শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

প্রসঙ্গ : সাহিত্যিক সংবর্ধনা … মাইকেল মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথ।

সময়কাল ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দ। তারিখ ৭ ফেব্রুয়ারি। সময় সন্ধ্যে পৌনে সাতটা। বাতাসে শীতের হিমেল আমেজ । জোড়াসাঁকো সিংহীবাড়ি । এক প্রকান্ড হলঘর অসংখ্য রেড়ির তেলের প্রদীপে চমৎকার সাজানো। দেউড়িতে মশালচির মশালের আলোয় পথ আলোকিত। সদর দরজায় ঘোড়ার গাড়ি এবং বহু গণ্য-মান্য মানুষের ভিড়। রীতিমতো গমগমে পরিবেশ।

সেদিনের সন্ধ্যা মনীষায় উজ্জ্বল গণ্য-মান্য বিদগ্ধ ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। কে নেই? কিশোরীচাঁদ মিত্র থেকে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায় পর্যন্ত। আছেন সাহিত্যে উৎসাহী বহু সাধারণ মানুষ। বিরাট হলঘর ভর্তি। ঝাড়লণ্ঠনের আলোয় আলোয় পূর্ণিমা।

সংবর্ধনা সভার উদ্যোক্তাদের প্রধান ঐ প্রকান্ড বাড়ির মালিক। টকটকে ফর্সা । সুদর্শন। একুশ বছরের তরুণ জমিদার। নিজেও খুব গুণী। তাঁরই উৎসাহে ও আনুকূল্যে প্রতিষ্ঠা হয়েছে ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’র। এই সভায় আজ সন্ধ্যায় সংবর্ধিত হবেন কৃষ্ণবর্ণ, কোট-প্যান্টধারী এক আগন্তুক।

সাতটা বাজার প্রায় সঙ্গেই সেই আগন্তুক এসে উপস্থিত হলেন। নিঁখুত ইউরোপীয় পোশাক ও আদবকায়দায় এক দুর্দান্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ভারতীয়। উচ্চতা মধ্যমের চেয়ে একটু বেশি। ঈষৎ স্থূলকায়। আয়ত চোখ। মাথায় কালো ঝাঁকড়া চুল। মধ্যে সিঁথি করে আঁচড়ানো। গাল অবধি বিরাট জুলফি।

এই আগন্তুক হলেন স্বয়ং মাইকেল মধুসূদন দত্ত। আর উদ্যোক্তা হলেন তরুণ সাহিত্যরসিক মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহ। উদ্যোক্তারা পরম সমাদরে কবিকে নিয়ে হলঘরে বসালেন। শুরু হল অনুষ্ঠান।

দেওয়া হল মানপত্রের সাথে একটি রুপোর পানপাত্র। যাকে বলে ক্ল্যারেট জাগ। ইটালিয়ান ধাঁচে তৈরি। ভারি আকারের। গায়ে অতি সুন্দর কারুকার্য।

সাহিত্য-অনুরাগী এক তরুণ সভার তরফ থেকে মানপত্র পড়ে শোনালেন -“আপনি বাঙলা ভাষায় অমিত্রাক্ষর কবিতা লিখিয়াছেন। তাহা সহৃদয় সমাজে অতীব আদৃত হইয়াছে..আপনি বাঙলা ভাষার আদি কবি বলিয়া পরিগণিত হইলেন…আপনি বাঙলা ভাষাকে অপূর্ব অলঙ্কারে অলঙ্কৃত করিলেন- এজন্য আমরা আপনাকে অজস্র ধন্যবাদের সহিত বিদ্যোৎসাহিনী সভাপ্রদত্ত রৌপ্যময় পাত্র প্রদান করিতেছি…”

সকলের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা যা পেলেন তার দাম কোটি টাকারও বেশি। কৃতজ্ঞ দেশবাসীর ঐ পুরস্কারের মাধ্যমে মাইকেলের শিরে পরানো হল সম্রাটের তিলক।

কালীপ্রসন্ন সিংহ ও মধুসূদন দত্ত

বলা যায় এই প্রথম বঙ্গসাহিত্যের এক সেবককে দেশবাসীর পক্ষ থেকে যথাযোগ্য মর্যাদায় অভিনন্দিত ও পুরস্কৃত করা হল।

সাহিত্যিককে সংবর্ধনা দেওয়ার এই মহৎ প্রচেষ্টা কিন্তু পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে আর হয়নি। এমনকি বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্রকেও সংবর্ধনা দিতে এগিয়ে আসেননি কেউ। বঙ্কিমচন্দ্রের তো কথাই ওঠেনি, বিদ্যাসাগর মহাশয়কেও সোনার দোয়াত কলম দিয়ে সংবর্ধনা দেওয়ার প্রস্তাব বেশ কয়েক বছর ধরে হচ্ছে হবে করেও ভণ্ডুল হয়ে যায়।

অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের কথা, গুণগ্রাহী মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহ চলে গিয়েছিলেন মাত্র ৩০ বছর বয়সে। বাঙালি জীবনে তথা বঙ্গভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের সে ক্ষতিপূরণ হয়নি কখনো।

জোড়াসাঁকো সিংহীবাড়ির বিদ্যোৎসাহিনী সভায় যেদিন মাইকেল সংবর্ধিত হলেন তার তিনমাস পরেই মাত্র কয়েকখানি বাড়ির তফাতে ঠাকুর পরিবারে জন্ম নিলেন আর এক জ্যোতির্ময় শিশু। পরবর্তী দ্বিতীয় সংবর্ধনা নির্দিষ্ট শুধু এই নবজাতকের জন্যই। দেশবাসী অপেক্ষা করে রইলেন ৫০ বছর।

সাহিত্যাকাশে জ্যোতির্ময় রবির আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই অসংখ্য লোক দীর্ঘ সময় ধরে একটানা নির্মম আক্রমণ চালিয়ে যান। তবু তাঁকে রোখা কারু পক্ষেই সম্ভব হল না। তিনি ২০,২১ ও ২২ বছর বয়সে পর পর তিনবার সাহিত্যসাধনার স্বীকৃতি পেলেন খ্যাত সমালোচক এবং স্রষ্টার কাছ থেকে।

কালীপ্রসন্ন ঘোষ সে যুগের বিখ্যাত সাহিত্য-সমালোচক ও প্রবন্ধকার। উঁচুমানের মাসিকপত্র “বান্ধব” এর সম্পাদক। তাঁকে ‘পূর্ববঙ্গের বিদ্যাসাগর’ নামে সবাই একডাকে চিনত। ঢাকা থেকে প্রকাশিত বান্ধব পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের সপ্রশংস উল্লেখ করে লিখলেন -…”বাবু রবীন্দ্রনাথ এদেশের একজন উদীয়মান কবি… তার প্রীতিময়ী পবিত্র কবিতা সুরুচিসম্পন্ন পাঠকের চিত্তবিনোদন করিবে..বাংলা কবিতার পঙ্কিল জলে এরূপ নির্মল পুষ্প কি প্রীতিপদ।”…

পরের বছর ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ আদায় করে নিলেন স্বয়ং সাহিত্যসম্রাটের কণ্ঠের মালা। মেয়ের বিয়েতে উপস্থিত মহামান্য অতিথি বঙ্কিমচন্দ্রের গলায় মালা পরিয়ে দিতে গেলে সেই মালা বঙ্কিমচন্দ্র কাছেই দাঁড়ানো তরুণ রবীন্দ্রনাথের গলায় পরিয়ে দিয়ে বললেন – ”এ মালা ইহারই প্রাপ্য।”

তৃতীয় স্বীকৃতি এল তার পরের বছর ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে। সর্বজনশ্রদ্ধেয় মনীষী ভূদেব মুখোপাধ্যায় ” এডুকেশন গেজেট”-এ এক প্রবন্ধে তরুণ রবিকে “প্রকৃত আর্যকবি” আখ্যা দিলেন।

বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ

১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৫৬ বছর বয়সে বঙ্কিমচন্দ্র যখন চলে গেলেন, তখন তাঁর ফেলে যাওয়া রাজসিংহাসনের সবচেয়ে কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন ৩৩ বছরের রবীন্দ্রনাথ।

অবশ্য মাইকেলের শূন্য আসনে বঙ্কিমচন্দ্র “মহাকবি” আখ্যাায় যাঁকে ভূষিত করেন- সেই হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় তখনো আছেন। আছেন আরো দুজন “মহাকবি” নবীনচন্দ্র সেন ও গিরীশচন্দ্র ঘোষ। এঁদের ভক্ত পাঠকের সংখ্যা অনেক হলেও রবীন্দ্রসাহিত্যের পক্ষে-বিপক্ষে দোষ-গুণ বিশ্লেষণে, প্রশস্তি-নিন্দায় বাংলা সাহিত্যে তখন ঝড় তুলেছে।

আরও কয়েক বছর পার হল। রবীন্দ্রনাথের স্বীকৃতি বাড়ছে ক্রমেই, বাড়ছে তারিফও। কোনো কোনো দিশেহারা সমালোচক এহেন মন্তব্যও করেন ‘ভারতচন্দ্রের পর’ কিংবা ‘চন্ডীদাসের কথা’ বাদ দিলে – এইরূপ কবি নাকি আর বাংলা ভাষায় দেখা যায় নি।

১৯১০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ রবীন্দ্রনাথের জ্যোতির্ময়ী প্রভায় বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি শাখা উদ্ভাসিত। এমনকি তাঁর দুর্দান্ত ৭৬ টি ছোট গল্পের অধিকাংশই লেখা হয়ে গেছে। এই পটভূমিতেই রবীন্দ্র-অনুরাগীরা স্থির করলেন ওঁর পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে এক মহতী সংবর্ধনা সভার আয়োজন করতে হবে।

রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধনা দেবার কথাটা মুখে মুখেই চাউর হতে আরম্ভ করে। শুনে অনেকের চোখ কপালে উঠে গেল। রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধনা কেন দেওয়া হবে? রবীন্দ্রনাথের বয়োজ্যেষ্ঠ সাহিত্যাচার্য অক্ষয়চন্দ্র সরকার, স্যর গুরুদাস বন্দোপাধ্যায়, শিবনাথ শাস্ত্রী, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমুখ সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিরা তখনো আছেন। এঁদের একেবারে টপকে যাওয়া কেমন কেমন লাগে।

কিন্তু স্বয়ং গুরুদাস বন্দোপাধ্যায় যখন খুব উৎসাহের সঙ্গে রবীন্দ্র সংবর্ধনা প্রস্তাব সমর্থন করে দুর্দান্ত মরাল সাপোর্ট এনে দিলেন তখন তো আর বলার কিছু নেই।

“কবি সম্বর্ধনা” শিরোনামে এ সম্বন্ধে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হল ১৩১৮ বঙ্গাব্দের বৈশাখে।

…” রবীন্দ্রবাবু আমাদের দেশের একজন শ্রেষ্ঠ সাহিত্যসেবী;… তাঁহার একপঞ্চাশৎতম জন্মতিথি উপলক্ষে তাঁহাকে যথোচিত অভিনন্দন দেওয়া ও সম্বর্ধনা করা দেশবাসীর কর্তব্য বলিয়া মনে হওয়াতে নিম্নলিখিত মহোদয়গণকে লইয়া একটি সমিতি সংগঠিত হইয়াছে। সমিতি ইচ্ছা করিলে সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করিতে পারিবেন।

সমিতির সদস্যগণ – মহারাজা শ্রীযুক্ত মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দী, শ্রীযুক্ত জগদীশচন্দ্র বসু, শ্রীযুক্ত ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, শ্রীযুক্ত সারদাচরণ মিত্র, শ্রীযুক্ত রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, শ্রীযুক্ত যতীন্দ্রনাথ চৌধুরী, শ্রীযুক্ত রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, শ্রীযুক্ত প্রফুল্লচন্দ্র রায়, শ্রীযুক্ত হীরেন্দ্রনাথ দত্ত।

কিন্তু আমাদের দেশে ভালো কিছু হতে দেখলে, কিংবা কেউ সংবর্ধিত, পুরস্কৃত বা অভিনন্দিত হলে, তাতে বাগড়া দেবার লোকের অভাব হয় না। তাঁরা তখন অভিনন্দনযোগ্য ব্যক্তির হাজারো দোষ খুঁজে বের করতে সচেষ্ট হয় সেইসঙ্গে অনুষ্ঠান পন্ড করতে তৎপর হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রেও তাই হল ।

সংবর্ধনা ভণ্ডুল করতে বিরোধীরা এবার আসরে নামলেন। তাঁরা একে একে আপত্তি তুললেন – রবিবাবু কি আদৌ সংবর্ধনা পাওয়ার যোগ্য? না, যোগ্য নন। ওঁর জনপ্রিয়তা একটা হুজুগ মাত্র – রবীন্দ্রসাহিত্য কিছু বড়লোকের ড্রয়িংরুমের শোভা বর্ধন করে, এ ছাড়া আর কিছু নয়। অতীতে বাংলার মহামনীষীদের যেখানে সংবর্ধনা দেওয়া হয়নি, সেখানে রবিবাবুকে নিয়ে নাচানাচি কি অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি নয়?

অতএব ছাপাও হ্যান্ডবিল। বিলি করো রাস্তায় রাস্তায়, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুঝিয়ে বলো যে নজিরবিহীন এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠান ঘোরতর অন্যায় – এটা বন্ধ করতেই হবে।

ওদিকে আবার রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, স্যর গুরুদাস বন্দোপাধ্যায় প্রভৃতি বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি এ সংবর্ধনা সভা যাতে অনুষ্ঠিত হয়, সে ব্যাপারে একেবারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

এঁদের টলানো যাচ্ছে না কিছুতেই। মুশকিল! তাহলে, প্রচারের ধরন যে পাল্টাতে হয়!

সংবর্ধনা-বিরোধীরা জোর গলায় প্রচার চালালেন যে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ও গুরুদাসবাবুদের মত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের তেমন কোনো ইচ্ছে নেই। চক্ষুলজ্জার খাতিরে রাজি হয়েছেন মাত্র। আসলে সংবর্ধনা পাওয়ার লোভে রবিবাবুই ভিতরে ভিতরে কলকাঠি নাড়ছেন। সমস্ত পরিকল্পনাটাই তাঁর।

ব্যাপার এমন গুরুতর হয়ে দাঁড়াল যে রবীন্দ্রনাথ ঐ সংবর্ধনা নিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করলেন। উদ্যোক্তাদের কাছে চিঠি লিখে কাতর মিনতি জানালেন তাঁকে নিষ্কৃতি দিতে। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর কাছে লেখা দুটি চিঠিতে তাঁর মনোবেদনা ব্যক্ত করলেন–

“…আমাদের দেশে জন্মলাভকে একটা পরম দুঃখ বলিয়া থাকে, কথাটা যে অমূলক নহে তাহা আমার জন্মদিনের পঞ্চাশৎ সাম্বৎসরিক উপলক্ষ্যে বিশেষভাবে অনুভব করিবার কারণ ঘটিল… ভগবানের কৃপায় আমি সত্য মিথ্যা অনেক নিন্দা জীবনে বহন করিয়া আসিয়াছি। আজ আমার পঞ্চাশৎ বৎসর পূর্ণ হইবার মুখে এই আর একটি নিন্দা আজ আমার জন্মদিনের উপহাররূপে লাভ করিলাম এই যে আমি আত্মসম্মানের জন্য লোলুপ হইয়াছি।

এই নিন্দাটিকেও নতশিরে গ্রহণ করিয়া আমার একপঞ্চাশৎ বৎসরের জীবনকে আরম্ভ করিলাম….”

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে আর একটি চিঠিতে লিখছেন -“… আপনি জানেন আমি সংসারের জনতা হইতে সরিয়া আসিয়াছি। আজ আমাকে এই গ্লানির মধ্যে কেন টানিয়া আনিলেন? অন্তর্যামী জানেন আমি মিথ্যা বলিতেছি না, এই সম্মানের ব্যাপার হইতে নিষ্কৃতি লাভ করাই আমি আমার পক্ষে কল্যাণ বলিয়া মনে করি.. এই জন্য আপনাদের কাছে সানুনয়ে আমি মুক্তি ভিক্ষা করিতেছি…”।

সংবর্ধনা উদ্যোক্তারা পড়লেন মহা মুশকিলে। কোন দিক সামলান? মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। যে মহৎ কাজে তাঁরা ব্রতী হয়েছেন উত্তেজিত হলেই তা পন্ড হয়ে যেতে পারে। অনেক কষ্টে তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করালেন।

রবীন্দ্রবিরোধিতা ও সংবর্ধনা সভা ভণ্ডুল করার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিখ্যাত “সাহিত্য” পত্রিকার সম্পাদক সুরেশচন্দ্র সমাজপতি ও তাঁর দলবল। কিন্তু এত প্রচেষ্টা চালিয়েও তাঁরা সংবর্ধনা সভা পন্ড করতে পারেন নি।

২৫শে বৈশাখ থেকে পিছিয়ে ১৩১৮ বঙ্গাব্দের ১৪ই মাঘ টাউন হলে মহাসমারোহে রবীন্দ্র সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়। ফুলের তোড়া দিয়ে টাউন হলের ভিতর এবং বাহির খুব সুন্দর ভাবে সাজানো হয়। হলের মধ্যে ধূপের সৌরভ। প্রকান্ড হলঘর ও বারান্দা কানায় কানায় পূর্ণ। নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ বিশিষ্ট মানুষদের ভিড়। হলঘরের চেয়ারের পিছনে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ানোর জায়গা ও দু’পাশের করিডোর পর্যন্ত ঠেসাঠেসি।

এক-একজন বিখ্যাত ব্যক্তি হলে ঢুকছেন আর উল্লসিত দর্শকদের হাততালিতে হল ফেটে পড়ছে। এরকম দারুণ হাততালির মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করলেন স্বর্ণকুমারী দেবী, সরলা দেবী, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, গোপালকৃষ্ণ গোখলে। তারপর প্রচন্ড হাততালির শব্দে টাউন হল যখন টলে উঠল, তখন বোঝা গেল রবীন্দ্রনাথ আসছেন।

তারপর শুরু হল ঐকতান বাজনা। কিন্তু শ্রোতাদের চিৎকারে সে বাজনার আওয়াজ যেন ঢাকা পড়ে গেল। সভাপতি সারদাচরণ মিত্র বক্তৃতা শুরু করলে হৈ-হল্লা অনেক কমে যায়। পন্ডিত ঠাকুরপ্রসাদ আচার্য সংস্কৃত ভাষায় স্বস্তিবচন করেন।

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী পড়ে শোনালেন একটি সুন্দর মানপত্র। তারপর রবীন্দ্রনাথের হাতে তুলে দিলেন উপহার। হাতির দাঁতের ফলকে খোদাই করা অভিনন্দন, রূপোর অর্ঘপাত্র। সোনার তৈরি অতি চমৎকার পদ্মফুল এবং সোনার সুতোয় গাঁথা মালা।

রবীন্দ্রনাথের পরনে সেদিন ছিল সাদা ধুতি, সাদা পাঞ্জাবি ও সাদা চাদর। রবীন্দ্রনাথ আগাগোড়াই খুব শান্ত ভঙ্গিতে বসেছিলেন। এবং তাঁর চেহারার ‘অপূর্ব করুণ সৌন্দর্য’ সমস্ত দর্শকদের হৃদয় হরণ করেছিল।

রবীন্দ্রনাথের প্রতি দেশবাসী যে কতখানি কৃতজ্ঞ, তার খোলাখুলি বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল এদিনের সভার হৃদয়-ভরা ভালবাসার মধ্য দিয়ে। নবীন-প্রবীণ বক্তারা রবীন্দ্রনাথের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ব্যক্ত করেন।

অভিনন্দনের উত্তর দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে উপলক্ষ্য মাত্র উল্লেখ করে এ সভায় পাওয়া সব সম্মান ও আদর জননী বঙ্গভাষা এবং দেশের মানুষকে উৎসর্গ করলেন।

এরপর কিশোরী ও মহিলারা এগিয়ে এলেন কবিকে “পুষ্প-অর্ঘ্য” দেবার জন্য। উঠে দাঁড়িয়ে সেই মানবশ্রেষ্ঠ ফুল উপহার নেন। তারপর এল সাহিত্যিকদের পালা। শেষে ক’টি গান ও ঐকতান বাজনার পর সভা ভঙ্গ হল। প্রবল জয়ধ্বনির মধ্যে রবীন্দ্রনাথ হলের বাইরে চলে গেলেন। আগাগোড়া ফুলের মালায় সজ্জিত তাঁর গাড়ি পথের বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

————————————————————————-

বই: সোনালী দিনের পাখিরাঃ সুজিতকুমার সেনগুপ্ত।

 

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


2 1 vote
Article Rating
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়
তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়
5 months ago

অসামান্য দুই প্রজন্মের দুই সাহিত্যিকের নাগরিক সম্বর্ধনার ইতিবৃত্ত।