছাকাছি। পৃথিবীর সর্বস্বান্ত শ্রেণীর মধ্যেই আবার মানুষের উজ্জীবন খুঁজেছিলেন তাঁরা। কাকতালীয়? হয়তো তাই।

[লেখকের অন্য রচনা]

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
3 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Chandan Sen Gupta
Chandan Sen Gupta
10 days ago

সংক্ষেপে প্রসঙ্গটির সুন্দর উপস্থাপনা পড়ে খুব ভাল লাগল।

Ashesh Dasgupta
Ashesh Dasgupta
9 days ago

প্রত্যাশিত ভাবেই লেখাটি খুবই ভাল লাগল। রবীন্দ্রনাথের প্রতি সত্যজিত রায়ের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা অত্যন্ত স্বাভাবিক,কিন্ত একই সঙ্গে তা সম্ভবত অন্ধ ভক্তির পর্যায়ে কখনোই পরে না।বারবারই সত্যজিত রায় রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সৃষ্টির আশ্রয় নিয়েছেন নিজের সৃষ্টির অভিব্যক্তির মধ্যে এবং অনেক ক্ষেত্রেই তা হয়ত মূল লেখকের message কেও ছাড়িয়ে গেছে।এখানেই সত্যজিত রায় এক এবং অনন্য।

trackback
6 days ago

[…] মুখোপাধ্যায়ের সুলিখিত প্রবন্ধ ‘সত্যজিতের মননে রবীন্দ্রনাথ’ পড়ে কিছু মন্তব্য করতে বসে দেখছি তার […]

3
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x