শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

কলা পাতায় তেরছা আলো। ছিটে মেঘের বজ্র নিনাদ । মা দুর্গা আসছেন। ঐতো আকাশে সিংহের আগমনী গর্জন। জমির আলে কাশবন। এক থালা ভাতের মতো সাদা – দুলছে, ডাকছে : আয় গো উমা ঘরে আয়। রেল লাইন ধরে মুঠো ভর্তি শিউলি নিয়ে অনু ছুটছে। পুরোনো ধূসর প্যান্ট, আদুড় গা, এলোমেলো চুল, একজোড়া দিগন্ত চোখ। অনু ছুটছে, ছুটছে। মাথার ওপর ফিঙে বন্ধু কোতোয়াল, সেও হাওয়ায় ডুবকি মেরে উড়ছে। ঊর্ধ্বশ্বাস দুজনেরই। কোনোমতে পৌঁছুতে হবে। একটু পরেই শুরু হবে ; নাকি হয়ে গেলো ! ইশ!!! দেরি হলে আর দেখা যাবে না। ‘চ, চ, কোতোয়াল তাড়াতাড়ি চ ‘।
বচ্ছরান্তে দেবী পক্ষের দ্বিতীয়ায়, জাঁকালো জটাধারী হরিহর সকাল সকাল স্নান , আহ্নিক সেরে লাল পেড়ে পাটের কাপড় পরে ঠাকুর দালানে আসে। নতুন রং তুলি কপালে ঠেকিয়ে শুরু করে – শ্রী শ্রী গৌরীর চক্ষুদান পর্ব। নরম তুলির ছোঁয়ায়, জবার কুঁড়ি ফোটার মতো ধীরে ধীরে জগজ্জননী ডাগর চোখ মেলেন। ঘরে ঘরে শাঁখ, জয় ঢাকে কাঠির ঢ্যাং কুড়কুড় বেজে ওঠে । খোড়ো চালের ওপর লাউ পাতায় ছড়িয়ে পড়ে – শিশিরে শিশিরে শারদ আকাশে ভোরের আগমনী শিহরণ। হরিহরের দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরে ভাবধারা। স্মৃতিধারা। সে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। বচ্ছরান্তে, হৃদয়ে অনুভব করে আরও কার আবাহনী স্পর্শ।


এই রকমটাই হয়ে এসেছে এ যাবৎ কাল। এই রকমটাই হতো এবারও, যদি না ঠাকুরদালান ফাঁকা থমথমে দেখে হতবাক হতো অনু। কেউ কোথাও নেই, শুধু ষষ্টি খুড়োর দুটো কুকুর অকাতরে অক্লেশে ঘুমুচ্ছে। যেন কিছুই হয় নি। কিংবা বলা যেতে পারে কোথাও কিছু হলেও বা তাদের কি এসে যায়? ওরা যে উচ্ছিষ্টভোজী। কিন্তু অনু !!! ওর পুরো উদ্যমটাই তো হিম হয়ে যাচ্ছে। ঝটতি শিউলিদের অবশিষ্ট পড়ে থাকা এক তাল মাটির ওপর রেখে সে ছুট্ দিলো হরিহরের বাড়ির দিকে। সঙ্গে মাথার ওপর নিত্যসঙ্গী উড্ডীন কোতোয়াল।
বাদামতলায় হরিহরের বাড়ি। সদ্য পাকা গাঁথনির মাথা বাঁধা, টিনের চালা দিয়ে। ফি বছরে ছাদ ঢেলে জীবনে কিছু একটা করে সবাইকে বুক বাজিয়ে দেখাবে এই পরিকল্পনা। উঠোনে সারি সারি কাঁচা মাটিতে চিড় খাওয়া ন্যাংটো ছোটো, মেজো, সেজো সাইজের লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক আর দুটো শুঁড় ভাঙা গণেশ। যে পাব্বণে যাকে লাগে, ঠিক সেই সময়ে হরিহর তাদের তেমন করেই সাজিয়ে গুছিয়ে বসন-মুখোশ পড়িয়ে ভক্তি বাজারে চালান করে। ব্যতিক্রম শুধু বাড়ির ঈশান কোণে প্রায় ভেঙে পড়া তাল পাতার ছাউনিতে জিব কেটে দাঁড়িয়ে থাকা – কালো, ঝুলে ভর্তি, চক্ষুহীন, বসনহীন, অস্ত্রহীন রোখ্যেকালি মূর্তি। ওদিকে পারতপক্ষে কেউ যায় না। ওদিকে গেলেই নাকি বাতাস হিসহিসিয়ে ওঠে।


সেদিন ছিল ভাদ্রমাসের একাদশী। সারাদিন আকাশ দোয়াত-ঢালা। সন্ধ্যের আগেই বাঁধ ভাঙলো। অবিশ্রাম বৃষ্টি। দমকা হাওয়ায় ইলেকট্রিক পোলের তার ছিঁড়ে আলো নিভে গেছে। হরিহরের হাতে রং তুলি, কপালে ভাঁজ, চোখে সংশয়। কি করে কী হবে এমন দুর্যোগে! সব যে ভেসে যাচ্ছে। এমনতো কোনোদিন হয় না। তিন দিন পরেই অমাবস্যা – চৌধুরী বাড়ির পুজো। মোটা টাকার বায়না করে গেছে। কুপির লিকলিকে আগুনে হরিহরের সামনে মূর্তি আর তার করাল ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে লাগলো। কেমন যেন দুলছে, টিক্ টিক্ অশান্ত পেন্ডুলামের মতো, শূন্যে, অন্ধকারে। হরিহর সম্মোহিত চোখে সে দিকে তাকিয়ে। মহাবুদবুদের মধ্যে অসহায় শিশু।
আকাশ ফেঁড়ে বাজের শব্দে ঘোর কাটলো আর তারপর সেই শিউরে শিরা ফাটানো চিৎকার।
‘ও মা গো! গেলুম গো গেলুম! বাঁচাও! বাঁচাও!’
তড়িৎ গতিতে সমস্ত চেতনাব্যাপী দিগ্বিদিক, জ্ঞানশূন্য ভয়ে সে ফিরে তাকালো। কি সর্বনাশ! একি হলো! বস্তা চাপা নতুন খড়ের গাদার পাশে প্রায় অচৈতন্য গৌরী; মাটিতে পরে কাতরাচ্ছে – অপল্কা শরীর যন্ত্রনায় নীল। সন্নেসি রোগ না কি কোনো দৈব-ভর? না কি আরো ভীষণ ভয়ানক কিছু? হরিহর বৌ’কে পাঁজাকোলা করে তুলে আনলো দাওয়ায়। উদ্ভ্রান্তের মতো কপালে জল দিয়ে চাপড়, তারপর দু গালে চড় মারতে লাগলো। ওকে জাগিয়ে রাখতেই হবে। নইলে ঘুম, সেই ঘুম – না না, হতে পারেনা, এ হতে পারেনা! ওরে কে আছিস একবারটি আয়। এ আমার কি হলো! দুর্দান্ত মরিয়া, দু হাতে সবলে হাঁ মুখে জল ঢালতে গেলো। সবটাই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো মাটিতে। তাহলে কি? না না, এতো পাপ আমি করিনি। দেবতার শরীরে আমি তো প্রাণ প্রতিষ্ঠা করি – চক্ষু দান করি – হাতে অস্ত্র তুলে দি। আমি এঁদের প্রত্যেকের আশীর্বাদ-ধন্য। না না, এ হতে পারে না! হরিহর জোয়ান শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে গৌরীকে ঝাঁকাতে লাগলো; মাটি ল্যাপার আগে ঠিক যে উদ্দাম শক্তি প্রয়োগে সে প্রতিমার খড় আঁটো করে বাঁধে। ওঠ হতভাগী ওঠ ! চোখ খোল! খোল বলছি! শুনতে পাচ্ছিস না? অসহায় তলিয়ে যেতে যেতে কথাগুলো গৌরীর কানে পৌঁছেছিল কি না জানা নেই। তবে চির বাধ্য সে চোখ খুলে, অনর্গল হেঁচকি তুলে, একবার বলতে চেয়েছিলো – হেরে গেলে তুমি। একেবারে ডাহা হেরে গেলে গো, আমার নাগর! গ্যাঁজলা বমি গড়িয়ে পড়েছিল অনেকটাই নাক কান মুখ দিয়ে। বৃষ্টিতে মুখ থুবড়ে পরে থাকা হেরিকেনের আলোয় নিথর হরিহর তাকে দেখেছিল চলে যেতে, এঁকে বেঁকে বুকে হেঁটে। অন্ধ আক্রোশে, রেগে ভীষণ হয়ে বাঁশ নিয়ে তাড়া করেছিল। কিন্তু ছুঁতেও পারেনি। নিশ্চল দেবী প্রতিমার গলা পেঁচিয়ে গৌরীখাদক, ক্রূর ফণা তুলে অতর্কিত আক্রমণের আঁশটে ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে ছিল। মনের মধ্যে রাগ, ক্ষোভ, যন্ত্রণা হলেও কিছুই করার রইলো না হরিহরের। নিয়ন্ত্রিত কোনো দম দেয়া পুতুলের মতো সে পিছিয়ে এলো। ওদিকে ততক্ষনে দুর্গা – হরিহরের একমাত্র ষোড়শী মেয়ে, মায়ের দুটো বরফ চোখ টেনে টেনে খোলার চেষ্টা করতে গিয়ে মাঝেমাঝে ফিকফিক করে হেসে ফেলছিলো। দুর্গা জন্ম থেকেই বলতে পারেনা, শুনতে পারেনা, কাঁদতেও পারেনা। শুধু মাঝে মাঝে সব দেখে শুনে অবলীলায় হাসে, এখন যেমন মায়ের মরা মুখ দেখে। হরিহর ওকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কান্নায় হাবুডুবু খেতে লাগলো। জ্বলোচ্ছাসে নদীর কুল একের পর এক ভাঙলো।


অনু গন্তব্যে পৌঁছে দেখলো, পুলিশের গাড়ি আর লোকে লোকারণ্য। বেষ্টনী পেরিয়ে ভিতরে কিছতেই ঢুকতে পারলো না। রামুকাকা কান মুলে দাবড়ে দিয়ে বললে – এই ছেলে – এখানে কি করছিস? যা বাড়ি যা। এসব জিনিস বাচ্চাদের দেখতে নেই। দূর হ বলছি এখান থেকে এক্ষুনি। বন্ধুর বিপর্যয় দেখে তাকে কোতোয়াল লম্বা শিস দিয়ে ডাকলো। তারপর ওরা দুজনে গিয়ে বসলো ভাঙা শেওলা সবুজ পাঁচিলের আড়ে আকাশের নীলিমাভুক বিকট জাম গাছের ডালে। সেখানে পাতার আড়াল থেকে ওরা শুনতে পেলো :
‘স্যার, দু’দলই ক্রমশ বাইরে ভিড় করেছে।’
‘সালা চিল শকুনির দল – গন্ধ পেলেই উড়ে এসে জুড়ে বসে।’
‘কিছু করার নেই স্যার, সস্তায় ফায়দা তুলতে কে না চায় !
‘অথচ এদের মতোই কেউ একজন ঘটনা ঘটিয়েছে।’
‘সে আর বলতে – ।’
‘মাঝে মধ্যে কি মনে হয় জানো?’
‘কি স্যার – সোনাগাছির বেশ্যা, যেই পারে সেই – ?’
‘মানে তোমারও কি ওই একরকম মনে হয়?’
‘না স্যার! আপনার আগে দাশ সাহেবও ওই এক কথা বলতেন। তারপর তো প্রমোশন পেয়ে কি যেন নেতা হয়ে গেলেন।’
‘যাগ্গে যাক – এখন কি করা যায় বলতো – বাড়িতে আবার মেয়ের জন্মদিন সেলিব্রেশন।’
‘তাড়াতাড়ি পাপ বিদায় করুন। অন্য কিছু ভেবে লাভ নেই। এদেশে যেটা এতকাল হয়ে এসেছে সেটাই হবে। নিয়তির বিধান কোনো হারামির বাচ্চা পাল্টাতে পারবে না।’
‘হুম!!! ভ্যান গাড়িটা এসেছে আর দড়ি?’
‘একদম স্যার, সঙ্গে মালা আর ধুপ – হাজার হোক জাত বলে তো একটা ব্যাপার আছে – ‘
‘এবং তুমি মানো সেটা?’
‘ওসব না মানার মাকু ঢং আর করিনা স্যার। ‘
‘যাগ্গে যাক – মেয়েটির পরিবারে শুধুই তো বাপ? ‘
‘হ্যাঁ স্যার। হরি কুমোর – একদম নির্বিবাদী – নিরীহ – ।’
‘ওতে কিছুই যায় আসে না – যাই হোক ডেকে নিয়ে এসো।
‘ওকে স্যার। ‘
‘আর শোনো – একটু দেখে এসো তো পরিষ্কার কোনো পায়খানা আছে নাকি – । ‘
‘স্যার, ওটা কি তদন্তে লাগবে ‘?
‘আরে না না। তদন্ত ফদন্ত আজকাল কে করে। সকাল থেকে হয়নি তাই – । ‘
কোতোয়াল বিষয়টা আন্দাজ করতে পেরেছিলো। বিভিন্ন আকাশে ঘোরার সুবাদে অনুর চেয়ে ওর অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। অনুর মাথায় ঠোক্কর দিয়ে বলতে চাইলে – বন্ধু, চলো এবার এখান থেকে চলে যাই। এর পর যা হবে সেটা দেখার জন্য আমরা পৃথিবীতে আসিনি। চলো বন্ধু চলে যাই – নিশ্চিহ্ন হয়ে যাই – অনেক দূরের বনের দিকে – ঘন সবুজ পাতার বন – অসংখ্য বর্ণালিঘেরা আকাশ , পাহাড় আর মাটির দিকে। এখানে আর এক মুহূর্তও নয়।
কিন্তু অনু নাচার। সে থাকবেই, দেখবেই, জানবেই। গল্পে এর পর কি হলো, নদী কোন দিকে বইলো। সে যে মানুষ – তার আনন্দ, কৌতূহল নিবৃত্তিতে, নিছক শুধু আনন্দবৃত্তিতে নয়।
বৃদ্ধ বাবলু জেলে আর তার পেট রোগা, হাড় ডিগডিগে ছেলের কাঁধে, বাঁশে বাঁধা নাইলনের জালের মধ্যে, বড় বড় কচুরিপানায় জড়ানো,পাঁক আর শ্যাওলা মেখে ষোড়শী দুর্গা, তৃতীয়ার দিন সকালে এলো। শিশির-স্বাদ, সুশ্রী মুখে ইতস্তত আঘাত আর রক্তের চিহ্ন। হলুদ কামিজের একাংশ ফাল্লা করে ছেঁড়া, নিম্নাঙ্গ উন্মুক্ত বস্ত্রহীন, শীর্ণ উরু-টাটকা কালশিটের দাগে ভরা। মাছের মতো জাল ছাড়িয়ে তাকে উঠোনে শোয়াতেই কে যেন ছুটে এসে নিজের গায়ের তেলচিটে গামছা দিয়ে তাকে ঢেকে দিলো। অনু ওকে চেনে। ওর নাম শম্ভূ – বহুরূপী সেজে ট্রেনে ভিক্ষে করে খায়। মাঝে মাঝেই দুগ্গাকে – ওর খুব পছন্দের নোনতা ঝাল লজেন্স কিংবা দিলখুশ নিয়ে এসে দিতো। ওদের মধ্যে কিছু একটা ছিল যা অনুর কাছে মনে হতো নদীর জলের মতো সহজ সরল, কিন্তু সে তার নাম বলতে পারতো না।
এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে, খাঁকি হাফ হাতা শার্টের নিচে ভারী পাথর বসানো তাবিচটা তুলে, বড়োবাবু, হরিহরের দিকে তাকালো।
‘ঠাকুর কি ঠিক করলে বলো?’
‘আমি আর কি বলবো হুজুর – আমার তো আর কিছু রইলো নি গো’, মুখের সামনে থেকে বটের ঝুড়ির মতো জটা সড়িয়ে অস্ফুট স্বরে দু’ হাতে দারোগার হাত ধরে বুকের কাছে টেনে নিয়ে সে উত্তর দিলে।
‘শোনো। এখানে বেশি সময়ে এরকম গা এলিয়ে শোকবাজি করলে বিপদ তোমারি। পার্টির লোকেরা ঢুকে পড়লে বুঝতেই পাচ্ছো কিচাইন কোন লেভেলে যাবে। তাই বলছি, ওদের কথায় কান দিয়ো না। এদেশে ওই সব তদন্ত, কোর্ট কাচারী, সব বাবার দরবারে পাগলের খেলা। পাঁচু বাগ্দীর ভ্যান গাড়ি তৈরী, ফুল মালা ধুপ আনা আছে। চৌধুরীদের বাবুদের ছেলে আবার গরজ করে এই এক শিশি অগুরু, নামাবলী আর সৎকারের জন্য দু হাজার টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে। এগুলো নিয়ে তাড়াতাড়ি যা করবার করো। ভয় নেই, প্রশাসন তোমার সঙ্গেই আছে ।’
কি বলবে বুঝতে না পেরে ভুরু কুঁচকে, হরিহর স্তম্ভিতের মতো তাকিয়ে রইলো। তার অবস্থা – স্বপ্নে বিভীষিকার সামনে থেকে পালানোর ক্ষমতা লুপ্ত হয়ে যাওয়া কোনো এক হতভাগ্য মানুষের। মাথার ভিতরে সব কিরকম শুকিয়ে ফাঁকা হয়ে আসছিলো। চোখের সামনে সে দেখতে পেলো মহাসাগরের তুফান দোলে, উদ্দাম ঢাকের বোলে, সমস্ত শারদ পৃথিবীটা – শত শত ছায়া শরীরী হয়ে দুলছে। কেউ স্থির নেই। ক্রমশ অনিয়ন্ত্রিত সর্বভুক, দংষ্ট্রা করালবদনা, মহাঅন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। এ যেন, এতকাল শুনে আসা, মহাপ্রলয়ের মহামহোৎসবের সূচনাপর্ব।
হরিহরের জ্ঞান ফিরতে সে দেখে, নাচের চৌকাঠে কলসি ভেঙে দুগ্গা ভ্যানে চেপে ভাসানে চলে গেছে। বাজদোর খালের দ’য়ে, শ্মশানে, হবে সেই আগুন ভাসান। বাড়িতে এখন শুধু সে, বন্ধু ষষ্টিপদ, আর তালপাতার ছাউনিতে কালো মোটা ঝুল আর মাকড়সার জালের ধুলোট বিন্যাসে মোড়া কালীমূর্তি।
‘হরি, এবার দিনক্ষণ দেখে ওই মূর্তিটাকে বিসজ্জন দিয়ে আয়’, বন্ধু বিড়ির শেষাংশে লম্বা টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে, বললে।
‘হ্যাঁ, ওর শেষ ব্যবস্থাটা এবার করতেই হবে। তবে, ওর কাছে আমি হার মানব না। কিছুতেই না। আমি কোনো পতিত নই’, চোয়াল শক্ত করে কথাগুলো বলে একেবারে স্থির হয়ে গেলো হরিহর। তাকিয়ে রইলো টলটলানো নিবিড় রহস্য চোখে আকাশের দিকে। তার মনে হলো শরতের সাদা মেঘ যেন একেকটি বোবা বিস্ফোরণ।
অনু আর কোতোয়াল, পুলিশ আর গাঁয়ের হোমরা চোমরা কজনের পিছুপিছু দুর্গার বিসর্জন যাত্রায় গিয়েছিলো। গলায় মালা, পায়ে আলতা, মাথায় চুল আঁট করে বেঁধে ফুলের মুকুট এঁটে, পরিপাটি করে ডুরে শাড়ি পড়ে, শরীরে অগুরু আর চন্দন ধূপের গন্ধ নিয়ে সে শুয়েছিল কাঠের পাঁজায়ে। অপেক্ষায় ছিল – কখন সে আসবে, কখন ওষ্ঠে দেবে অগ্নি চুম্বন, কখন ছাই করে উড়িয়ে নিয়ে যাবে চিরদিনের মতো। দুর্গার মুখাগ্নি করেছিল সেই বুদোকাকার ছেলে – বাপ মা মরা বহুরূপী শম্ভূ। দূর পাহাড়ের আড়ালে মেঘের গায়ে তখন চুঁয়ে চুঁয়ে সূর্যমুখীর শেষ রক্ত পড়েছিল। আকাশের রাঙা ঝলকে কালো ছায়া পড়তে শুরু হয়েছিল তারও কিছু পরে, চিতায় শান্তি জলের ছলাক্ ছলাক্ শব্দে।

সেদিন রাত গভীর হলে আগুন জ্বলেছিল আরো একবার। তার আঁচে,টকটকে লাল হয়ে উঠেছিল হরিহরের মুখ, গলায় পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষের মালা । বেতের কঞ্চির মতো মাতাল শরীর তিন বার মোচড় দিয়ে ঘুরিয়ে এতদিনের অতিক্রান্ত অনন্ত যন্ত্রণার পথের জ্বালা সে নতুন করে জাগিয়ে, অগ্নিদীপ্ত করে তুললো। তারপর উন্মত্ত অর্ধ নগ্ন গনগনে মশাল হাতে ছুটে গিয়েছিলো সেই কালীমূর্তির দিকে। জটা ঝাঁকিয়ে, উরুতে চাপড় মেরে বিকট হৃৎপিণ্ড ছিন্নকারী চিৎকার করে বলে উঠেছিল – পিশাচিনী, তোর কাছে আজ আর হারবো না – তোকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে আজ সব ছারখার করবো। এতদিন জ্বালিয়েছিস আজ তুই নিজে জ্বল, দাউ দাউ আগুনে জ্বল, আমার দুগ্গার মতো জ্বল। তারপর একে একে, ভিতর ঘর, উঠোন, দরজা, জানলা – প্রত্যেকে, মরণযজ্ঞের সমিধ হয়ে নিঃশেষ হতে থাকলো। আগুনের গহ্বরে নিশ্চিহ্ন হয়ে বেঁচে রইলো যাকে আমরা সচরাচর বলে থাকি – বিপর্যস্তের শেষ প্রতিবাদ।
‘তারপর?’ পঞ্চমীর ঝিঁঝিঁ রাতে অস্পষ্ট আলোয় গেলাসে বাকি ডাবের জল আর ভদ্কা মিশিয়ে বড় বড় কাজল চোখে জিজ্ঞেস করলো সৌমী।
‘তারপর আর কি ? এখনো সেই আধ-পোড়া ভাঙা মূর্তি সেখানেই দাঁড়িয়ে। বছরে একদিন, চৈত্র সংক্রান্তিতে কারণবারি দিয়ে পুজো হয়। ডজন খানেক বলি হয়। মেলা বসে। কাল সকালে দেখাতে নিয়ে যাবো গ্রামের প্রসিদ্ধ রোখ্যাকালীতলা। ‘
‘আর সেই থেকেই বুঝি – । ‘
‘হুম ঠিক ধরেছো। সেই থেকেই আমাদের গৌরী মায়ের চোখ নির্মল, স্বচ্ছ, সাদা।’
‘আচ্ছা , তারপরে কেউ ওই চক্ষুদানের চেষ্টা করে নি কেন ? ‘
‘করেছিল কিন্তু — কি আর বলবো!’
‘বলো না, প্লিজ ।’
‘বোধনের আগের দিন চৌধুরীদের ছোট ছেলে ঠিক করলো শহর থেকে আর্টিস্ট নিয়ে এসে রাতারাতি কাজটি করবে। সব আয়োজন প্রস্তুতও ছিল। কিন্তু সেখানেও –
‘কি হলো – ‘
‘আকণ্ঠ পান করে গাড়ি চালাতে গিয়ে হাইওয়েতে একসিডেন্ট। স্পট ডেড !’
‘ইশ !!! একেই বলে নিয়তি।’
‘জানি না। তবে সময় নিজস্ব ভাষায় সমাধানগুলো লিখে রেখে যায়। ছেলের মৃতদেহ মর্গে পাঠিয়ে চৌধুরী মশাই আছড়ে পড়েছিল ঠাকুরদালানে। অনর্গল শানে মাথা ঠুকে বলেছিলো – দুগ্গা, এই কি রে তোর প্রতিশোধ? বাপের স্বীকারোক্তি শুনে গ্রামের সবাই কেঁপে উঠেছিল। ঢাকি, কাঁশি স্তব্ধ হয় গিয়েছিলো। আর সেই দিনই গাঁয়ের লোকেরা ঠিক করলে আমাদের মায়ের চোখ চিরদিন নিষ্পলক, বিশ্বজোড়া থাকবে। যেমনটি তুমি দেখে এলে।’


‘আর তোমার সেই কোতোয়াল? তার কি হলো ?’
তাক থেকে পুরোনো কাঠের বাক্স নামিয়ে একটা হলুদ পোকা-কাটা ডাইরি বার করলো অনিমেষ। নিঃশব্দে হাওয়ায় বিলি কেটে লম্বা কালো পালকটি সাদা টেবিল ক্লথের ওপর ঝরে পড়লো।
বাইরে তখন শাঁখের শব্দ। রাত থাকতে এয়োরা জল সইতে বেরিয়েছে দীঘির ঘাটে। কাল দুগ্গা ষষ্টি।

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়
তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়
20 days ago

এত ভাল লেখার হাত, অথচ ইদানিং লেখেন বড় কম। সুহৃদের এটাই প্রীতিপূর্ণ অনুযোগ।

সৌরভ হাওলাদার
সৌরভ হাওলাদার
18 days ago

কাব্যময়তায় গাঁথা গদ্য। ভালো লাগল।

2
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x