
আপনি শান্তিনিকেতনের ছাত্র হয়ে এসব বলছেন? কিন্তু রবীন্দ্রনাথের আশাবাদের উপর নির্ভর করেই যে আমরা এগিয়ে চলেছি!
“যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গীতাঞ্জলির মূর্তিকে অনায়াসে দলে দিয়ে চলে যান, আত্মদেবায়নের গরিমা ভেঙেচুরে মানুষের অবচেতন অস্তিত্বের ছবি আঁকেন, সে-রবীন্দ্রনাথই বরং আমায় বেশি টানে “। এই প্রজ্ঞাময় উচ্চারণ পাঁচের দশকের যে কবির, তিনিই তো অনায়াসে একসময়ে অকপট বলে উঠবেন,” রবীন্দ্রনাথের সে- কবিতাগুলোই আমার কাছে রক্তমণির হার যেগুলোয় কোন আরোপিত আশাবাদের কথা নেই।”
পাঁচের দশকের সেই কবিই শান্তিনিকেতনের প্রাক্তনী এক প্রধানমন্ত্রীর মুখের উপর নির্দ্বিধ বোঝাতে চাইছিলেন যে কোন ফাঁপা আশাবাদে তাঁর কোনো আস্থা নেই।

আসলে সেদিন রাজভবনে প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে এক চা- চক্রে বিশিষ্ট কয়েকজন মানুষ আর প্রথিতযশা কবির সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন এই কবিও। ইন্দিরা কি জরুরি অবস্থার সমর্থনে গৃহীত ব্যবস্থার সাফাই গাইতে কোন আশাবাদের কথা শোনাচ্ছিলেন? হয়তো। সেক্ষেত্রে সোচ্চারে বা নিরুচ্চারে সেই আশাবাদ আর স্বপ্ন ঘিরে অনাস্থা দেখানোর জন্য কবি হওয়ার প্রয়োজন ছিল না। একটু সাহসী হলেই যেকোন সচেতন গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের পক্ষেই সে- অনাস্থা দেখানো স্বাভাবিক ছিল।
কিন্তু এ কবির প্রজ্ঞা যে অন্য এক বোধের জারণ থেকে উঠে এসেছিল। শব্দের মায়াময় জগৎ থেকে দূরে সে এক অন্য পৃথিবী যে! তাই ইন্দিরা বা জরুরি অবস্থা সেদিন প্রসঙ্গ হিসেবে ছিল নিছকই গৌণ। ঐ প্রত্যয়ের ঘোষণা ছিল আসলে নিজের প্রশ্নার্ত অন্বেষার আত্মবিশ্বাস।
তফাতটা সত্যিই ছিল শিরদাঁড়ায়। তাই মিসেস গান্ধীর মুখের উপর অনায়াসে এই কবি বলতে পারলেন, “আপনি হয়তো জানেন না। কিন্তু আপনার বাবা জানতেন Leslie Stephen-এর সেই কথাটা, ‘Nothing is less poetical than optimism.”
আশাবাদের থেকে কম কাব্যিক যে আর কিছু হয় না। এ যে ততদিনে তাঁরও বোধদীপ্ত নান্দনিক প্রত্যয় হয়ে উঠেছিল।
‘শেষ লেখা’র ‘প্রথম দিনের সূর্য’র প্রতি তাঁর দুর্মর টানের কথা বলতেন তাঁর কবিতা-সংবেদী বন্ধুমহলে।
নাহ্! কোনও আরোপিত নতুন দিনের সূর্য নয়! ‘প্রথম দিনের সূর্য’! আসলে হয়তো প্রথম ও শেষ দুই নিরুত্তর সূর্যের কাছেই তাঁর প্রশ্নকে জায়মান করে তুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথের মতো, এ কবিও! হয়তো কোনও সূর্যই নয়। আসলে প্রশ্ন ছিল নিজেরই সত্তার প্রতি। হয়তো।
“প্রথম দিনের সূর্য
প্রশ্ন করেছিল
সত্তার নূতন আবির্ভাবে—
কে তুমি,
মেলে নি উত্তর।
বৎসর বৎসর চলে গেল,
দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল
পশ্চিমসাগরতীরে,
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়—
কে তুমি,
পেল না উত্তর।”
যে-সত্তা প্রশ্নময়, সে-ই যেন শূন্যতায় ভরা! কোথাও কি তবে সত্তা আর শূন্যতা পরস্পরস্পর্শী পরিপূরক? কে দেবে উত্তর? কোনো সূর্য নয় নিশ্চয়ই। প্রশ্ন তো আসলে নিজের সত্তার কাছেই। সে-সত্তা তো জীবনের শেষে জ্ঞানীর মতো সোচ্চার নন। ঋষির মতো নিরুত্তর। কোনো ফাঁপা আশাবাদ আর ইচ্ছা-ঈপ্সিত উত্তর সে-অন্বেষায় যাত্রাশেষের গল্প লেখে না। নিরুত্তর জায়মানতাই সে- প্রশ্নার্ত খোঁজের ভবিতব্য যে!
নিশ্চয়ই এমন ব্যাখ্যায় নয়, রবীন্দ্রনাথের এ কবিতার আর্তিকে এর থেকে অনেক গভীর ব্যঞ্জনায় ছুঁয়েছিলেন পাঁচের দশকের কবি! সন্দেহ নেই!

যে-কবি সমস্ত নান্দনিকতার ঊর্ধ্বে উঠে প্রজ্ঞাদীপ্ত প্রত্যয়কে কবিতার আশ্রয় করে তুললেন, গ্যয়েটে-হাইনে-রিলকে-ব্রেশট-বোদলেয়রের ঋদ্ধি নিয়েও, ব্যাথাতুর মন নিয়ে তিনিই সময়ের সমান্তরালে লিখলেন শরণার্থীদের কথা, নকশাল আন্দোলনের কথা, গাল্ফ যুদ্ধ বা আফগানিস্তানের যুদ্ধের বীভৎসতার কথা। প্রজ্ঞার আলোয় “ভিনদেশী ফুল” – এর সৌরভ আর সুফীবাদকে ছুঁয়ে একসময়ে লিখতে পেরেছিলেন “শুনে এলাম সত্যপীরের হাটে” কাব্যগ্রন্থ! এক তথাকথিত দ্বি-মেরুবৈষম্যকে নস্যাৎ করে, প্রজ্ঞালগ্ন থেকেও মাটিলগ্ন যন্ত্রণার কথা তুলে আনতে তাঁর আটকাল না যে এতটুকু। অথবা উল্টোটা। আটকাল না মাটির বুকে কান পেতেও প্রজ্ঞার আলোয় স্নান করতে। আজ প্রায়ই শুনি বৌদ্ধিকতার সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত ও জীবনস্পর্শী সৃজনের নাকি শত্রুতার সম্পর্ক! কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ও তাঁর কবিতা সেই ধারণাকে কিন্তু নস্যাৎই করে।
পল্লব গাঙ্গুলির ‘অ-কাব্যিক’ পড়ে মনের তারে একটা অদ্ভুত অনুরণন উঠল , ঠিক যেভাবে তরফের তার ঠিক ঠিক সুরে বাঁধলে সেতার বা এসরাজ বেজে ওঠে ঝনঝন করে। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত সেই বিরল গোত্রীয় কবি, যিনি কবিতার সীমানাকে ক্রমাগত প্রসারিত করে গেছেন। তিনি ছিলেন যাঁদের আমরা বলি কবির্মনীষী। তিনি যত বড় কবি , তত বড়ই প্রাবন্ধিক এবং তত বড়ই অনুবাদক এবং আরো বড় একজন মানুষ যিনি সারা জীবন অবহেলিত, ছিন্নমূল এবং আবিশ্ব বর্ণবৈষম্যের শিকার, দারিদ্র পীড়িত মানুষের জীবনের সঙ্গে নিজের জীবনকে সম্পৃক্ত করে নিয়েছিলেন , হয়ে উঠেছিলেন একজন আক্ষরিক অর্থেই রাবীন্দ্রিক যাঁর শিকড় শান্তিনিকেতনে , যাঁর কাণ্ড এবং শাখা-প্রশাখা ধীরে ধীরে বিশ্ব আকাশকে দু’হাতে আপন করে নিয়েছিল।