শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

সাহিত্য-সচিবের আলাপনে অন্তরঙ্গ রবীন্দ্রনাথ

বিস্মৃতিচারণা – পর্ব (২)

সত্তরের দশকের শেষভাগ। আগরপাড়ার প্রভাসতীর্থে একটি সাহিত্য-সভায় প্রথমবার দেখেছিলাম তাঁকে। তিনি রবীন্দ্রজীবনের অন্তিম পর্বের সাহিত্য-সচিব নন্দগোপাল সেনগুপ্ত। সেদিনের সাহিত্যবাসরের আয়োজকদের আগ্রহ ছিল রবীন্দ্রনাথের মতো এক কালজয়ী মহাপ্রতিভাকে যিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন, জেনেছেন নানান নিত্য নৈমিত্তিকতায়, যিনি তাঁর জীবনচর্যার সহায়ক হয়েছেন, তাঁর কথকতায় কবির দৈনন্দিন জীবনচর্যার কিছু ছবি পাওয়ার।

নন্দগোপাল সেনগুপ্ত

কে এই নন্দগোপাল সেনগুপ্ত?

১৯৩৭ সালে রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে সাড়া দিয়ে নন্দগোপাল বাবুর বিশ্বভারতীতে যোগদান অধ্যাপক ও কবির সাহিত্য-সচিবের যৌথ ভূমিকায়। একই সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন বিশ্বভারতীর গ্রন্থ-সম্পাদক হিসেবেও। দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার পরও কবির জীবনের অন্তিম দিন পর্যন্ত স্নেহে ও শ্রদ্ধায় কবির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। গদ্য ও পদ্য রচনায় পারদর্শিতার জন্য কবির কাছ থেকে পেয়েছিলেন ‘সাহিত্য সব্যসাচী’ অভিধা।

সময়ের সমুদ্র পেরিয়ে বিস্মৃতির আস্তরণ সরিয়ে সেদিনের ঘটনাক্রম হুবহু উদ্ধার করা অসম্ভব হলেও মনে থেকে গেছে তাঁর কথিত রবীন্দ্রনাথের কিছু বিচিত্র পত্রালাপের কাহিনি। আর রয়ে গেছে কিছু দিনলিপি, যা আজ আমার অবলম্বন। তারই কিয়দংশ আপনাদের কাছে পরিবেশন করছি।

তিনি বলেছিলেন, “রবীন্দ্রনাথ তো শুধুই কবি নন, তিনি একটা যুগ, একটি শতাব্দীব্যাপী সংস্কৃতির প্রতিভূ। যুগ যুগ ধরে রবীন্দ্র-গবেষক ও অনুসন্ধিৎসুরা আলোচনা করবেন তাঁর সাহিত্য, তাঁর গান, তাঁর বিবিধ বিচিত্রগামী কর্মকান্ড, সংস্কৃতির বিভিন্ন অঙ্গনে তাঁর প্রতিভার অবাধ স্বচ্ছন্দ সঞ্চরণ নিয়ে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সমগ্র সত্তার পরিচয় হয়তো তাঁদের কাছে অধরা থেকে যাবে। সে দিক দিয়ে আমরা, যারা এই মহাপ্রতিভার স্নেহচ্ছায়া পেয়েছিলাম, পাশে থেকে কাজ করবার সুযোগ লাভ করেছিলাম, যাদের জীবনের কোনো এক পর্ব মাধুর্যমন্ডিত হয়েছিল সেই দিব্যকান্তি পুরুষের প্রত্যক্ষ দীপ্তিতে, তারা অশেষ সৌভাগ্যবান।”

কবির প্রয়াণের প্রায় সাড়ে তিন দশক পেরিয়েও স্মৃতিভারে আচ্ছন্ন তিনি বলেছিলেন, “আমি কিছুতেই ভুলতে পারিনা সেই দ্যুতিময় দৃষ্টি, প্রশান্ত ধ্যানগম্ভীর মূর্তি, ছন্দায়িত কণ্ঠস্বর! ভুলতে পারিনা, কত সহজে তিনি তাঁর সুউচ্চ আসন থেকে সমস্ত আভিজাত্য ও গরিমার বসন খুলে রেখে নেমে আসতে পারতেন দীনতম তুচ্ছ মানুষটির পাশে। তার সামান্য অসুস্থতার খবর পেলেই পাঠিয়ে দিতেন তাঁর হোমিওপ্যাথি ওষুধ, কত অভাজনকে অযাচিতভাবে উপহার দিতেন তাঁর আঁকা ছবি, লেখা কবিতা। অতি সাধারণ সহযোগীদের সঙ্গে, ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মেতে উঠতেন আলাপে, কৌতুকে, আবৃত্তিতে, গানে। এমনকি কবির খাস পরিচারক বনমালীও তাঁর সে দান থেকে বঞ্চিত হোত না। সহাস্য ঔদার্যে তিনি পারতেন বৃহতের আসন থেকে নেমে এসে ছোটর কাছে ছোট হয়ে ধরা দিতে।”

এই প্রসঙ্গে একটি মজার গল্প শুনিয়েছিলেন নন্দগোপাল বাবু। একদিন একটি বাচ্ছা মেয়েকে গল্প শোনাচ্ছিলেন কবি। কবির ভাষায়, এটা সেই সময়ের গল্প, যখন বাঘেরা পান খেত। সে এক শান্তির সময়। গল্পের ছোট্ট শ্রোতাটি জিজ্ঞেস করল, বাঘটা যে পান খেত, কে সেজে দিত? গল্পকথকের উত্তর, সেজে দেওয়ার ভাবনা কি? ওর কত বন্ধুই তো ছিল বাঘের গুহায়, শান্তা, মণিকা, ঝর্ণা…। আতঙ্কিত প্রশ্ন উঠল, কী সব্বোনাশ! বাঘটা ওদের খেয়ে নিত না? কথক বললেন, খাবে কি করে? একে তো মহানুভব বাঘ, তার ওপর ওরা পান সেজে দিত যে!

রবীন্দ্রনাথ ও ভৃত্য বনমালী

ভৃত্য বনমালীর সঙ্গেও মাঝে মাঝে কবির কথোপকথন রীতিমত উপভোগ্য হয়ে উঠত। একদিন বনমালীর কাজের কোনো ত্রুটিতে বিরক্ত হয়েছিলেন কবি। কিন্তু বিরক্তির প্রকাশেও তাঁর রসবোধে ঘাটতি পড়েনি। বললেন, জানিস, তোর আচরণ যদি সংবাদপত্রের সম্পাদকদের জানাই, তাহলে দেশ জুড়ে এখন তীব্র প্রতিবাদের ঝড় বইবে, বড় বড় স্তম্ভ লেখা হবে, এমনকি একটা অনাস্থা প্রস্তাবও গৃহীত হতে পারে!… বনমালী এসবের কিছু না বুঝলেও এটুকু বুঝল যে সে ভুল করলেও কর্তাবাবা খুব একটা রাগ করেননি। মুচকি হেসে প্রস্থান করল। গুমোট ভাবটা কেটে গেল। আমরা উপস্থিত জনেরা আমোদিত হলাম।

কবিজীবনের আর একটি বিশেষ দিকে সেদিন আলোকপাত করেছিলেন নন্দগোপাল বাবু। সেটি চিঠিপত্রের। বলেছিলেন, “চিঠিপত্রের রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে ছিলেন এক বিপুল বিস্ময়। সকালের একটি সময় তাঁর বরাদ্দ থাকত চিঠি লেখা ও প্রাপ্ত চিঠির উত্তর দেবার জন্যে। একদিকে বিদগ্ধজনেদের সঙ্গে, নিকটজনেদের সঙ্গে তাঁর প্রতিনিয়ত পত্রালাপ, যার পরিণতিতে আমরা পেয়েছি বাংলার অসামান্য পত্র সাহিত্যের ভান্ডার, অন্যদিকে অতি সাধারণ মানুষজনের সঙ্গে তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ে তাঁর পত্র বিনিময়, যা আমার অনেক সময়েই তাঁর অমূল্য সময়ের অপব্যয় বলেই মনে হত। এই সব অকিঞ্চিৎকর পত্রের উত্তরদানে অসীম উদ্যমে তাঁর যে মহানুভবতা দেখেছি, তার কোনো তুলনা নেই!”

“দেশী-বিদেশী, উচ্চ-নিচ, সাধারণ-অসাধারণ, পরিচিত-অপরিচিতর কাছ থেকে অসংখ্য চিঠি আসত কবির কাছে। তিনি স্বহস্তে খুলতেন সেগুলি, পড়তেনও। কাজের চিঠিগুলি চলে যেত ব্যক্তিগত সচিবের দপ্তরে, ব্যক্তিগত চিঠিগুলি রাখতেন নিজের কাছে। এগুলির উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর কোনও বাছবিচার ছিল না। বিষয়ের বৈচিত্র্যেও অসামান্য ছিল সে সব পত্রালাপ। অতি গভীর ভাবনার পত্রাদির পাশাপাশি থাকত প্রভূত হাস্যরসের খোরাক সম্বলিত পত্র।”

এরপর দু’চারটি রসসিক্ত পত্র বিনিময়ের কাহিনি শোনালেন নন্দগোপাল বাবু। কাহিনিগুলো এই রকম…

এক ভদ্রলোক চিঠিতে কবিকে জানালেন যে তিনি ভূতে বিশ্বাস করেন এবং ভূত দেখেছেন। তাঁর প্রশ্ন, কবি ভূতে বিশ্বাস করেন কিনা। কবি লিখলেন, ‘বিশ্বাস করি বা না করি, তাদের দৌরাত্ম্য টের পাই মাঝেমাঝেই। সাহিত্যে, পলিটিক্সে তুমুল দাপাদাপি জুড়ে দেয় ওরা।… দেখতে শুনতে ঠিক মানুষের মতোই!’

জনৈক পত্রলেখক একবার লিখলেন, ‘শুনেছি দাড়ি রাখলে মানুষ দীর্ঘায়ু হয়। আপনি দাড়ি রেখেছেন, তাই এব্যাপারে আপনার মত জানতে চাই।’ কবির উত্তর, ‘আমি দাড়ি রেখেছি ও দীর্ঘায়ুও হয়েছি। জানিনা দুইয়ের মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে কিনা। কিন্তু এটা সত্যি যে যারা স্বল্পায়ু হয়, তাদের দাড়ি বাহুল্য অর্জন করতে পারে না। কাজেই উল্টো দিক দিয়ে বিষয়টা যাচাই করার উপায় নেই।’

একটি ছেলে তাঁকে লিখল, ‘ডিম জিনিসটাকে আমিষ বলা হয় কেন? নিরামিষ বললে ক্ষতি কি?’ কবি জবাব ‘ঠিকই বলেছ। ওর গায়ে আঁশ দেখেছি বলে তো মনে হয়না। দিব্যি গোলগাল, খাসা আলুর মতোই দেখতে তো!

আর একবার একটি ছেলে লিখল: তার খুব ইচ্ছে যে সে স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দেয়। কিন্তু তার বাবা-মায়ের তাতে প্রবল আপত্তি। সে, কবির কী মত, তা জানতে চায়। কবি তাকে লিখলেন, ‘বাবা-মার কথা শুনো, সেটাও কোনো বিদেশি আন্দোলনের পর্যায়ে পড়ে না।’

এরকম রঙ্গ রসিকতার পত্র বিনিময় ছাড়াও রবীন্দ্রনাথের কিছু গভীর মানবিক উপলদ্ধি ও উপদেশ সম্বলিত চিঠির কাহিনিও শুনিয়েছিলেন নন্দগোপাল বাবু সেই সন্ধ্যায়। কোনোটিতে ছিল বাল্যবিধবা তরুণীর জীবনযন্ত্রণার উপশমের পথনির্দেশ, কোনোটিতে পুত্রের অসম বিবাহে ব্যথিত পিতামাতার মানসিক শুশ্রুষার ব্যবস্থা, কোনোটিতে হতাশাগ্রস্ত তরুণের মানসিক উত্তরণের পথসন্ধান।

পরিশেষে তিনি শোনালেন কবির সঙ্গে শান্তিনিকেতনের উদয়নে তাঁর শেষ সাক্ষাৎকারের মর্মস্পর্শী কাহিনি। কবি তখন খুব অসুস্থ ও শয্যাশায়ী। তিনি দেখা করতে গেছেন। কবি মৃদু হেসে বসতে বললেন। পায়ের কাছে একটি মোড়ায় তিনি বসেছেন। ধীরে ধীরে তিনি পায়ে হাত বোলাতে লাগলেন। দেখলেন, পা দুটি বেশ ফুলেছে। কবি বুঝতে পারলেন। হেসে বললেন, ‘মরণ চরণে শরণ নিয়েছে। আর তাকে বিমুখ করব না হে’।… নন্দগোপাল বাবুর ভাষায়, ‘কান্না পেতে লাগল, অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। বুঝলাম, আর দেরি নেই।

কবির সাহিত্য-সচিবের সেই সন্ধ্যার কথকতায় এক অন্তরঙ্গ, রসিক, সংবেদনশীল, পরিপূর্ণ সত্তার মহামানবের যে অবয়বটি আমাদের কাছে উন্মোচিত হয়েছিল, সময়ের প্রলেপ অস্বীকার করে সেই স্মৃতি আজও অমলিন।

[লেখকের অন্যান্য লেখা]

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


5 1 vote
Article Rating
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Chandan Sen Gupta
Chandan Sen Gupta
4 months ago

যাঁরা রবীন্দ্রনাথের অন্তরঙ্গ সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্যের অধিকারী হয়েছিলেন,একমাত্র তাঁদের লেখা বা কথা থেকেই আমরা অন্তরঙ্গ রবীন্দ্রনাথের ছোঁয়া পাই। তেমনই একজনের আলাপচারিতার কথা আপনার লেখায় উঠে এসেছে।আগে পড়া এই লেখাটি আবারও পড়ে একই রকমের অনুভূতি হল।

তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়
তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়
Reply to  Chandan Sen Gupta
4 months ago

অনেক ধন্যবাদ। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা তো কবিকে দেখিনি, এঁদের ভাষ্যই আমাদের অন্তরঙ্গ রবীন্দ্রনাথকে চিনিয়ে দেয়।