উপক্রমণিকা:-
আমাদের সকলের বড় প্রিয় মেঘদূত এই নামটি। বর্ষা, বিরহ আর মেঘদূত যেন একই সূত্রে গাঁথা। ছোটবেলায় “কশ্চিৎ কান্তাবিরহগুরুণা স্বাধিকারপ্রমত্তঃ” এই শ্লোকটি শুনতাম। শব্দগত অর্থ জানার বয়স তখন ছিল না। শৈশবে কল্পনার আধিক্য জ্ঞানের খর্বতাকে করে পরাভূত। স্বকৃত একটা অর্থের প্রতিমা গড়ে উঠেছিল মনের মধ্যে। রবীন্দ্রকাব্যের সঙ্গে যখন পরিচয় ঘটল কালিদাসের কালের একটা ছবি মনের মধ্যে আঁকা হয়ে গেল। শিপ্রা, রেবা, অবন্তী, উজ্জয়িনী, নির্বিন্ধ্যা, বেত্রবতী এই নামগুলি এল কাছে। বহুযুগের ওপার হতে আষাঢ় নিয়ে এল প্রাচীন বেদনাকে, রবীন্দ্রকাব্যের মধাদিয়ে। রবীন্দ্রনাথের কল্পনা কাব্যগ্রন্থের স্বপ্ন কবিতাটি পড়ে আজও মনে হয় যেন মহাকবির মেঘদূতের অন্তর্ঘন ভাববিন্যাস। পরে মেঘ দূত পেলাম পাঠ্যরূপে।
মেঘদূতকে “খন্ডকাব্য” বলে অভিহিত করাহয়। এখানে খন্ডশব্দটি একটি বিশেষ অর্থবহ। ভারতের কোন কোন অঞ্চলে খাঁড়ি গুড় এইশব্দবন্ধটি প্রচলিত আছে। খাঁড়ি শব্দটি মিষ্টত্বের দ্যোতক। মেঘদূতের বিশেষণ খন্ড শব্দটি মিষ্টি অর্থেই ব্যবহৃত।
এইসব জানতে জানতে পড়ার পাট শেষ হল। কালিদাসের কাল দূরে সরে গেল। নিত্য পুষ্প, নিত্যজ্যোৎস্না অলকার উপর নেমে এল এক যবনিকা। তারপর কাটল অনেক কাল। হঠাৎ এক সময় মহাকবি কালিদাসের মেঘদূতের বাংলা রূপান্তর করার এক দুঃসহ স্পর্ধা আমাকে পেয়ে বসল। কেন এ হেন ভাবনা এল আজও তা আমার কাছে অজ্ঞাত। কাজটা করতে গিয়ে বুঝলাম কি সুকঠিন এ কাজ। এর অন্তরমাধুরীকে ছন্দোবন্ধনে বাঁধা আমার পক্ষে অসম্ভব। তবুও নিবৃত্ত হইনি।মেঘকে সঙ্গী করে অরণ্যপর্বতনদী অতিক্রম করেছি। পথের সৌন্দর্য পথশ্রমকে করেছে লাঘব। শেষে রামগিরি থেকে অলকায় উত্তরণ। আর সবশেষে ব্যথার রাজ্যে প্রবেশ।।
পূর্বকথন:-
ধনপতি কুবের। কৈলাসে তার আবাস। নগরীর নাম অলকা। পরিপূর্ণ সৌন্দর্যের ধাম। সুউচ্চ প্রাসাদ ভবন নগরীর আকাশকে স্পর্শ করছে। ভবনের ছাদ শিখীর নৃত্যে ছন্দিত। মধুপ গুঞ্জরিত শতশতদলে সরোবরগুলি সদা আন্দোলিত। রাত্রি নিত্য জ্যোৎস্নাজড়িত। আনন্দাশ্রু ছাড়া নয়নসলিল সেখানে বিরল। আর বয়স তো যৌবনেই আবদ্ধ। কুবেরের কর্মসচিব যক্ষ। তরুণবয়স সদ্যপরিণীত। সুন্দরী বধূটি। তপ্ত কাঞ্চনবর্ণা, তন্বী, শিখরীদশনা, পাকা বিম্বফলের মতো অধর। হরিণনয়না, ক্ষীণকটি, নিম্ননাভি। যক্ষের কাজে ঘটে প্রমাদ। মন চলে যায় নিজকক্ষের বাতায়নপথে। তার কর্মশৈথিল্যে ক্রুদ্ধ কুবের ধৈর্য হারালেন। নির্বাসন দিলেন অলকা থেকে রামগিরি আশ্রমে । একাকী যক্ষ চলে এলেন সেই আশ্রমে ক্ষীণদেহ, প্রিয়াবিযুক্ত। কণকবলয়হাত থেকে যাচ্ছে খুলে। ঘনিয়ে এল নীল নব মেঘমালা নিয়ে আষাঢ় মাস।
মেঘদূত
যক্ষ ছিল সে কুবেরের অনুচর
ধনপতি প্রভু দিলেন তাহারে শাপ
বর্ষভোগ্য অসহ বিরহ দুখ
সহিতে হবে যে দেখিবে না প্রিয়ামুখ,
প্রভুকাজে হেলা, দুঃসহ অপমানে
পাঠালেন তারে দীর্ঘ নির্বাসনে।
রঘুপতি রাম যেথা বৈদেহীসনে,
কাটাতেন কাল ভাই লক্ষ্মণসহ
ছায়াতরু ঘেরা রামগিরি আশ্রমে
জানকীর স্নানে পুণ্য সে নদীজল।
সেথায় যক্ষ একা বাঁধিলেন ঘর।
সেই পর্বতে হল কিছুকাল বাস,
ক্রমে এসে গেল সঘন আষাঢ় মাস।
প্রিয়াবিচ্ছেদে শীর্ণ দুখানি কর
কণকবলয় খসে যায় বারবার
পর্বতসানু ফিরেছে মেঘের স্তর,
হেরিল যক্ষ চাহিয়া বারংবার।
গজরাজ যেন বপ্রক্রীড়ায় রত
নবীন শোভায় সাজিল সে পর্বত।
চিত্ত ব্যাকুলে যে নবমেঘে হেরি,
হৃদয়বাসনা কোনমতে সংবরি
তাহারই সমুখে দাঁড়ায়ে বিরহী ভাবে,
সুখী যারা তারা উতলা জলদাগমে
প্রিয়াবিরহিত প্রবাসী প্রেমিক তবে
কত না ব্যাকুল মেঘদর্শনে হবে।
সঘন শ্রাবণ অচিরে আসিবে ফিরে
দয়িতার ভীরু জীবন লতিকাটিরে,
বাঁচাইতে তাই মেঘের দৌত্য যাচি,
কূটজকুসুমে অর্ঘ্যথালিকা রচি,
প্রসন্ন চিতে করিল সে নিবেদন,
আর সে জানাল প্রণয়সম্ভাষণ।
(ক্রমশ)
(চিত্র-কৃতজ্ঞতাঃ আন্তর্জাল)
সুলতাদির এই কাজটির কথা আগে শুনলেও এবার পড়ার সুযোগ পেলাম।মূল কবিতাটির রসাস্বাদন করার যোগ্যতা আমার নেই।কিন্তু ওঁর এই ভাবানুবাদ আমার চোখের সামনে প্রকৃতির বিবরণ সহ সেই বিরহী মানুষটির ছবি এঁকে দিয়েছে সার্থক ভাবে। ওঁর করা ইংরেজ কবিদের বেশ কটি বিখ্যাত কবিতার ভাবানুবাদ পড়ার সুযোগ আমি পেয়েছিলাম।কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওঁর সেই ভাবানুবাদ মূল কবিতার চেয়ে অনেক বেশী ভাল লেগেছে আমার কাছে।পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
আপনার মতো গুণগ্রাহী মানুষের
এই অকৃপণ দাক্ষিণ্যলাভে আমি
আপ্লুত। অনুবাদ করতে গিয়ে বুঝেছিলাম, কালিদাসের কালকে
সামনে আনা,কতই না কঠিন তবু বিরত হইনি, কারণ, journey is more pleasurable than to
reach the destination. অনেক প্রীতি ও শ্রদ্ধা জানাই।
সুলতাদি কৃত মহাকবি কালিদাসের মেঘদূত এর ভাবানুবাদ পড়ে অনেক সমৃদ্ধ হলাম l খুব ভালো লাগলো l পরবর্তী সংখ্যার জন্য উদগ্রীব হয়ে রইলাম l
যাঁরা আমার লেখাটি পড়েছেন সকলকে জানাই আমার সশ্রদ্ধ
প্রীতি ও নমস্কার।
যাঁরা আমার লেখাটি পড়েছেন সকলকে জানাই আমার সশ্রদ্ধ
প্রীতি ও নমস্কার।