ফ্রান্স্ কাফকা-ম্যাক্স ব্রড, ভিন্সেন্ট ভ্যান গখ্-পল গগ্যাঁ, বঙ্কিমচন্দ্র-দীনবন্ধু মিত্র,
রবীন্দ্রনাথ-জগদীশ চন্দ্র বসু- এঁদের, এবং এঁদের মতো এরকম আরও সখ্য-সম্পর্কগুলি
আঁতিপাঁতি করে পড়লে হারিয়ে যাওয়া এক একটা সময় এক লহমায় কীরকম যেন হাতের নাগালে ধরা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসে এঁদের মনের একরকম ইতিহাসও। কিন্তু এ সবের পাশাপাশি যে বিষয়টা মনকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয়, তা হল এঁদের একের অন্যের প্রতি যত্নশীল হওয়ার ব্যাপারটা। পাঠক হিসাবে অফুরান এক ভালোলাগায় মন ভরে ওঠে। দিলীপকুমার রায়- নিশিকান্ত রায়চৌধুরীর সম্পর্ক প্রসঙ্গে ভাবতে গিয়ে এই যত্নের ব্যাপারটাই বিশেষ করে আবারও লেখার কথা মনে হল।
১৯৩৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পন্ডিচেরি- অধুনা পুদুচেরি অরবিন্দ আশ্রমে, নিশিকান্ত
রায়চৌধুরীর সঙ্গে দিলীপকুমার রায়ের প্রথম পরিচয়। সদ্য শান্তিনিকেতন ছেড়ে এসে নিশিকান্ত সে সময় পন্ডিচেরি অরবিন্দ আশ্রমে যোগদানে একান্ত আগ্রহী, দিলীপকুমারের সমীপে তাঁর আগ্রহ ব্যক্ত করেন।
দিলীপকুমার রায় শ্রী অরবিন্দ এবং শ্রী’মা দুজনেরই বিশেষ স্নেহধন্য মানুষ। কখনও কখনও তাঁর প্রতি সে সময় এই দুজনেরই স্নেহ-জনিত কিছু অতিরিক্ত প্রশ্রয়ও লক্ষ করা যায়। যে সময় আশ্রমের প্রায় প্রত্যেক সাধককেই গুরুসেবার্থী হিসাবে কোনও না কোনও কাজ করতে হত, দিলীপকুমার কেবল নিজের পড়াশুনো এবং সংগীত-চর্চায় দিনযাপনের ছাড় পেতেন। এই ব্যবস্থা একেবারে গোড়া থেকেই। আশ্রমে থাকতে এসে একেবারে প্রথম দিনেই তাঁর জন্য নির্ধারিত বাড়িটিতে পৌঁছে দিলীপকুমার দেখেন একজন সাধক তাঁর ঘরে একটি পুলি (Pulley) টাঙাচ্ছেন। কী ব্যাপার!
দিলীপের প্রশ্নের উত্তরে সাধক জানান, শ্রী’মার নির্দেশ – দিলীপ পড়াশুনো করবেন, বিজলি বাতির রশি টেনে লম্বা বা খাটো করে নেবেন নিজের সুবিধা মতো। এ ছাড়া গোড়া থেকেই শ্রী অরবিন্দের সঙ্গে দিলীপকুমারের পত্রালাপের চল ছিল। দিলীপকুমারকে প্রায় আড়াই-হাজারের মতো চিঠি লেখেন তিনি। হয়তো এসব ভেবে-ই প্রথম আলাপে, সব কথা খুলে বলার ব্যাপারে, তাঁকেই নিশিকান্তর সবচেয়ে উপযুক্ত মানুষ বলে হয়। তবে এ অনুমান মাত্র, দিলীপকুমারকে নানা কারণেই ভরসাযোগ্য বলে মনে হয়ে থাকতেই পারে নিশিকান্তর। মনে রাখতে হবে, দিলীপকুমার রায় ইতিমধ্যেই স্বনামে পরিচিত হয়েছেন। উপরন্তু, শান্তিনিকেতনের প্রাক্তনী হিসাবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সংগীত-বিষয়ক তর্ক-বিতর্কের কথাও নিশিকান্ত জেনে থাকতে পারেন, এমনকী হয়তো কখনও দেখেও থাকতে পারেন
তাঁকে সেখানে, সে সব ভেবেও তাঁর কথা মনে হয়ে থাকতে পারে নিশিকান্তর। তবে এসবও অনুমান, এমন কিছু ঘটে থাকলেও তার কোনও প্রমাণ হাতে নেই। দিলীপকুমারের লেখা পড়লে মনে হয়, তিনি নিশিকান্তর কাছেই প্রথম শোনেন তাঁর শান্তিনিকেতন পর্ব – রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের প্রসঙ্গ।
অবিন্যস্ত মলিন পোষাক, উস্কোখুস্কো চুলের নিশিকান্ত প্রথম দর্শনেই নজর কাড়েন তাঁর, নজর করেন তাঁর উজ্জ্বল, ভাবে-ভরা চাহনি। দিলীপকুমার বিশেষ করে মুগ্ধ হন, তাঁর বক্তব্য পেশ করার ধরনে। এর আগে আগ্রহী অনেক মানুষকেই দেখেছেন, কিন্তু একেবারে অপরিচিত কাউকে এরকম অকুন্ঠে কোনওদিন নিজেকে পেশ করতে দেখেন নি কখনও। নিশিকান্তর আশ্রয় তখন পন্ডিচেরির এক সস্তা তামিল হোটেলে, রেঁধে বেড়ে খান নিজেই। পরিস্থিতি বুঝে স্বাভাবিকভাবে দিলীপকুমার তাঁকে তাঁর আবাসে রোজ খাবার অনুরোধ জানান – আশ্রমে কঠোর শৃঙ্খলা-বিধান তখন, শ্রী অরবিন্দের সম্মতি ব্যতিরেকে উঁকি দেওয়া পর্যন্ত বেশ কঠিন। দেখা যায় নিশিকান্ত তাঁকে বিব্রত করতে একদমই রাজি নন। ঠাট্টা করে বলেন – ‘দিলীপদা আমার রেস্ত না থাকলেও মস্তিষ্ক আছে’ — সুযোগ নিতে চান না তিনি, দিলীপকুমারের কাছে তাঁর চাওয়া একটাই- সাধক হিসাবে যাতে যথানিয়মে যথাস্থানে কেবল তাঁকে পেশ করেন তিনি। দিলীপকুমারের বই – ‘সাধু গুরুদয়াল ও কবি নিশিকান্ত’- দিলীপকুমার রায়, নিশিকান্ত রায়চৌধুরীর পারস্পরিক সম্পর্কের জায়গাটা সবিস্তার জানার, বোঝার ব্যাপারে এক অন্যতম সহায়। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয় এই বই। এর ঠিক তিন বছর আগে ১৯৭৩ সালে পন্ডিচেরিতে প্রয়াত হন নিশিকান্ত। এ সময় দিলীপকুমারের বসবাস পুনায়, ১৯৫০ সালে শ্রী অরবিন্দের প্রয়াণের পরপরই পন্ডিচেরি আশ্রম ত্যাগ করেন তিনি। ১৯৩৪ থেকে ১৯৫০ – এই ষোলো বছর দুজনের পন্ডিচেরিতে একসঙ্গে থাকা। এর মধ্যে দিলীপকুমার তা-ও বছর খানেক গান গাওয়ার টানে কলকাতায় কাটান। কিন্তু নিশিকান্তকে কখনও-ই আশ্রম থেকে কোথাও বেরোতে দেখা যায় না। আমৃত্যু সেখানেই কাটে তাঁর। দুজনের বয়সের ব্যবধান বারো বছরের। দিলীপকুমার ১৮৯৭ এর জাতক আর নিশিকান্ত ১৯০৯ এর। কিসের টানে গড়ে উঠেছিল এই অসমবয়সী সম্পর্ক! দিলীপকুমার বেশ খোলসা করে লেখেন – ‘নিশিকান্ত ও আমার মধ্যে যে অন্তরঙ্গ সম্বন্ধ গড়ে উঠেছিল তার মূল উপজীব্য ছিল দুটি – কাব্যসৃষ্টি তথা যোগসাধনা। আমরা উভয়েই বলাবলি করতাম যে, আমরা পরস্পরের কাছে এসেছি মুখ্যত দুটি টানে- বঙ্গবাণীর ও দীক্ষাগুরুর। এ সান্নিধ্যের ফলে আমরা পরস্পরের প্রত্যক্ষ সহায় হয়ে উঠি কবিতা ও গানের রাজ্যেই বটে, কিন্তু এ’ অন্তরঙ্গতার উৎস ছিল আমাদের পরস্পরের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ – তিনি আমার কাব্য ও গীতির রাজ্যে আমাকে প্রভূত প্রেরণা দিয়েছিলেন বলে, তিনি আমাকে ভালোবেসেছিলেন আমি তাঁকে সুরের মন্ত্রে গানের দীক্ষা দিয়েছিলেম বলে।’ – সত্যি বলতে, গান এই সম্পর্কে অন্যতম অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে। সে সময় দিলীপকুমার রায় নাকি প্রায়-ই বলতেন – আসুন নিশিকান্তবাবু, আমরা দুজনে কাব্য ও সংগীতের জুড়িগাড়ি চালাই। আপনি কথা দিয়ে মালা গাঁথুন আমি সুর দিয়ে তা দোলাই। পন্ডিচেরি আসার আগে শান্তিনিকেতনে, কলাভবনে থাকাকালে, নিশিকান্ত, শান্তিদেব ঘোষ, বনবিহারী ঘোষ, রামকিংকর বেজ এবং আরও বন্ধুদের উদ্যোগে এক কবির দল তৈরি হয়। নিশিকান্ত ছিলেন সে দলে গানের বাঁধনদার। আশ্রমের নানা মানুষ, নানা ঘটনা ছবির মতো করে ধরা পড়ত সে সব গানের কথায়। নিশিকান্তর সহজাত তীক্ষ্ণ রসবোধ, তীর্যক পর্যবেক্ষন মিশে যেত এতে। সমকালে নিশিকান্ত লিখছেন ‘টুকরি’র কবিতা, রবীন্দ্রনাথের হাতে পরিমার্জিত হয়ে একের পর এক সেগুলি ছাপা হচ্ছে উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বিচিত্রা’য়। এ’ গানগুলি চরিত্রে ছিল অনেকটা সেগুলিরই মতো। দিলীপকুমার অবশ্য মনে করতেন পন্ডিচেরি এসে পড়াটা নিশিকান্তর কবি নিয়তির পক্ষে একটা বড়ো ধাক্কা। তাঁর যুক্তি ছিল, পন্ডিচেরি না এলে নিশিকান্তর এই আত্মিক গানের জায়গাটায় হয়তো এভাবে পৌঁছনো হত না কখনও। নিশিকান্তকে গান গড়তে শেখান দিলীপকুমার – নানা রকম সুর, ছন্দ মেলে ধরে অনবরত উশ্কে যান তাঁর ভাবনা, অবিরাম বয়ে চলে নিশিকান্তর লেখনী। শুধু এইরকম টেকনিক্যাল উশ্কানি নয়। আসল কথাটা লুকিয়ে থাকে অন্য জায়গায়। সে সময় শ্রী অরবিন্দের দিব্য-চেতনের প্রভাবে সংগীত-বিষয়ক ভাবনায় দিলীপকুমার এক ভিন্ন পথের পথিক, ভিন্ন এক নন্দনের দীক্ষায় আচ্ছন্ন। যে গান শুধুই মাধুরী দেয় তার তুলনায় আধ্যাত্মিক গানের প্রতি তাঁর স্পষ্ট পক্ষপাত। আধ্যাত্মিক সংগীতের প্রেরণার মূলে আমাদের Psychic being, আধ্যাত্মিক সংগীতের আনন্দ মাধুরীসর্বস্ব সংগীতের চেয়ে ঊর্ধতর, গভীরতর- অন্তর থেকে বিশ্বাস করেন এ সব। দিলীপকুমারের বইয়ে পাতার পর পাতা জুড়ে তাঁর সঙ্গে নিশিকান্তর গান গড়া নিয়ে কথাবার্তার যে বিবরণ পাওয়া যায়, ভাবনার এই চোরাস্রোতটা তার তলে বহমান। সম্পর্ক গড়ে ওঠার একেবারে গোড়ার দিনগুলিতে একে অন্যের ভাবনাকে বুঝে নিতে চাওয়ার, ছুঁতে চাওয়ার এক বিবরণ মেলে ধরে এই বই।
নিশিকান্ত আচমকা শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে আসেন পন্ডিচেরি। চিঠি লিখে রবীন্দ্রনাথকে তাঁর পৌঁছনোর খবর দেন দিলীপকুমার। উত্তরে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে লেখেন- ‘নিশিকান্ত তোমাদের আশ্রমে গেছে এতে আমি খুব খুশি হয়েছি। কেন না ওর মধ্যে প্রতিভা প্রচ্ছন্ন আছে। তোমাদের ওখানে যদি মন
স্থির করে বসতে পারে তাহলে ওর শক্তি পরিণতি লাভ করবে…।‘ কেবল এই নয়, এই ১৯৩০-এর দশকে যখন একের পর এক গান লিখে চলেন নিশিকান্ত, লেখা হওয়া মাত্রই পত্রযোগে তা রবীন্দ্রনাথের কাছে পাঠিয়ে চলেন দিলীপকুমার। ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয় দিলীপকুমার নিশিকান্তর যুগ্ম সম্পাদিত গানের বই ‘গীতশ্রী। তাতেও প্রতিক্রিয়া দেন রবীন্দ্রনাথ। লেখেন – নিশিকান্তের রচনাগুলি আমার খুব ভালো লাগল। ওগুলি গীতিকাব্য-ভাষার সুরেই রচিত।’ ১৯৩৭ সালে গান গাইতে কলকাতা আসেন দিলীপকুমার, এই শহরে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত থাকেন সে দফায়। রেকর্ডে একের পর
এক গেয়ে চলেন নিশিকান্তর গান। কেবল নিজেই নন, প্রিয় গীতিশিষ্যা উমা বসুকে দিয়েও গাওয়ান তাঁর একাধিক গান। এই প্রথম বৃহত্তর বাঙালি শ্রোতা সুযোগ পান নিশিকান্তর রচনা আস্বাদনের। দিলীপকুমারের উপন্যাস ‘আলোছায়া আঁকা পাখি’-তে পরম যত্নে ধরা আছে এই সময়। এ বইয়ের পাতা
ওল্টালে মনে হয় – এ কেবল গান নয়, এ যেন নিবিড় এক সখ্য – উদযাপনের এক সময়ের কথা। সত্তরের দশক, প্রায় গৃহবন্দী দশায় অশক্ত নিশিকান্তর দিন কাটে পন্ডিচেরিতে।
দিলীপকুমারের সঙ্গ প্রত্যাশা করেন। বন্ধু শচীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়কে দিয়ে সে সময় চিঠি লেখান দিলীপকুমারকে। ২৯ অগাষ্ট, ১৯৭২, এমন করে লেখানো এক চিঠিতে পাওয়া যায়- ‘ঊনত্রিশ তারিখে সন্ধেবেলা সাহানাদির শেখানো ছেলেমেয়েদের কন্ঠে আমার ‘অর্ঘ্য’ আর ‘দুঃখহরণ’ শুনলাম। কিছুক্ষণ বসলেই আমার শরীরটা জড় হয়ে যায় – ডায়াবেটিক কোমার পর থেকেই আমার এই অবস্থা। শরীর স্থানু হয়েছে, চোখের দৃষ্টি কমেছে, কিন্তু কানের শ্রবণশক্তি আশ্চর্য প্রখর! প্রত্যেকটি কথা প্রত্যেকটি লাইন শুনছি আর মনে মনে মিলিয়ে নিচ্ছি…জনৈক অধ্যাপক আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন – কবি আপনার স্বরচিত গান আপনার কেমন লাগল? বললাম খুবই ভালো লেগেছে, আরো ভালো লাগত যদি দিলীপকুমারের কন্ঠস্বর মনে না থাকত…।’
অবস্থান-জনিত দূরত্ব বয়ে চলা নিশ্চিত সময়ে কখনও কখনও একরকম ছেদ আনে। সময়ের নিয়মেই অন্য এক সময়ের বাসিন্দা হয়ে পড়তে হয় মানুষকে। বলা বাহুল্য, তাতে সম্পর্কের সময়টা মুছে যায় না। বন্ধুদের মনে সে অনুদিন অমলিন-ই থাকে। যত্নে গড়ে তোলা সম্পর্কের মজাটাই এখানে।
তথ্যসূত্র-
১ সাধু গুরুদয়াল ও কবি নিশিকান্ত, দিলীপকুমার রায়, সুরকাব্য সংসদ
২ আলোছায়া আঁকা পাখি, দিলীপকুমার রায়, সুরকাব্য সংসদ
৩ কবি নিশিকান্ত, ডালিয়া সরকার, আনন্দ
৪ রচনা বিচিত্রা, নীরদবরণ, শ্রী অরবিন্দ আশ্রম পন্ডিচেরি
মন ছুঁয়ে যাওয়া এ-লেখাটায় জানা গেল অনেক কিছু।