শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

জীবনের উপান্তে এসে বাংলা ও বাঙালির যে কোনো অনুষঙ্গে ভাবনাটা তাড়িয়ে নিয়ে যায় উজান স্রোতে। সেদিনকার কত কথা আর কত স্মৃতির কোলাজকে বারেবারে বর্তমান বাঙালির এই পোড়া সংসারের অধিবাসী মনটা ছুঁতে চায় একটু ধনী হওয়ার প্রত্যাশায়। গতানুগতিকতায় গা ভাসিয়ে সবই চলছে বটে, তবু ১৯৫৬ সালের পুজোয় প্রথম শোনা শচীনকত্তার পুরানো গন্ধ-মাখা চিরনতুন গান ‘তুমি আর নেই সে তুমি’ শুনলে আজও হৃদয়ের রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যায়! নেই-নেই-নেই, কিছু নেই – একই আর একঘেয়ে শূন্যতায় বুকটা হু-হু করে ওঠে। আজকের দিনটা একেবারে গতকালের নকল! সম্ভবত Irving Wallace-এর কোনো লেখায় পড়েছিলাম, কথাটা মনে গেঁথে আছে – ‘Each day seems to be a xerox of the day before’। কাকভোরে কলাবৌয়ের স্নান যাত্রায় ঢাকের আওয়াজে ঘুম ভাঙানো শরীর-মনের সেই নিদারুণ রোমাঞ্চের শিহরণ – আজ ষষ্টি! কোথায় হারিয়ে গেল সেই অনুভব? সেদিন পুজো মানে তো শুধু ধূপ-ধুনোর গন্ধমাখা পুজো ছিল না; ছিল নতুন হাওয়া, নতুন আকাশ আর নতুন নতুন গানের আবেশে সেই পুজোকে মহিমান্বিত করে তোলা; ছিল কাগজের বিজ্ঞাপনে আর এইচ এম ভি-র ‘শারদ অর্ঘ্য’তে দাগ দিয়ে দিয়ে শনি আর রবিবারের অনুরোধের আসরকে গিলতে থাকা। মহালয়ার গান দিয়ে দেবী পক্ষের সূচনা। একই গান প্রতি বছর, অথচ প্রতি বছরই কী এক অমোঘ আকর্ষণ!


পুজোর গান বলতে বুঝি চলচ্চিত্র বহির্ভূত বেসিক রেকর্ডে আধুনিক বাংলা গান (78, EP-45, LP-33-1/3 R.P.M.)। ১৯১৪ সালে পুজোর গান প্রথম শুরু করে গ্রামাফোন কোম্পানি। সেইবার অমলা দাশের দুটো রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ড করা হয়। সংযুক্তির আগে কলম্বিয়া ও দ্য গ্রামাফোন কোম্পানি পৃথক পৃথকভাবে রেকর্ড প্রকাশ করত। ১৯৫২ সালে সংযুক্তির পর গড়ে ওঠে His Master’s Voice – সংক্ষেপে HMV । ‘পূজার গান’ নামে গানের তালিকার বই প্রকাশ হয় সম্ভবত ১৯৩০ সালে। ১৯৫৫তে নাম বদল হয় – ‘পূজার ডালি’। আবার নামের পরিবর্তন হয় – ‘শারদ অর্ঘ্য’, যা ১৯৬০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। এর পর ক্যাসেটের যুগ এসে যাওয়াতে ‘শারদ অর্ঘ্য’-এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। All India Radio অথবা আকাশবাণীর জন্ম হয় ১৯৩৬ সালে। ১৯৪০ সালের শুরুতে ‘গল্পদাদুর আসর’ এবং ‘সংগীত শিক্ষার আসর’-এর সঙ্গে একগুচ্ছ বাংলা গান নিয়ে ‘অনুরোধের আসর’ নামে একটি অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। কালক্রমে এই অনুষ্ঠানটির ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার নিরিখে গ্রামাফোন কোম্পানি(HMV) পুজোকে উপলক্ষ্য করে বাংলা আধুনিক গানের বেসিক রেকর্ডগুলো প্রকাশ করতে শুরু করে। আমার জানা ইতিহাস অতি সংক্ষেপে এইটুকুই। তথ্যে ফাঁক থেকে যাওয়ার আশঙ্কা করি।

তত্ত্বগতভাবে বাংলা আধুনিক গানের জনক বলতে তো আমি রবীন্দ্রনাথকেই বুঝি। কিন্তু সেই মহাকাব্যিক ইতিহাস নিয়ে নাড়াচাড়া করার পরিসর অন্যত্র। অন্যান্য বাংলা আধুনিক গানের সামগ্রিক ইতিবৃত্তও তো এক মহাভারত। আজকের ভাবনাটা শুধুই সেই অনুরোধের আসরে পরিবেশিত টাটকা রেকর্ড করা পুজোর গান নিয়ে। আহা, সে কী গান, সে কী দিন! তবে একটা কথা স্মরণ রাখা দরকার, বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে মনমাতানো প্রায় সব গানেরই প্রকাশ ঠিক পুজোর উপলক্ষ্যে নয়। তবে হ্যাঁ, পরবর্তীকালে অধিকাংশ গানই পুজোর গান হিসাবে চিহ্নিত। আমার চেতনাকে আচ্ছন্ন করা গানগুলোর সময়সীমাটা শুরু গত শতাব্দীর চল্লিশের মধ্যভাগ থেকে বড়জোর সত্তরের মধ্যভাগ পর্যন্ত। প্রায় শুরুতেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, জগন্ময় মিত্র – সংগীতপিপাসু বাঙালি চিত্তে এই ত্রয়ীর উজ্জ্বল উপস্থিতি।

অসাধারণ কথা আর সুরে সমৃদ্ধ বাংলা আধুনিক গানের জগতে ওই তিনটে দশকে বরণীয় শিল্পীদের তালিকাটা কিন্তু দীর্ঘ। বেচু দত্ত, সত্য চৌধুরী, সুধীরলাল চক্রবর্তী, শচীনদেব বর্মন থেকে শুরু করে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে ছুঁয়ে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য-জগন্ময় মিত্র-মান্না দে-শ্যামল মিত্র-সতীনাথ মুখোপাধ্যায়-মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়-সুবীর সেন- দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়-তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়-তালাত মাহ্মুদের প্রতি বছরের পুজোর গান তো আমাদের এখনও প্রাণিত করে রাখে। পাশাপাশি দিলীপ সরকার-মৃণাল চক্রবর্তী-শৈলেন মুখোপাধ্যয়-সনৎ সিংহ-সুদাম বন্দ্যোপাধ্যায়দের পুজোর গানগুলো শোনার প্রতীক্ষাও কিছু কম ছিল না। তবে সবাইকে ছাপিয়ে আমাকে সব থেকে বেশি আক্রান্ত করতেন পিয়াল শাখার ফাঁক দিয়ে একফালি চাঁদের জ্যোৎস্না ঝরানো অখিলবন্ধু ঘোষের গান। আহা!

পুজোয় মহিলা শিল্পীরাও ছিলেন সমান সম্ভ্রমের অংশীদার। তবে একটু পিছিয়ে গিয়ে যূথিকা রায়কে আমাদের স্মরণ করা উচিত। বলতে গেলে প্রণব রায়ের কথায় আর কমল দাশগুপ্তে সুরে ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত যূথিকা রায়ের ‘আমি ভোরের যূথিকা’ আর ‘সাঁঝের তারকা আমি’ দিয়েই পুজোর গানের রমরমা শুরু। এর পরের মধ্যমণি অবশ্যই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, ১৯৫০ সালে যাঁর ‘ওগো মোর গীতিময়’ মধুময় করে তুলল পুজোর আবহাওয়াকে। অবশ্যই স্বতন্ত্র গরিমা নিয়ে পুজোর গানের নৈবেদ্য সাজিয়ে প্রাণ মাতালেন গীতা দত্ত, লতা মঙ্গেশকর, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, উৎপলা সেন, সবিতা চৌধুরী, আরতি মুখোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীরা। আজকের প্রজন্মের হয়ত স্মরণ নেই, আর শোনাও হয় না সুপ্রীতি ঘোষ, বাণী ঘোষাল, গায়ত্রী বসু, ইলা বসু, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীদের সেদিনকার সোনাঝরা গানগুলো। বহু শিল্পী আর তাঁদের স্মরণীয় গানের দীর্ঘ তালিকা প্রকাশের অবকাশ এখানে নেই। কারণ ভাললাগা পুজোর গানের উল্লেখ যতই এখানে করি অনুল্লেখ থেকে যাবে আরও অনেক বেশি। আজ যাদের জীবন পশ্চিমে অনেকটাই ঢলে পড়েছে, তাদের অশেষ সৌভাগ্য বলতে হবে যে, আগ্রহ থাকলে ইউ টিউবের কল্যাণে তারা পেতে পারে অনেক হারানো মানিকের সন্ধান! ‘বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ কেড়ে নিয়েছে আবেগ’ – ‘দৃষ্টিপাত’ বইটার কথা মনে পড়ে? যাযাবরের এমন উক্তিকে এক্ষেত্রে অন্তত মান্যতা দেওয়া গেল না।
প্রশ্ন থাকতে পারে, পুজোর গানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য কী ছিল? না, আলাদা কোনো চরিত্র নেই সেই গানগুলির। আজকের প্রেক্ষিতে তফাতটা গড়ে দিয়েছে সময়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবনচর্চার গতিটা পালটে গেছে, ভবিষ্যতে নিশ্চয় আরও যাবে। তাই আমাকে প্রাণিত করা কম-বেশি সেই তিন দশকের বাংলা আধুনিক গানের মদিরতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে পুজোর শিরোপা পরিয়ে আলাদা করে কিছু গানকে বিশেষ মর্যাদা দিতে কুণ্ঠা হয়। কিন্তু পুজোর মথিত আবেশের মধ্যে বহু প্রতীক্ষিত সেই অতিরিক্ত এক গুচ্ছ গানের ডালির উপহার যে আলাদা এক রোমাঞ্চের জন্ম দিত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যেমন পুজোর সময় মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা ছায়াছবিগুলোর প্রতি মানুষের অতিরিক্ত উৎসাহ ব্যবসায়িক সাফল্যেরও একটা অন্যতম কারণ ছিল। কিন্তু তাই বলে সারা বছরের মুক্তিপ্রাপ্ত বাকি ছবিগুলির মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবার কোনো প্রশ্ন ছিল না।

আগেই বলেছি, বাংলা আধুনিক গানের আকর্ষণ আমার কাছে টেনেটুনে সত্তরের দশক পর্যন্ত। অবাক করার বিষয় হচ্ছে, তাঁদের জীবনের শেষ দশ বছরে সলিল চৌধুরী(১৯৯৫), হেমন্ত মুখোপাধ্যায়(১৯৮৯), রবীন চট্টোপাধ্যায়(১৯৭৬), সুধীন দাশগুপ্ত(১৯৮২), নচিকেতা ঘোষ(১৯৭৬), সতীনাথ মুখোপাধ্যায়(১৯৮২), শ্যামল মিত্র(১৯৮৭) ইত্যাদির মতো উল্লেখযোগ্য সুরকারদের কাছ থেকে দৈবাৎ এক-আধটা মনে রাখার মতো ভাল গান জুটেছে। এরপর নব্বইয়ের দশক থেকে এল ‘জীবনমুখী’ গান, যার প্রতিক্রিয়ায় সলিল চৌধুরীর চার লাইনের সেই ছড়াটা স্মরণ করা যেতে পারে –

“আলু খুইঁজ্যা পাইলাম না তাই
খাইলাম কচুমুখী
সুর খুঁইজ্যা পাইলাম না তাই
গাইলাম জীবনমুখী।”

দেখলাম তো, হঠাৎ এসে হঠাৎই কেমন হারিয়ে যায় এই সব গান। কই হারালো না তো রবীন্দ্রনাথ থেকে সলিল চৌধুরী! অবশ্যই আজকের বাংলা গানের এই অতল অন্ধকারের মধ্যেও কবীর সুমনের ‘তোমাকে চাই’, মৌসুমী ভৌমিকের স্বপ্নের গান ‘আমি শুনেছি সেদিন তুমি’ আর উপলের গাওয়া (চন্দ্রবিন্দু)- ‘আমি যে রিস্কাওয়ালা দিন কি এমন যাবে/বলি কি ও মাধবী তুমি কি আমার হবে’ – এমন ব্যাতিক্রমী গানের দৈবাৎ হঠাৎ আলোর ঝলকানিতেও চিত্ত ঝলমল করে ওঠে। আমার বিচারে ‘চন্দ্রবিন্দু’র এই গানটি পঞ্চাশের দশকে দিলীপ সরকারের অত্যন্ত জনপ্রিয় – ‘কাঠফাটা রোদে, পিচঢালা পথে, ঝড়-বাদল রাতে, শীতের রাতে রিকশা চালাই মোরা রিকশাওয়ালা’ গানটিকে কী কথার বিচারে কী সুরের মাধুর্যে নিশ্চিত টেক্কা দিয়েছে। তবে শিল্পী হিসাবে আমার কাছে অবশ্যই দিলীপ সরকারের মান্যতা অধিক। যারা দিলীপ সরকারের নামই শোনেননি তারা এই শিল্পীর গাওয়া অন্তত ‘তোমার ওই এলো চুলে’ আর ‘নীল সাগরের বালু তীরে’ গান দু’টি শুনে দেখতে পারেন।


আবার বলি, আর পাঁচটা ভাল গানের মতো ভাল কথা আর মনমাতানো বৈচিত্র্যময় সুরের সম্ভার নিয়েই পুজোর গান। তবু বিশেষ করে গানগুলোর মূল আকর্ষণ ছিল তার মেলোডি আর রোম্যান্টিকতা। গানের এই পথ চলায় বিভিন্ন বৈচিত্র্যের সমাহারে সাক্ষর রেখেছেন প্রধানত কমল দাশগুপ্ত, শচীনদেব বর্মন (যদিও নিজের গানের বৃত্তেই তাঁর অধিষ্ঠান), অনুপম ঘটক, রবীন চট্টোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, নচিকেতা ঘোষ, সুধীন দাশগুপ্ত, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, রতু মুখোপাধ্যায়, প্রবীর মজুমদার, মৃণাল চক্রবর্তী, ভি বালসারার মত সুরকারেরা। সঙ্গী গীতিকারদের প্রসঙ্গে মনে আসে শৈলেন রায়, মোহিনী চৌধুরী, বিমলচন্দ্র ঘোষ, অমিয় বাগচী, প্রণব রায়, শ্যামল গুপ্ত, সলিল চৌধুরী, সুধীন দাশগুপ্ত, পবিত্র মিত্র, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, মুকুল দত্ত, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ইত্যাদি অনেক নাম।


এখানে সলিল চৌধুরীর গান নিয়ে কিছু কথা বলার আছে। সন্দেহ নেই রবীন্দ্র পরবর্তী যুগের শ্রেষ্ঠ সাংগীতিক ব্যক্তিত্বের নাম সলিল চৌধুরী। অসামান্য এই সুরকার ও গীতিকার, তবু প্রেমের গানে তাঁর উৎসাহের অভাব কেন! সলিল-হেমন্ত জুটিতে পুজোর আধুনিক বাংলা গানের শ্র্রেষ্ঠ গৌরবোজ্জ্বল সৃষ্টিগুলোর নির্মাণ, যা চিরকালীন এক অক্ষয় সম্পদ। কথায় ও সুরে বৈচিত্র্যের ছোঁয়া, কিন্তু হরেক ফুলের গাঁথা মালায় প্রেমের নৈবেদ্যকে কষ্ট করে খুঁজতে হয় সলিলের গান-ভাণ্ডারে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা লতা মঙ্গেশকরকে নিয়ে কোনো গান নির্মাণের প্রশ্নে সলিল চৌধুরীর বিচার – ‘Sky is my limit’। তাহলে তাঁরই সুরে আর কথায় এই দুই বরেণ্য শিল্পীর গানে রোম্যান্টিকতা কই? লতার কিছু গানে তবু মেলডির ছোঁয়া আছে; কিন্তু ওই পর্যন্তই, প্রেমের রসায়নে তা জারিত নয়। অথচ সবিতা চৌধুরীর কণ্ঠে ‘মরি হায় গো হায়’ (১৯৫৮) সৃষ্টি করে সলিল আমাদের দেখিয়েছেন যে, এমন পরিসরেও তিনি কত সার্থক, কত মহান হতে পারে তাঁর গান। ‘গাঁয়ের বধূ’র স্নিগ্ধতা ও পেলবতায় মাখা গান বিপ্লবের পরিপন্থী – তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির এমন হাস্যকর ও মৌলবীসুলভ বিধান তাঁকে বিড়ম্বিত করলেও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের দাবিকে মান্যতা দিয়ে সলিল চৌধুরী তাঁর স্বকীয় শিল্পী-সত্তার প্রতি স্থিত থেকেছিলেন। তা হলে গণনাট্যের সেই ভাবাদর্শের প্রতি আজীবন পিছুটানের কারণেই কি মানবিক প্রেম সম্ভূত পরম রোম্যান্টিক সৃষ্টির ক্ষেত্রে তাঁর এমন সজ্ঞান উপেক্ষা? প্রশ্নটা থাকেই।

রবীন্দ্র সংগীত, অতুলপ্রসাদী, নজরুলগীতি, কীর্তন ইত্যাদি নানা ধরণের গান ‘শারদ অর্ঘ্য’-এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে শনি-রবিবারের অনুরোধের আসরে পরিবেশিত গানগুলোই আমাদের কাছে পুজোর গান হিসাবে আদরের। বাংলা আধুনিক গানের উপর চর্চিত গবেষণার তেমন কোনো ইতিহাসের সন্ধান আমার জানা নেই, পুজোর গান যে ইতিহাসেরই অংশবিশেষ। কিন্তু বোঝা তো দরকার, বাংলা আধুনিক গানের কালানুক্রমিক রূপান্তরের চরিত্র এবং চিত্রটা। যথার্থ বাংলা আধুনিক গানের ব্যাপ্তির সীমানাটা কোথা থেকে কোথায় তা নিয়ে ভাবনার অবকাশ তো আছেই। এই প্রসঙ্গে অনিবার্য প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতেই হবে – আধুনিকতার সংজ্ঞা কী? দু’ভাবে আধুনিকতার বিচার হয় – যা শাশ্বত (eternal), অথবা যা সমকালীন (contemporary)। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের প্রত্যাহিক জীবনচর্চার নানা অনুষঙ্গে কার কেমন আপন মনের মাধুরী মেশানো অনুভব? মনে রাখা দরকার, পুজোর গান আরও বৃহৎ অর্থে বাংলা আধুনিক গান, যাই বলি – এমন শব্দবন্ধে প্রাণিত করার সেই হৃদয় নিংড়োনো শব্দটি তো ‘বাংলা’। প্রশ্ন হচ্ছে বাংলা ভাষা আজ বাঙালির কতটা অন্তরের ভাষা। সেই প্রেক্ষিতেও ভাবতে হয়, কার জন্য আমাদের গানের সংসারে পাতা হবে আসন – আমার সীমানা টানা সত্তর দশক পর্যন্ত সেই সোনাঝরা গান, যার প্রতি আমাদের অনিঃশেষ আর্তি – ‘আলোকেরই ঝর্ণা ধারায় ধুইয়ে দাও’, নাকি স্ফুলিঙ্গের মতো উড়ে গিয়ে ফুরিয়ে যাওয়া ছাই-ভস্ম – ‘যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে রইব কত আর’?

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x