শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

বিয়ের পদ্য – বাঙালির একটি অবলুপ্ত রীতি

বাঙালি চিরকালই একটু রসেবশে থাকতে ভালবাসে । পদ্য লেখা, ছড়া কাটা, গান বাঁধা , ছবি আঁকা এ সব তার এমনি এমনিই এসে যায় । আর সে সব সামিল হয়ে যায় তার ধর্মে কর্ম্মে মর্মে। ঢুকে পড়ে তার জীবনের সব ঔপচারিকতার মধ্যে । হয়ত তার স্বভাবদোষে বা স্বভাবগুনে একটানা খুব ভাবগম্ভীর পরিবেশ তার বিশেষ পছন্দ নয়। অং বং চং দুর্বোধ্য মন্ত্রের কাছে সে খুব বেশিক্ষণ বাঁধা পড়ে থাকতে চায় না। তাই সুযোগ পেলেই তার মধ্যে একটু ঐ পদ্য- গান-ছড়া-ছবি এ সব আমদানি করে একটু হালকা হয়ে নিতে চায়।

এই যেমন বাঙালির বিয়েবাড়ির কথাই যদি ধরি, প্রাচীন কাল থেকেই বাঙালি বিয়ের উদযাপনের মধ্যে পুঁথিপত্রে লেখা রীতি রেওয়াজের সঙ্গে সে মিশিয়ে দিয়েছে তার স্বভাবচিত কিছু নিজস্ব নান্দনিকতা আর রসবোধ । বিয়ের গুরুগম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে একটু কমিক রিলিফ দেওয়ার জন্যে নরসুন্দরের(আমরা যাকে নাপিত বলে থাকি) একটি ভূমিকা ছিল – সেটা হল ছাঁদনাতলায় মজার ছড়া বলে সবাইকে এক চোট হাসিয়ে দেওয়ার । শুভদৃষ্টির আগে কনে পক্ষের নাপিত এসে বর পক্ষের সগে একটু রগড় করে বলে ওঠে-

‘শুন সবে, এবে আমি করি নিবেদন ।

ছাঁদনাতলায় এসেছে বর বৃষভবাহন ।।

মন্দলোকে থাক যদি, যাও সরে যাও ।

ছাউনি নাড়ার সময় হল এয়োরা দাঁড়াও ।।

খুঁটি খাঁটা ছেড়ে দাও, ভাতার পুতের মাথা খাও

যে ধরবে চালের বাতা, সে খাবে ভাতারের মাথা।

যে জন করবেক কু, তার বাপের মুখে গু।’

অথবা ,

শুনুন শুনুন মহাশয়, করি নিবেদন।
হরগৌরীর বিবাহ কথা, করি গো বর্ণন ।।
হরগৌরীর বিবাহে কৌতুক লাগিল।
বরণডালা লয়ে রাণী মেনকা আইল।।
কুমকুম কস্তুরি আমলা মেথি যত।
সকল দ্রব্য লয়ে থালা করিল পূর্ণত‌।। ইত্যাদি ।

এ ছাড়া সেই একই উদ্দেশ্যে মানে পরিস্থিতিকে হালকা করার জন্যে আবার কিছু খেলার ব্যাবস্থাও থাকে যেমন – কড়িখেলা, পাশাখেলা, ভাঁড়কুলো খেলা ইত্যাদি ।

এ সব রকম আচার নিশ্চয় মনুর বিধানে লেখা নেই, এ একান্তভাবে বাঙালির নিজস্ব আবিষ্কার।

তেমনি আর একটা রীতি ছিল বিয়ে উপলক্ষে কনে এবং বরের আত্মীয়স্বজনদের পদ্য লিখে তার একটি সংকলন বের করে বিয়ে বাড়িতে নিমন্ত্রিতদের মধ্যে বিতরণ করা। আমাদের ছোটোবেলাতেও আমরা দেখেছি গোলাপী বা হলুদ রঙের জ্যালজ্যলে কাগজে এ রকম একটি বিয়ের পদ্যের সংকলন বার করা হত। প্রথম পাতায় আঁকা কিছু ফুল পাতার নকসা এবং দুধারে দুজন পরী মালা হাতে দাঁড়িয়ে থাকার ছবি । উপরে অবশ্যই প্রজাপতির ছবি তার নিচে ‘শ্রী শ্রী প্রজাপতয়ে নমঃ’ এবং তার নিচে এবং বড় বড় হরফে লেখা শ্রীমান অমুকের সহিত, তমুক রানীর শুভবিবাহ। পাতা ওলটালেই বেশ কয়েকটি পদ্য।

সে সব কবিতায় কাব্যগুণ খোঁজা বৃথা। হয়ত দিদিমা লিখছেন – ‘নাতনীর বিয়েতে আনন্দোচ্ছ্বাস’ শিরোনামে একটি ছড়া । ছোট ভাই দিদির বিয়েতে একটু মজার ছলে লিখছে – ‘দিদির বিয়েতে একটু চাটনি’, কিম্বা কন্যার মা একটু মনের দুঃখ মিশিয়ে লিখছেন- ‘দেখতে দেখতে ষোলটি বছর করলি পার/ চললি এবার শ্বশুর ঘরে মোদের ঘর করে আঁধার’।

এই পদ্য লেখার রীতি কিন্তু বেশ প্রাচীন। যতদুর জানা গেছে এই রীতির শুরু হয় ১৩০৪ বঙ্গাব্দে রাজা সুবোধ মল্লিকের বিয়ের সময়। এই রীতি চলে এসেছে বিশ শতকের পঞ্চাশ বা ষাটের দশক অবধি । তার পর কেন জানিনা আধুনিকতার আক্রমণে, বা কারো হাতে সময় নেই এই অজুহাতে, বা সব কিছু outsource করে দেওয়ার হিড়িকে এই রীতি অবলুপ্ত হয়ে যায়। এই সব বিয়ের পদ্যের কোনো তেমন কোনো সংকলন পাওয়া যায় না। কারণ এই সব পদ্যের লেখক লেখিকা তো ছিলেন পাত্রপাত্রীর বাবা-মা, ঠাকুমা-ঠাকুরদাদা, কাকা-কাকিমা, মামা-মামিমা ইত্যদিরা। তাদের স্নেহসিক্ত, আশীর্বাদসৃজিত, কৌতুকস্নিগ্ধ লেখাগুলির মধ্যে যতটা প্রাণের স্পর্শ থাকত ততটা হয়ত থাকত না সাহিত্যমূল্য । কিন্তু আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে যখন থাকতেন তেমন কোনো কবি সাহিত্যিক তখন সেই সব পদ্যও বিয়ে বাড়িতে বিতরিত হলুদ দু তিন পাতার কাগজের থেকে বেরিয়ে গিয়ে স্থান পেত ইতিহাসে। আর এমনিভাবেই এখানেও বাঙালির সর্বব্যাপি পুরুষ সেই রবীন্দ্রনাথের কথাই চলে আসে । তিনি তাঁর আদরের ভাইপো সুরেন্দ্রনাথের কন্যা জয়শ্রীর বিয়েতে একটি পদ্য লিখেছিলেন যার মধ্যে তাঁর রসবোধের সঙ্গে একটু যেন সমাজের নিগড়ের প্রতি একটু আলগা খোঁচাও আছে –

‘তোমাদের বিয়ে হল ফাগুনের চৌঠা

অক্ষয় হয়ে থাক সিঁদুরের কৌটা

সাত চড়ে তবু যেন কথা মুখে না ফোটে

নাসিকার ডগা ছেড়ে ঘোমটাও না ওঠে

শাশুড়ী না বলে যেন কি বেহায়া বৌটা ।।‘

তবে রবীন্দ্রনাথকে তো অনুরোধ, উপরোধ বা ফরমায়েশের চাপে অনেক কিছু করতে হয়েছে।

কিছু গানও তৈরি করে দিতে হয়েছে পরিচিত পরিজনদের জন্যে । ১৮৮১ সালে রাজনারায়ণ বসুর মেয়ে লীলাবতীর সঙ্গে কৃষ্ণকুমার মিত্রের বিয়ে উপলক্ষে কয়েকটি গান রচনা করে দিয়েছিলেন। এই গান লেখার জড়িয়ে আছে আর এক মূল্যবান ইতিহাস। এই বিয়ের সময় রবীন্দ্রনাথ কয়েক জনকে বিয়ের সময় গানগুলি গাইবার জন্যে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। যাদের তিনি নিজে শিখিয়েছিলেন তার মধ্যে একজন ছিলেন সিমলের এক তরুণ নরেন্দ্রনাথ দত্ত। বিয়ের আসরে তিনি ঠিক কোন গান গেয়েছিলেন তা জানা না গেলেও অনুমান করা যেতে পারে যে গানটি গেয়েছিলেন সেটি – দুই হৃদয়ের নদী একত্র মিলিল যদি/ বল দেব কার পানে আগ্রহে ছুটিয়া যায়… ।

অনুমানের কারণ এই গানটি স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর সঙ্কলিত গানের বই ‘সঙ্গীতকল্পতরু’তে সঙ্কলিত করেছিলেন ।

এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথ পরিচিত অনেকের বিয়েতেই লিখে দিতেন আশীর্বাণী । কবি অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল ডেনমার্কের মেয়ে হিয়রডিস সিগারের সঙ্গে । রবীন্দ্রনাথ পাত্রীর নুতন নাম দিলেন হৈমন্তী । সেই সঙ্গে লিখে দিলেন একটি ছোট্ট কবিতা –

‘বিস্ময়ে ভরিল মন এ কী প্রেমের ইন্দ্রজাল,

কোথা হতে করে অন্তর্ধান মুহুর্তে দুস্তর অন্তরাল –

দক্ষিণ পবন সখা উৎকণ্ঠিত বসন্ত কেমনে

হৈমন্তীর কণ্ঠ হতে বরমাল্য নিল শুভক্ষণে।‘

কুচবিহারের রাজকন্যা ইলাদেবীর সঙ্গে ত্রিপুরার রাজকুমার রামেন্দ্রকিশোর দেববর্মার বিয়েতে কবি লিখে দিলেন এক আশীর্বাণী –

তোমরা যুগল প্রেমে রচিতেছ যে আশ্রয়খানি

আমি কবি তার পরে দিনু মোর আশীর্বাদ আনি।

মিলন সুন্দর হোক , সংসারের বাধা হোক দূর,

জীবন যাত্রার পথ হোক শুভ হোক অবন্ধুর ।

কিন্তু এ রকম একই ধরণের আশীর্বাণী লিখতে লিখতে কবি একসময় বেশ বিরক্তই হয়ে যেতেন । তবু অনুরোধ এড়াতে পারতেন না । সাহিত্যিক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়ের বিয়েতে কবিতা লেখার অনুরোধ পেয়ে কবি লিখলেন –

‘চারু, আর তো পারা যায় না । ক্রমাগত ফরমাশ আসবে নানা দিক থেকে। বিষয়টা এক, কলমটাও এক। অথচ বাণীকে করতে হয় বিচিত্র। তোমাদের অনুরোধ এড়াবার জো নেই, অতএব –

‘যুগলযাত্রী করিছ যাত্রা

নুতন তরণীখানি

নবজীবনের অভয়বার্তা

বাতাস দিতেছে আনি ।

দোঁহার পাথেয় দোহার সঙ্গ

অফুরান হয়ে রবে ।

সুখের দুখের যত তরঙ্গ

খেলার মতন হবে ।।‘

কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিক নাকি বিয়ের পদ্য লেখার জন্যে খুব বিখ্যাত ছিলেন। কবি তারক চন্দ্র রায়ের নাতির বিয়েতে যে ছড়াটি তিনি লিখেছিলেন সেটি এই রকম –

‘আজকে তোমার বইবে তুফান বুকে / মুখেতে আর বলব আমি কত

দুই জনেতে থাক পরম সুখে/ একটি বোঁটায় দুইটি ফুলের মত।‘

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছাত্র রেবতীভূষণ খুব বিখ্যাত শিল্পী এবং কার্টুনিস্ট ছিলেন । তাঁর বিয়ের সময় ‘সাত পাকের পাঁচালি’ নামের একটি বিয়ের পদ্যর সঙ্কলন বার করা হয়েছিল । তাতে ছড়া লিখেছিলেন অনেক প্রখ্যাত সাহিত্যিকরা ।

প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছিলেন—

‘‘এতদিন তো বাটিতে রং গুললে নানা রকম/ চালিয়ে গেলে তুলি।

এখন থেকে মনের-ই রং এমন হবে জবর/ আঁকতে না যাও ভুলি।

যাই কেন না আঁকো তবু/ এইটুকু ঠিক জানি

আলতো তুলির টানেও পাবো/ গভীর বুকের বাণী।’’

আশাপূর্ণা দেবী লিখেছিলেন —

‘‘একটি চাকায় চলছিলো রথ/ ক্লান্ত তালে মন্থরে।

জুড়লো এসে আর এক চাকা/ বেদের বাঁধন মন্তরে।

সবেগে রথ চলবে এবার/ উৎসাহে আর উল্লাসে।

জয়ধ্বনি দিচ্ছি মোরা,/ আছি যারা আশপাশে।

তার সাথে থাক আশীর্বাণী/ পথ যেন হয় অবন্ধুর।

যুক্ত জীবন-যন্ত্রে বাজুক/ সুষমাময় স্নিগ্ধ সুর।’’

শিবরাম চক্রবর্তী লিখেছিলেন —

‘‘সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় হোক/ সুখের হোক ও ঘর।

দীর্ঘজীবন মধুময় হোক/ ছেলে-পুলে সুন্দর।’’

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন—

‘‘তুলি কালি রঙ দিয়ে/ হাসি আর খুশিতে

ছোট বড়ো সকলেরে/ পারো তুমি তুষিতে।

সুধাঝরা এই রাত/ মধুভারে টলমল

জীবনেরে করো ছবি/ রঙে রসে ঝলমল।’’

তবে সব বিয়েতে তো আর কবি সাহিত্যিকদের সমাগম হত না । তাই দিদা ঠাম্মি মাসি পিসি থেকে ভাগ্নে-ভাগ্নি , ভাই-বোন এবং অবশ্যই বধু বান্ধবেরা কলম ধরতেন । একটা অলিখিত প্রতিযোগিতাও থাকত বর পক্ষের সঙ্গে কনে পক্ষের, কাদের কবিতার সংখ্যা বেশি হল ।

যতীন্দ্রনাথ দত্ত মশাই এই বিয়ের পদ্য নিয়ে একটি গবেষণা করে কিছু তথ্য আমাদের সামনে রেখেছেন । তিনি এক হাজারটি বিয়ের পদ্যের সঙ্কলন সংগ্রহ করে তার থেকে কিছু মজার সংখ্যাতত্ব আমাদের উপহার দিয়েছেন । তাতে দেখা যাচ্ছে বিয়ের পদ্য সবচেয়ে বেশি লিখতেন বন্ধুবর্গ (২৭৮) আর বউদিদিরা (২২১) । তার পরেই মা ( ১০৩), তার পরে ছোটো বোন (৭৫), তার পরে বড় বোন (৬৮) ইত্যাদি । তবে বাবাদের কবিতার সংখ্যা তুলনায় নেহাতই নগন্য। হাজারে মাত্র দুইটি। হয়ত গুরুদায়িত্ব পালনে বাবারা এতটাই ব্যাস্ত থাকতেন যে পদ্য তাঁদের গদ্যময় পৃথিবীতে ধরা দিত না।

শুধু পদ্য লেখা নয় , বরণ ডালার কুলো সাজানো, ছাঁদনাতলায় চারিপাশে আলপনা দেওয়া, বিয়ের পিঁড়ি চিত্রিত করা এ সবের মধ্যেই থাকত সম্পুর্ন বাঙালি ধারার নন্দনতত্ত্বের প্রকাশ। যাঁরা এ সব করতেন তাঁরা কেউ আঁট স্কুলের পাশকরা শিল্পী নন, ইভেণ্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির কারিগর নন, তারা বরের বা কনের বাড়ির আত্নীয় স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব।

আর একটি জায়গা ছিল বিয়ের তত্ত্ব সাজানো । সেখানে তো রীতিমত বর পক্ষ আর কনে পক্ষের শিল্পরুচির প্রতিযোগিতা। বিয়ে বাড়িতে নিমন্ত্রিতরা এসে এই তত্ত্ব সাজানো দেখে তারিফ করলেই সে সব ঘরোয়া শিল্পীরা তাদের পুরস্কার পেয়ে যেতেন।

২০১৩ সালে ঋতুপর্ণ ঘোষের অকালমৃত্যুর পরে শ্রীমতী অপর্ণা সেন তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘প্রথমা এখন’ নামের একটি পত্রিকায় তাঁর বড়মেয়ের বিয়ের সময় বরপক্ষের কাছে পাঠানোর তত্ত্বের প্রত্যেকটি ডালিতে তার মধ্যে থাকা জিনিসের প্রসঙ্গ দিয়ে ঋতুপর্ণ যে পদ্যগুলি লিখে দিয়েছিলেন সেগুলি প্রকাশ করেছিলেন, ঋতুপর্ণের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে। আমার মনে হয়েছে, এ সব পদ্যে সেই আগেকার দিনের রীতিবৈশিষ্ট্য বজায় রেখেও বেশ আধুনিক সৌকর্যের ছোঁয়াও আছে । তার মধ্যে কয়েকটি তুলে দিচ্ছি।

পাল্কি ক’রে বৌ এল রে, পাড়াপড়শি কৈ?

অঙ্গে শাড়ী বালুচরী, রূপ করে থৈ থৈ

কল্কা করা নক্সা আঁচল, জামরঙা তার খোল,

ছোট্ট রুপোর পাল্কি সাথে-সাবধানেতে তোল।

***

তুঁতে রঙের বেনারসী, সাদা রঙের পাড়ে

সোনার বরণ কল্কা করা – অপূর্ব বাহারে!

তিনকোণা এক রুমাল আছে, শাড়ির ভাঁজে রাখা

সাদা সুতীর রুমাল, তার এককোণে ফুল আঁকা।

***

বেগনী রঙের রেশম শাড়ী, সম্বলপুর থেকে

টুকটুকে লাল রঙ রয়েছে, আঁচল পাড়ে ঢেকে

ব্লাউজ আছে, সঙ্গে আছে চুড়ির গোছা ষোল

রং মিলিয়ে পরবে বলে সঙ্গে দেওয়া হ’ল।

***

জোব্বা পরা ফ্যাশন এখন, কাফতান তার নাম

আগাগোড়া আরশি ঢাকা তিনটে পাঠালাম

দু’খানি তার কলমকারি রঙবাহারি কাজে।

অন্যটিতে আয়না দেওয়া, সাদা – বুকের মাঝে।

***

এই ডালাতে রয়েছে যত স্নানের সরঞ্জাম

তিন কোণা এক বাক্স ভরা সুগন্ধি হামাম

নক্সা করা স্নান তোয়ালে ভিজে শরীর মো্ছে।

স্নানের পরে নরম দেহে বুলিও আলগোছে।

***

এ পর্যন্ত সবই কনের সাজ সরঞ্জাম নিয়ে পদ্য । কিন্তু ডালাতে তো বরের সাজ সরঞ্জামও দিতে হয় । সে রকমও আছে ।

গা ভরা কাজ রেশমী পিরাণ – রয়েছে ডালাজুড়ে

ধুতির পাড়ে খয়েরি রঙে সোনার ডুরে ডুরে

‘D’ লেখা শ্বেত রুমাল কাছে পিরাণ-ধুতির সাথে

স্বর্ণজরির কাজ রয়েছে খয়েরী নাগরাতে।

অথবা

দু’টো টি-শার্ট বেনেটন, আর একটা টি-শার্ট পোলো,

সব মিলিয়ে দীপাঞ্জনের তিনটে টি-শার্ট হ’ল।

তিন বোতলে সাজিয়ে দিলাম পোলোর প্রসাধন।

শ্যাম্পু দিলাম, ডিওডোরেন্ট – সঙ্গেতে কোলন।

***

তবে শুধু বর কনেরই নয় , সঙ্গে দিতে হয় ননদের জন্যেও কিছু উপহার । তার জন্যে লেখা –

খুকুমণি ননদিনী এই ডালাটা তারই

টুকটুকে পাড় সবুজ রঙের দক্ষিণী সিল্ক শাড়ী

শাড়ীর সাথে বাক্স ভরে বিবিধ প্রসাধনী।

মেয়েকে মোদের সুখী রেখো, দোহাই ননদিনী।

***

সবিনয়ে জানাই এ লেখাটির উদ্দেশ্য শুধুমাত্র পাঠককে স্মৃতিমেদুর করে দেওয়া নয়। তার সঙ্গে আরো একটু অন্য বাসনাও আছে।

আসলে আমরা এমন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি যখন বাঙালির কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল তার বাঙালিত্ব বজায় রাখা । ভয়টা শুধু ‘বহিরাগত’দের থেকেই নয়। আমরা নিজেরাই ভুলে যাচ্ছি আমাদের পরম্পরার অভিমান, ঐতিহ্যের বহমানতা। এখন সবেতেই গোঁজামিল, সবেতেই নকলনবিশি। আমরা শুধু একটা দুটো বিশেষ দিনকে বেছে নিই আমাদের বাঙালিয়ানা প্রকাশ করার দিন হিসেবে। যেন বাকি সব দিনগুলো বাঙালিত্ব ভুলে থাকলেও ক্ষতি নেই ।

ব্যাপারটা কিন্তু তেমন নয় । বাঙালির সংস্কৃতি শুধু তার সাহিত্য, সিনেমা, গানবাজনার মধ্যেই আবদ্ধ নেই । আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক কিছুর মধ্যে আমাদের বাঙালি স্বকীয়তা লুকিয়ে আছে । সেই স্বকীয়তা বজায় রাখতে গেলে সেই চেষ্টা আমাদের নিজেদেরই করতে হবে ।

বিয়ে নিয়ে যখন কথা হচ্ছে, তখন বলি মেহেন্দি লাগানোর রীতিটি যদিও অন্য প্রদেশ থেকে এসেছে, তা হলেও তা থাকতেই পারে আমাদের বিয়েতেও । কিন্তু মেহেন্দির কারুকাজে আমাদের সাবেকি আল্পনার ডিজাইনের ধরনটি আনা যায় কী না ভেবে দেখা যেতে পারে। বিয়ের আগের দিন সন্ধেবেলায় সঙ্গীত অনুষ্ঠানটি অন্য প্রদেশ থেকে আনা হলেও তা বেশ ভাল। আসলে আমাদের গ্রামগঞ্জের বিয়েতেও পাড়াপড়শি মিলে গান গাওয়ার রীতিটা আগেও ছিল। জানি, কালের দাবী মেনে নিয়ে আজকালকার ‘সঙ্গীত’ অনুষ্ঠানে নাচের উপযোগী গান চাই। সত্যিই তো, নাচ তো আনন্দের প্রকাশভঙ্গী। কিন্তু সেখানে যদি ‘বদতমিজ দিল’ জাতীয় গান না গেয়ে ( বা বাজিয়ে) – ‘লীলাবলি লীলাবালি’ জাতীয় গান গাইলে (বা বাজালে) কেমন হয় তা ভাবা যেতে পারে। খাবার মেনুতে অন্য যাই থাক প্রথম পাতের লম্বা করে কাটা বেগুন ভাজাটি , লুচির সঙ্গে নারকেল কুচি দেওয়া ছোলার ডালটি নাহয় রেখে দেওয়া যাক ।

পার্লার থেকে যেমনই সাজানো হোক কনের সেই সনাতন লাল চেলি আর কপালে চন্দন কুমকুমের কারুকাজটি আগের মতই রেখে দিলে কেমন হয়? জোড়া পান পাতায় মুখ ঢাকার রেওয়াজটি, এখন আর তেমন গুরুত্ব নেই, তবু রেখে দিলে ক্ষতি তো কিছু নেই। কনের হাতের কাজল লতাটি আর বরের রুপোর জাঁতিটি ফিরে আসুক না আবার। পিটুলি গোলা দিয়ে আলপনা দেওয়া, তিল, নারকেল, গুড়, ময়দা দিয়ে পাড়া-পড়শি মিলে আনন্দনাড়ু বানানো, বাসর জাগানির টাকা আদায় করার ছদ্ম কলহ এ সব যতই অর্থহীন লাগুক আধুনিকত্বের পটভূমিতে, এর মধ্য দিয়েই থাক না আমাদের বাঙালি হয়ে থাকার ইচ্ছের প্রকাশ ।

আর সেই হারিয়ে যাওয়া বিয়ে পদ্য – সেটাও যদি ফিরিয়ে আনা যায়, কেমন হয় ?

আমার মনে হয় অনেক সময় কিছু প্রতীকী ব্যাবস্থার মধ্যে দিয়ে কিছু স্বাভিমান বেঁচে থাকে। এই ধরণের কিছু চেষ্টা করা খুব একটা কঠিন নয়, যদি আমাদের বাঙালিত্ব বজায় রাখার ইচ্ছেটা খাঁটি হয়ে থাকে।

(নিচের ছবিটি বিয়ের পদ্য সংকলনের একটি নমুনা)

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


5 1 vote
Article Rating
4 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Sourav Howlader
6 months ago

ভালো লাগল। আনন্দ পালনের মধ্যেও যে স্বকীয়তা আর আর পরম্পরা ধরে রাখা যায়, এই লেখাটি সেই সম্ভবনাকে উসকে দিল।

প্রসঙ্গত আমার বাবা মায়ের এই বিশেষ দিনে প্রকাশিত কবিতার কাগজটি, ছোটকালে আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। সে বড়ই মজার, কালের নিয়মে সে কোথায় হারিয়েছে, জানি না।

আমি ব্যক্তিগত ভাবে বেশ কিছু নিকটাত্মীয়ের বিয়ের তত্বে অনুরূপ ছবি সহ কবিতা রচনার চেষ্টা করেছি। সব মিলিয়ে সে অভিজ্ঞতার সঙ্গে এখনকার সঙ্গীত, ডি-জে, হলদি-র উচ্চকিত দাপট স্পর্শ করে না।

Somen Dey
Somen Dey
Reply to  Sourav Howlader
29 days ago

সেই বিয়ের তত্বের সঙ্গে যা লেখা হয়েছিল তার দু একটা কি মনে আছে ? পাঠকজনের আনন্দার্থে যদি দেওয়া যায় এখানে …।

Alak Baauchoudhury
Alak Baauchoudhury
1 month ago

আমাদের প্রজন্মের কাছে পরিচিত এই বিয়ের পদ্য এমন একটি বিষয় যা আধুনিক প্রজন্মের কাছে প্রায় অজানা। আপনি বিয়ের সংক্রান্ত কবিতার যে নানা রকম নিদর্শন নানা স্থান থেকে সংগ্রহ করেছেন সেজন্য আপনাকে সাধুবাদ জানাই। আমাদের ছোটবেলা পর্যন্ত এগুলো আমরা দেখেছি। আমার বাবা অনেকের বিয়েতে এরকম কবিতা লিখে দিয়েছেন, কিন্তু আমাদের প্রজন্ম থেকেই এই প্রথা লুপ্ত হতে শুরু করে। বর্তমানে যৌথ পরিবার প্রায় উঠে যাওয়াতে এই জাতীয় কবিতার প্রাসঙ্গিকতা ও মজা অনেকটা হারিয়ে গেছে। এই প্রথা আবার শুরু করার যে প্রস্তাবটি আপনি করেছেন, সেটা ভেবে দেখার মতো, যদিও আধুনিক রুচির কাছে এই কবিতার রস কতটা গ্রহণযোগ্য হবে সেটাও একটা বিচার্য বিষয় ।

আমার সংগ্রহে এরকম কিছু প্রাচীন বিয়ের পদ্যের নিদর্শন এখনো রয়েছে, যা আমার পারিবারিক স্মৃতিচিহ্ন বলা চলে। আমাদের ছোটবেলাতেও আমরা এরকম বিয়ের কবিতা কিছু দেখেছি। আমার ছোটদাদু প্রীতীশচন্দ্রের বিয়ে উপলক্ষে প্রথম কবিতাটি লেখা হয়েছিল তাঁর তিন ভাইপো ভাইঝির নামে, শিরোনাম :- “কাকামনির শুভ-পরিণয় উপলক্ষে”।
সে-যুগের এই বিয়ের কবিতাগুলোর কিছু বাঁধা গৎ থাকত, যেমন পরিবারের সকলের আনন্দ অনুভূতি, যাদের জবানিতে বক্তব্যটি পরিবেশিত হচ্ছে, তাদের সঙ্গে বর বা কনের পারিবারিক সম্পর্ক অনুযায়ী যথোচিত শুভেচ্ছা, আশীর্বাদ বা হাসিতামাশা এবং সবশেষে “মঙ্গলময়” ঈশ্বরের কাছে নবদম্পতির আগামী জীবনের জন্য আশীর্বাদ প্রার্থনা। এখানে উল্লিখিত চিঠিটির শুরুর স্তবকটি ছিল এরকম:- “আনন্দ ছুটিছে আজ/ পরিয়া নূতন সাজ/ ভুলিয়া আপন কথা পুলক-চঞ্চল,/ ওই দেখ যায় দেখা/ ঠাকুমার মুখে আঁকা/ মৃদু-চাপা-হাসি-রেখা অতীব উজল!”
কবিতাটির শেষের দিকের দুটি স্তবক:- “….মিলনের অবসানে/ বাঁধি অতি সযতনে/ অঞ্চলের এক কোনে কাকীমা-রতন/ ফিরিবেন কাকামণি/ আনন্দিত চিত্তখানি–/ অভিযানের হবে এক নব আয়োজন।/ পারুল বকুল হাসি’/ ছড়াইবে গন্ধ রাশি,/ গোপাল বাজাবে বাঁশি সুদূর প্রান্তরে;/ আকাশে হিমাংশু আভা/ ফুটিবে কী মনোলোভা/ বিভু-পদ আনি’ দিবে সুশান্তি অন্তরে!” এখানে যে কাব্যালঙ্কার প্রয়োগ করা হয়েছে সেটি বোঝা যাবে, যদি জানিয়ে রাখা যায়, এখানে উল্লিখিত পারুল আর বকুল আমার দুই পিসীমার আর গোপাল আমার বাবার নাম। উদ্ধৃত শেষ পংক্তিতে (“বিভু-পদ আনি দিবে সুশান্তি অন্তরে’) ঢাকা রয়েছে প্রীতীশচন্দ্রের অপর দুই ভাইপোর নাম শান্তি ও পদ)! কবিতার নীচে লেখা হয়েছে “কাকামনির ও নব পরিচিতা কাকীমার স্নেহের/ গোপাল, পদ ও বকুল”।

FB_IMG_1725195177989
Somen Dey
Somen Dey
Reply to  Alak Baauchoudhury
29 days ago

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ । খুব মূল্যবান সংযোজন করেছেন । যদি আলাদা করে আরো একটা লেখা লেখেন এই বিষয়ে বা এই রকম হারিয়ে যাওয়া বিবাহরীতি নিয়ে তা হলে বেশ হয় ।একটু ভেবে দেখবেন ।