শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাঃ এক অনিকেত মানবতাবোধের স্বপ্নকথন

” প্রেমের গান গাইতে গাইতে হঠাৎ গলা থেকে এক ঝলক রক্ত উঠে আসে। “

রক্ত আর ঘামতো তাঁর কবিতায় অক্ষরের মেরুদণ্ড। কোন দার্শনিক দ্যুতি বা নিছকই শূন্যগর্ভ নন্দনের জন্য তিনি শব্দের মিছিলে হাঁটেননি কোনদিনও। রক্তক্ষরণ, যন্ত্রণা, স্বপ্নভঙ্গ, ক্ষোভ বা দ্রোহকে আশ্রয় করেই তাঁর কবিতায় তিনি জীবনলগ্ন থেকেছেন বারবার।

তিনি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সমাজসংবেদের স্পন্দন বুকে নিয়ে কবিতায় সারাজীবন মাটিলগ্ন থেকে গেছেন এমন কবি বাংলা সাহিত্যে বেশ কিছু আছেন। কিন্তু তিনি অনন্য অন্য কারণে। চিরকালই তাঁর সমাজ- বীক্ষণ একেবারেই তাঁর নিজস্ব কৌণিকতা! তাঁর চেতনার কাছে তাঁর মুক্ত বিবেকের প্রতিশ্রুতিই বরাবর ছিল মানবিক কম্পাসের দিগদর্শন। নিশ্চিত করেই তা কোন সঙ্ঘলগ্ন আরোপিত বীক্ষণ নয়।

প্রাক- স্বাধীনতায় চরমপন্থী আন্দোলের প্রতি সাময়িক আগ্রহ বা পরবর্তীকালে আর এস পির সঙ্গে সাময়িক ঘনিষ্ঠতা তাঁর মূল পরিচয় তৈরি করেনি কখনো। আসলে সঙ্ঘ- বিশ্বাসে তিনি ছিলেন অনিকেত! মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতায় নিজস্ব বিবেকই ছিল তাঁর একমাত্র আশ্রয়।

কালের পরিবর্তনের সমান্তরালে কাব্যগ্রন্থ ধরে ধরে তাঁর কবিতার বিবর্তন ও স্পন্দমানতা নিয়ে আলোচনা ছোট পরিসরের এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। এক জায়গায় তিনি লিখছেন,” সময়, স্বদেশ,মনুষত্ব– কবি, কবিতা, কবিতার পাঠক কোথাও যদি একসূত্রে বাঁধা যেতো!” তাঁর কবিতার মুলসুর এই উদ্ধৃতিরই নির্যাস, যেখানে স্বদেশ ও মনুষত্ব পরস্পরবিচ্ছিন্ন নয়। এই আলোকিত দিক রেখা ধরে সামান্য কিছু উদাহরণ নিয়ে তাঁর কবিতার মূল প্রস্বরগুলোকে একটু ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করা যাক এই প্রবন্ধে।

গড়পড়তা অগোছালো ঘেঁটে যাওয়া আবেগের মানুষ তাঁর কবিতায় কান পাতেন। আর নিজের বুকের ধুকপুক গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলেন! আধা আলো আধা অন্ধকারে ফ্যালফ্যাল করে মিশে যেতে দেখেন প্রেম লিখতে গিয়ে কখন মাটি লিখে বসেছেন কবি! আর মাটি লিখতে গিয়ে, কষ্টের কথা। প্রেম,মাটি, স্বদেশ একাকার হয়ে গেছে যেন তাঁর কলমে।

“,তোর কি কোন তুলনা হয়

তুই

চোখ বুজলে হিমসাগর, চোখ মেললে অনন্ত নীল আকাশ….

তোর কি কোন তুলনা হয়?

তুই

ঘুমের মধ্যে জলভরা,মেঘ জাগরণে জন্মভূমির মাটি’ ( ‘তুই’/’ ‘আমার রাজা হওয়ার স্পর্ধা’)

অথবা,

“,রক্তকরবী, তোকে

বুকের মধ্যে যত খু্ঁজি, যন্ত্রণা বেড়ে যায়….

এখন গভীর রাত্রি ;

আমার স্বদেশ পায়ে পায়ে কোন তিমিরের অভিসারে

চলেছে সঙ্গোপনে

‘ কোথা যাও তুমি’? কেউ নেই তাকে

প্রশ্ন করতে পারে”

অথবা নীচের কবিতাংশ দেখুন। শরীরী সংবেদ আর যৌবনের ইশারা সাজিয়েছে শব্দের আবহ! জীবনের গন্ধ টেনে টেনেই তাতে জড়িয়ে যায় জীবনের জটিলতা আর থোক থোক যন্ত্রণা! প্রগাঢ় বুনুনির মায়াজাল ছিঁড়ে প্রেমকে জীবনের যন্ত্রণা থেকে সেখানে আলাদা করা যায় না!

“বুক থেকে একটি টানে ছিঁড়ে ফেল রেশমি কাঁচুলি

বিষ-মাখানো যুগ্ম- স্তন মুক্ত করো,,চাঁদের কুয়াশা

জ্বলুক হীরার মতো নগ্ন দেহে, যাতে আমরা ভুলি;

এস বুকেবুক রেখে জ্বলতেজ্বলতে মিটাই পিপাসা”

( উদ্বাস্তু/ সভা ভেঙে গেলে)

অথবা,

“একটি মেয়ে উপুড় হয়ে কাঁদছে যন্ত্রণায়

বিবর্ণ তার নয়ন দুটি, কিন্তু বড় মিঠে

একটি ছেলে জানে না, তাই অঘোরে নিদ্রা যায়

জানলে পরে থাকতো এখন পঙ্খীরাজের পিঠে।”

(‘ আশ্চর্য ভাতের গন্ধ রাত্রির আকাশে’/’ দিবস রজনীর কবিতা’)

এ কোন তেপান্তরের গল্প? শুরু হয় প্রেমের শিহরনে। সে-প্রেম যেন পাপড়িতে লেগে থাকা শিশিরের মতো! তারপরেই বিষাদ দিয়ে আঁকা এক মরমি বিরোধাভাসে চোখ জুড়িয়ে যায় আমাদের। ‘ মিঠে’ আর ‘ বিবর্ণ’ এই দুই বিষম রঙে রূপকথার এক পটছবি! রোদবেলায় শুকিয়ে ওঠা এক নিস্তেজ ফুলের মতো সে বৈপরীত্য। কোন এক স্বপ্নঘুম থেকে উঠেই এক তেপান্তরের উড়ান এসে রূপোর কাঠির স্বপ্ন যেন ছু্ঁইয়ে দিয়ে যাবে মাটিলগ্ন ‘ বিবর্ণ’ এক অবহেলিত যন্ত্রণাকে।

হতাশা এসেছে বারবার। কিন্তু তাও যেন সৃজনশীলতায় সংবেদী। অক্ষরের পোষাকের ভিতর সেখানে রূপকেরা শীতঘুমে জেগে থাকে। কিন্তু কে জানে! নক্ষত্রেরা বুঝি সরে যায় একটু একটু করে! আর বুঝিবা সময় হারিয়ে ফেলে সময়েরই গতিপথ! রূপকেরাও তাই বোধহয় নিরাশ্রয় হয়ে যায়। সময়ের বুকে দাপিয়ে ঘুরে বেরায় শুধু নির্মোক আর প্রতিভাস।

” কে মুখোশ, কে মুখ এখন

স্পষ্ট কিছু দেখা যায় না, কঠিন অসুখ

সেরে গেলে যেরকম হয়”

তাঁর মাটির গন্ধমাখা কবিতায় সংগঠিত রাজনীতির যান্ত্রিক বাঁধুনি ছিল না! বয়নে বয়ানে শেকড়ের বিস্তার নাকি শিথিল সেখানে। এমনি বলে থাকেন কোনো কোনো পাঠক বা সমালোচক। ভাগ্যিস! ভাগ্যিস কোন যান্ত্রিক বাঁধন নেই। তাইতো মাটির রূপকথারা গল্পে গল্পে স্বপ্ন বুনতে ভুলে যায় না তাঁর কবিতায়!

“ন্যাংটো ছেলে আকাশে হাত বেড়ায়

যদিও তার খিদেয় পুড়েছে গা

ফুটপাথে আজ জেগেছে জোছনা;

চা্ঁদ হেসে তার কপালে চুমু খায়।

লুকিয়ে মোছেন চোখের জল, মা”( ‘ফুটপাতের কবিতা’/ ‘আর এক আরম্ভের জন্য’)

যুক্তি ও তত্ত্বের শৃঙ্খলে বাঁধা আদর্শের পক্ষে এই অমিতাচারী স্বপ্নকথনকে প্রশ্রয় দেওয়া সম্ভব ছিল না। জানতেন তিনি। তাই মাটি ও মানুষের কথা বলেও তিনি অনিকেতই রয়ে গেলেন একরকম! তাঁর কলম চলল নিজেরই চলনে। মানবিক ধুকপুকগুলো বুকে নিয়ে।

” বরং তাকেই একদিন আকাশ ছাড়তে হয়, যার,স্পর্ধা আকাশ ছু্ঁয়ে যায়।”— প্রতিস্পর্ধার একটা শিহরন এই কাব্যিক উচ্চারণে সংহত লড়াইয়ের অভিমুখ তৈরি করল ঠিকই, কিন্তু পরমুহূর্তেই বললেন–

“কেউ কাউকে রাস্তা ছেড়ে দেয় না,যতদিন এই পৃথিবীতে গান থাকে,

গানের মানুষ থাকে, স্বপ্ন থাকে…”( ‘রাস্তা কারও একার নয়’/ ‘ অথচ ভারতবর্ষ তাদের’)

এই রোমান্টিক ভাবালুতা সূত্রেগাঁথা লড়াই থেকে কবিকে মুক্তি দেয়। প্রমাণ করে, মাটিতে মাখামাখি তাঁর গাঢ় নিঃশ্বাস এক স্বাধীন চলন! কোন প্রাতিষ্ঠানিক শেঁকল তাকে বেঁধে রাখেনি!

” গোটা পৃথিবীকে গিলে খেতে চায় সে-ই যে ন্যাংটো ছেলেটা/ কুকুরের সাথে ভাত নিয়ে তার লড়াই চলছে চলবে”— এই দৃপ্ত বীক্ষণ আর অঙ্গীকারতো ঠিকই ছিল!

হাজার হাজার বার নির্দ্বিধ উচ্চারিত হলো শ্লেষে ব্যঙ্গে–

“এই রাজা আসে ওই রাজা যায়

জামা কাপড়ের রং বদলায়

দিন বদলায় না( ‘রাজা আসে যায়’/ ‘ বেঁচে থাকার কবিতা’)

তাওতো ঠিক। কিন্তু অভিমুখ হারিয়ে ফেলার ভয়ে শেষ লাইনের হতাশা সঙ্ঘ রাজনীতি লালন করবেনা জেনেও তিনি তাঁর সংবেদ নিয়ে লগ্ন রইলেন সেই বিশ্বাসে, যেখানে অন্ধকারই আলোর জন্মদাত্রী। হতাশার গর্ভেই ধীরে ধীরে উঠে জন্ম নেয় স্বপ্নের কথামালা। ” দিন বদলায় না”-ই দিন বদলের প্রতিশ্রুতি!

কখনো কবিতায় লগ্ন নিঃশ্বাসে মিশিয়ে দিয়েছেন বেঁচে থাকার আঁচড়গুলো । আর অভিমানে, কষ্টে একা হয়ে গেছেন ক্রমাগত !

“ কবিতা

তুমি কেমন আছো?’

যেমন থাকে ভালোবাসার মানুষ

অপমানে“

অথবা অভিমানে অভিমানে আরও গাঢ় করে তুলেছেন নিজের গহন একাকিত্ব!

“” ভালোবাসার কান্নাগুলি

নির্বাসনের একাকীত্বে

ভিক্ষা চাইবে?

দেবার মানুষ নেই।”

তবে সে ব্যক্তিবিষাদ তুচ্ছ করে তাঁর ব্যক্তি অভিমানকে গণ-যন্ত্রণার বিরুদ্ধে সোচ্চার অক্ষরকথায় তুলে এনেছেন যগযুগান্তের অন্ধকারের বিরুদ্ধে, সংহত ক্ষোভে, মানুষের প্রতি ভালোবাসায়।

” কোথায় তাদের মান? দেশ থাকতে দেশ নেই,

পথের ঠিকানা নেই,

অথচ ভারতবর্ষ তাদের রক্ত ও হাড়– তারাই গড়েছে এই মহাদেশ

শত শতাব্দীর শ্রমে, পরিচ্ছন্ন সততায়,,শুভেচ্ছায়- বোধে” ( ‘অথচ ভারতবর্ষ তাদের’/’ অথচ ভারতবর্ষ তদের’)

কবিতাকে নিছক শব্দবিলাস যিনি মনে করেন না, তিনি এই কবিতায় কতটুকু শ্লোগান আর কতটুকু শীলিত শিল্পের স্পর্শ,তা খু্ঁজতে যাবেন না। মহান মানবিক অনুভূতিটুকুকেই ছুঁয়ে দেখবেন শুধু।

নিগড়ে বাঁধা প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতি অথবা সৃজনের প্রাতিষ্ঠানিক লালন যে মানুষটা বিতৃষ্ণার দৃষ্টিতে দেখে নিভৃতযাপনেই রেখে গেলেন তাঁর গোটা অক্ষরজীবন, তিনিই তো বলতে পারেন

“………ঢের

পুরস্কৃত হওয়া যেত,এমন সুযোগ

উপোসেও নেয়নি সে, সয়েছে দুর্যোগ।”( ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়’/ ‘ মহাদেবের দুয়ার’)

কী অমোঘ এই চপেটাঘাত! সস্তায় অর্জনের গা ঘিনঘিনে গড্ডালিকাতে আজ যেন তিনি আরো বেশি প্রাসঙ্গিক!

শ্রেষ্ঠ কবিতা সংগ্রহের ভুমিকায় বললেন–” প্রশ্নের উত্তর দেওয়া নয়, প্রশ্ন করাটাই কবির ধর্ম”

ঠিক এইখানেই তাঁর প্রকৃত উত্তরণ। প্রশ্নে প্রশ্নে কবির বোধ ছু্ঁয়ে জায়মান রয়ে যায় অনন্ত জিজ্ঞাসা। এক চিরকালীন নচিকেতা কবির বোধিতে জ্বালিয়ে রাখে এক অনির্বান দীপশিখা।

“তাই নিয়ে নচিকেতা,তবু তুমি গড়বে প্রতিমা?

অন্ধ হবে,,বোবা ও বধির

তবু ক্লান্তিহীন,,মৃত্তিকায় পুনর্জন্মের অস্থির

জিজ্ঞাসায় মৃত্যুর তুষার

বারবার হে্ঁটে হবে পার?

অগ্নিদগ্ধ দুইহাতে কতবার খুলবে তুমি যমের দুয়ার” ( ‘নচিকেতা’/ ‘ লখিন্দর’)

যে কোন কারণেই হোক এই কবিতাটা নিয়ে বিশেষ উচ্ছ্বাস বা মনোযোগ কমই দেখা যায়। অথচ কবি হিসেবে তাঁর সমস্ত বোধ ও বোধি, স্পন্দন ও রণন তুলে এনেছে এ কবিতা! বয়ন ও বয়ানের তীক্ষ্ণ সংবেদ ছুঁয়ে।

এই কবিতাটাই যেন তাঁর মননভূমির ভরকেন্দ্র।সঙ্ঘবিচ্ছিন্ন তাঁর সমাজ- মানবিক বীক্ষণ নিছকই এক রাজনৈতিক জিজ্ঞাসা নয়। বরং নিগূঢ়তম কোন অন্বেষা। তাই মাটিলগ্ন মানবপ্রেমে আদ্র হয়েও তা স্বপ্নসম্ভব মানবিক পৃথিবী ছু্ঁয়ে থেকেছে সর্বক্ষণ । এই স্বপ্নকথন একেবারেই অনিকেত এক মুক্ত পৃথিবীর অনুষঙ্গ।

© Pallab Ganguly

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.