(সতর্কীকরণঃ সিরিয়াস পাঠকের জন্য এই প্রতিবেদন নয়)

প্রথমেই বলে নিচ্ছি কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া আমার অভিপ্রায় নয়, কারও ধর্মবিশ্বাস নিয়ে বিদ্রুপ করা একেবারেই আমার লক্ষ্য নয়। প্রথম দুটি শব্দের সঙ্গে ধর্মীয় অনুষঙ্গ বিজড়িত থাকলেও তৃতীয় শব্দটির সঙ্গে কোনভাবেই নেই। কিন্তু আমার আলোচনা একেবারেই ধর্মসংক্রান্ত নয়। এই আপাত উদ্ভট শিরোনামের মধ্য দিয়ে শুধু একটি প্রশ্ন রাখতে চেয়েছি।এবং সেটি শুধুই ভাষাসংক্রান্ত। প্রশ্নটি ভাষায় শব্দত্রয়ের ব্যবহার নিয়ে। প্রাথমিক পর্যালোচনাতে দেখা যাচ্ছে শিরোনামের গঠক তিনটি শব্দই স্ত্রীলিঙ্গ। কিন্তু এমন শব্দ তো অজস্র আছে, শুধুমাত্র লিঙ্গপরিচয় কোনভাবেই পরস্পর অসম্পৃক্ত তিনটি শব্দের আলোচনার ভিত্তি হতে পারে না। শেষ দুটি শব্দের মধ্যে তবু একটা ঐক্য খুঁজে পাওয়া যেতে পারে, দুটিই মনুষ্যেতর প্রাণী (সেটাও কিন্তু তুলনামূলক আলোচনার জন্য কোন জোরালো যুক্তি নয়)।কিন্তু এখানে এক দেবীর প্রসঙ্গ অবতারণা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক নয় কি? উক্ত প্রাণীদুটির কোনটিই দেবীর বাহন নয়, বা ওদের সঙ্গে কোনভাবেই দেবীর অনুষঙ্গ জড়িত নয়।তবে? গভীরতর পর্যালচনায় আমরা দেখব ভাষায় প্রয়োগে শব্দত্রয়ের আরও একটি ঐক্য আছে। এক এক করে আসছি।
লক্ষ্মী
কোন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বা আচরণের ভিত্তিতে মানুষের সঙ্গে দেবদেবীর তুলনার রীতি বহুলপ্রচলিত। শান্তস্বভাবা নারীর জন্য “লক্ষ্মী” বিশেষণটি নির্দিষ্ট। পরমা সুন্দরী ও অশেষ গুণান্বিতা নারীর জন্য রয়েছে “রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী” শব্দবন্ধটি। কর্মপটীয়সী, একইসঙ্গে বহু দায়িত্বপালনকারিনী নারীকে “মা দুর্গা” “দশভূজা” বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। অতি অল্পে সন্তুষ্ট পুরুষকে “শিবঠাকুর” বিশেষণে বিশেষিত করা হয়; মেয়েরা তাই শিবের মত স্বামীর প্রার্থনা করে থাকে। দেবদেবীর সঙ্গে তুলনা যে সবসময় প্রশংসার্থে করা হয় এমন নয়, ব্যাঙ্গার্থেও করা হয়ে থাকে। “কেষ্ট” বা “কলির কেষ্ট” বহু রমণীতে আসক্ত পুরুষকে নির্দেশ করে।“কার্তিক” রূপবান পুরুষের চেয়ে বরং ফুলবাবু অর্থেই বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কোপনস্বভাবা নারীকে “মা মনসা” “রণচণ্ডী” বলে অভিহিত করা হয়।এমন আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু লক্ষণীয় সবক্ষেত্রেই পুরুষ মানুষের সঙ্গে তুলনা করা হয় পুরুষ দেবতার এবং স্ত্রীলোকের সঙ্গে দেবীর। এটাই স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত তাই না? কিন্তু এখানেই ব্যতিক্রম হলেন লক্ষ্মী।
বিশেষণরূপে একমাত্র “লক্ষ্মী”ই নারী পুরুষ উভয়ের জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন “লক্ষ্মীমেয়ে” তেমনি “লক্ষ্মীছেলে”ও হতে পারে। যেমন মিনতি করে “লক্ষ্মী মা” বলা হয় তেমনি “লক্ষ্মীবাবা”ও বলা যেতে পারে। “লক্ষ্মী হয়ে থেকো” এটা ছেলে মেয়ে উভয়কেই বলা যেতে পারে। “লক্ষ্মীসোনা” শব্দবন্ধটিও লিঙ্গনিরপেক্ষ। একই কথা “লক্ষ্মীটি” সম্বোধন সম্বন্ধেও প্রয়োজ্য। শেষোক্ত সম্বোধনটি কেবল শিশুদের ক্ষেত্রেই করা হয় না , কাতর মিনতি করতে পরিণতবয়স্কের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যায়। ৬০ এর দশকের সেই গানটি “চুপ চুপ লক্ষ্মীটি / শুনবে যদি গল্পটি” কোন শিশুপুত্রের উদ্দেশে লেখা (এক যে ছিল তোমার মত ছোট্ট রাজকুমার)। আবার ৭০এর দশকে আশা ভোঁসলের কন্ঠে গীত “লক্ষ্মীটি দোহাই তোমার / আঁচল টেনে ধোরো না” কোন নাবালক নয়, সাবালক প্রেমিকের উদ্দেশেই রচিত।
অন্য কোন দেবীর নাম পুরুষের ক্ষেত্রে বিশেষণরূপে প্রয়োগ করা যায় না। তেমনি কোন পুরুষ দেবতার নাম বিশেষণরূপে কোন নারীর ক্ষেত্রে কখনই ব্যবহার করা চলে না। এইদিক থেকে লক্ষ্মী হলেন একমেবাদ্বিতীয়ম।
“লক্ষ্মী” শব্দের প্রয়োগের এই সম্প্রসারণ অত্যন্ত সরস ভঙ্গীতে রবীন্দ্রনাথ তুলে ধরেছেন “হাস্যকৌতুক” এর অন্তর্গত “চিন্তাশীল”এ। নায়ক নরহরি যেহেতু সর্বদাই চিন্তারত থাকে, তার খাওয়াও হয় না। যখন মা তাকে ভাত খেয়ে নেওয়ার জন্য চিন্তামগ্ন ছেলেকে কাতর মিনতি করে বলেন “লক্ষ্মী আমার একবার ওঠ” তখন চিন্তাশীল ব্যক্তিটি সেই কথার মধ্যেও নতুনতর চিন্তার উপাদান খুঁজে পেয়ে বলে “লক্ষ্মী? কী আশ্চর্য ! এক কালে লক্ষ্মী বলতে দেবী-বিশেষকে বোঝাত। পরে লক্ষ্মীর গুণ অনুসারে সুশীলা স্ত্রীলোককে লক্ষ্মী বলত, কালক্রমে পুরুষের প্রতিও লক্ষ্মী শব্দের প্রয়োগ হচ্ছে। একবার ভেবে দেখো মা, আস্তে আস্তে ভাষার কেমন পরিবর্তন হয়।”
এখানে আমাদের আলোচ্য শব্দার্থের বিবর্তন নয়। লক্ষ্মী শব্দের যে প্রয়োগের উল্লেখ আমরা করলাম তার তাৎপর্য সম্যক অনুধাবন করার জন্য, তার সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী চরিত্রটি উপলব্ধি করার জন্য বাংলায় পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ শব্দের ব্যবহারের একটা সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করা যেতে পারে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পুরুষপ্রাধান্য ভাষাব্যবহারের স্তরে স্তরে প্রতিফলিত। আমাদের পরিচিত ভাষাগুলিতে আমরা দেখি পুংলিঙ্গ শব্দটিই generic term. Logic এর সেই ধ্রুপদী উদাহরণ All men are mortal বাক্যে All menএর মধ্যে All womenও অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু All women are mortal বললে কেবল সব নারীকেই নির্দেশ করা হয়। পূর্বপুরুষ, সপ্তপুরুষ / সাতপুরুষ, চতুর্দশপুরুষ/ চৌদ্দপুরুষ শব্দবন্ধসমূহ একই সঙ্গে সব পুরুষ ও নারীকে নির্দেশ করে কিন্তু পূর্বনারী, সপ্তনারী/সাতনারী, চতুর্দশনারী /চৌদ্দনারী বলে কোন শব্দের অস্তিত্ব নেই। পুংলিঙ্গ শব্দের বহুবচনে নারীকে অন্তর্ভুক্ত করা যায় কিন্তু বিপরীতটা নয়।
বাংলাতে বহুসময় পুংলিঙ্গ শব্দের একক বা সমাসবদ্ধ ব্যবহার করা হয় নারীকে বোঝাতে কিন্তু বিপরীতটা কখনও নয়। একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ “ভাই”।শব্দটি এখন আর “ভ্রাতা” অর্থে সীমাবদ্ধ নেই, সেটি বন্ধু বা বন্ধুস্থানীয় অর্থে ব্যবহৃত হয় এবং তার চেয়েও বড় কথা নারীপুরুষনির্বিশেষে ব্যবহার করা চলে। “ভাই অমুক” বলে নারী পুরুষ উভয়কেই সম্বোধন করা যায়।আমরা জানি রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্ত্রীকে “ভাই ছুটি” বলে চিঠি লিখতেন। একজন মহিলাও আর একজন মহিলাকে “ভাই” বলতে পারেন। অপরপক্ষে কোন পুরুষকে কোন অবস্থাতেই “বোন” বলে সম্বোধন করা যায় না। দিদিকে বা দিদিস্থানীয়া কোন মহিলাকে “দিদিভাই” সম্বোধনের রীতি বহুলপ্রচালিত। অন্যদিকে দাদা বা দাদাস্থানীয় কাউকে “দাদাবোন” সম্বোধনের কথা ভাবাই যায় না। এমনকি কোন মেয়েকে বোঝাতে সমাসবদ্ধ পদে পুংলিঙ্গ শব্দ ব্যবহার করা যায় : মেয়েছেলে। শব্দটি তাচ্ছিল্যতাদ্যোতক; যে কোন নারীর পক্ষে অবমাননাকর কিন্তু অবমাননা করেও কোন পুরুষকে “ব্যাটামেয়ে” বলা হয় না। তসলিমা নাসরিন বাংলায় কোন নারীর শৈশব নির্দেশ করতে “ছেলেবেলা”র পরিবর্তে “মেয়েবেলা” শব্দটি চালু করেছেন এবং সাম্প্রতিককালে তা যথেষ্ঠ বিস্তৃতি লাভ করেছে। কিন্তু “ছেলেমানুষ” এর স্ত্রীলিঙ্গরূপে “মেয়েমানুষ” শব্দটি এখনও চালু হয় নি; শব্দটি “মেয়েছেলে”র মতই অবমাননাকর রয়ে গেছে।শিশুসুলভ আচরণ বোঝাতে ছেলে মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই “ছেলে্মানুষি” শব্দটি এখনও বহাল আছে; “মেয়েমানুষি” বলে কোন শব্দ এখনও চালু হয় নি।
“গিন্নিমা” শব্দটি বাংলায় বহুলপ্রচলিত; সঙ্গে সঙ্গে পুংলিঙ্গ শব্দযুক্ত “কর্তামা” শব্দটিও রয়েছে (আধুনিক বাংলায় শব্দটির ব্যবহার নেই কিন্তু পুরানো বাংলায় জমিদারগিন্নি বা মালকিন অর্থে শব্দটির ব্যবহার দেখা যায় ) কিন্তু মালকিনের স্বামী বোঝাতে “গিন্নিবাবা” শব্দের ব্যবহার নেই, কোনদিন ছিল না। একইভাবে শিক্ষাদাত্রী বা দীক্ষাদাত্রীকে অথবা শিক্ষাদাতা বা দীক্ষাদাতার স্ত্রীকে “গুরুমা” সম্বোধন করা হয় কিন্তু শিক্ষাদাত্রী বা দীক্ষাদাত্রীর স্বামীকে কোনভাবেই “গুর্বীবাবা” বলা যায় না। বস্তুত গুর্বী শব্দের ব্যবহার বাংলায় তেমন নেই। আর গুরুমার পুংলিঙ্গ “গুরু’ শব্দটি নারীর ক্ষেত্রেও ( যেমন নৃত্যগুরু সঙ্গীতগুরু) ব্যবহার করা যেতে পারে।
এই প্রসঙ্গে বর্তমানে “বাবা” শব্দের ব্যবহারের সম্প্রসারণও লক্ষণীয়। পিতা ছাড়া পুত্রস্থানীয়কে “বাবা” সম্বোধন করা হয়ে থাকে, ঠিক যেমন করে কন্যাস্থানীয়াকে “মা” সম্বোধন করা হয়। কিন্তু ইদানীংকালে শিশুকন্যাদের ক্ষেত্রেও কখনও কখনও আদর করে “বাবা” বলার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। যেমন “এসো বাবা” “এটা করে না বাবা” “এটা ধরে না বাবা” ইত্যাদি। এখানে “বাবা” অনেকটা “সোনা”র সমার্থক। ভাষার এই ব্যবহার সর্বস্তরে বিস্তৃতি লাভ করে নি, তবে একেবারে অশ্রুত নয়। (আমি তো কখনও কখনও শুনেছি, আপনারা কী বলেন?) এটা অবশ্য একান্তভাবেই শিশুকন্যাদের ক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে, “ভাই” সম্বোধনটি যেমন সব নারীর ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা চলা তেমন নয়। কিন্তু বিশেষভাবে লক্ষণীয় কোন পুরুষশিশুকেও কিন্তু কোনভাবেই “মা” বলা হয় না।
ভাষাব্যবহারে সর্বময় এই পুরুষপ্রাধান্যের আলোকে যদি এই স্ত্রীলিঙ্গ “লক্ষ্মী” শব্দের পুরুষের ক্ষেত্রে প্রয়োগের বিচার করি তাহলে বলতে হয় এই প্রয়োগ নিঃসন্দেহে বিরলতমের মধ্যে বিরল। একথা বলা চলবে না যে লক্ষ্মী দেবী বলেই এই বিশেষ অধিকার পেয়েছেন । দুর্গা কালীর মত দোর্দণ্ডপ্রতাপান্বিত দেবীরাও সেই অধিকার লাভ করেন নি; আমরা আগেই উল্লেখ করেছি কোন পুরুষকে কখনও দুর্গা কালী বলে অভিহিত করা হয় না অথবা কোন পুরুষ দেবতার নামও নারীর বিশেষণ হয় না। পুরুষ দানব বা অসুর বধ না করেও নিতান্ত ঘরোয়া শান্তস্বভাবা লক্ষ্মীঠাকরুণ তেজস্বিনী দেবীদের ছাড়িয়ে গেছেন —- কোন বাহ্য আড়ম্বর ছাড়াই নীরবে নিঃশব্দে প্রতিদিনের ভাষাব্যবহারে তাঁর প্রভাব বিস্তার করেছেন। এক্ষেত্রে আরও লক্ষণীয় পুরুষের ক্ষেত্রে স্ত্রীলিঙ্গ শব্দের এমন ব্যবহার কিন্তু কোনভাবেই অবমাননাকর নয়। এই প্রয়োগের মধ্য দিয়ে আদর, কোমলতা প্রকাশ পাচ্ছে — যা থেকে পুরুষতান্ত্রিক রীতির কারণে পুরুষেরা বহুসময় বঞ্চিত। নারীবাদীরা বলবেন পুরুষরা তো সমাজে, পরিবারে সব সু্যোগসুবিধা পাচ্ছে, পরিবারে পুত্রসন্তান সবচেয়ে ভালো জিনিসটা পেয়ে থাকে। এখনও সমাজের একটা বড় অংশ সম্বন্ধে কথাটা প্রযোজ্য।কিন্তু পুরুষও কখনও কখনও পুরুষতান্ত্রিক রীতির বলি হয়। যেমন পুরুষকে সবসময় হতে হবে rough and tough পুরুষমানুষকে কখনও কাঁদতে নেই। ছোট একটা বাচ্চা ছেলে কাঁদলে বলা হয় “কী মেয়েদের মত কাঁদে”। কিন্তু “লক্ষ্মী” শব্দের ব্যবহারে কোনভাবেই “মেয়েলি পুরুষ” বোঝানো হয় না — কোনরকম তাচ্ছিল্য বা ব্যঙ্গ নয়, শুধুই প্রকাশ পায় আদর। নারী পুরুষের মধ্যে এই পূর্ণ সাম্য বিধান করেছেন একমাত্র মা লক্ষ্মী।
———————————————-
গোরু, মুর্গি
লিঙ্গপরিচয় ছাড়াও উক্ত দুটি প্রাণীর মধ্যে একটি ঐক্য (অন্তত আংশিক ঐক্য) দেখা যায় সামাজিক রীতিনীতির ক্ষেত্রে। দুটি প্রাণীরই মাংস নিষিদ্ধ —- প্রথম ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আজও বলবৎ, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সেই নিষেধাজ্ঞা অতীতে্র রীতি। আজ থেকে পঞ্চাশ ষাট বছর আগে বহু হিন্দু বাড়িতে মুর্গির মাংস ঢূকত না, পরবর্তীকালে অভিভাবকেরা ক্রমশ বাইরে মুর্গি খাওয়ার অনুমতি দিতে লাগলেন। এখন আমিষাশী মানুষের মধ্যে মুর্গি খান না এমন খুব কমই আছেন। মুষ্টিমেয় কিছু গোঁড়া ব্রাহ্মণকেই দেখেছি যারা আজও মুর্গি খান না। সামগ্রিকভাবে পাঁঠার মাংসের চেয়ে এখন অনেক জনপ্রিয় মুর্গির মাংস। তবে গোরুর মাংস একটা বড় অংশের হিন্দুদের কাছে এখনও নিষিদ্ধ।এই নিষেধাজ্ঞার কারণ দুরকম। প্রথম ক্ষেত্রে কারণটি ধর্মীয়, হিন্দু ধর্মে গোরু একটি পবিত্র প্রাণী। অন্যদিকে মুর্গির মাংস নিষিদ্ধ ছিল সম্ভবত প্রাণীটি অপরিচ্ছন্ন বল (আমি তাই জানি)। কিন্তু মাংসের উপর নিষেধাজ্ঞা আমাদের আলোচনার বিষয় নয়। আমাদের আলোচ্য ভাষায় শব্দদ্বয়ের ব্যবহারের ঐক্য।
যেমন মনুষ্যকুলের ক্ষেত্রে তেমনি মনুষ্যেতর প্রাণীর ক্ষেত্রেও বাংলায় পুংলিঙ্গ শব্দটি হল generic term. “এখানে প্রায়ই বাঘের দেখা পাওয়া যায়” বলার অর্থ এই নয় যে এই অঞ্চলের বাঘিনীরা অসূর্যম্পশ্যা, তারা কখনো দেখা দেয় না। “বাঘ”এর মধ্যে “বাঘিনী” অন্তর্ভুক্ত। বস্তুত বাংলায় খুব কম ক্ষেত্রেই স্ত্রীজাতীয় প্রাণীদের জন্য পৃথক শব্দ রয়েছে।কোন কোন স্ত্রীলিঙ্গ শব্দটি শুধুই অভিধানে অথবা কাব্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। যেমন কুকুর > কুকুরী, বিড়ালী ; কাব্যে “কোয়েলা” “ভ্রমরা”। কোন কোন ক্ষেত্রে তৎসম শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ থাকলেও খাঁটি বাংলা প্রতিশব্দের শুধু পুংলিঙ্গ রূপটিই পাওয়া যায়। যেমন হংস > হংসী কিন্তু “হাঁস” শুধুই পুংলিঙ্গ ; হস্তী> হস্তিনী কিন্তু হাতী শুধুই পুংলিঙ্গ। বাংলায় প্রাণীদের জন্য বহুলপ্রচলিত স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ হল কেবলমাত্র “সিংহী” “বাঘিনী” “হরিণী” “ময়ূরী” (আর আছে কি? “বাঁদরী” শব্দটি স্ত্রী বাদরের পরিবর্তে কেবল গালাগালি অর্থেই ব্যবহৃত হয় না কি?) এই সামান্য কয়েকটি ক্ষেত্র ছাড়া স্ত্রী প্রাণীর ক্ষেত্রে পুংলিঙ্গ শব্দের আগে স্ত্রীলিঙ্গবাচক শব্দ জুড়ে দেওয়া হয়। (যেমন স্ত্রী কুমীর, মাদী হাতি, মেয়ে খরগোশ ইত্যাদি) তসলিমা নারসিন আক্ষেপ করেছেন “খোকা ইলিশ” আছে অথচ “খুকু ইলিশ” হয় না।
যেখানে স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ রয়েছে এবং পুংলিঙ্গ শব্দটি ব্যবহার করা সম্পূর্ণভাবেই অযৌক্তিক সেখানেও পুংলিঙ্গ শব্দের ব্যবহারের দৃষ্টান্ত রয়েছে। “যেমন “বাঘের দুধ” (দুষ্প্রাপ্য বস্তু অর্থে আলঙ্কারিক প্রয়োগে), “ছাগলের দুধ”। পুরুষপ্রাণী তো আর দুধ দিতে পারে না। “মোষের দুধ” মানা যায় কারণ মোষের স্ত্রীলিঙ্গ হয় না। কিন্তু “বাঘিনী”র মত বহুলপ্রচলিত স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ থকতেও “বাঘিনীর দুধ” বলা যাবে না। “ছাগলে”র ব্যাকরণসম্মত স্ত্রীলিঙ্গরূপ থাকা সত্ত্বেও “ছাগলীর দুধ” বলা যাবে না। অবশ্য “ছাগলী” শব্দটা সাধারণভাবে “ছাগী” অর্থে নয়, গালাগালি দিতেই ব্যবহার করা হয়ে থাকে । কিন্তু কোন মহিলাকে গালি দিতে “ছাগলী” না বলে অনায়াসেই “ছাগল” বলা যেতে পারে যদিও পুরুষের ক্ষেত্রে “ছাগলী” নৈব নৈব চ”।
এখানেও ব্যতিক্রম হল “গোরু” এবং “মুর্গি”। স্ত্রীলিঙ্গ এই শব্দদুটি হল generic term. “গোরুর মাংস” “মুর্গির মাংস” বললে নির্দিষ্টভাবে স্ত্রী প্রাণীটির মাংস বোঝানো হয় না ষাঁড় বা মোরগের মাংসও হতে পারে। অন্যদিকে “ষাঁড়ের মাংস” বা “মোরগের মাংস” বললে নির্দিষ্টভাবে পুরুষ প্রাণীটির মাংসই বোঝানো হয়।একই বক্তব্য প্রযোজ্য “গোরু/ মুর্গি খাওয়া” গোরু/ মুর্গি কাটা, গোরু/ মুর্গি পোষা, গোরুর/ মুর্গির ঠাং ইত্যাদি শব্দবন্ধ সম্বন্ধেও।
হিন্দুদের কাছে গোরু পবিত্র প্রাণী হলেও “গোরু” বলে সম্বোধন করে কাউকে সম্মানিত করা হয় না, শুধুই গালি দিতেই ব্যবহার করা হয়। নির্বোধ বলতে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলকেই “গোরু” বলা যায়। পুরুষ হলেও তাকে ‘’ষাঁড়” বলা হয় না। অন্তত এককভাবে শব্দটির প্রযোগ হয় না; বিশেষ অর্থে “ধর্মের ষাঁড়” শব্দবন্ধটি ব্যবহৃত হয়। “মুর্গি” শব্দে কাউকে গালাগালি দেওয়া যায় না কিন্তু প্রতারণা করা অর্থে নারী পুরুষ উভয়কেই “মুর্গি বানানো” যায়। পুরুষকেও “মোরগ” বানানো যায় না।
গোরু হল একমাত্র প্রাণী যেখানে স্ত্রীলিঙ্গ শব্দটি পুংলিঙ্গ শব্দ থেকে নির্মিত হয় না, বরং বিপরীতটা সম্ভব। গোরু > এঁড়ে গোরু। যদিও “এঁড়ে বাছুর” শব্দবন্ধের ব্যবহারই সমধিক তবু আমরা “এড়ে গোরু” শব্দবন্ধের ব্যবহারো পাই (খাচ্ছিল তাঁতী তাঁত বুনে / কাল হল এঁড়ে গোরু কিনে)।কিন্তু “মাদী ষাঁড়” “স্ত্রী ষাঁড়” “মেয়ে ষাঁড়” বলে কোন শব্দবন্ধের অস্তিত্ব নেই। স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ থেকে পুংলিঙ্গ রূপ নির্মাণের অন্য কোন দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না।
গোরু বা মুর্গি শব্দদুটির generic চরিত্রটি স্পষ্টতর হয়ে ওঠে সমাসবদ্ধ পদে শব্দদুটির ব্যবহারে। “হাঁসমুর্গি” (হাঁসমুর্গি পালন) দুই প্রজাতির স্ত্রী পুরুষ উভ্যকেই বোঝায়। পুংলিঙ্গ “হাঁস” শব্দে হংস ও হংসী উভয়কেই বোঝানো হয় আর স্ত্রীলিঙ্গ “মুর্গি” শব্দে মোরগ ও মুর্গি উভয়কেই নির্দেশ করা হয়। যদি সবই “হংসী” হয় বা যদি সবই “মোরগ” হয় তাহলেও “হাঁসমুর্গি”ই বলতে হবে।একই বক্তব্য “গোরুছাগল” শব্দবন্ধটি সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। একই দলে যদি শুধুই “ষাঁড়” বা শুধুই “ছাগী” থাকে তাহলেও “ষাঁড়ছাগল” অথবা “গোরুছাগলী” বলা যাবে না।এই শব্দবন্ধটি প্রায়শই আলঙ্কারিক অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন একদল নির্বোধ মানুষ (যত্তোসব গোরুছাগল জুটেছে) অথবা একদল মানুষের সঙ্গে যখন পশুর মত ব্যবহার করা হয় ( এই বাসে একেবারে গোরুছাগলের মত যাত্রী তোলা হয়)।এক্ষেত্রেও সেই নিয়মই প্রযোজ্য : উক্ত দলের সকলেই যদি পুরুষ হয় বা সকলেই নারী হয় তাহলেও কেবলমাত্র “গোরুছাগল” শব্দটিই ব্যবহৃত হয়।
স্ত্রীপ্রধান এই দুই পশুসমাজে পুরুষপ্রাণীর অবস্থানের তুলনামূলক বিচার করলে দেখা যাবে ষাঁড়ের তুলনায় মোরগের অবস্থা আরও শোচনীয়। ভাষাব্যবহারে গোরুর চেয়ে পিছিয়ে থাকলে ষাঁরের তবু একটা স্থান আছে ; যেমন “ধর্মের ষাঁড়”, “ষাঁড়ের মত চীৎকার করা”। কিন্তু মোরগ নিয়ে বাংলায় কোন বাগধারা প্রবাদপ্রবচন নেই।
——————————–
শব্দত্রয়ের এই সাদৃশ্য নিঃসন্দেহে সমাপতন। পৃথক পৃথকভাবে তিনটির বিশ্লেষণ করতে হবে।আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি লক্ষ্মীশব্দের এমন সর্বময় প্রয়োগের ব্যাখ্যা লক্ষ্মীর দেবীত্ব হতে পারে না কারণ তিনি তো দেবমণ্ডলীতে সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিতা নন। গোরু বড় অংশের হিন্দুদের কাছে পবিত্র প্রাণী হলেও ভাষায় ব্যবহারে তো প্রাণীটির কোন সম্মানের স্থান নেই। আর মুর্গির তো কোনভবেই কোন সম্মানিত প্রানী নয়। একথা সত্য যে হাঁস, মুর্গি গোরু, মোষ, ছাগল ইত্যাদি যেসব প্রাণীকে অর্থনৈতিক কারণে দলবদ্ধভাবে পালন করা হয় সেখানে স্ত্রীপ্রাণীর গুরুত্ব বেশি থাকে ডিম, দুধ বা প্রজননের জন্য ; অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় ওই দলে স্ত্রী প্রাণীর সংখ্যা বেশি। কিন্তু সেইক্ষেত্রে শুধু মাত্র গোরু আর মুর্গির ক্ষেত্রে ভাষায় ব্যবহারে স্ত্রীপ্রাধান্য কেন? সুতরাং এই স্ত্রীপ্রাধান্য অর্থনৈতিক গুরুত্ব নয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চিরাচরিত রীতি ভেঙে এই তিনটি শব্দের ক্ষেত্রে স্ত্রী প্রাধান্যের ব্যাখ্যা তবে কী ? সুধী পাঠকের কাছ থেকে মতামতের অপেক্ষায় রইলাম। ধন্যবাদ।
খুব মজা পেলাম পড়ে। এই প্রসঙ্গে একটি কথা মনে এল। রাজার স্ত্রীকে যদি রাজমহিষী বলা হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে তার পুংলিঙ্গ কি রাজমহিষ হতে পারে?
চমৎকার !