শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

বাঙালির বিলেত যাত্রার আদি পর্ব এবং বেঙ্গল রেনেসাঁ

পনেরো-ষোলো দশকের ইয়োরোপের রেনেঁসার সঙ্গে উনিশ শতকের বাংলার রেনেসাঁর তুলনা টানাটা হয়ত বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে । একটি পরাধীন দেশের একটি অঙ্গরাজ্য বাংলায় যদি রেনেসাঁ আদৌ এসে থাকে, ইয়োরোপের তুলনায় অবশ্যই তা এসেছিল অনেকটাই খণ্ডিত, আড়ষ্ট এবং সীমাবদ্ধভাবে। সর্বাত্মকভাবে আসেনি। কিছু উন্নাসিক মানুষ এই কারণে এই রেনেসাঁকে একেবারেই নস্যাৎ করে দেন, আবার কেউ কেউ তা নিয়ে কিছুটা অতিরঞ্জিত আবেগে প্লাবিত হয়ে থাকেন । এ দুই মনোভাবই সম্ভবত ইতিহাসের বাস্তবতা থেকে দু’দিকে সরে যাওয়া । উনিশ শতকে এই বঙ্গ সংস্কৃতিতে যে একটা বড় আকারের জাগরণ ঘটে ছিল, যা বাঙালিকে, এই দেশে একটা সম্ভ্রমের জায়গাতে উন্নীত করেছিল, তাকে বেঙ্গল রেনেসাঁ অথবা যে নামেই ডাকি, তার প্রারম্ভিক প্রেরণা প্রাচীন ভারতের আদর্শ থেকে নয়, বরং এসেছিল সে সময়ের নবজাগ্রত ইয়োরোপ থেকে । বাঙালি যে তৎকালীন প্রাক-রেনেসাঁ সময়ের সঙ্কীর্ণ চিন্তাধারা, গতিহীন জীবন, ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসের নিগড়ে বাঁধা সমাজ থেকে খানিকটা হলেও উঠে দাঁড়াতে পেরেছিল; অন্তত শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা মননগত উন্নয়ন ঘটেছিল তা অস্বীকার করা যায় না। শহর কলকাতা ইংরেজদের প্রধান কার্যালয় হওয়ার ফলে বাঙালি হয়তো অন্য প্রদেশের তুলনায় একটু বেশি সুযোগ পেয়েছিল পাশ্চাত্য সভ্যতার আলোকের সঙ্গে নিজেকে পরিচিত করবার । কিছু মানুষ দেশে থেকেই ইয়োরোপের মনীষীদের চিন্তা, ভাবনা, মতবাদ, সৃষ্টি, এষণা থেকে নিজেদের চেতনায় ব্যাপ্তি ও ঔদার্য্য আনতে পেরেছিল । আবার কিছু মানুষ কালাপানির কল্পিত সীমারেখা ছাড়িয়ে বিলেত গিয়ে সে দেশ থেকে দর্শন, জ্ঞান, বিদ্যা, প্রযুক্তি সরাসরি আহরণ করে দেশের কাজে নিজেদের লাগাতে পেরেছিল । সেই সঙ্গে আবার অন্যদিকে কিছু অবাঞ্ছিত সাহেবিয়ানার মোহও ঢুকে পড়েছিল কিছু বাবু শ্রেণির মানুষের মধ্যে। তবে সব মিলে আমাদের রেনেসাঁয় বিলেত তথা ইয়োরোপের প্রতক্ষ্যভাবে ইতিবাচক প্রভাব ছিল । বলা যেতে পারে সে সময় শিক্ষিত বাঙালির একটি অংশের চেতনায় পশ্চিমী দৃষ্টির সঙ্গে প্রাচ্যাভিমানের এমন একটা শুভ সংযোগ ঘটতে শুরু করেছিল, যাতে অনেক দিন ধরে এক শ্লথ, বিষাদগ্রস্ত, হতোদ্যম সমাজে একটি নতুন প্রাণশক্তির উদ্দীপনা অনুভব করা যেতে লাগল।


ডি. এল. রায় মশাই নিজে একজন ‘বিলেত ফেরতা’ বাঙালি হয়েও ‘বিলেত ফের্ত্তা’ নামের একটি কবিতায় তৎকালীন বিলেত ফেরত বাঙালিদের দেশীয় রীতি রেওয়াজ ভুলে মনে প্রাণে সাহেব হয়ে ওঠার চেষ্টাকে তীব্রভাবে ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন –
‘…আমরা ছেড়েছি টিকির আদর
আমরা ছেড়েছি ধুতি ও চাদর
আমরা হ্যাট, বুট আর প্যান্ট কোট প’রে
সেজেছি বিলিতি বাঁদর।
আমরা বিলিতি ধরণে হাসি
আমরা ফরাসি ধরণে কাশি
আমরা পা ফাঁক করে সিগারেট খেতে
বড্ডই ভালোবাসি। … ‘


অবশ্য তারও আগে ১৭৮৪ শকাব্দে হুতোম প্যাঁচা তাঁর বিখ্যাত নক্সাতে বিলিতি আদব কায়দায় অনুরক্ত বাঙালি বাবুদের নিয়ে তাঁর সেই নিজস্ব শাণিত ভাষায় যা বলেছিলেন তার পুরোটা লিখলে সম্পাদক মশাই আপত্তি জানাতে পারেন । তাই কিছু অংশ বাদ দিয়ে উদ্ধৃত করছি –
‘টেবিল চেয়ারের মজলিশ, পেয়ালা করা চা, চুরোট, জগে ঝরা জল, ডিক্যান্টারে ব্র্যান্ডি ও কাচের গ্লাসে সোলার ঢাকনি, সালু মোড়া, হরকরা ইংলিশম্যান ও ফিনিক্স সামনে থাকে, পলিটিক্স ও ‘বেস্ট নিউজ অব দি ডে’ নিয়েই সর্ব্বদা আন্দোলন । টেবিলে খান, কমোডে হাগেন , এবং কাগজে – – । এঁরা সহৃদয়তা, দয়া, পরোপকার, নম্রতা, প্রভৃতি বিভিন্ন সদ্গুণে ভূষিত, কেবল সর্ব্বদাই রোগ, মদ খেয়ে জুজু , স্ত্রীর দাস – উৎসাহ , একতা, উন্নতেচ্ছা , একেবারে হৃদয় হতে নির্বাসিত হয়েছে , এঁরাই ওল্ড ক্লাস। ‘
রবীন্দ্রনাথ ১৮৭৮ সালে সতেরো বছর বয়সে জাহাজে চেপে প্রথমবার বিলেত গেছিলেন ব্যারিস্টারি পড়বার উদ্দেশ্য নিয়ে । আমরা জানি, শেষ পর্যন্ত তাঁর ব্যারিস্টারি পড়া হয় নি । তিনি দেড় বছরের মতন সময় ইংল্যান্ডে কাটিয়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন । বয়স মাত্র সতেরো হলেও রবীন্দ্রনাথ তখন সাহিত্যচর্চায় মন দিয়েছেন এবং নানা পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। তিনি তাঁর বিলেত যাত্রার এবং ওখানে বাস করার অভিজ্ঞতা কয়েকটি পর্বে পাঠিয়েছিলেন ভারতী পত্রিকার জন্যে । এই লেখাগুলিতে তিনি বেশ কিছু জায়গায় ইয়োরোপের মানুষ-জন এবং সেখানকার রীতিনীতির সমালোচনা যেমন করেছিলেন, তেমনি নিন্দা করেছিলেন বাঙালির সাহেব চাটুকারিতারও । বিলেতগামী জাহাজে যাত্রীদের সেবার জন্যে যে ইংরেজ ভৃত্যরা নিযুক্ত ছিল রবীন্দ্রনাথ তাদের মধ্যে বাঙালিকে সেই ফিরিঙ্গি ভৃত্যদের ‘স্যার স্যার’ বলে সম্বোধন করতে দেখেছিলেন। তাদের মনোবৃত্তির নিন্দা করে রবীন্দ্রনাথ ইঙ্গ-বঙ্গদের গাওয়া একটি গানের উল্লেখ করেছিলেন যার লাইনগুলি এই রকম –
‘এবার ম’লে সাহেব হব
রাঙ্গা চুলে হ্যাট বসিয়ে, পোড়া নেটিভ নাম ঘোচাব
সাদা হাতে হাত দিয়ে মা, বাগানে বেড়াতে যাব
আবার কালো বদন দেখলে ডার্কি বলে মুখ ফেরাব।’


আলাদা আলাদা সময়ে, বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের তিন জন পুরোধাপুরুষ তিন ভাবে বাঙালির ইংরেজ ভজনাকে নিন্দে করেছিলেন । বঙ্গ সমাজের বেশ কিছু মানুষ ইংরেজদের নির্লজ্জভাবে চাটুকারিতা করে নিজেদের জন্যে নানারকম সুবিধা আদায় করে নেবার প্রতিযোগিতায় যেমন মেতে উঠেছিলেন । কিন্তু এটি একটি দিক মাত্র । অন্যদিকে তার পাশাপাশি কিছু উজ্জ্বল মেধা এবং মুক্ত মনের বাঙালি কিন্তু সেই উনিশ শতকের প্রথম থেকেই পাশ্চাত্যের আলোকে নিজেদের আলোকিত করে সেই আলো সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দিতেও শুরু করেছিলেন । অনেকেই মনে করেন এই রেনেসাঁর সূচনা হয়েছিল রাজা রামমোহন রায়ের হাত ধরে । এবং এও মনে করেন কালাপানি পার হয়ে রামমোহন রায়ের বিলেত যাওয়া, বাঙালির ইতিহাসে একটি সন্ধিক্ষণ । রাজা রামমোহন রায় বিলেত যাত্রা করেন ১৮৩০ সালের ১৫ই নভেম্বর এবং ১৯৩১ সালের ৮ই এপ্রিল তারিখে লিভারপুলে পৌঁছান । কিন্তু এর অনেকদিন আগে আর এক বাঙালি অবশ্য বিলেত গিয়েছিলেন। ইতিহাসের স্বার্থে তার কথাও ভুলে গেলে চলবে না।


যতদূর জানা যায় বিলেত গিয়েছিলেন নদীয়া জেলার রাণাঘাটের কাছে পালপাড়ার আজগুবিতলার এক বাঙালি , যাঁর নাম ছিল মির্জা শেখ ই’তেসামউদ্দীন , তিনি বলা যেতে পারে একেবারে নিজের যোগ্যতায় বিলেতে গিয়েছিলেন। পলাশী যুদ্ধের পর যখন ইংরেজ এদেশে জাঁকিয়ে বসতে শুরু করেছে , সেই সময় ১৭৬৫ সালে দ্বিতীয় শাহ আলম ঠিক করলেন একটি অনুরোধপত্র এবং এক লক্ষ টাকার উপঢৌকন দিয়ে দূত পাঠাবেন ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় জর্জের কাছে। দূত নির্বাচিত হলেন এক ইংরেজ প্রশাসক। কিন্তু তার সঙ্গে একজন ভারতীয়কে পাঠানোর প্রয়োজন ছিল । সেই কাজের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন শেখ ই’তেসামউদ্দীন । ই’তেসামউদ্দীন একজন ফার্সি ভাষায় পণ্ডিত মানুষ ছিলেন। দীর্ঘ ছ’মাস ধরে যাত্রা করে তিনি জলপথে পৌঁছান ইংল্যান্ডে। ইংল্যান্ডের অভিজ্ঞতা নিয়ে ফার্সি ভাষায় একটি বই লেখেন। বইটির নাম – ‘শিগার্ফ নামা-এ-বিলায়েত’ । এই বইটি ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান ও স্প্যানিশ ভাষায় অনুদিত হয়। ইংরেজি বইটির নাম – ‘The Wonders of Vilayet’।


তার প্রায় পঁয়ষট্টি বছর পরে রাজা রামমোহন রায় বিলেত গিয়েছিলেন । তাঁকে অবশ্য মূলত মোগল বাদশাদের প্রতিনিধি হয়ে তাঁদের হয়ে ভাতা বাড়াবার জন্যে তদ্বির করতে তাঁকে বিলেত পাঠানো হয়েছিল । কিন্তু পাশ্চাত্য সভ্যতার উজ্জ্বল দিকটির সঙ্গে প্রতক্ষ্যভাবে পরিচিত হওয়ার স্বপ্ন রামমোহন রায় মনে মনে পোষণ করতেন । সে সময় রামমোহন রায় মোগল সম্রাটকে জানিয়েছিলেন যে বিলেতে রাজা বাদশা না হলে সেখানকার লোকেরা ভারতীয়দের তেমন পাত্তা দেয় না । মোগল সম্রাট ইঙ্গিত বুঝতে পেরে রামমোহন রায়কে রাজা উপাধি দেন এবং সমস্ত খরচা দিয়ে বিলেতে পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। অবশ্য রামমোহন রায়ের রাজা উপাধি নেবার কোনো দরকার ছিল না। কারণ ইংল্যান্ডে যাওয়ার আগেই রামমোহন সেখানে একজন জনপ্রিয় ব্যক্তি হয়ে গেছিলেন। সে সময় ডাক ব্যবস্থা খুব ভালো না থাকা সত্ত্বেও রামমোহন তাঁর লেখা এবং চিঠি পত্রের মাধ্যমে ইয়োরোপ এবং আমেরিকার অনেক মনীষীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন ।তাঁরা রামমোহনের রায়ের সমাজসংস্কারের উদ্যোগের খবর রাখতেন। রামমোহন রায় এতটাই বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন যে স্পেন দেশের একটি খসড়া সংবিধান রামমোহন রায়কে উৎসর্গ করা হয়েছিল । এই দেশে রামমোহন সতীদাহ প্রথা তুলে দেবার জন্যে যখন আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, সেই সময় ইংল্যান্ডে ইউনিট্যারিনিয়ান দল দাসপ্রথা উচ্ছেদের জন্যে আন্দোলন করছে । এই আন্দোলনকারীরা রামমোহনের লেখা বই থেকে অনুপ্রেরণা পেতেন । সেখানে রামমোহন এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন যে রামমোহনের সই করা ছবি দোকানে দোকানে বিক্রি হত।


রামমোহন যখন জাহাজে করে ম্যানচেস্টারে পৌঁছালেন তখন সেখানকার শ্রমিকরা তাঁকে দেখার জন্যে নাকি হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দিয়েছিল । আসলে রামমোহনের নাম সেখানে চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছিল ১৮২৩ সাল থেকেই, যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়, তখন রামমোহন সব রকম ভাবে তার প্রতিবাদ করেন। এই নিয়ে নানা লেখালেখির মাধ্যমে , সুপ্রিম কোর্ট থেকে প্রিভি কাউন্সিল সব জায়গায় রামমোহন তাঁর ক্ষুরধার যুক্তি দেখিয়ে তাঁর মত প্রকাশ করেন। এই সব যুক্তি ব্রিটিশ আন্দোলনকারীরা তাঁদের আন্দোলনকে শক্ত করার জন্যে ব্যবহার করেন। এই সময় এমন কি আমেরিকাতেও তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছিল। শুধু বাঙালি হিসেবে নয়, রামমোহনই প্রথম ভারতীয় যিনি বিদেশে গিয়ে একজন সেলিব্রিটি হয়ে উঠেছিলেন। তিনি এ সময়ে ফ্রান্সেও যান । হয়তো ইয়োরোপের অন্যান্য দেশেও যাবার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ১৮৩৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মেনিঞ্জাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল শহরে তিনি মারা যান।
যেহেতু সে সময় কালাপানি পার হওয়া নিয়ে হিন্দু বাঙালিদের মধ্যে আগে থেকেই নানা রকমের কুসংস্কার প্রচলিত ছিল, তাই টুলো পণ্ডিতরা প্রচার করার সুযোগ পেলেন, কালাপানি পার হওয়ার পাপেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। অতএব এর পরে বেশ কিছুদিন ধরে আর কোনো হিন্দু বাঙালিকে বিলেত যাবার সাহস অর্জন করতে দেখা যায়নি । তবে কয়েক জন ধর্ম পরিবর্তন করে খ্রিস্টান হয়ে বিলেত গিয়েছিলেন বলে জানা যায় ।


রামমোহন রায়ের পরম বন্ধু ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর । তিনিও রামমোহনের মতো বিলেত যাবার স্বপ্ন মনে মনে পোষণ করতেন । রামমোহন যখন বিলেত যান, তখন আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি সেই যাত্রা শুরু করেছিলেন দ্বারকানাথের প্রাসাদ থেকেই। রামমোহনের মৃত্যুর প্রায় দশ বছর পরে ১৮৪২ সালের ৯ই জানুয়ারি তারিখে দ্বারকানাথ বিলেতের উদ্দ্যেশ্যে যাত্রা করেন নিজের জাহাজ ‘ইন্ডিয়া’তে চেপে।


রামমোহন রায় ‘রাজা’ উপাধি নিয়ে বিলেত গেলেও দ্বারকানাথ বিলেত যাত্রা করেন প্রকৃত রাজার মতো। তিনি তাঁর নিজের জাহাজে সঙ্গে নিয়েছিলেন এক সাহেব ব্যক্তিগত চিকিৎসক, একজন ব্যক্তিগত সেক্রেটারি, তিনজন হিন্দু ভৃত্য এবং একজন মুসলমান বাবুর্চি। এবং সঙ্গে ছিলেন তাঁর ভাগ্নে চন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়। জাহাজে করে সুয়েজ বন্দরে পৌঁছে , সেখান থেকে ঘোড়ার গাড়ি করে কায়রো হয়ে পৌঁছালেন আলেকজান্দ্রিয়া । সেখান থেকে অন্য জাহাজে চেপে গেলেন ইটালি। সেখান থেকে রোম, ভেনিস, নেপলস এই সব শহর দেখে পৌঁছালেন জার্মানি । সেখানেও কিছু শহর দেখে পৌঁছালেন ব্রাসেলসে । সেখান থেকে যান ফ্রান্সে এবং অবশেষে ইংলিশ চ্যানেলে জাহাজে পার হয়ে পৌঁছালেন লন্ডনে। সময় লেগে ছিল পাঁচ মাস দু দিন।


লন্ডনে তিনি বিলাসবহুল সেন্ট জর্জেস হোটেলে উঠলেন । মহারানি তাঁর সম্মানে একটি অভ্যর্থনা সভা ডাকেন। সেখানে ডিউক অফ নরফোক তাঁকে আর্মেরিয়াল এনসাইন পদক দেন। লন্ডনের মেয়রও একটি আলাদা ভোজসভায় তাঁকে নিমন্ত্রণ জানান। তিনি যখন স্কটল্যান্ডে যান, তখন তাঁকে এডিনবরা মিউনিপ্যালিসিটি থেকে মহানাগরিক অধিকার দেওয়া হয়। তিনি ফ্রান্সে গেলে স্বয়ং সম্রাট লুই ফিলিপ তাঁর সম্মানে একটি ভোজসভার আয়োজন করে। ম্যাক্সমুলার সাহেব সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী সেই সভায় ফ্রান্সের সব চেয়ে অভিজাত মহিলারা এসেছিলেন। সেই সভাটি সাজানো হয়েছিল দ্বারকানাথের আনা কিছু মহার্ঘ্য ভারতীয় শাল দিয়, যা সেই সময় ফরাসি মহিলাদের সবচেয়ে কাম্য বস্তু ছিল। সভার শেষে দ্বারকানাথ প্রত্যেক মহিলাকে একটি করে শাল গায়ে পরিয়ে দিয়েছিলেন । দ্বারকানাথের চেহারায় এবং আচার-ব্যবহারে প্রকৃত আভিজাত্য দেখে ম্যাক্সমুলার সাহেব মুগ্ধ হয়েছিলেন । আর তাঁর ইংরেজি বলা শুনে ইংল্যান্ডের রানিসাহেবাও মুগ্ধ হয়েছিলেন।


প্রথমে রামমোহন রায় এবং তার পরে দ্বারকানাথ ঠাকুর, এই দুই বাঙালি ইয়োরোপে গিয়ে তাঁদের জ্ঞানের পরিধিতে, আভিজাত্যপূর্ণ ব্যবহারে, সে দেশে বাঙালি জাত সম্বন্ধে উচ্চ ধারণার সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। রামমোহন রায় কালাপানি পার হয়ে এ দেশে ফিরে আসেননি। কিন্তু দ্বারকানাথ ইয়োরোপের অভিজাত মহলে রীতিমতো সাড়া জাগিয়ে ফিরে আসেন কলকাতায়।


কিন্তু সে সময় প্রভূত প্রভাবশালী ধনী একজন ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও সমাজের রক্তচক্ষু এড়াতে পারেননি। সমাজের এক শ্রেণী তাঁকে একঘরে করবার জন্যে উদ্যোগ নেন । এমন কি বর্ধিত ঠাকুর পরিবারেও অনেকেই তাঁর বিরুদ্ধাচারণ করেছিলেন। কিন্তু দ্বারকানাথ আলাদা জাতের মানুষ ছিলেন। তিনি একটুও না দমে তাঁর বাগানবাড়িতে একটি নৈশভোজের আয়োজন করে সেখানে সে সময়ের কলকাতার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানান। সে সময়ের খবরের কাগজ সেই ভোজসভা নিয়ে লিখতে গিয়ে লিখেছিল যে এমন জাঁকজমকপূর্ণ পার্টি কলকাতায় এর আগে কখনো হয়নি। শুধু তাই নয়, তিনি দ্বিতীয়বার বিলেত যাবার পরিকল্পনা করলেন। আবার তিনি নিজের জাহাজে করে ইয়োরোপের উদ্দেশ্যে রওনা হন ১৮৪৫ সালের মার্চ মাসে। সঙ্গে তিনি ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং ভৃত্যদের তো নিলেনই। সেই সঙ্গেই নিলেন নিজের কনিষ্ঠ পুত্র নগেন্দ্রনাথ এবং ভাগ্নে নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে । এঁদের সঙ্গে নিলেন তাঁদের বিলেতে উন্নততর শিক্ষা দেবার জন্য। এছাড়া চারজন মেধাবী ছাত্রকে নিয়ে যান বিলেতে চিকিৎসা শাস্ত্রের পাঠ দেওয়ার জন্য।


দ্বারকানাথ এবারেও লন্ডনের অনেক জ্ঞানী-গুণী মানুষদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করলেন। তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন ভারতবিদ পণ্ডিত ম্যাক্সমুলার । ইয়োরোপিয়ান সঙ্গীত, নাটকের রস আস্বাদন করলেন। অপেরা গায়কের কাছে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের পাঠ নিলেন। মাঝে মাঝেই লন্ডনের অভিজাত সমাজকে নিয়ে পার্টি দিলেন। ব্রিস্টলে বন্ধু রামমোহন রায়ের সমাধি দেখতে গেলেন এবং সেখানে রামমোহন রায়ের দেহাবশেষ নিয়ে একটি সমাধিক্ষেত্র নির্মাণ করেন। কিন্তু এর পরেই তাঁর স্বাস্থ্য ক্রমাগত খারাপ হতে থাকে। চিকিৎসায় বিশেষ কাজ হয় না। ১৮৪৬ সালের পয়লা আগস্টে তিনি লন্ডনে মারা যান। তাঁকে খুব অনাড়ম্বরভাবে সমাধিস্থ করা হয় লন্ডনের কেন্সালগ্রিনে ।

প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সমাধি

যে চারজন ছাত্রকে দ্বারকানাথ জাহাজে চাপিয়ে বিলেতে নিয়ে গিয়েছিলেন তার মধ্যে দু’জন ছাত্রের ডাক্তারি পড়ার সমস্ত খরচ নিজেই বহন করেছিলেন। তাঁরই উদ্যোগে বাকি দু’জনের খরচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দিয়ে দেয়। এছাড়া কোম্পানির তরফ থেকে এঁদের সঙ্গে এঁদের তদারকি করার জন্য অ্যানাটমি ও মেডিসিনের অধ্যাপক হেনরি গুডিবকেও এই জাহাজে পাঠানো হয় । এই চারজন দ্বারকানাথ বসু, সূর্য্যকুমার চক্রবর্তী, ভোলানাথ বসু এবং গোপাললাল শীল সবাই কৃতিত্বের সঙ্গে ডাক্তারি পাশ করেন এবং কলকাতায় ফিরে এসে প্রথম বিলেতফেরত ডাক্তার হয়ে মানুষের চিকিৎসা শুরু করেন।
খুব ধীরে ধীরে হলেও এখান থেকেই শুরু হয় বাঙালিদের ডাক্তারি পড়তে অথবা ডাক্তারি পাশ করে উচ্চশিক্ষার্থে বিলেত যাওয়া। ১৮৬০-এর দশকের মধ্যভাগে ব্রিটিশ সরকার ছাত্রদের উৎসাহ দেবার জন্যে কিছু বৃত্তি শুরু করায় এই সময় থেকে বাঙালি ছাত্রদের বিলেত যাওয়া বাড়তে থাকে। শুধু লন্ডন নয়, গ্লাসগো এবং এডিনবরাতেও ছাত্ররা যেতে শুরু করেন।


শুধু ডাক্তারি নয়, ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেত যাওয়া বাঙালিদের মধ্যে শুরু হয় উনিশ শতকের মধ্য ভাগ থেকে। বিলেত থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করা প্রথম বাঙালির নাম জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর। তিনি মধুসূদন দত্তর মতই ‘ইয়ং বেঙ্গল’ গোষ্ঠীর একজন ছিলেন। তিনি ছিলেন সে সময়ের কলকাতার সবচেয়ে নাম করা উকিল শ্রী প্রসন্নকুমার ঠাকুরের একমাত্র পুত্র। তিনিও মধুসূদনের মতই খ্রিস্টান ধর্মান্তরিত হন ‘ইয়ং বেঙ্গল’ এর নেতা রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন মুখোপাধ্যায়ের দ্বারা । জ্ঞানেন্দ্রমোহন কৃষ্ণমোহনের কন্যা কমলমণিকে বিবাহ করেন। এই কারণে প্রসন্নকুমার তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করেন। তিনি বিলেতে যান সস্ত্রীক। এবং ১৮৫৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি বিলেতের লিঙ্কন ইন কলেজে ব্যারিস্টারি পড়বার জন্যে ভর্তি হন এবং ১৮৬২ সালে ভালোভাবে ব্যারিস্টারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ।
রাজনারায়ণ দত্তর ছেলে মধুসূদনের তরুণ বয়স থেকেই স্বপ্ন ছিল বিলেতে গিয়ে ইংরেজি ভাষায় কবি হবেন । কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর বিলেত যাওয়ার স্বপ্ন সাকার হয়, ব্যারিস্টারি পড়বার জন্য। তিনিও জ্ঞানেন্দ্রমোহনের মতই খ্রিস্টান হয়ে যান এবং এর ফলে তাঁর পিতাও কার্যত তাঁর সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করেন। তাঁর বিলেত যাওয়ার জন্যে বিদ্যাসাগরমশাই সাহায্য করেন এই ভেবে যে তিনি চেয়েছিলেন একজন বাঙালি ব্যারিস্টার হয়ে আসুক কলকাতায়। ১৮৬২ সালের জুন মাসে মধুসূদন দত্ত ব্যারিস্টারি পড়বার জন্য লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হন। কিন্তু লন্ডনে পৌঁছে তিনি অর্থাভাব এবং নানান অসুবিধার মধ্যে পড়েন। শেষ পর্যন্ত লন্ডন ছেড়ে চলে যেতে হয় ফ্রান্সের ভার্সাই শহরে। সেখানে তিনি প্রায় দু’বছর ছিলেন। এর পরে ১৮৬৫ সালে বিলেতে ফিরে এসে ব্যারিস্টারি পড়া শুরু করেন এবং ১৮৬৭ সালে ব্যারিস্টারি পাশ করে দেশে ফিরে আসেন । মধুসূদন দত্ত এবং জ্ঞানেন্দ্রমোহন দুজনেই ব্যারিস্টার হিসেবে সফল হননি।
মধুসূদনের পরে পরেই আর এক তরুণ ছাত্র প্রায় সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে যার। তিনি অবশ্য পরিবারের কাছ থেকে গোপন করেই, একটি বৃত্তি নিয়ে বিলেত চলে যান এবং সেখানে পৌঁছে পিতাকে চিঠি লিখে জানান। তাঁর নাম উমেশচন্দ্র ব্যানার্জি। ইনি দেশে ফিরে একজন সফল ব্যারিস্টার হন এবং কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছিলেন। তখন তিনি ডাব্লিউ. সি. বোনার্জি নামে পরিচিত ছিলেন। ১৮৬০-এর দশকে এই ভাবে প্রথম সাত-আট জন বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরে এসে সফল ব্যারিস্টার হয়ে যাবার পর দেখা যেতে লাগল, উচ্চবিত্ত বাঙালিদের মধ্যে বিলেতে গিয়ে ব্যারিস্টার হয়ে আসার সংখ্যা বাড়তে লাগল পরের দশকে। ১৮৭0-এর দশকে প্রায় তিরিশ জন বাঙালি বিলেত থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে এলেন। এই সময়ে ইংরেজ সরকার ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ নামের আইন প্রবর্তন করার ফলে কলকাতায় মামলা মোকদ্দমার সংখ্যা অনেক বেড়ে যায় । এবং তাতে আইন ব্যবসায় তাড়াতাড়ি আয় করে বড়লোক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পায় । এর ফলে তার পরের দশকগুলিতে এই সংখ্যা আরও বাড়তে লাগে ।

সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর

এই সময়ে ভাল ছাত্রদের জন্যে আরো একটি সুযোগ আসে লন্ডনে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পাশ করে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে উচ্চপদে চাকরি পাওয়া। আমরা সবাই জানি যে এদেশের প্রথম সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তবে এটা হয়তো সবার জানা নেই যে সে সময়ে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আরো এক বাঙালি আই. সি. এস. পরীক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁর নাম মনমোহন ঘোষ। ইনিও একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। কিন্তু তিনি কৃষ্ণনগরের এক মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে কলকাতার কলেজে পড়তে এসেছিলেন। এবং দেবেন্দ্রনাথের বাড়িতে থেকেই কলকাতায় লেখাপড়া করেন। এ সময় সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়ে যায় এবং তাঁরা দু’জনেই আই. সি. এস. পরীক্ষা দেবেন বলে ঠিক করেন। ১৮৬২ সালের মার্চ মাসে তাঁরা দু’জনে বিলেতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তাঁরা দু’জনেই লন্ডনে থেকে খুব কঠোর পরিশ্রম করে আই. সি. এস. পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ১৮৬৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে দুজনেই আই. সি. এস. পরীক্ষা দেন । কিন্তু এই পরীক্ষায় সত্যেন্দ্রনাথ পাশ করলেও , মনমোহন ঘোষ পাশ করতে পারলেন না । তিনি এর পরে আরও একবার পরীক্ষা দিয়ে কৃতকার্য হতে পারেন না। পরে অবশ্য ব্যারিস্টারি পরীক্ষা দিয়ে ব্যারিস্টার হয়ে বিলেত থেকে ফিরেছিলেন ১৮৬৬ সালে। ইংরেজরা হয়তো চাইতেন না সিভিল সার্ভিসে খুব বেশি নেটিভ লোকেরা সুযোগ পান। তাই ভারতীয়দের জন্যে এই পরীক্ষা খুব কঠিন করে রাখা হয়েছিল। এর পরে আবার পরে এই পরীক্ষা পাশ করার বয়ঃসীমা তেইশ থেকে কমিয়ে একুশ করে দেওয়া হয়। যাতে ভারতীয়রা এই পরীক্ষা দিতে বিশেষ উৎসাহী না হয় । কিন্তু ১৮৬৮ সালে তিন বাঙালি বন্ধু জাহাজে চেপে এই পরীক্ষা দিতে যান । তাঁরা হলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র দত্ত এবং বিহারীলাল গুপ্ত। এঁরা তিনজনেই আই সি এস পরীক্ষায় শুধু উত্তীর্ণই হননি, ৩৩০ জন প্রার্থীর মধ্যে রমেশচন্দ্র দ্বিতীয় , বিহারীলাল চতুর্থ এবং সুরেন্দ্রনাথ বিংশতিতম স্থান অধিকার করেন। এর পর কয়েক বছর অনেকেই ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেত গেলেও বাঙালিদের আই সি এস পরীক্ষায় বসতে তেমন উৎসাহ দেখা গেল না।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ১৮৭৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর মেজদা সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে এক জাহাজেই বিলেত যান ব্যারিস্টারি পড়তে। আসলে তাঁর পিতার এবং মেজদার ইচ্ছে ছিল রবিও আই সি এস পরীক্ষায় বসে । সেখানে যদি সফল না হয় তাহলে অন্তত ব্যারিস্টারি পাশ করে আসে । রবীন্দ্রনাথের ট্রেনিং সে ভাবেই শুরু হলেও দেখা গেল রবীন্দ্রনাথ ক্রমশ সে পথে এগিয়ে যাবার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন । পরের প্রসঙ্গ সবারই জানা বলে এখানে আর সে প্রসঙ্গ নিয়ে লেখা থেকে বিরত থাকলাম ।
উনিশ শতকের মধ্য ভাগ থেকে প্রায় সবটা জুড়েই বাঙালিরা অনেকেই ব্যারিস্টারি পাশ করে দেশে ফিরে আসতে লাগলেন । মাঝে মাঝে আই সি এসও হতে লাগলেন ।
তবে শুধু ডাক্তার এবং ব্যারিস্টার নয় । অন্যান্য ক্ষেত্রেও দেখা গেল বাঙালিরা উচ্চশিক্ষা লাভ করতে বিলেত যেতে আরম্ভ করল । ১৮৮৬ সালে ইংরেজ সরকার ভারতীয় ছাত্রদের জন্য বিলেতে গিয়ে পড়াশোনার জন্যে কয়েকটি বৃত্তি দেওয়া শুরু করাতে, গরিব ছাত্ররাও বিলেত যাবার সুযোগ পেতে লাগল।
১৮৭৪ সালে আনন্দমোহন বসু কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে গণিতে ফার্স্ট ক্লাস অনার্স ডিগ্রি পেয়ে ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম র‍্যাংলার হলেন । একে একে সরকারি বৃত্তি পেয়ে আরও অনেক মেধাবী বাঙালি ছাত্ররা পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, ইংরাজি সাহিত্য ইত্যাদি বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে বিলেত যেতে লাগলেন । এর মধ্যে ছিলেন অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়, প্রসন্নকুমার বসু , জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, গিরীশচন্দ্র বসু প্রমুখ ।
ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম ডি এস সি হয়েছিলেন প্রসন্ন কুমার রায় । ইনি প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন । অঘোরনাথ হায়দ্রাবাদের নিজামের অধীনে উচ্চপদে চাকরি করেন , তাঁর দুই কন্যা ট্রাইপ্স পেয়ে কেম্ব্রিজে পড়াশোনা করেছিলেন । তাঁরা হলেন সরোজিনী নাইডু এবং মৃণালিনী চট্টোপাধ্যায় । প্রমথনাথ বসু ভূ্তত্ত্ববিদ্যায় উচ্চশিক্ষা লাভ করে ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম রয়াল সোসাইটি অফ মাইন্স এর ফেলো হন । নানা জায়গায় অধ্যাপনা করার পর তিনি ময়ূরভঞ্জ জেলায় লোহার খনি আবিষ্কার করে পার্শি ব্যবসায়ী জামসেদজি টাটাকে এ দেশে প্রথম ইস্পাত কারখানা নির্মাণ করতে রাজি করান । জগদীশচন্দ্র লন্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে বি এস সি পাশ করে দেশে এসে প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা করেন । তিনি পরে একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক হয়ে ওঠেন, চারটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি এস সি পান । প্রফুল্লচন্দ্র রায় এডিনবরা ইউনিভার্সিটি থেকে ডি এস সি করে দেশে ফিরে আসেন । তিনি চাকরি না করে নিজে দেশীয়দের মধ্যে প্রথম একটি রাসায়নিক কারখানা স্থাপন করেন । নাম দেন বেঙ্গল কেমিক্যাল । স্বদেশী আন্দোলনেও তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন। ১৮৮০ সালে সরকার কৃষিবিদ্যায় একটি বৃত্তি দেওয়া শুরু করলে , এই বিদ্যায় প্রথম পড়তে যান গিরীশচন্দ্র বসু এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ।
কেশব সেন মশাই বিলেতে যান ১৮৭০ সালের মার্চ মাসে । প্রায় সাত মাস তিনি বিলেতে থেকে ম্যাক্সমুলার, গ্ল্যাডস্টোন, স্টুয়ার্ট মিলের মত বিখ্যাত মনীষীদের সঙ্গে দেখা করেন । অনেক চার্চে গিয়ে ধর্ম বিষয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন । নারীবাদী আন্দোলনের সপক্ষে নানা জায়গায় বক্তব্য রাখেন । তাঁর চেহারার আভিজাত্যে, শুদ্ধ ইংরিজি ভাষণে তিনি খুব অল্প সময়েই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি প্রায় রামমোহন রায়ের মতই বিলেতে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন । কেশব সেন ছাড়া ব্রাহ্ম ধর্মের হয়ে বিলেতে বলতে আসেন প্রতাপচন্দ্র মজুমদার , বিপিনচন্দ্র পাল এবং শিবনাথ শাস্ত্রী ।
স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকায় শিকাগো ধর্ম সম্মেলনে যুগান্তকারী বক্তৃতার পরে কিছু দিন আমেরিকায় নানান জায়গায় বেদান্তের বিষয়ে বক্তৃতা করেন। পরে তিনি ইংল্যান্ডে এসেছিলেন ১৮৯৫ সালের গ্রীষ্মে । ভারতীয় দর্শন ও যোগ বিষয়ে তিনি নানান জায়গায় যে শিক্ষাদান করতেন তা শোনবার জন্যে বহু মানুষ অগ্রিম টিকিট কেটে অপেক্ষা করত । তিনি ১৮৯৯ সালে আবার ইয়োরোপে এসেছিলেন । সে সময়ে অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ভারতীয় দর্শন বিষয়ে বক্তৃতা করেছিলেন ।
বিশ শতকের প্রথম থেকেই বাঙালির কাছে বিলেত যাওয়া আর বিশেষ কিছু ঘটনা রইল না । অনেকেই উচ্চশিক্ষার্থে, ব্যবসার কাজে, সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি হয়ে অথবা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বিলেত যেতে লাগলেন । উনিশ শতকের মধ্যভাগের পরে বাঙালি শুধু বিলেত ফেরত হয়ে দেশে ফিরে না এসে অনেকেই সে দেশে বসবাস করতেও শুরু করল । এঁরা মূলত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক, প্রযুক্তিবিদ । এই সংখ্যা ক্রমে বাড়তে থাকে ।
এই সময়ে দাঁড়িয়ে যখন ভুবনায়িত পৃথিবী এক রকমের অলখ সুতো দিয়ে নিবিড় ভাবে যুক্ত হয়ে গেছে, তখন সেই উনিশ শতকের মধ্যভাগে বাঙালির বিলেত যাওয়ার গুরুত্ব এবং তাৎপর্য কেমন ছিল তা সম্যক ভাবে বুঝে নেওয়া হয়ত সম্ভব নয় ।
উনিশ শতকে সব বিলেত ফেরত বাঙালিই বাংলার নবজাগরণে সরাসরি কোনো অবদান রেখেছেন তা হয়ত নয় । পাশ্চাত্যের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ হওয়ার ফলে এই বঙ্গসমাজ যে মধ্যযুগীয় তন্দ্রায় আচ্ছন্ন ছিল তা ধীরে ধীরে ভাঙতে শুরু হয় । এবং ক্রমশ তা থেকে শিক্ষিত বাঙালির মননে এক আধুনিক চিন্তাধারা, পরিবর্তিত মূল্যবোধ, এবং নূতন জীবনাদর্শের সূচনা হয়। রবীন্দ্রনাথ যে ‘ভারতবর্ষ’ কবিতায় লিখেছিলেন – ‘পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার / সেথা হতে সবে আনে উপহার’ , অন্তত বঙ্গদেশে সে রকম একটা অনুকূল আবহ তৈরি হয়েছিল । শুধু তাই নয় ইয়োরোপ থেকে বাঙালি যে আধুনিকতার আলো নিয়ে এসেছিল তা পরে ছড়িয়ে পড়েছিল সারা ভারতেই ।
আচার্য যদুনাথের মতে – ‘এই নতুন বাংলায় উদ্ভূত আধুনিক কালের প্রতিটি শুভ ও মহৎ প্রচেষ্টা ভারতের অন্যান্য প্রদেশে ধীরে ধীরে ব্যাপ্ত হয়ে পড়েছিল । বাংলাদেশ থেকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত শিক্ষক এবং ইয়োরোপ-অনুপ্রাণিত ভাবধারা সর্বত্র প্রসারিত হয়ে বিহার , উড়িষ্যা, উত্তর ভারত এবং দাক্ষিণাত্যের আধুনিকীকরণের পথ প্রশস্ত করেছিল । নতুন সাহিত্য রচনা, ভাষার সংস্কার , সমাজের পুনর্গঠন , রাজনৈতিক আন্দোলন , ধর্মসংস্কার এমন কি জীবনযাত্রা আচার ব্যবহার পরিবর্তন বাংলার প্রাদেশিক গণ্ডি পেরিয়ে ঘূর্ণি থেকে বার হওয়া ছোটো ছোটো ঢেউয়ের মত , ভারতের সুদূর প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে ।

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়
তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়
5 months ago

ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালির আন্তর্জাতিকতাবাদের সূচনার ইতিহাস ফুটে উঠেছে রচনাটির ছত্রে ছত্রে।