১৮৮০ সালের ২৭ শে জুন আলাবামা রাজ্যের দক্ষিণে টাসকামবিয়া নামের একটি ছোট শহরে হেলেন কেলারের জন্ম হয়। স্বাভাবিক অবস্থায় জন্মালেও দু বছর বয়সে সম্ভবতঃ স্কারলেট ফিবারে আক্রান্ত হয়ে তার দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি – দুটিই নষ্ট হয়। একটু একটু করে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে যখন বুঝতে পারে, বাইরের জগৎ, যাকে সে ছুঁতে পারে কিন্তু বুঝতে পারে না, তখন সে ধীরে ধীরে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। হেলেন বুঝতে পারত না, সে কে, তার কি কি দরকার। সে চিৎকার করত, কিন্তু দুঃখ কাকে বলে জানত না। রেগে গেলেও বুঝতে পারত না যে সে রেগে গেছে। তার জীবন ছিল ভালবাসা এবং ধারণা-শূন্য। মানুষ ভাবে, ইচ্ছে প্রকাশ করে, মনে রাখে – সবই ভাষা দিয়ে। কিন্তু তার জগৎ ছিল শব্দহীন।
তার পাঁচ বছর বয়েসের সময় তার একটি ছোটবোন মিল্ড্রেড-এর জন্ম হলে হেলেন যখন অনুভব করে যে মায়ের কোলে তার একজন প্রতিযোগী এসেছে, তখন সে বোনকে ঘৃণা করতে শুরু করে। একদিন তার পুতুলের দোলনার কাছে গিয়ে যখন সে বুঝতে পারে যে, শিশুটি সেখানে শুয়ে আছে, তখন সে দোলনাটা উল্টে বোনকে ফেলে দেয়।
মা বাবা দ্বিতীয় সন্তানটির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হন। বাবা প্রস্তাব দেন হেলেনকে সরকারী উন্মাদ আশ্রমে পাঠাবার। কিন্তু হেলেনের মা তাঁকে থামিয়ে দিয়ে একটা শেষ চেষ্টা করতে বলেন। তিনি খবরের কাগজে পারকিন্সে লরার চিকিৎসার কথা পড়েছিলেন। স্বামীকে একবার সেখানে চিঠি লিখে কোনো ব্যবস্থা হয় কিনা জানার জন্য অনুরোধ করেন।
ক্যাপ্টেন কেলারের চিঠিতে আর্ত আবেদন পেয়ে মিঃ অ্যানাগনস প্রথমে সমস্যায় পড়েন কারণ পারকিন্সে লরার মত আর একটি মেয়ের দায়িত্ব নেবার মত অবস্থা ছিলনা। শেষ পর্যন্ত তিনি অ্যানিকে ক্যাপ্টেন কেলারের চিঠিটিসহ প্রস্তাব দিয়েছিলেন হেলেনের দায়িত্ব নেবার জন্য।
হেলেনকে শেখানোর প্রথম ধাপটা অ্যানির কাছে রীতিমত কঠিন ছিল। একজন নতুন মানুষকে গ্রহণ করার ব্যাপারে হেলেনের মধ্যে প্রতিরোধ ছিল মাত্রাছাড়া। বোঝার বয়সে পড়ার পর থেকে হেলেন যা করতে চাইত ওর পরিবারের সবাই সেটা ওকে করতে দিতে বাধ্য হত ওর জেদী বিক্ষোভকে এড়ানোর জন্য। ফলে ওর মধ্যে একটা স্বৈরাচারী স্বভাব তৈরী হয়ে গিয়েছিল। অ্যানিকে প্রথমে ওকে বাধ্যতা শেখানোর জন্য বলপ্রয়োগ পর্যন্ত করতে হয় এবং ওর মা-বাবার কাছ থেকেও প্রথম দিকে কিছুটা আপত্তি ওঠে। অ্যানিকে কঠিনে কোমলে মিশিয়ে তাঁদের বোঝাবার চেষ্টা করতে হয়। একমাত্র হেলেনের মা কেটি কেলার তাঁর উদ্দেশ্য পরে বুঝতে পেরে তাঁর সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করেন এবং ক্যাপ্টেন কেলারকেও তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা করতে অনুরোধ করেন।
অ্যানি বুঝতে পেরেছিলেন যে, প্রাথমিকভাবে হেলেনকে ওর পরিবারের থেকে আলাদা করে না নিলে ওকে তাঁর বাধ্য করা যাবে না। সেই ব্যবস্থা করিয়ে অ্যানি খুব অল্প দিনের জন্য অন্য জায়গায় ওকে নিয়ে একা থাকেন এবং ধীরে ধীরে ওকে শেখানোর কাজ শুরু করেন। শেখানোর কাজ অবশ্য তিনি একেবারে প্রথম দিন থেকেই শুরু করেছিলেন। প্রথমে উনি হেলেনকে ম্যানুয়াল বর্ণমালার সাহায্যে কতগুলি শব্দ শিখিয়েছিলেন।হেলেন একটা নতুন খেলা হিসাবে সেগুলি শিখছিল। পরে কোন বস্তুকে ওর হাত দিয়ে স্পর্শ করিয়ে সেই বস্তুগুলোর নাম ওর হাতে লিখে দিয়ে নামের সাথে বস্তুটির যোগাযোগটা বুঝিয়ে দেন। হেলেন যখন সেটা বুঝতে পেরে যায় তখন সে শেখার আনন্দে প্রতিদিন নতুন নতুন শব্দ শিখতে থাকে ক্লান্তিহীন ভাবে।
হেলেনের সেই বোঝার প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা একটু বিশদভাবে বলা দরকার। হেলেন যখন প্রথম বুঝতে পারে যে, প্রত্যেকটা বস্তুর একটা নিজস্ব নাম আছে, তখন সে ইশারায় তার নিজের নাম জানতে চায়। অ্যানি তার হাতে Helen লিখে দেন। তারপর সে অ্যানির নাম জানতে চায়। অ্যানি তার হাতে Teacher লিখে দেন। হেলেনের মন সেদিন এত আনন্দে ভরে উঠেছিল যে সেদিন সারাদিন ধরে সে নতুন নতুন শব্দ শিখে চলে। রাতে ঘুমোবার সময় সেই প্রথমবার সে অ্যানির গালে চুমু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
এরপর হেলেন দৃষ্টিহীনদের জন্য তৈরি বিশেষ বর্ণমালার সাহায্যে অক্ষর শিখে খুব অল্প সময়ের মধ্যে শব্দ তৈরী করতে শিখে যায় এবং একদিন নিজে থেকে সেই বিশেষ বর্ণমালার সাহায্যে একটি পূর্ণ বাক্য লিখে ফেলে অ্যানিকে রীতিমত অবাক ও খুশী করে দেয়। পরের ধাপে অ্যানি তাকে লিখতে শেখান যাতে সে তার ভাবনাগুলি লিখে জানাতে পারে। তারপর তাকে ব্রেল বর্ণমালা শিখিয়ে দেন যাতে সে নিজে নিজে পড়তে ও লিখতে পারে। এই শেখানোর পদ্ধতি যে কতটা ধৈর্যের ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, আমরা সাধারণ মানুষরা তা কল্পনাও করতে পারি না। কিন্তু হেলেন ছিল এতটাই প্রাণবন্ত এবং তার শেখার আগ্রহ এতটাই প্রবল যে অ্যানির পক্ষে এই দুর্গম পথ পেরোনো কিছুটা সহজ হয়।
এরপর অ্যানি তাকে উন্মুক্ত প্রকৃতিতে নিয়ে যান। একটি একটি করে বাইরের জীবজন্তু,গাছ, ফুল, ফল ও পাতার সাথে তার হাতের স্পর্শের সাহায্যে পরিচয় করাতে থাকেন। নাকের কাছে বিভিন্ন জিনিস এনে গন্ধ চিনতে শেখান। হেলেনের খেলার সাথী হয়ে, জল দিয়ে মাটি মেখে, তাই দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্র তৈরী করে স্পর্শের সাহায্যে হেলেনকে পাহাড়, নদী, জঙ্গল, আগ্নেয়গিরি ইত্যাদির সাথে পরিচয় করান। সে’সবের অপূর্ব বর্ণনা তার হাতে লিখে লিখে বুঝিয়ে তাকে প্রকৃতির পাঠ দেন। হাতের তালুতে তুলে দেন জ্যান্ত ব্যাঙ, প্রজাপতি, ঝিঁঝিঁ পোকা, যাতে হেলেন তাদের প্রাণের স্পন্দন অনুভব করতে পারে। চাষের মাঠে নিয়ে গিয়ে তাকে শেখান,কেমন করে চাষীরা ক্ষেতের মাটি তৈরী করেন বীজ পোঁতার জন্য, কিভাবে রোদ বৃষ্টি মাটিকে সাহায্য করে গাছের জন্ম দেবার জন্য, যে গাছ ফল ফুল দেয়, আশ্রয় দেয় পাখি ও অন্যান্য জীবজন্তুদের ।
হেলেনের বয়স এখন সাত। কিন্তু এখনও নিজের সম্পর্কে তার অনেক জানা বাকি। অসুখের পর থেকে সে কোনদিন হাসেনি।
একদিন অ্যানি জোরে জোরে হাসতে হাসতে হেলেনের ঘরে ঢুকে তাকে অনুভব করাতে চাইলেন তাঁর হাসিমাখা ঠোঁট,গলার শিরার কাঁপন,শরীরের ঝাঁকুনি। সেই সঙ্গে হেলেনের ভ্যাবাচ্যাকা হাতে লিখে দিলেন LAUGH। তারপরেই হেলেনকে বিছানায় তুলে দিয়ে কাতুকুতু দিতে দিতে বারবার লিখে যাচ্ছিলেন LAUGH।
হঠাৎ হেলেন হাসতে শুরু করল।প্রথমে মৃদু, তারপর মুচকি হাসি, তারপর হো হো করে। পাশের ঘর থেকে হেলেনের মা বাবা অনেকদিন পরে হেলেনের হাসির আওয়াজ পেয়ে আনন্দে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি।
একদিন অ্যানি তাকে যোগের অঙ্ক শেখাচ্ছিলেন। বার বার চেষ্টা করেও হেলেন কিছুতেই সেটা করতে পারছিল না। অ্যানি তার কপালে টোকা দিয়ে তার হাতে লিখে দিলেন ‘THINK’ – মুহূর্তের মধ্যে হেলেন অনুভব করল যে, তার মাথার ভিতর তখন ওই কাজটাই চলছিল, চিন্তা করা। সেইদিন প্রথম হেলেন এমন একটা শব্দ আর তার মানে শিখল, যেটা হাতে ধরিয়ে শেখান যায়না। অর্থাৎ যেটা কোন বস্তু নয়।
তার আগেই হেলেন একটা শব্দ জেনেছিল, ‘LOVE’ । বারবার অ্যানিকে জিজ্ঞাসা করে ঠিক উত্তরটা বুঝতে পারছিল না। নতুন যে শব্দটা সে জেনেছিল ,তার আলোয় সে LOVE কথাটার অর্থ বোঝার চেষ্টা করছিল। সেদিন আকাশ মেঘে ঢাকা ছিল, মাঝে মাঝে একটু একটু বৃষ্টি পড়ছিল।তারপর হঠাৎ রোদে আকাশ ভরে গেল। হেলেন জিজ্ঞাসা করল, ‘এটাকেই কি ভালবাসা বলে?’ অ্যানি উত্তর দিলেন, ‘LOVE হচ্ছে ওই মেঘের মত, যেটা রোদ ওঠার আগে আকাশে ছিল। তুমি তো মেঘকে ছুঁয়ে দেখতে পারনা, কিন্তু তা থেকেই বৃষ্টি হয়, এটা বোঝ। তৃষিত মাটি ও ফুলেরা গরম দিনের পরে বৃষ্টি পেয়ে কেমন আনন্দিত হয়, এটাও বুঝতে পার। তেমনি ভালবাসা তুমি ছুঁয়ে দেখতে পারনা। কিন্তু এটা বুঝতে পার যে, ভালবাসা সবাইকে বা সবকিছুকে খুশি করে তোলে।’
তখন হেলেনের মনে হয়, তাহলে ভালবাসা হচ্ছে তেমন কতগুলি অদৃশ্য রেখা, যেগুলি তার মন থেকে অন্যের মন পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়ে তার মনকে অন্যের মনের সাথে যুক্ত করে উভয়কেই খুশী করে।
এভাবেই অ্যানি হেলেনকে নির্বস্তুক (abstract) শব্দের ধারণা দিয়েছিলেন।
১৮৮৭ সালের ৩১শে জুলাই অ্যানি লরা ব্রিজম্যানের কাছ থেকে চিঠি পান। অক্টোবর মাসেই তিনি পারকিন্স ইনস্টিটিউশনের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে হেলেনের পত্রবন্ধুত্ব শুরু করেন। ১৮৮৮ সালের জুন মাসে অ্যানি হেলেনকে নিয়ে পারকিন্স ইনস্টিটিউশনে যাবার জন্য মিঃঅ্যনাগনসের কাছ থেকে আমন্ত্রণ পান এবং সেখানে যান। সেখানকার শিশুদের সঙ্গে হেলেনের সময় খুব মজায় কাটে।মিঃ অ্যনাগনসের মনে অ্যানির ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব উদ্বেগ ছিল। তিনি অ্যানিকে পারকিন্স ইনস্টিটিউশনে হেলেনকে নিয়ে থাকার এবং সেখানকার বাচ্চাদের পড়াবার চাকরি নিতে বলেন। কারণ, তার ধারনা ছিল, হেলেন এর বেশী এগোতে পারবে না। অ্যানি সাথে সাথেই সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ, তিনি জানতেন একটি ঘরে আজীবন আবদ্ধ থাকার জীবন হেলেনের নয়।
১৮৯০ সালে হেলেনকে কথা বলা শেখান শুরু হয়। অ্যানি তাকে হোরেস মান স্কুলের প্রিন্সিপাল মিস সারা ফুলারের কাছে নিয়ে যান। মিস ফুলার কথা বলা শেখানোর সময় হেলেনকে তাঁর মুখের ভিতরে আঙুল ঢুকিয়ে কথা বলার সময় তাঁর জিভ ও ঠোঁটের অবস্থান অনুভব করতে দিতেন। হেলেন সেগুলি অনুকরণ করে উচ্চারণ করার পদ্ধতি খুব তাড়াতাড়ি শিখে নিয়েছিল। মিস ফুলার তাকে মোট এগারোটা পাঠ দিয়েছিলেন। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সেগুলি অনুশীলন করানোর কাজটি অ্যানিই করেছিলেন। যতক্ষণ পর্যন্ত হেলেন একদম ঠিকঠাক উচ্চারণ করতে না পারত, অ্যানি ততক্ষণ পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরে তাকে অনুশীলন করাতেন।
১৮৯০ সালেই সবাই জানতে পেরেছিল হেলেন পৃথিবীতে দ্বিতীয় অন্ধ বধির বালিকা, যে নিজের মুখ দিয়ে কথা বলতে পারে। বারো বছর বয়েসে হেলেন শান্তভাবে ঘোষণা করেছিল, একদিন সে হাভার্ড কলেজে পড়তে যাবে। অনেকের মনে সংশয় ছিল, যারা দেখতে শুনতে পায় তাদের সঙ্গে ওই উচ্চস্তরে হেলেন কি করে পাল্লা দেবে? কিন্তু অ্যানির মনে কোন সংশয় ছিল না। তিনি শুধু বলেছিলেন, হাভার্ড নয়, হেলেন।ওটা ছেলেদের স্কুল।
ধাপে ধাপে হেলেনের স্কুল কলেজের শিক্ষা এগিয়ে গিয়েছিল। অ্যানি ছায়া সঙ্গিনীর মত হেলেনের পাশে ছিলেন। শিক্ষার পথে যত রকমের বাধা এসেছিল, নিজের উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে হেলেনকে সেই বাধা উত্তীর্ণ হতে সাহায্য করেছেন। হেলেন তার চেতনার দিগন্ত যতটা বিস্তৃত করতে চেয়েছে অ্যানি তাঁর সর্বশক্তি দিয়ে পথ কেটে হেলেনকে এগিয়ে দিয়েছেন। অ্যানির জন্য কোন চেনা পথ ছিলনা। ডা: হাওয়ে শুধু তাঁকে একটি পথের আভাস দিয়েছিলেন। বাকী পথটা অ্যানির নিজের আবিষ্কৃত।
১৯০০ সালে হেলেন Radcliffe কলেজে সাধারণ ছাত্রীদের সাথে ভর্তি হয়ে ১৯০৪ সালে গ্র্যাজুয়েট হয়ে বেরিয়ে আসে। হেলেনের এই সাফল্যের পিছনেও অ্যানির অবদান অপরিহার্য্য ছিল। ক্লাসে লেকচার চলার সময় অ্যানি ঝড়ের গতিতে হেলেনের হাতে লিখে হেলেনকে লেকচার হৃদয়ঙ্গম করাতেন।সারা পৃথিবীর অন্ধ বধির ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সে শ্রেষ্ঠতম বিবেচিত হয়। সেই সাথে সকলের অ্যানির দিকে নজর পড়ে। একটি পত্রিকার একজন লেখক অ্যানির কাছে তাঁকে নিয়ে একটি লেখা প্রকাশের ইচ্ছা প্রকাশ করেন, অ্যানি সরাসরি তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন।তিনি সারাজীবন প্রচারের আড়ালে শুধু টিচার হয়েই থাকতে চেয়েছিলেন। তাই অ্যানির জীবনের বেশির ভাগ তথ্যই জানার জন্য হেলেনের লেখার উপর নির্ভর করতে হয়।
Radcliffe কলেজে পড়ার সময় থেকেই হেলেন পত্রপত্রিকায় লেখালিখি শুরু করে। আমেরিকার সেই সব পত্রপত্রিকায় যখন সে তার জীবনের কথা লেখে, তার জীবনের প্রতিটি পর্বের কথায় তার টিচারের অবদানের কথা লিখতে সে তার শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার ঝুলি উজাড় করে দিয়েছিল। তার অস্তিত্ব অ্যানির সাহায্য ছাড়া যে অসম্ভব ছিল, সেকথা সে বার বার নানা ভাবে বলেছে।
শিক্ষা শেষ করার পরে হেলেন অন্ধ ও বধির মানুষদের সমস্যা নিয়ে সবাইকে সচেতন করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে সারা পৃথিবী ঘুরে বক্তৃতা দিয়েছিল যাতে সেই মানুষদের অবস্থার উন্নতি হয়। সে সময়েও অ্যানি তার পাশে যতদিন সম্ভব হয় থেকেছেন। চোখের আবছা দৃষ্টি নিয়ে হেলেনের জন্য প্রচুর পড়াশোনা করতে গিয়ে তিনি নিজের দৃষ্টিশক্তি ক্রমশ হারিয়ে ফেলেছিলেন। তাঁর সেই বিস্ময়কর কর্মশক্তি ও ফুরিয়ে আসছিল। ১৯২০ সালে তিনি হেলেনের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। তবে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যখন
হেলেনের সাক্ষাৎ হয় তখন অ্যানি তার সাথে ছিলেন।
অ্যানির বিদায়ের সময়ে একটা প্রশ্ন উঠেছিল, তাঁকে ছাড়া হেলেনের কিভাবে চলবে? অ্যানি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ তাহলে বলতে হয়, আমি ব্যর্থ হয়েছি।’ তাঁর সারাজীবনের সাধনাই তো ছিল হেলেনকে স্বাধীন করে তোলা। ১৯৩৬ সালের ১৯ শে অক্টোবর অ্যানির মৃত্যু হয়।
অ্যানির সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হবার পর প্রথম দিকে হেলেনের মনে এক শূন্যতা সৃষ্টি হয়। হেলেন একসময় ভাবছিল, সে থেমে যাবে। কিন্তু যখন তার মনে হয় টিচার তো কোনদিন এটা চাননি, তখন গভীর বেদনা বুকে নিয়েও নতুন উদ্যমে সে তার জীবনের লক্ষ্যে এগিয়ে গিয়েছিল।
অ্যানি সালিভানের জীবন পরিক্রমা করে আমার যা মনে হয়েছে, সেটা লিখছি :
অ্যানির জীবনপ্রবাহ যেন হেলেনের জীবন সার্থক এবং পরিপূর্ণ করে তোলার জন্য নিয়তি নির্দিষ্ট ছিল। নদী যেমন উৎস থেকে বেরিয়ে একদিন সমুদ্রে পৌঁছয়, তাঁর জীবনের যাত্রাপথ তেমনই একমুখী ছিল।
দুঃখ, যন্ত্রণা, উপেক্ষা, অবহেলা দিয়ে তাঁর জীবন শুরু হয়েছিল বলেই তিনি ভালবাসার প্রকৃত মূল্য উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং সেই ছোট ছোট ভালবাসার ছোঁয়া তাঁকে ধীরে ধীরে শান্ত ও আত্মস্থ করেছিল। এই ভালবাসার স্মৃতিই পরবর্তী জীবনে তাঁকে প্রভাবিত করেছিল হেলেনের জীবনে পরিপূর্ণতা এনে দেবার সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করতে।
অবরুদ্ধ চেতনার মুক্তির জন্য শিক্ষাই যে একমাত্র উপায় তা তিনি ওই ছোট বয়েসেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এটা তাঁর দুঃখ-কষ্টে ভরা জীবনের উপহার।’ দুঃখের তিমিরে’ তিনি ‘মঙ্গল-আলোক’ এর সন্ধান পেয়েছিলেন।
কোন পিছুটান না থাকায় হেলেনের পাশে থাকার ব্যাপারে তাঁর কোন বাধা আসেনি। ১৯০৫ সালে জন অ্যালবার্ট ম্যাসি নামে এক যুবকের সাথে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু ১৯১৪ সালে সেই সম্পর্কটা ভেঙে যায়।
সব শেষে বলব,তাঁর অন্তরের মাতৃসত্বার সাথে তাঁর শিক্ষক সত্তাকে মিলিয়ে শিক্ষাদানের কাজটিকে তিনি এমন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন যে সেটা বিশ্ববাসীর কাছে মাতৃত্ববোধের এক উজ্জ্বলতম উদাহরণ হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। যুগে যুগে যে সব মায়েরা তাঁদের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তানদের জীবনের মূলস্রোতে আনার জন্য প্রতিদিন লড়াই করে যাচ্ছেন, তাঁদের কাছে তিনি একজন শ্রেষ্ঠ প্রেরণাদাত্রী হয়ে রইলেন।
অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের মনে হয়েছিল, অ্যানির কীর্তি আধুনিক শিক্ষা বিজ্ঞানের সব আবিষ্কারের চাইতে বড়।
ঋণ স্বীকারের ব্যাপারে একটু বিস্তারিত বলার দায়বদ্ধতা অনুভব করছি।
বাংলা অনুবাদে প্রকাশিত অ্যানি সালিভান হেলেন কেলারের ‘টিচার’ বইটির পরিচয় কয়েক বছর আগে করিয়েছিলেন শ্রীমতী বোলান গঙ্গোপাধ্যায়। আগ্রহী হয়ে বই পাড়া থেকে বইটি সংগ্রহ করেছিলাম। মিকি ডেভিডসনের ইংরাজিতে লেখা মূল বইটির আবিষ্কার এবং প্রকাশের কৃতিত্ব ‘সোসাইটি ফর দ্য ভিসুয়ালি হ্যান্ডিক্যাপড’ (এস.ভি.এইচ.) – এর সম্পাদক শ্রীমতী হেনা বসুর। অনুবাদ করেছেন এস. ভি. এইচ.-এর শুভার্থী শ্রী সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুবাদের ভাষা সুখপাঠ্য, প্রাঞ্জল এবং সংক্ষিপ্ত। আমার মতো অলস মানুষের কাছে দারুন পছন্দের। আমার লেখার বেশ অনেক জায়গায় আমি ওঁর ভাষা হুবহু তুলে দিতে বাধ্য হয়েছি।বইটির ভূমিকা থেকে এস.ভি.এইচ.-এর কর্মকাণ্ডের একটা বিশেষ পরিচয় পেয়েছি। এঁদের সকলের কাছে আমার অনেক কৃতজ্ঞতা।
নারীরা অনুযোগ করেন যে, নারীদের কীর্তির কথা আজও নারীদেরই লিখে জানাতে হয়। এই কাহিনীর মূল চরিত্র দুই অসামান্যা নারী। এক্ষেত্রেও কিন্তু আশ্চর্য সমাপতন দেখতে পেলাম। মূল বইটির লেখক, আবিষ্কারক ও প্রকাশক এবং সর্বশেষ, যিনি পরিচিতি দিলেন, তাঁরা সকলেই নারী। সুতরাং তাঁদের অনুযোগ যে যথার্থ তারও একটা প্রমাণ আমরা এখনও পেলাম।
আমাদের অসংখ্য মানুষের মনোজগতের মূর্তিমান ঈশ্বর যিনি, সেই রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার সাথে অ্যানির জীবনের মর্মবাণী কেমন আশ্চর্যভাবে মিলে যায় সেটা জানাবার লোভ কিছুতেই সামলাতে পারলাম না। তাই কবিতাটি তুলে দিলাম।
পাখিরে দিয়েছ গান, গায় সেই গান,
তার বেশি করে না সে দান।
আমারে দিয়েছ স্বর ,
আমি তার বেশি করি দান,
আমি গাই গান।
বাতাসেরে করেছ স্বাধীন,
সহজে সে ভৃত্য তব বন্ধনবিহীন।
আমারে দিয়েছ যত বোঝা
তাই নিয়ে চলি পথে,কভু বাঁকা কভু সোজা –
একে একে ফেলে ভার মরণে মরণে
নিয়ে যাই তোমার চরণে
একদিন রিক্ত হস্ত সেবায় স্বাধীন;
বন্ধন যা দিলে মোরে
করি তারে মুক্তিতে বিলীন।
পূর্ণিমারে দিলে হাসি;
সুখস্বপ্নরসরাশি
ঢালে তাই ধরণীর করপুট সুধায় উচ্ছ্বাসি।
দুঃখ খানি দিলে মোর তপ্ত ভালে থুয়ে,
অশ্রুজলে তারে ধুয়ে ধুয়ে
আনন্দ করিয়া তারে
ফিরায়ে আনিয়া দিই হাতে
দিনশেষে মিলনের রাতে।
তুমিতো গড়েছ শুধু
এ মাটির ধরণী তোমার
মিলাইয়া আলোকে আঁধার।
শূন্য হাতে সেথা মোরে রেখে
হাসিছ আপনি সেই
শূন্যের আড়ালে গুপ্ত থেকে।
দিয়েছ আমার ‘পরে ভার
তোমার স্বর্গটি রচিবার।
আর সকলেরে তুমি দাও,
শুধু মোর কাছে তুমি চাও।
আমি যাহা দিতে পারি আপনার প্রেমে,
সিংহাসন হতে নেমে
হাসিমুখে বক্ষে তুলে নাও।
মোর হাতে যাহা দাও
তোমার আপন হাতে
তার বেশি ফিরে তুমি পাও।
[ছবিঃ আন্তর্জাল]
[পর্ব ১ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন]
চমৎকার লেখাটিতে এই মহীয়সী নারীর প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদিত। তাঁর The World I Live in গ্রন্থে ‘আমি চঞ্চল হে আমি সুদূরের পিয়াসী’ কবিতার শেষ দুটি ছত্রের অনুবাদ করে (কক্ষে আমার রুদ্ধ দুয়ার…) রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন হেলেন কেলার –
To Rabindranath Tagore.
Yes, Master,
I forget, ever forget, that the gates are shut everywhere in the house where I dwell alone!
Hellen Keller
4-2-1921
চমৎকার সংযোজন। হিমাদ্রীদা’কে অশেষ ধন্যবাদ।
এই মূল্যবান সংযোজনের জন্য হিমাদ্রিদাকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।
সমস্ত ব্যর্থতাকে অতিক্রম করে জ্যোতির্ময়ী হয়ে ওঠা
দুই নারীর জীবনসংগ্রামের মর্মস্পর্শী কাহিনী সহজ করে পরিবেশন করায় সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে
এই নিবন্ধটি।এই জন্য
চন্দনবাবুকে অনেক ধন্যবাদ।
আন্তরিক শ্রদ্ধা গ্রহণ করবেন।
দুটি পর্বে আলোকপথযাত্রী অ্যানি স্যালিভান ও হেলেন কেলারের সংগ্রামী জীবনের যে ছবি লেখক উপহার দিলেন, তা একদিকে অতীব মর্মস্পর্শী, অন্যদিকে মনোমুগ্ধকর।
এই মূল্যবান সংযোজনের জন্য হিমাদ্রিদাকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।
অসামান্য সংযোজন।
Somridho holam lekhati pore… anek subhechcha amon sundor lekhar jonno.
ধন্যবাদ।লেখাটা পড়ে ভাল লেগেছে জেনে উৎসাহিত হলাম।
দুটি পর্বে আলোকপথযাত্রী অ্যানি স্যালিভান ও হেলেন কেলারের সংগ্রামী জীবনের যে ছবি লেখক উপহার দিলেন, তা একদিকে অতীব মর্মস্পর্শী, অন্যদিকে মনোমুগ্ধকর।
উৎসাহিত হলাম।যাঁরা পড়বেন,তাঁদের ভাল লাগলে লেখা সার্থক হবে।
এই মূল্যবান সংযোজনের জন্য হিমাদ্রিদাকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।
অসাধারণ লেখা . সমৃদ্ধ হলাম 🙏
ধন্যবাদ।লেখাটা পড়ে ভাল লেগেছে জেনে উৎসাহিত হলাম।