শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

বিস্মৃতিচারণা – পর্ব (১)

স্মৃতির ভেলায় কত ছোট ছোট মণি মানিক্য নিয়ে জীবনতরী এগিয়ে চলেছে সাগরপানে, তার হিসেব কে রাখে! সময়ের তরঙ্গে ওরাও তো ভেসেই চলে যায়। এমন মহার্ঘ্য জীবন তো নয়, যে জীবনস্মৃতি লিখতে প্রেরণা পাব। তথাপি তরঙ্গমালার দোলায় ক্কচিৎ কখনো ছোট ছোট স্মৃতিরত্নগুলো যখন ঝলসে ওঠে, তখন রবি ঠাকুরের গানটি মনে রিনরিন করে বাজতে থাকে, ‘সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি… ‘। না না, সোনার খাঁচায় ওরা রইল না বলে দুঃখবিলাস আমাকে পরাভূত করে না। বরং বিস্মৃতির অতল থেকে স্মৃতির আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠে ওরা আমার চিত্তাকাশে আলো ছড়িয়ে দেয়।

আপাত বিস্মৃতির অতল থেকে যৎকিঞ্চিত তুলে নিয়েই আমার কয়েক পর্বের এই বিস্মৃতিচারণা।

আনন্দ পুরস্কারের অনুষ্ঠান। স্থান, কলকাতার গ্র্যান্ড হোটেলের বিশিষ্টজন সমাকীর্ণ বলরুম। সন্ধ্যাকাল। গ্রীষ্মসাঁঝের জুঁই ফুলের বিপুল সাজে সজ্জিত মঞ্চ থেকে ভেসে আসা মিষ্টি গন্ধে বিশালকায় ঘরটির চতুর্দিক মাতোয়ারা। সেখানে মধ্য ও পেছনের সারিতে সাধারণ সাহিত্য-সংস্কৃতিপ্রেমীদের ভিড়ে এই অভাজনও উপস্থিত।

শুরু হল অনুষ্ঠান। প্রারম্ভিক গানে মনোরম আবহ রচনা করলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্রাজ্ঞী সুচিত্রা মিত্র ও তাঁর সাঙ্গীতিক জীবনের অন্যতম পথপ্রদর্শক শান্তিদেব ঘোষ।

প্রথম পর্বের অনুষ্ঠান-শেষে পুরস্কার ঘোষণা ও সম্মানজ্ঞাপন সভা শুরু হবার আগে ক্ষণিকের বিরতি।

কৌতুহলী দৃষ্টি নিয়ে গুটিগুটি পায়ে সামনের সারিতে এগোতেই চোখে পড়ল কাঁচা পাকা কেশের শশ্রুমন্ডিত নির্লিপ্ত প্রশান্ত মুখমন্ডলের এক অধীশ্বরকে। কী আশ্চর্য, ওই জনারণ্যেও একা। শ্রোতৃমন্ডলী তখন বাইরের লবিতে জলযোগে ও চা-পানে মত্ত কোলাহলে মগ্ন। তিনি শম্ভু মিত্র। বাংলা রঙ্গমঞ্চের দুটি সমান্তরাল ধারার অন্যতম ধারক। বিপুল জনপ্রিয়তার প্রলোভনকে উপেক্ষা করে কিছু বছর আগেই মঞ্চ থেকে স্বঘোষিত স্বেচ্ছাবসর নিয়ে অন্তরালে চলে গিয়েছেন তিনি। আকস্মিকভাবে আশির দশকের শেষ পর্বে বাংলাদেশের বন্যাদুর্গতদের সাহায্যার্থে তাঁর ঘোষিত অবসরের সাময়িক বিরতি ঘটিয়ে পরপর তিনটি সন্ধ্যায় রবীন্দ্রসদনের মঞ্চে ফিরছিলেন পঞ্চাশের দশকে তাঁরই বিপুল জনপ্রিয় ‘দশচক্র’ নাটককে সঙ্গী করে। সে নাটক দর্শকের আসনে স্তব্ধ করে দিয়েছিল আমাকে।

অতঃপর কিছুদিনের মধ্যেই দর্শকাসনে এই দেবদর্শন, সাহেবী হোটেলের সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায়। এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে মন সায় দিল না। কিন্তু পরিচিতজনের কাছে থেকে পাওয়া জনশ্রুতি বাধা দিল ভেতর থেকে। বলল, লোকটা দাম্ভিক ও আত্মসচেতন। তেমনভাবে সাড়া পাবে না। আমি বললাম, তা হোক। মানী ও গুণী মানুষ, ওরকম একটু হয়েই থাকেন।

সটান হাজির হলাম সামনে গিয়ে। একটু ঝুঁকে চেয়ারে সমাসীন মানুষটিকে নিজের অকিঞ্চিৎকর পরিচয় দিলাম। কী আশ্চর্য! সাড়াও দিলেন সহৃদয়তার সঙ্গে। এবার একটু সাহস সঞ্চয় করে অল্প দু’চার কথার পরেই জিজ্ঞেস করে বসলাম: এত তাড়াতাড়ি সরে গেলেন কেন মঞ্চ থেকে? আমাদের প্রজন্ম তো সেভাবে পেলই না আপনাকে! অথচ দশচক্র নাটকে আপনাকে দেখে মনে হল, আপনি আরও কিছু বছর দিব্যি অভিনয় করতে পারতেন।…

সসম্ভ্রম অনুযোগের উত্তরে মৃদু হেসে মিহি অনুনাসিক কণ্ঠস্বরে বললেন, ‘সব পেশাতেই তো একটা অবসর থাকে, তাই না? ধরে নাও না আমার অবসরের বয়স হয়েছে।’

সঠিক কিনা জানিনা, কিন্তু তাঁর সেদিনের উত্তরের মধ্যে কোথাও যেন একটা করুণ সুর শুনতে পেয়েছিলাম।

পরে নিজেকেই প্রশ্ন করেছিলাম, কেন তিনি তাঁর অসামান্য মঞ্চজীবনকে দীর্ঘায়িত করবেন? আমরা কতটুকু দিতে পেরেছি তাঁকে? বিপুল অর্থ নয়, সরকারী সহায়তা নয়, দু’ হাত ভরে নিয়েই গেছি। কী সব ঐতিহাসিক সৃষ্টি তাঁর, যা আমাদের প্রতিনিয়ত গর্বিত করেছে ! বিনিময়ে সরকারের কাছ থেকে কলকাতার বুকে একটা জাতীয় নাট্যশালা চেয়েছিলেন তিনি। সর্বাত্মক নাট্য চর্চা ও গবেষণার জন্য কলকাতার বুকের ওপর সাধারণ ঘরের মঞ্চাভিনেতাদের জন্য ‘নন্দন’-এর একটা প্রতিরূপ চেয়েছিলেন তিনি। চরম উন্নাসিকতা দেখিয়ে আমরা তাঁর প্রকল্পকে তদানীন্তনকালে প্রায়-অগম্য লবন হ্রদে পাঠাতে চেয়েছিলাম। যেতে অস্বীকার করেছিলেন তিনি। জাতীয় নাট্যশালার জন্য তাঁরই উদ্যমে সঞ্চিত বিপুল অর্থ তিনি তুলে দিয়েছিলেন ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার রিসার্চ হাসপাতালের উন্নতিকল্পে। সমাধিস্থ হয়েছিল তাঁর স্বপ্নের প্রকল্প। বাঙালি ও কলকাতা আজও জাতীয় নাট্যশালা পায়নি।

তাই মনে মনে ভাবি, সেদিন সন্ধ্যায় গ্র্যান্ড হোটেলের বলরুমে একান্তে প্রশ্নটা করা হয়তো ঠিক হয়নি আমার, যদিও পরিণত স্থৈর্যে শোভনতা মেনেই জবাব দিয়েছিলেন তিনি। কেন তিনি চলে গিয়েছিলেন মঞ্চ থেকে, সে তো আমার অজানা ছিল না!

জন্মদিনে অন্তরের প্রণাম বাংলার রঙ্গমঞ্চের এই মহীরুহকে।

(চিত্রঋণঃ সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, আন্তর্জাল)

২২.৮.২০২১

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
magic mushrooms michigan
6 months ago

I really like reading an article that can make men and women think.
Also, thanks for permitting me to comment!