শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

হেমন্ত, হেমন্ত কুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

চিরকুমার কণ্ঠ দিয়ে সপ্তসুরকে যিনি বাঙালির মজ্জায় মিশিয়েছেন, তাঁর গল্প।

মনে হয় রবি ঠাকুরের ‘হেমন্তে কোন বসন্তেরই বাণী’ গানের ঔরসে জন্ম। নইলে কি করে হয় – নামে হেমন্ত গলায় বসন্ত। অসম্ভব ! ভাবা যায় : ষাট বছরের গায়কের গানে লিপ দিচ্ছে বাইশ বছরের তরুণ ! ছাতিমতলার উপাসনাগারের রঙিন কাঁচ ভেঙে জন্ম নিচ্ছে সুপার হিট – চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে ! প্রেমে পড়ছে ব্যানার্জিপাড়ার  শাড়ি পড়ে ফিতে বেঁধে স্কুলে যাওয়া ক্লাস ইলেভেনের চন্দ্রানী ! নিশীথকে চিরকুটে লিখে পাঠাচ্ছে – ওই গানটা শুনলেই মনে হয় তোমার বুকে মাথা রেখেছি । শোনো, কাল গঙ্গার পারে ছুটির পরে এস। একবার চোখের দেখা দেখবো।

রবীন্দ্রনাথ হাতে ধরে ভালোবাসতে শিখিয়েছিলেন। ভালোবাসার গান জুগিয়েছিলেন। হেমন্ত কুমার – চিরকুমার কণ্ঠ দিয়ে বাঙালির মজ্জা রসে ঢেলেছেন সেই ভালোবাসার আত্মপ্লাবী আবেগের সুগন্ধি আতর। ১৯৩৭ থেকে ১৯৮৯। দেব আনন্দ থেকে তাপস পাল – এক  হেমন্ত সূত্রে গাঁথা সহস্র নায়ক। ‘জানিতে যদি গো তুমি’ থেকে  ‘যাঁর ঘর নেই তাঁর পথ আছে’র  হাত ধরে বাঙালি – পাঁচ দশকের  বিস্তারে – দেশ ভাগ, খাদ্য আন্দোলন, বরাহনগর গণহত্যা, লক আউট, রিট্রেন্চমেন্ট’এর ঘাম কপাল থেকে মুছে, আরো শতবার প্রেমিক হয়ে, আকাশের চাঁদকে একান্ত দুজনের করে, কুহু কূজনে গেয়ে উঠেছে  – এই রাত তোমার আমার, শুধু দুজনের। ক্লেদাক্ত, প্রতারিত কেরানি স্টেশন থেকে সাইকেলে বাড়ি ফিরে, স্নান সেরে, প্যানাসনিক টেপরেকর্ডারের বোতাম টিপে শুনেছেন – রানার ছুটেছে তাই ঝুম্‌ ঝুম্‌  ঘন্টা বাজছে রাতে কিংবা ছুটির দিনের বৃষ্টি বিকেল, সুশান্ত গলির মুখে দাঁড়িয়ে, কোনো ঘর থেকে ভেসে আসছে – এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন, গত তিন দিন ‘ওগো কাজল নয়না’ সুমনা দেখা করবো বলেও দেখা করেনি, অথচ পালিয়ে বিয়ের করার পরিকল্পনা সব ঠিক। সুমনা কথা রাখেনি। ফিরে আসেনি। সুশান্ত বিয়ে করেনি। বয়েস সত্তরের ওপর। তবু আজ মাঝে মাঝে আলো নেভানো ঘরে স্মৃতিমেঘ হয়ে – হেমন্ত মুখোপাধ্যায় – তুমি আছো আমি আছি তাই, অনুভবে তোমারে যে পাই। তবু আজ তিরিশ বছরের ভাইঝি , পার্লার থেকে ফিরে বলে – উফফ কাকু, তোমার এই স্লো ইমোশোনাল গান গুলো থামাবে! অন্ধকারে বসে এসব শুনে কি যে মজা পাও জানি না। তোমাকে কাল চন্দ্রবিন্দুর লেটেস্ট আলবামটা ডাউনলোড করে দেবো। জাস্ট শুনো। অওসাম!’

এর মধ্যে পাশের কোনো এমআইজি ফ্ল্যাটে পর্দার আশেপাশে হাওয়ার জমাট মিতালি।  মধ্যবিত্ত ঘুরপাক শব্দগুলো বলছে –

‘তাহলে কি কথাটা সত্যি, ইন্দ্রানী?’

‘কি ?’

‘আমরা কি প্রকৃত ভালোবাসতে ভুলে যাচ্ছি ?’

‘এ মা তা কেন হবে ।’

‘তাহলে স্বচ্ছ, নির্মল, হৃদয়-জারিত সেই ভালোবাসার ভাষা, বোধ, গান, ছবি কোথায়?’

ইন্দ্রানী উত্তর না দিয়ে ফুলদানির জল পাল্টে প্লাষ্টিক ফুলগুলো ধুয়ে মুছে আবার সাজিয়ে রাখে। দেখে যেন মনে হয় এখুনি ফুটেছে।

‘তুমি আমায় এড়িয়ে গেলে কিন্তু আবার। ‘

‘এর পরও বলবে ওই কথা?’

‘কি?’

‘এখন সবটাই মেক বিলিভ, প্রতীকী  – ফুল, ভালোবাসা এমনকি আমার তোমার ওপর রেগে ওঠাও। ‘

অস্থির অসহায় নিস্তব্ধতা। খড়দহ স্টেশনে ট্রেনের ভোঁ। প্রতিদিনের মতো আজও বৌয়ের কাঁধে ভর দিয়ে লাঠি নিয়ে কামরায় উঠলো অন্ধ বাবলু। শীর্ণ চেহারা, খাঁকি প্যান্ট, কোঁচকানো জামা, একমুখ পাকা দাড়ি, হলুদ দাঁত, বিড়ি পোড়া ঠোঁট। শরীর জুড়ে সময়ের করাল ঝাপট। অথচ আহা কি গলা। চোখ বুঝলে একদম হেমন্ত। সেই মরুতীর্থ হিংলাজের গান – পথের ক্লান্তি ভুলে। সেই দাদার কীর্তির – এই করেছো ভালো নিঠুর হে। সেই গরিবের মেয়ের – পৃথিবীর গান আকাশ কি মনে রাখে। তোবড়ানো এনামেলে – এক টাকা , দু টাকা , বড় জোর পাঁচ টাকার বিনিময়ে একের পর এক – শুধু হেমন্ত গান – অন্ধ ভিখিরি বাবলুর কণ্ঠে। চায়ের ভাঁড় হাতে ধরিয়ে, বাবলুকে জিগ্যেস করেছিলাম – হ্যাঁগো, তোমার আপসোস হয়না?

‘কিসের গো দাদা?’

‘এই যে তাকে কোনো দিন দেখতে পেলেনা। ‘

‘আপসোস কিসের? গুরু তো অন্তরের মানুষ। আমারএই হৃদয় জুড়ে চিরকাল হেমন্তের বসন্ত। ‘

‘চিরকাল ওঁর গানই গাইছো ?’

‘না,না শুরু করেছিলাম পান্নালালের শ্যামাসংগীত দিয়ে। তারপর দেখলাম সারাদিন অফিসে গলদঘর্ম হেনস্তা হয়ে কেউ আর মায়ের নাম সে রকম নেয় না। তখন হেমন্তকে ধরলাম। ভিক্ষের বাজারে আয় হতে লাগলো ‘,

‘এতো গান শিখলে কি করে ?’

‘শুনে শুনে। জানো তো আমরা এই অন্ধরা খুব ভাগ্যবান গো দাদা। ‘

‘বুঝলাম না । ‘

‘নানা রকম দেখার বালাই  নেই, তাই তার স্মৃতিও নেই । গানের শব্দকে আমরা সুর দিয়ে এঁটো করে অন্তরে বসাই । তোমরা বৌকে দু চোখ দিয়ে পরখ করে চুমু খাও আমরা অনুভবের দু’হাত বাড়াই।’

‘আর কারো গান শোনাও না। ‘

‘ওটা আর পারবো না গো দাদা – গুরু ছাড়া আর কারো গান তো এই গলায় আসে না। উনি আমার ভগবান।’

ডাউন রানাঘাট লোকালের এনাউন্সমেন্ট হতেই বাবলুর বৌ বাধ সাধলো। তার হেমন্ত স্বামীকে নিয়ে ওভারব্রিজ পার হতে হবে। অলির কথা গলায় বসিয়ে রোজগার। বাড়িতে ছেলে বৌ থেকেও নেই।

সেদিন – আমি, মানে তন্ময় – একটা জিনিস মনে করার চেষ্টা করছিল। ঠিক কজন শিল্পী, এই বাবলুর মতো হেমন্ত গায়কীর উজান ঠেলে প্রতিষ্ঠিত পারে উঠেছেন। দ্বিজেন, তরুণ, সুবীর, শিবাজী, সুমন, বীথিন নামগুলো যেন সুরের আকাশে হেমন্ত তারা। বাবলুর মতো রাতের অন্ধকারে আরো অনেক তারা আছে যাদের গান শুনে একসময়ে কলেজের ফ্রেশার্স প্রোগ্রামে মেয়েরা ঠিক করে নিতো ঠিক কোন গায়কের সঙ্গে আগামী তিন বছর অন্তত নায়িকা হবে, পাশে বসে, ঘাড়ে মাথা রেখে ক্যান্টিনে কদর পাবে।

বৃষ্টি নামতে তন্ময়ের মনে পড়লো ছেলেবেলার টালির চালের গ্রামের স্কুল – কালিপদ বেরার কথা। বাধাবিপত্তি কাটিয়ে কালিপদ জীবনটাকে নতুন করে শুরু করবে ভেবে প্রায় বাইশ বছর বয়েসে ভর্তি হয়েছিল সপ্তম শ্রেণীতে। তন্ময়রা ডাকতো কালিদা বলে। সে ছিল স্কুলের সব অনুষ্ঠানের বাঁধাধরা সঙ্গীতশিল্পী। অপূর্ব গানের গলা ছিল।

এক দিন প্রধানশিক্ষক খবর দিলেন, কালীদার বম্বে থেকে চিঠি এসেছে। জানা গেল, চিঠির লেখক সঙ্গীতশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। কালীদা কোন একটা পত্রিকা থেকে হেমন্তের ঠিকানা জোগাড় করে, তাঁকে চিঠি লিখেছিল, তাঁর বাড়িতে কাজের লোক হিসেবে থেকে গান শিখতে চেয়ে। জানিয়েছিল তার দারিদ্রের কথা।

তার উত্তরে হেমন্তবাবু তাকে মন দিয়ে লেখাপড়া করতে বলেছেন। লিখেছেন, তোমাকে মানি অর্ডার মারফত সামান্য কিছু পাঠালাম, গ্রহণ করো। আরো জানা গেল উনি যে পরিমাণ টাকা পাঠিয়েছেন, তা এই দরিদ্র ছাত্রের সারা বছরের খরচ। সঙ্গে কালীদার অনুরোধে নিজের সই করা একটি ছবিও পাঠিয়েছেন। তন্ময়ের আরো অভিভূত হবার পালা এলো যখন পরের বছর একই সময়ে, হেমন্তবাবু সমান পরিমাণ আর্থিক সাহায্য কালীদাকে আবার পাঠালেন, সঙ্গে তাঁর লেখা একটা চিঠিও।

বাঙালির জন্মকাল থেকে ‘অন্যের ব্যাপারে দাঁত কপাটি’ মুদ্রাদোষ কারো অজানা নয়। শচীনকত্তার মতো হেমন্তবাবুরও সেটা কিন্তু ছিল না। সংগীত কিংবা ফিল্মের, পেশাদারি রাস্তায় কোনো বাঙালিকে এগিয়ে দেবার ব্যাপারে তিনি ছিলেন মূলসূত্রধার। গীতাঞ্জলি  প্রোডাকশন্সের, বীরেন নাগের সুপার হিট বিস্ সাল বাদ ছবি দিয়েই নায়ক বিশ্বজিৎ’এর ক্ষণিকের জয়যাত্রার শুরু। আর উত্তমকুমার? নিজের পায়ে কুড়ুল মেরেছিলেন নইলে ‘ছোটি সি মুলাকাত’এর বাঁচা মরার লড়াই মহানায়ককে লড়তেই হত না। হেমন্তবাবুই ১৯৬২ সালে বলিউডের দরজা খুলে দিয়েছিলেন। ওয়াহিদা রেহমানের সঙ্গে একক নায়কের চরিত্রে আমন্ত্রণ করেছিলেন উত্তমকুমারকে ‘শর্মিলী’ ছবিতে কাজ করার জন্য। সমস্তটাই তৈরি ছিল, জাতীয় সংবাদ পত্রে বিজ্ঞাপন থেকে আসানসোলের শুটিং, প্রচুর টাকা পয়সা অ্যাডভান্স ইত্যাদি। কিন্তু উত্তমকুমার কথা দিয়ে কথা রাখলেন না। ছবির কাজ শুরুতেই শেষ। বিপুল অর্থনৈতিক মাশুল গুনতে হলো হেমন্ত কুমারকে। যদিও দু’বছর পরে ফিরে এলেন বিশ্বজিৎ, ওয়াহিদা, ‘কোহরা’ আর কাইফি আজমির লেখা সেই চিরস্মরণীয় গান ‘ইয়ে নয়ান ডারে ডারে, ইয়ে জাম ভরে ভরে’ নিয়ে তবু অস্বস্তির চিড় ধরলো উত্তম-হেমন্ত স্মরণীয় জুটির মধ্যে। পরবর্তী কালে সেরকম আর জোড় লাগেনি। ইতিহাসের পাতায় রয়ে গেলো মহানায়কের হিন্দি ছবিতে অসফল হবার প্রথম ভুল যা সর্বতোভাবেই মারাত্মক ছিল।

অভির  কথাগুলো, হেমন্তের জন্ম শতবর্ষে এলাচ গন্ধের মতো ছড়িয়ে পড়ছে রবিচক্রের ফেসবুক পাতায়। স্ক্রল করে পড়তে পড়তে তন্ময় কমেন্ট বক্সে লিখতে শুরু করলো, ‘তখন আসাম জুড়ে ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন চলছে। আমার পোস্টিং গুয়াহাটিতে। দলে পরে জুড়ে গিয়েছিলাম বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে। ফ্যান্সি মার্কেটের পাশের মাঠে জলসা। হেমন্তবাবু ওঁর চিরাচরিত পোশাক ধুতি, শার্ট পরে গান গাইতে উঠলেন। দর্শকদের মধ্যে বাঙালি, অসমিয়া ছাড়াও বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ ছিলেন। অসমিয়া দর্শকরা চিৎকার করতে লাগলেন,সুপারহিট সিনেমা ‘নাগিন’-এর গান দিয়ে শুরু করতে হবে। হেমন্তবাবু দর্শকদের নমস্কার জানিয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান ধরলেন ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা’। চার পাশে তখন অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। গান শেষ হওয়ার পর, সব শ্রোতা কয়েক মিনিট ধরে হাততালি দিয়ে ওঁকে অভিনন্দন জানান। পরের দিন নামী সংবাদপত্র ‘আসাম ট্রিবিউন’ বিরাট করে এই সংবাদ প্রকাশ করে। শেষ করছি সেই রাতের চরম অভিজ্ঞতা দিয়ে। অনুষ্ঠান শেষে সবাই যখন ফিরব ফিরব করছি, এক বয়স্ক মিলিটারি অফিসার, আমার দু হাত ধরে প্রায় কেঁদে ফেলার জোগাড়। জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার। ধরে আসা গলায় সে বললে – আজ হামারা  জিভান সাফল হ্যায়। কাভি সোচা নাহিন থা কি হেমন্তজি কো ইতনে করিব সে দেখেঙ্গে। গীত কো সুনুঙ্গা। পুরানে দিন ইয়াদ আ গয়ে। হম সভি এক সাথ বেড়াক মে গাতে থে – বেকারার করকে হমে যুঁ না জায়িয়ে। । তব ভারত চীন কে সাথ য়ুধ মে থে। হেমন্তজী কা গানা হামারে লিয়ে টনিক থা। সে রাতে ব্রহ্মপুত্রের পারে স্কচের মিঠে আমেজে, সর্দারজি আরো অনেক কথার মধ্যে গেয়ে উঠেছিল বিয়ের রাতে বৌয়ের গলায় শোনা  – কাঁহি দীপ জলে কাঁহি দিল, যারা দেখ লে আকর পরওয়ানে। হেমন্তের সুরে লতা। আবেশে আচ্ছন্ন দুজনের সেদিন বাড়ি ফেরা আর হলো না। রাত কাটলো,পদ্মশ্রী নয়, পদ্মভূষণ নয়, সুরসাগরে পরম পদ্মনাভর আলোচনায়।

কমেন্ট পোস্ট করে তন্ময়  কি যেন ভেবে আলো নিভিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। দমকা হাওয়ার পিঠে বৃষ্টি নেমেছে। নিওন আলোয় হুলুস্থুল চারিদিকে ভাঙার শব্দ। গ্লাসনস্ত, পেরেস্ত্রোইকা, অভ্যুত্থান – ভাঙছে বার্লিনের দেয়াল, সমাজব্যবস্থা, বিশ্বাস, বোধ। কালচারাল উমফুন। সুমন গাইছে আর পিঠে বাঁধা জার্মান ‘শ্লাগার মিউজিক’এর ছায়া, নজরুল মঞ্চ ডুবিয়ে অঞ্জন গাইছে আর বিটলস’এর  ঢঙে উজিয়ে উঠছে মধ্যবিত্তের অতৃপ্ত বেলা বোস নস্টালজিয়া, শিলাজিৎ, নচিকেতা, ভূমি, ক্যাকটাস, লক্ষীছাড়া সবাই ঝিনচ্যাক ট্রেন্ডি কোমর ঝাঁকিয়ে আর টুংটাং কাঁধ দুলিয়ে গাইছে ‘জীবনমুখী গান’ ব্যান্ডের হুল্লোড়ে কেঁপে উঠছে ইনডোর স্টেডিয়াম, নব্বইয়ের কোঠায় পৌঁছে মান্না দে ইন্টারভিউতে বলছেন – ‘আচ্ছা বলুনতো আমরা কি তবে মৃত্যুমুখী  ছিলাম?’ আর এরই মধ্যে তালিম ছেড়ে, ওস্তাদের ঘরে না ঢুকে তরতরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে ‘শিল্পী’ টোকা মারলো তন্ময়ের দরজায়। ছিটকিনি খুলতেই পায়ে হাওয়াই চটি, কাঁধে গিটার, সবে গোঁফ দাড়ি ওঠা সাত তলার ফ্ল্যাটের ছেলেটা এক গাল হেসে ভেসে উঠলো। একটা সিডি বাড়িয়ে বললে – ‘আঙ্কল, আমার প্রথম সিডি। আপনি আর আন্টি শুনবেন। ইউ টিউব লিংকে প্লিজ একটা লাইক দিয়ে দেবেন। একচুয়ালি লাইক বাড়লে বিজ্ঞাপন পেতে সুবিধে হবে।’

‘ওহ আচ্ছা’ ছাড়া তন্ময়ের আর কিছু বলার ছিল না । কি বা বলার থাকতে পারে যে যুগে সবাই ভেবে নিয়েছে, গলা থাকলেই গায়ক, বলতে জানলেই আবৃত্তিকার, লিখতে জানলেই লেখক আর ক্যামেরা ফোন থাকলেই ফটোগ্রাফার ! বাংলাদেশ দূরদর্শনে দেওয়া শেষ ইন্টারভিউতে এই যুগের হাওয়ার দিকে ইঙ্গিত করে হেমন্তবাবু বলেছিলেন  –  কিচ্ছু করার নেই। তবে আমার ধারণা এরা একদিন বুঝবে, ইলেক্ট্রনিক অর্কেস্ট্রেশানের সঙ্গে যা হচ্ছে সেটা গান নয়, নয়েজ; যে ভাষায় গাইছে সেটা কোরাপ্টেড। তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তা মহান শিল্পের মাপকাঠি নয়। এরা বুঝবে যেদিন  বড় রকমের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

তন্ময়, টেবিলে, ৭৮ আরপিএম রেকর্ডগুলোর ওপর  সিডিটাকে রেখে বারান্দায় ফিরলো। রবীন্দ্র সরোবরের উল্টো দিকে অজস্র পাতারা তখন বৃষ্টির জল ঢেলে তাকে স্নান করিয়ে দিচ্ছে । কাল জন্মদিন – ১০০ বছর। কথারমালা নয় ফুলের মালা কণ্ঠে নিয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকবে নিশ্চল, নিশ্চুপ –  অপূর্ব,অদ্ভুত, একা। একটু হাঁটলেই মেনকা সিনেমা, বাড়ি। কিন্তু কোন ভালোলাগা তাকে নেমন্তন্ন করে নিয়ে যাবে? আরো অনেক ভালোবেসে কোন স্বপ্ন, সরোবরের জল থেকে উঠে এসে পাশে দাঁড়াবে? কোন সাথী প্রাণের সভাতলে নবরাগে রেগে, নতুন নতুন সুরের স্বরলিপি লিখবে?

ঝিরিঝিরি হাওয়ায় তন্ময়ের কাঁধে আলতো হাতের স্পর্শ।  ইন্দ্রানী পাশে দাঁড়িয়ে। অনুভবে অনুভব – অপেক্ষায় অপেক্ষা; বিশ্বাস – কোনোদিন কোনো এক নতুন গানের ভোর ভৈরবী চুরমার করে মেজর কর্ড বাজিয়ে ওদের জ্বেলে দেবে আরো এক অবাক পৃথিবীর সৃষ্টি লগ্নে।

যা কিছু  সম্বল উজাড় করে, অপেক্ষায় হেমন্তও – বাঙালির বন্যার কাছে ঘূর্ণির কাছে রেখে যাওয়া  অনন্য গানের দুর্বার ঝড়ের শিলালিপি; আবার  কখনো হাসতে, আবার কখনো কাঁদতে, জীবন জোয়ারে ভাসতে। আর এই রাতজাগা ধৈর্যদের, অপেক্ষাদের মুখে দমবন্ধ ধোঁয়া কেশে অন্ধকার চিরে দুরন্ত গতিতে চলে গেলো বেসামাল গাড়ি, গান জাতীয় কোন অশ্লীল আত্মম্ভরী আওয়াজ করে।

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


5 1 vote
Article Rating
3 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Shouvik
Shouvik
3 months ago

শ্রী নারায়ন সান্যাল একবার সকৌতুকে উল্লেখ করেছিলেন যে তার বই সাজাতে যে কোন গ্রন্থাগারিক নেস্তো নাবুদ হবেন কারণ কোন দুটি বইয়ের বিষয় এক নয় আবার একটি বইকে কোন একটি বিষয়ের তাকে ফেলা যাবে না। এই রচনাটি পড়ে তেমনি ধন্দ জাগে। একি প্রবন্ধ? না কি কাহিনী? না কি কিছুটা কবিতা ও গদ্যের হাত ধরাধরি? হোক যাই, নিবিষ্ট পাঠের দাবি রাখে। পরের লেখার জন্যে কৌতূহল রইল।

Himadri Kumar Das Gupta
Himadri Kumar Das Gupta
3 months ago

আহাঃ, হৃদয় নিংড়ে কী লিখলেন !!

দ্বৈপায়ন গোস্বামী
দ্বৈপায়ন গোস্বামী
3 months ago

খুব ভালো লাগলো লেখাটি পড়ে, লেখককে আমার আন্তরিক অভিনন্দন।