কয়েক বছর আগে রবীন্দ্র-সাহিত্যের প্রখ্যাত জার্মান অনুবাদক মার্টিন কেম্পশ্যেন তাঁর শান্তিনিকেতনের আস্তানার গাছ-গাছালিতে ঘেরা প্রাঙ্গণে বসে একটি ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘সাধারণ বাঙালি রবীন্দ্রনাথকে আজও, মৃত্যুর পর আট দশক পেরিয়েও ঠিক মতো বুঝতে পারেনি। তারা তাঁকে শুধু বিশ্বকবি তকমায় বন্দী করে রেখেছে। আমি নিজে বিদেশী বলেই হয়তো তাঁর কবি ও সাহিত্যিক সত্তার পাশাপাশি কর্মী রবীন্দ্রনাথকে আমি কখনোই ভুলতে পারিনা। আমি মনে করি, পৃথিবীর ইতিহাসে একটি মানুষের মধ্যে এমন বিশ্বজয়ী কবি ও সমাজ-চিন্তক কর্মীর সমাহার ঘটেনি। তিনি যত বড়ো কবি, তার থেকে কোনো অংশে ছোট কর্মী ছিলেন না।’
রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে হাল আমলের রবীন্দ্র-সাহিত্যের চর্চায় ও অনুবাদ কর্মে নিমগ্ন একজন বিদগ্ধ বিদেশীর এই পর্যবেক্ষণ আমাদের চমকিত করে। বাঙালি জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষা হিসেবে চিহ্নিত মানুষটির বিশ্বের দরবারে এই যে এক ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী পরিচিতি, আমরা ক’জনই বা তা ভেবে দেখি বা চর্চা করি?
রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ জীবনের পর্বে পর্বে বেশ কিছু বিদেশীর অসামান্য ভূমিকার কথা আমাদের অজানা নয়, যা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণের দাবি রাখে। উইলিয়াম রোটেনস্টাইন থেকে সি এফ অ্যানড্রুজ, পিয়ার্সন-এল্মহার্স্ট থেকে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, এডওয়ার্ড টমসন থেকে হ্যারম্যান কাইজারলিং, মে সিনক্লেয়ার, উইল ডুরান্ট, রোমাঁ রোল্যাঁ প্রমুখ – এঁরা রবীন্দ্রনাথকে যেভাবে চিনেছিলেন তাঁর কবিকৃতি থেকে চিত্রকলা যেভাবে সাদরে বরণ করে নিয়েছিলেন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রচার ও পরিচিতি লাভে কবিকে সহায়তা করেছিলেন, তা তুলনারহিত। এঁদের পাশাপাশি তদানীন্তন বিদেশী বিদ্বজ্জনসমাজ ও বহু উল্লেখযোগ্য সংবাদপত্র পরাধীন দেশের এক কবির প্রশস্তিতে কোনো কার্পণ্য করেননি।
আমরা লক্ষ করি, কবির পঞ্চাশ বছর বয়সের পর থেকে শুরু হয়েছিল তাঁর আন্তর্জাতিক পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা, যার প্রাথমিক সেতুবন্ধনটি করেছিলেন খ্যাতনামা ইংরেজ শিল্পী উইলিয়াম রোটেনস্টাইন। শিল্পীর নিবিড় বন্ধুত্বে আপ্লুত রবীন্দ্রনাথ এঁকে বলেছিলেন, ‘স্বভাববন্ধু’! বন্ধুত্বের স্বীকৃতিতে কবি ‘গীতাঞ্জলি’ উৎসর্গ করেছিলেন তাঁকেই।

ঘটনাক্রম অনেকের পরিচিত হলেও একটু পেছন ফিরে তাকাই। ১৯১০ সাল। ভারতীয় শিল্পকলার টানে ভারতে এলেন রোটেনস্টাইন। ঠাকুরবাড়ির নামী চিত্রশিল্পী গগনেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথের ছবি দেখতে ও বাংলার নব্যশিল্পচর্চা নিয়ে আলোচনার জন্য তিনি গেলেন ঠাকুরবাড়িতে। আলোচনায় উপস্থিত রবীন্দ্রনাথ। রোটেনস্টাইন আকৃষ্ট হলেন রবীন্দ্রনাথের প্রতি। কবির সঙ্গে আবদ্ধ হলেন এক গভীর বন্ধুত্বের বন্ধনে। রবীন্দ্রনাথের একটি প্রতিকৃতি আঁকলেন বিদেশী শিল্পী, যা পরবর্তীকালে ‘গীতাঞ্জলি’ গ্রন্থের মুখবন্ধের পাতায় প্রকাশিত হয়ে অমরত্ব পেল। কবিকে তিনি আমন্ত্রণ জানালেন ইংল্যান্ডে। ১৯১২ সালে কবির বিলেত সফর। রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি অনুবাদের কবিতায় মুগ্ধ রোটেনস্টাইন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপ করালেন কবি ডব্লু বি ইয়েটসের। রবীন্দ্রনাথের নিজের করা ইংরেজি কবিতার অনুবাদগুলি রোটেনস্টাইনের উদ্যোগেই পৌঁছে গেল এন্ড্রু ব্রাডলি, স্টপফোর্ড ব্রুক এবং ইয়েটসের কাছে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে রোটেনস্টাইনের মুগ্ধতা তখন চরমে। নিজেই আয়োজন করছেন বিলেতের বুধমন্ডলীর উপস্থিতি সমন্বিত সান্ধ্য সাহিত্যসভার। ইয়েটস সেখানে আবৃত্তি করছেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা। অন্য অনেকের পাশাপাশি কবির সঙ্গে পরিচয় ঘটছে সি এফ অ্যান্ড্রুজের, যে আলাপ সূচনা করছে একটি দীর্ঘমেয়াদী গুরু-শিষ্য সম্পর্কের।
আজকের কবি-স্মরণের এই সম্পাদকীয় নিবন্ধে আমরা ফিরে দেখব রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তৎকালীন আন্তর্জাতিক বিশিষ্টজনের ও খ্যাতনামা সংবাদপত্রের অসামান্য কিছু পর্যবেক্ষণ ও মন্তব্য।
• প্রখ্যাত জার্মান দার্শনিক কাউন্ট হেরম্যান কাইজারলিং ১৯১১ সালে বিশ্ব পরিক্রমায় বেরিয়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে এলেন এবং মুগ্ধ হয়ে শুনলেন ভারতীয় সঙ্গীত। তাঁর ‘Travel diary of a philosopher’ গ্রন্থে তিনি সে অভিজ্ঞতার বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখলেনঃ
“… এ যুগে যত গীতিকবিতা যত দেশে লেখা হয়েছে, তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের গীতিকাব্য গভীর নিগূঢ় ভাবের বিচিত্র বর্ণচ্ছটায় যেমন ঐশ্বর্যময় এমন আর কোথাও নেই।”
• ১৯১৩ সাল প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক সাহিত্য-পত্র Poetry Review মন্তব্য করলেনঃ “এ পর্যন্ত ভারতীয় স্বাদেশিকতার অনুকূলে যত যুক্তি শোনা গিয়েছে, তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথই সবচেয়ে বড় যুক্তি- “Rabindranath Tagore is the strongest argument in favour of Indian Nationalism that we have encountered.”
• ১৯২০ সালে আমেরিকাবাসী বিশ্বখ্যাত ইতিহাসবিদ, দার্শনিক, লেখক ও শিক্ষাবিদ উইল ডুরান্ট তাঁর ‘The Case for India’ বইখানি কবিকে উপহার দিয়ে লিখলেন: “You alone are sufficient reason why India should be free.”
• ভারতীয় সঙ্গীতে পারদর্শী ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আর্নল্ড বাকে বললেনঃ “রবীন্দ্রনাথ সুর-রচয়িতা হিসাবে বাঙালী জীবনের চূড়ান্ত পরিণতির প্রকাশ। বহির্জগতের সঙ্গে সংযোগে তাঁর মধ্যে বাঙালী হিসাবে দেশসীমায় যা সুপ্ত ছিল, তা পূর্ণ প্রকাশিত, জাগ্রত হয়েছে। এ কথা লক্ষণীয় যে তাঁর মধ্যে পাশ্চাত্য সঙ্গীত, কালোয়াতি সঙ্গীত ও লোকসঙ্গীত এই তিন ধারাই প্রবেশ করেছে। লোকসঙ্গীতের মধ্যে অন্য দু’টি ধারা ধীরে ধীরে বিস্রস্ত, দ্রব ও জীর্ণ হয়ে এক হয়ে গিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতের জন্ম হয়েছে।”
• ১৯২১-এর অগাস্ট সংখ্যায় Modern Review (Reporter of ‘London Observer’ from Vienna, 26/06/1921) মন্তব্য করলেনঃ
“আমার তো মনে পড়ে না যে কোনো জীবিত কবি এমন সর্বজনসম্মত অভ্যর্থনা, এমন গভীর ভক্তি ও প্রশংসা ভিয়েনাবাসীর কাছে বা ভিয়েনার সংবাদপত্রে কখনো পেয়েছে। ব্যক্তিগত দেহসৌন্দর্য্যেও এমন গভীর প্রভাব এই বাঙালী লেখক ও মনীষীর মত আর কেউ ফেলতে পারেনি।”
• ১৯৩২ সালে ‘Golden book of Tagore’ গ্রন্থে কাউন্ট কাইজারলিং লিখলেনঃ “আমার যত মানুষকে এ পৃথিবীতে জানবার সৌভাগ্য হয়েছে, তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ শ্রেষ্ঠ। তাঁর যে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি এবং স্বদেশে তাঁর যে সম্মানের আসন, এসবের চেয়ে তিনি অনেক বড়ো।… আমাদের পৃথিবীতে তাঁর মতো মানুষ বহু বহু শতাব্দীর মধ্যে জন্মাননি।”
• কবির স্মৃতিচারণায় সি এফ অ্যানড্রুজ লিখছেনঃ “তিনি যেন অন্য এক জগৎ থেকে এসেছেন, এই সত্য, সুন্দর ও সামঞ্জস্যের জগতের প্রভাব সকলে যে অনুভব করেছিল, তা সর্বত্র প্রকাশ পেয়েছে। তিনি যখন পথ দিয়ে চলেছেন, পথচারী জনতা ভক্তিনম্র হয়েছে, সে ভক্তি এমনি গভীর যেন তাদের সামনে দিয়ে স্বয়ং যীশু খ্রীষ্ট চলেছেন। তাঁর প্রতি দৃষ্টিপাত মাত্র স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় চিন্তামাত্র না করে টুপি খুলে ফেলেছে, নত হয়েছে।…”
• ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যোগাযোগের পরবর্তীকালে বলেছিলেনঃ
“যে সব ছবি আজও আমার স্মৃতির মধ্যে তুফান তোলে, সে সবই খুব সহজে মিলিয়ে যাবে একদিন, যেমন শূন্যতায় মিলিয়ে গেছে আরো সব ছবি। কিন্তু থেকে যাবে গীতাঞ্জলি, যে-গীতাঞ্জলি এমন করে সেদিন কাঁদিয়েছিল আমায়। ঠিক জানিনা, রবীন্দ্রনাথ, না কি ঈশ্বর, কার কথা ভেবে উঠেছি তখন।”
কবিকে কেন্দ্র করে পৃথিবীব্যাপী বিদ্বজ্জনের অসংখ্য মন্তব্যের স্রোত থেকে সামান্য কতিপয় সিঞ্চন করে এই নিবন্ধে সন্নিবিষ্ট হল। সারা জীবন দেশে ও বিদেশে প্রভূত সম্মানে ও প্রশংসায় ভূষিত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তবে একটা কথা বোধহয় নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, তাঁর বিদেশী শুভার্থী ও গুণগ্রাহীদের কাছ থেকে তিনি যা পেয়েছেন, এমন সর্বব্যাপী প্রশস্তি, শ্রদ্ধা ও অনুরাগের কুণ্ঠাহীন প্রকাশ রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের দেশে কখনো দেখেননি বা পাননি।
তথ্যঋণঃ
- ‘নমন’ (সাহিত্য ভারতী পাবলিকেশন)
- বিশ্বসভায় রবীন্দ্রনাথ – মৈত্রেয়ী দেবী
এবং আন্তর্জাল
.


I have rarely seen & read this type of Literary work. So nice and having so much of depth. I heartily thank all those respected erudite people who are working with so much of devotion and integrity.
Regards.
A.B.CHAUDHURI
Ahilyanagar. Maharashtra.
Amol Vihar. 414003
রবিচক্র অনলাইন আপনাদের কেমন লাগছে? নিচের ঠিকানায় লিখে জানান। ইমেল-ও করতে পারেন। চিঠি অথবা ইমেল-এর সঙ্গে নাম, ঠিকানা এবং ফোন নম্বর থাকা বাঞ্ছনীয়।
রবিচক্র
‘প্রভাসতীর্থ’, ৭৬ ইলিয়াস রোড, আগরপাড়া, কলকাতা – ৭০০০৫৮, ভারত
editor@robichakro.com
‘সামান্য কতিপয় সিঞ্চন’ সত্ত্বেও ভাল লেখা। ভাল লাগল।
সম্পাদকীয় প্রবন্ধটি পড়ে একটা কথাই মনে হল,এত বড় এক প্রতিভার সামগ্রিক মূল্যায়ন করার কাজটা বড় সহজ নয়। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন ক্ষেত্রের গুণী মানুষদের মন্তব্যগুলি তাঁদের নিজেদের পরিচিত বিষয়ের পারদর্শিতার নিরিখে করা।একমাত্র মার্টিন কেম্পসেনের মন্তব্যটির মধ্যে সামগ্রিকতার ছোঁয়া আছে।স্বদেশের মানুষরা রবীন্দ্রনাথকে কাছ থেকে দেখেছেন।তাতে তাঁর জীবনের সাধারণ বিষয়গুলির সঙ্গে তাঁর অতুলনীয় গুনগুলির মিশ্রণ ছিল।তাতে তাঁর অসাধারণত্ব বোঝার ক্ষেত্রে কিছুটা অসুবিধা তো নিশ্চয়ই থাকে। বিদেশীরা শুধু অসাধারণত্ব টুকুই দেখতে পেয়েছেন।ফলে তাঁদের মূল্যায়নে তারই প্রতিফলন হয়েছে।