শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

তারাশঙ্কর – এক আকাশ তারার আলো

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে উজ্জ্বলতম নক্ষত্র, নিজের আলোয় নিজেই পরিচিত ও সুখ্যাত। কথাসাহিত্যে, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পর খ্যাতির চূড়ায় তাঁর অনায়াস আরোহন……যে কোনো সাহিত্যপ্রিয় বাঙালির মনে তাঁর অনিবার্য উপস্থিতি, ভাবনায় তাঁর স্বছন্দ বিচরণ। তাঁর সাহিত্য প্রতিভার সম্যক ও সামগ্ৰিক মূল্যায়ন বেশ কঠিন কাজ, সে কাজ এখনও যে সম্পূর্ণ হয়েছে তা নয়। আমার মতো আনাড়ির পক্ষে তাঁকে শুধু ছুঁয়ে যাওয়া হয়তো সম্ভব, তাঁর সৃষ্টির শিকড়ে পৌঁছনো সহজ নয়। কারণ বৈচিত্র্য ও বিপুলতায় তাঁর সৃষ্টির সম্ভার বিস্ময়কর। তিনি ৬৫টি উপন্যাস, ৫৩টি ছোটোগল্প-সংকলন, ১২টি নাটক, ৪টি প্রবন্ধ-সংকলন, ৪টি স্মৃতিকথা, ২টি ভ্রমণকাহিনি, একটি কাব্যগ্রন্থ এবং একটি প্রহসন রচনা করেছেন।


প্রায় পাঁচ দশক জুড়ে তাঁর সাহিত্যচর্চার কাল (১৯২৬ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ) যুগসন্ধির অস্থিরতার কাল, তার সঙ্গে দেশ জুড়ে স্বদেশি আন্দোলনেরও কাল : বয়কট-বঙ্গভঙ্গ অসহযোগ এবং বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড। পরপর চলে আসে কমিউনিস্ট ভাবধারার প্রকাশ, আইন অমান্য , ‘৪২-এর আগস্ট আন্দোলন, স্বাধীনতা ও দেশবিভাগ, পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলন, পাকিস্তান বিভাগ ও বাংলাদেশের উদ্ভব ইত্যাদি।তারাশঙ্করের সাহিত্যকর্ম এই সময় এবং পরিবেশের আবহে রচিত হয়েছে।
তাঁর লেখায় ধুলোমাটির সংসার থেকে রাঢ় বীরভূম-বর্ধমান অঞ্চলের সাঁওতাল, বাগদি, বোষ্টম, বাউরি, ডোম, গ্রাম্য কবিয়াল, বেদে, পটুয়া, মালাকার, লাঠিয়াল, চৌকিদার, উঠে এসেছে বাংলা সাহিত্যের উদার উঠোনে। তাঁর নিজের গ্ৰাম দেশ, পরিবার,পরিজন, পরিবেশ,সবই তাঁর লেখায় কোনো না কোনো ভাবে হাজির। ছোটো বা বড়ো যে কোনও ধরণের মানুষই হোক না কেন, তারাশঙ্কর তাঁর সব লেখায় মানুষের মহত্ত্বকে খুঁজেছেন, তাকে ফুটিয়ে তুলেছেন অমল মহিমায়। হাট মাঠ ঘাট, পাঠশালা নদীবাঁক আখড়া থেকে ধুলো ঝেড়ে অবহেলার মানুষগুলোকে সাহিত্যের পাতায় তুলে আনাই তাঁর লেখার সবচেয়ে বড়ো গুণ। নিঃশব্দে ঘটে যাওয়া সমাজের ওলোট পালোট, পরিবর্তনের ছবি তাঁর অনেক গল্প, উপন্যাসের বিষয়। সেখানে আরও আছে গ্রাম জীবনের ভাঙনের কথা, নগর জীবনের বিকাশের কথা, পল্লি-গ্ৰামের সহজ সারল্য, কোঁদল, চণ্ডীমন্ডপ-বটতলা-পাঠশালার মায়াভরা বিবরণ, গ্রামীণ সামন্ততন্ত্র ভেঙে পড়ার বাস্তব কাহিনি। আরও এসেছে বিশ্বযুদ্ধের দুঃখ, দুর্ভিক্ষ, পেশাজীবীদের জীবনচিত্র সহ দাঙ্গা, দেশভাগ, আর্থ-সামাজিক অবস্থার অনটন ও বৈষম্যের শোচনীয় কাহিনি।


তাঁর সবক’টি ধ্রুপদি রচনা থেকে যে জীবন দর্শনের কঠিন সংশ্লেষ উঠে এসেছে তা কিন্তু নয়, তবু যা এসেছে তা আন্তরিকতার আবেগে ও মর্মস্পর্শী আবেদনে হৃদয়কে ভিজিয়ে দিয়ে যায়।
রাঢ় বাংলার লালমাটির জেলা বীরভূমের এক পড়ন্ত জমিদার পরিবারে তাঁর জন্ম। বাবা হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মা প্রভাবতী দেবী। বাবাকে তিনি অল্প বয়সে হারিয়েছিলেন। গ্রামের যাদবলাল স্কুলের পাঠ চুকিয়ে কলকাতায় এসেছিলেন উচ্চ শিক্ষার টানে। প্রথমে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ও পরে সাউথ সুবার্বান কলেজ , যা এখনকার আশুতোষ কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু গান্ধির আহ্বান, অসহযোগ আন্দোলনে পড়াশোনা আর এগোলো না, সব ছেড়েছুড়ে তিনি স্বদেশিতে ভাসলেন।


১৯৩০-এর লবণ সত্যাগ্ৰহে তাঁর কারাবাস , ‘গান্ধি-আরউইন’ চুক্তি বলে ছাড়া পাওয়ার পর ১৯৩২ সালে তাঁর জীবনে দুটি স্মরণীয় ঘটনা ঘটে গেলো, এক, শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা। এই বিরাট মানুষটির পা ছুঁয়ে প্রণাম করার শিহরণ তাঁর জীবনের অবিস্মরণীয় সঞ্চয়, এবং দুই, এই বছরই প্রকাশিত হলো তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘চৈতালী ঘূর্ণি’। ১৯৩৩ সালে ‘ত্রিপত্র’ নামে তাঁর একটি কবিতা সংকলন বেরিয়েছিল, পাঠক মহলে তার অভ্যর্থনা আশানুরূপ না হওয়ায় তিনি পাকাপাকিভাবে কাব্যসাহিত্য ছেড়ে কথাসাহিত্যেই নিজেকে পুরোপুরি নিবেদন করেন। তবে তাঁর কথাসাহিত্যও কাব্যের অরুণকিরণে উজ্জ্বল। আত্মপ্রকাশ পর্ব থেকে পরবর্তী পর্যায় পর্যন্ত তিনি একভাবে লিখে গেছেন, কল্লোল, কালিকলম, বঙ্গশ্রী, শনিবারের চিঠি, প্রবাসী,উপাসনা, দেশ, ভারতবর্ষ, বসুমতী, পরিচয় প্রভৃতি পত্রিকায়।
১৯৩৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘ধাত্রীদেবতা’ উপন্যাসটি। এরপর ১৯৪৬ পর্যন্ত পরপর প্রকশিত হতে থাকে তাঁর কালজয়ী লেখাগুলো — ‘কালিন্দী’, ‘গণদেবতা’, ‘মন্বন্তর’ , ‘পঞ্চগ্রাম’, ‘কবি’, ‘সন্দীপন পাঠশালা’, ‘অভিযান’, ‘ঝড় ও ঝরাপাতা’। ‘ধাত্রীদেবতা’য় ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বংশকে কেন্দ্র করে সমকালীন বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন ও পরিবর্তনের যে ছবি আঁকা তিনি শুরু করেন, ‘গণদেবতা’য় তাই মহাকাব্যিক পটভূমিতে বিস্তারিত হয়ে বাংলা থেকে যেন গোটা ভারতবর্ষের গ্রামীণ গণসমাজের ভাঙাগড়া, বিবর্তন ও বিকাশের চেহারাটা তুলে ধরে। ‘গণদেবতা’য় ভাঙনের ছবি মর্মান্তিক “সমাজ-শৃঙ্খলার সবই তো ভাঙিয়া গিয়াছে। গ্রামের সনাতন ব্যবস্থা নাপিত, কামার, কুমোর, তাতি আজ স্বকর্মত্যাগী, স্বকর্মহীন। এক গ্রাম হইতে পঞ্চ গ্রামের বন্ধন, পঞ্চ গ্রাম হইতে সপ্ত গ্রাম, নব গ্রাম, দশ গ্রাম, বিংশতি গ্রাম। শত গ্রাম সহস্র গ্রামের বন্ধন-রজ্জু গ্রন্থি গ্রন্থিতে এলাইয়া গিয়াছে।” স্বাধীনতা আন্দোলন, শিল্পায়ন ও আধুনিক জীবনের উপল ব্যথিত পথে উপন্যাসটির এগিয়ে যাওয়া, এ বই হাতে নিলে ছেড়ে আসার উপায় থাকে না, মগ্ন হয়ে পাতার পর পাতা উল্টে যেতে হয়। ‘গণদেবতা’রই অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পরবর্তীতে প্রকশিত হয় তাঁর ‘পঞ্চগ্ৰাম’, বাঁশির এক সুরে বাজতে থাকে হৃদয় মথিত করা আনন্দের গান, স্বপ্ন সফল হয়ে ওঠার সংগীত। “পঞ্চগ্রামের প্রতিটি সংসার ন্যায়ের সংসার; সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে ভরা, অভাব নাই, অন্যায় নাই, অন্ন-বস্ত্র, ঔষধ-পথ্য, আরোগ্য, স্বাস্থ্য, শক্তি, সাহস, অভয় দিয়া পরিপূর্ণ উজ্জ্বল। আনন্দে মুখর, শান্তিতে স্নিগ্ধ।” কিন্তু স্বপ্ন কিভাবে সত্য হলো তার কোনও পথনির্দেশ নেই। অনেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে ‘গণদেবতা’, ১৯৬৬ সালে ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার ‘জ্ঞানপীঠ’ পেয়েছে। আগেই, ১৯৫৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাসের জন্য তাঁকে রবীন্দ্র পুরস্কারে সম্মানিত করেছে। ১৯৫৬’তে পান সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার।সদ্য প্রয়াত তরুণ মজুমদার ‘গণদেবতা’র কাহিনি নিয়েই ১৯৭৯’তে ছবিও করেছিলেন।


নানা বৈচিত্র্যে পল্লবিত হয়ে তাঁর লেখা এগোতেই থাকে, ‘মন্বন্তর’, ‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথা’, ‘ডাক হরকরা’, ‘আরোগ্য নিকেতন’, ‘রাইকমল’, ‘কীর্তি হাটের কড়চা’ ছাড়িয়ে আরও অনেকদূর। নাটক লিখেছেন ‘যুগবিপ্লব’, ‘দ্বীপান্তর’, ‘মারাঠা তর্পণ’, একাধিক কাহিনি নাট্যরূপ পেয়ে মঞ্চায়িত হয়েছে, সত্যজিতের মতো পরিচালক ছবি তৈরি করেছেন। পেয়েছেন ভারত সরকারের ‘পদ্মশ্রী’ ও ‘পদ্মভূষণ’, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শরৎস্মৃতি পুরস্কার’ , ‘জগত্তারিণী স্মৃতিপদক’। অবশ্যই তাঁর ‘নোবেল’ পুরস্কারও প্রাপ্য ছিল। তবুও বলবো, তাঁর সাহিত্য ও সৃষ্টির স্বীকৃতিতে তিনি পরিপূর্ণতা পেয়েছেন, অর্থ উপার্জন করেছেন, সমকালীন সরকারের অঢেল সমর্থনও তাঁর জুটেছে। কিন্তু যে আদর্শের শিখরে তাঁর লেখক সত্তার প্রকাশ ঘটেছিল শেষ পর্যন্ত তা একই রকম থাকেনি। যে রাঢ়ের গান গন্ধ গল্প নিয়ে, যে গ্ৰামীণ সমাজের ভাঙা গড়া ওঠাপড়া, আশা নিরাশা ও আনন্দ অভিমান নিয়ে কাগজের বুকে তাঁর কলমের আঁচড়, তার রেশ অনেকটাই বিচলিত হয়েছিল তাঁর পরের লেখায়। এ অবশ্যই আমার একান্ত ব্যক্তিগত অনুভব, মতান্তর থাকতেই পারে। কিন্তু তারাশঙ্কর তারার আলোয় দীপ্যমান থেকেছেন, আজও এক আকাশ আলো নিয়ে তিনি আছেন পাঠকের অন্তরে। তিনি বারংবার বলেছেন, আলোর সাধনা, মানুষের মুক্তির সাধনাই তাঁর সাহিত্যের মূল সুর, বন্ধন ছেঁড়ার গানেই তিনি জীবনের সার্থকতা খুঁজে পেয়েছেন। ১৯৪২ সালে ‘বীরভূম সাহিত্য সম্মেলনে’ তাঁর অভিভাষণে তারাশঙ্কর যে কথা বলেছিলেন তা আজও স্মরণীয় : “রাজনৈতিক বন্ধনমুক্তির আকাঙক্ষার যে দুর্নিবার আবেগ আমি জাতীয় জীবনের স্তরে স্তরে বিভিন্ন সঙ্গীতে প্রকাশিত হতে দেখেছিলাম, তারই মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছিলাম, মানুষের সনাতন জীবন-মুক্তির সাধনা। জীবন মুক্তি বলতে ভয়ের বন্ধন, ক্ষুদ্রতার গণ্ডী, অভাবের পীড়ন, জীবনে জোর করে চাপানো সকল প্রকার প্রভাবের বিরুদ্ধে মানুষ সংগ্রাম করে চলেছে। সেই তার অভিযান।”

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.