শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

বলাইয়ের বন্ধু

পর্ব – এক

একটি লাল ও একটি সবুজ আপেল দিয়ে বিকেলের জলখাবার সারলেন ভগবান ৷ পাহাড়ের মানবেরা নিজের হাতে আপেলের চাষ করেন ৷ ক্ষেতের সেরা আপেলটি প্রতিদিন ভগবানের জন্য তুলে রাখেন তাঁরা ৷ ঠিক তিনটে কি চারটে বাজলে থালায় আপেলগুলো সাজিয়ে ভগবানের কাছে পৌঁছে দেন ৷ ভগবান একটি দুটি খেয়ে বাকিগুলো প্রসাদ হিসেবে রেখে দেন মানবদের জন্য ৷ সন্ধের আগে আগেই মানবের দল থালাভর্তি আপেল প্রসাদ নিয়ে লাফাতে লাফাতে নীচে নেমে যায় ৷ আজ লাল আপেলের সঙ্গে সবুজ আপেল দেখে সেটিই আগে হাতে তুলে নিয়েছিলেন ৷ মানবেরা তখন মন্দিরের চত্বরে বসে আলোচনা করছিলেন — সবুজ আপেল শরীরের পক্ষে উপকারী ৷ নানা রোগ –বিশেষত স্থূলতা প্রতিহত করে ৷ বাজারদর ক্রমশ চড়ছে এই আপেলের ৷ তাই ক্ষেতে আরো সবুজ আপেল ফলাতে উদ্যোগী হতে হবে ৷ কানে কথাগুলো আসতেই নিজের মনে হাসলেন ভগবান ৷ মানব তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ৷ সেই মানব কিনা সৃষ্টিকর্তাকে নিজের সমান ভাবছেন ৷ ভগবানের যে মানবশরীর নেই –এ তুচ্ছ বিষয়টিও ভুলে গেছেন তাঁরা ৷ সবুজ অপেলে অতৃপ্তির কামড় দিয়ে বাইরে তাকালেন ভগবান ৷ দামী হতে পারে –কিন্তু অত্যন্ত বিস্বাদ ফল ৷ কী যে সব ছাতার মাথা হাবিজাবি আনেন মানবেরা ৷
নাহ ! আজও তো এল না বালক ৷ আরে সেই বালক –কাকের মতো কালো যার রঙ ৷ কাঁচের গুলির মতো ঝকঝকে যার দুটো চোখ ৷ সে বালকের দৃষ্টি এত তীব্র এত গাঢ় যে নিজের তৈরী হলেও ভগবানের তা দেখতে কেমন এক বিব্রত ভাব জাগে ৷ বালকের চোখে সবসময় এক অনুচ্চারিত তিরস্কার –এই কালো পাথরের জানলাহীন ঘরটায় ভগবানের এই একঠাঁয় বসে থাকাটা মোটেই পছন্দ করছে না সে ৷ কতবার সে তার মা এর কাছে গজরগজর করেছে– কেন ভগবানের ঘর এত অন্ধকার ৷ কেন সৃষ্টি করেও ভগবান ভোরের সূর্য দেখতে পাবেন না — গৌরবর্ণ কন্যার মতো যে সূর্য পাখি ডাকার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিভাত হয় ৷ কেনই বা ভগবানের অগোচরে পাহাড় বেয়ে একটাকার কমলা লজেন্সগুলোর মতো সূর্য ঢলে !

পাথরের কান থেকে ফুলমালা সরিয়ে চুপিচুপি ভগবান বালকের এইসব উদ্ভট প্রশ্ন শোনেন ৷ আর তার মা তাকে রাম ঠেঙান ঠেঙান ৷ তবে ভগবান দেখেছেন যে –নানারকম বাঁদরামি করলেও যতক্ষণ সে থাকে ঘোরে কিন্তু সে ভগবানের আশেপাশে ৷ কখনো মন্দিরের কোটরে থাকা পায়রাগুলোর ডানার ময়লা পরিষ্কার করে কখনো ভগবানের গা থেকে বাসি ফুলের রাশ ছুঁড়ে ফেলে পাগলের মতো ৷ কখনো মন্দিরের সামনে পুঁতে দেয় সবুজ গুল্ম ৷ পরদিন সে গুল্ম মাটির অভাবে পাথরে মুখ থুবড়ে মরে ৷ বালক কাঁদে –মায়ের চড় কালিপটকার মতো আওয়াজ তুলে তার গালে পড়ে ৷ মৃত গুল্মের তাজা পাতা উড়ে এসে ভগবানের গায়ে পড়ে ৷ তাতে কেমন ঠাণ্ডা ভাব ৷ আরামে দুচোখ বুঁজে আসে ভগবানের ৷
দু হপ্তা হল বালক আসেনি ৷ কাতর ভগবান ঠিক করেছেন আজ যতদূর সম্ভব নীচে যাওয়া যায় যাবেন তিনি ৷ গিয়ে বালকটির গায়ে হাত বুলিয়ে বলে আসবেন — তাঁকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই ৷ মাঝে মাঝে সে ওপরে গিয়ে ভগবানের সঙ্গে দেখা করে আসতে পারে ৷ মা যদি বকেন তো ভগবান মাকে পাল্টা বকে দেবেন ৷ শূন্য বেদীকে আরতি করে বালকের কাছে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন ভগবান ৷
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেও ফিরে ফিরে দেখতে লাগলেন ফেলে আসা আসনটিকে ৷ তিনি বিহনে ক্যাবলাচণ্ডী হয়ে বসে আছে আসন ৷ এতবার ফেলে আসা আসনটিকে দেখার যুক্তি সাজালেন ভগবান –আত্মপ্রীতি কোন জীব ছাড়তে পারে ৷ আর তিনি তো জীবের সৃষ্টিকর্তা ৷ অনেকখানি নেমে গিয়ে আবার পিছু ফিরলেন ভগবান ৷ দেখলেন –মন্দিরের চূড়া আকাশকে দুভাগ করে দিয়েছে ৷ তিনি কি দুটো আকাশ তৈরী করেছিলেন ? তারাদের কি দু আকাশে আলাদা লাইনে সাজিয়েছিলেন ? ভীষণ ভয় হচ্ছে ভগবানের ! কেন নিজের সৃষ্টিকে নির্দিষ্টভাবে চিনতে পারছেন না তিনি ? কেন ? সে বালক কোথায় ? যে তাঁকে ভোর সন্ধে দেখাত তার শব্দ আর চোখ দিয়ে ? নিশুতি রাতে মানবের সন্তান খোঁজেন ভগবান ৷

পর্ব – দুই

বালকের কাছে পৌঁছে গিয়েও সে মুহূর্তে কোনো উত্তর পেলেন না ভগবান ৷ দেখলেন – বালক মোটেই তাঁর কথামতো চলছে না ৷ সে তার মাকে হুকুম জারি করেছে –অনেক পথ হেঁটে ভগবান ক্লান্ত ৷ আগে তাঁকে রুটি ও নতুন আলুর ঝাল বানিয়ে দেওয়া হোক ৷ আর একদম ভগবান ভগবান করা চলবে না ৷ সে তৎক্ষণাৎ নিজের বলাই নামের সঙ্গে মিলিয়ে ভগবানের নাম দিয়ে দিলে গদাই ৷ সে রাতে গলা জড়িয়ে ঘুমল বলাই গদাই ৷ গদাই শুধু ঘুমের ঘোরে বলাইয়ের গায়ের গন্ধ পেতে অনুভব করলেন –তাঁর ভেতর প্রশ্নের ভার কমছে ৷
ভোরে আরো আরো নীচে নেমে গেল বলাই গদাই ৷ একদম ঘাস ভর্তি সমতলে পৌঁছে গেল তারা ৷ সঙ্গে বলাইয়ের গাভী ও গাভীপুত্র ৷ পুত্রকে প্রয়োজনীয় দুধটুকু খাইয়েই বলাই গদাইকে দুধ খেতে ডাকলেন গাভী —আয় রে বলাই গদাই তাড়াতাড়ি দুধ খেয়ে যা ৷ গদাই বললেন –আরে আমি ভগবান ৷ আমাকে দুধ খাইয়েই তো তোর সব পুণ্য ৷ তো এত তাড়াতাড়ি কীসের তোর ? বলাই বললেন — তোমার প্রাপ্য দুধ খেয়ে গাভীকে ছেড়ে দাও গদাই ৷ তোমার পৃথিবীতে প্রচুর মাতৃহীন ৷ ও যাবে তাদের দুধ খাওয়াতে ৷

গদাই দেখলেন গাভীটির সাদা চামড়ায় হলুদ সূর্য খেলছে ৷ আকাশ এখন একটাই ৷ পাহাড়ের মন্দিরের চূড়া এখান থেকে দেখাই যাচ্ছে না মোটে ৷ ধীরে ধীরে বলাইয়ের হাত ধরলেন – চ বলাই আমরা আরো নীচে যাই চ ৷ সমুদ্রের ধারে ৷ চ দেখি গিয়ে — মা কচ্ছপ তার সদ্যজাত বাচ্চাকে খাদ্যের অভাবে কেমন নিজেরই বমন খাওয়াচ্ছে ৷ চ তার কাছে যাই ৷

[লেখকের অন্য রচনা]

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x