শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

কাজীদা’র কোল

“ভায়া লাফ দেয় তিন হাত, / হেসে গান গায় দিন রাত,
প্রাণে ফুর্তির ঢেউ বয়, / ধরায় পর তার কেউ নয়।“
কবি – গোলাম মোস্তফা

কৃষ্ণ-নাগরিক সুধীর (চক্রবর্তী) বাবু, জামশেদপুরে এক রবিবাসরীয় আড্ডায় খোশগল্পে মশগুল। যেখানে দুখিরাম তার অমৃত বচন প্রাণপণে ভরে রাখছে মনের ঝোলায়। হঠাৎ তিনি বললেন ‘কাজীদার কোল কত বড় সে কথা তোমার জানা আছে কি’? …কাজীদার কোল? ভারি গোলমেলে বোল! … দুখিরাম নিজে-তো গোল আলু বিশেষ। তরকারী বহুভোগ্য করতে যে অলক্ষিত সবজি ব্যবহার্য। তেমনি সহনীয় সভাসমিতিতে – মাথা গোনায় এক কোনায় – দুখিরাম পড়ে থাকে চুপচাপ। সে মাছি মারতে এমন গোলা দাগা কেন ! অবশ্য জবাব মিলল পরে, তিনিই দিলেন। তা জানাবে দুখিরাম তবে আগে ভণিতা। পিছিয়ে যাওয়া যাক বছর নব্বুই বা পঁচানব্বুই।

এক দুপুর বেলা এইচ এম ভি রেকর্ডিং স্টুডিও তে কাজ করছেন ভয়েস ট্রেনার ভদ্রলোক। এমন সময় দ্বাররক্ষীকে ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলেন এক বিচিত্র মানুষ। প্রবল গরমে তার গায়ে স্যুট, মাথায় টুপি। এসেই ‘ভূমিকা না করি কিছু’ ট্রেনার ভদ্রলোককে জানালেন যে তার নাম প্রফেসর চক্রবর্তী এবং তাকে একটি গান লিখে দিতে হবে। এ ধরনের বেয়াড়া আবদার ট্রেনার মশাই প্রায়ই শুনে থাকেন । তিনি তার বাবরি চুলে হাত বুলিয়ে সবে মাত্র হাঁ করেছেন – প্রফেসর চক্রবর্তী তাঁকে থামিয়ে বললেন যে নিরস্ত করার চেষ্টা করে লাভ নেই। প্রয়োজনে তিনি অনশন ইত্যাদির জন্যে তৈরি হয়েই এসেছেন । বিপদ বটে। তবে এই ট্রেনার মশাই তো যে সে নন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কাজ ফেলে এনার কবিতা শোনেন। তিনি প্রফেসরকে বাজিয়ে বুঝলেন সুরের সঙ্গে তার ভাসুর-ভাদ্রবৌয়ের সম্বন্ধ। একটু সময় চেয়ে নিলেন। চর্ম চক্ষে দেখলেন জানলা দিয়ে বাইরের ট্রাম গাড়ি। মানস চক্ষে ষ্টীম ইঞ্জিন। তারপর লিখলেন একটি গানের মুখড়া – ‘রেলগাড়ি ধায় ভসর ভসর’। একঘণ্টায় রচনা হল গান – সুর ওই সঙ্গে সঙ্গেই। জানা গেল সুরের কিছু এদিক ওদিক হলেও কথায় ভর দিয়ে ছুটবে রেলগাড়ি। তিনি বিদায় হলেন। কিন্তু ট্রেনার সাহেব ভাবলেন মন্দ নয় এ রকম আরেক খানা লেখা যাক। কয়েকদিন পরে ভূমিষ্ঠ হল – ‘আমার খোকার মাসি’ । হাসির গান ছাপ মেরে রেকর্ড হল ১৯৩৪ সালে – গাইলেন রঞ্জিত রায় । খুব বিক্রি । প্রথম গানটি হারিয়ে গেছে। প্রফেসর চক্রবর্তীকেও কেউ চেনে না, কিন্তু তিনি অসুরদের জন্যে একটি দ্বার খুলে দিলেন।

লেখাটি এইখান থেকে শুরু করতে হল কারণ এই ঘটনার থেকেই – চুরুলিয়ার কাজী ফকির আহমেদ আর জাহিদা বেগমের ষষ্ঠ সন্তান – দুখিরামের অন্যতম গুরু হলেন। সুধী পাঠক দয়া করে জ্ঞাত হোন – সাত সুর যার গলায় সাতটি পোষা পাখীর মত উড়াল ভরে – তাদের প্রশ্রয় দেওয়ার মানুষ অগুনতি। কিন্তু কিনু গোয়ালার গলিতে যে অন্য ভীষ্ম লোচন শর্মারা থাকেন, কান্ত-বাবুর কর্নেটে যাদের হৃদয় উথাল পাথাল হয়, যাদের সঙ্গীতে বুৎপত্তি দুখিরামের মতই, সেই আপামর জনতার কথা ভেবেছেন মাত্র দু জন। রবীন্দ্রনাথ আর কাজী নজরুল।

এনাদের মিল ও অমিল বহু গবেষণার বিষয়. কিন্তু একটি আশ্চর্য প্রায় সমাপতনের কথা দুখিরামের চিত্তে জাগে। রবি কবি ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ গেলেন ১৯৪১ । স্নায়ু বিপর্যয়ে নজরুলের চিন্তা স্রোত রুদ্ধ হল ১৯৪২। মর্তকায়ায় রইলেন বটে, কিন্তু সে ছায়া মাত্র। এক মায়াময় দিক-শূন্য-পুরের নাগরিক হয়ে রইলেন ১৯৭৬ পর্যন্ত। বাংলা সাহিত্যের পাকশালে দুটি আগুন নিভল প্রায় এক সঙ্গে।

রবীন্দ্র গান যে সুর কানা কেউ গাইতে পারেন – এ রকম তুঘলকি ফরমান দিলে রে রে করে উঠতেই পারেন রবীন্দ্র তাত্ত্বিকরা। এমনকি স্বর্গত দীনু ঠাকুর এস্রাজ ছুঁড়ে মারতে পারেন উপরতলা থেকে। কিন্তু দুখিরাম দমবে না। গাইতে পারে মানেই তো কাজ করা পাঞ্জাবি গায়ে মঞ্চে বসা নয়। ঘরের কোনে, ঝর্না তলার নির্জনে, হৃদয়ে পথে কেটে সে গান গাইতে হয় একাকী। সে গান দুঃখে, শোকে, সম্পদে , বিপদে , ভয় হরণের শক্তি যোগায়। ভক্তের সে অধিকার কাড়তে পারে না কেউই।

কিন্তু নজরুল গীতি? তাও কি তেমন বিরল যাপন? বোধহয় না। এ হৃদয়ে প্রকাশ হবার বাসনা থাকে। কাজেই কিছুটা হলেও সুরের ঝর ঝর ঝরনায় ডুব ডুব সাঁতারের কেরামতি জানা চাই। সাত সুরের সঙ্গে অল্প হলেও সহাবস্থান কাম্য। এখানে আবার আরেকটি বিভাজিকা রয়েছে। সবার যাত্রাপথের আনন্দগান এক সুর – তাল – লয়ে বাজে না। চিরকালই সুর সাধকরা একটু স্বাধীনতার দাবী রাখেন। উদাহারন চাইলে – একবার ইউ টিউবে হাতড়ে দেখা যেতে পারে।

আচ্ছা, আপনারা কেউ কি ‘চর্জ্যু কি মল্লার’ রাগটি সম্বন্ধে অবগত আছেন? নেই? মাভৈ। ‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে’ গানটি জানলেই হবে। মূল সুরকার জগন্ময় বাবু সহ আরো খান বত্রিশ গায়ক গায়িকার (এর বেশী গুনতে যায় নি দুখিরাম) পোস্ট আছে ইউটিউবে। সব নয় – যদি বাছাই করে কয়েকটি শোনা যায় – দেখা যাবে কিছুটা হলেও আলাদা উপস্থাপনা অপরের থেকে। এখানেই ‘আমার’ এ পথ কিছুটা বেঁকে যায় ‘তোমার’ পথের থেকে। সুতরাং ‘রবীন্দ্র – নজরুল সন্ধ্যা’ হলে – মনন ও প্রকাশের দুটি অমিশ্র ধারা হৃদয়ে নিতে হয় ভক্ত শ্রোতাকে। এক শ্রোতা একই মন নিয়ে বসতে পাবেন না দুই কবির সঙ্গীত আহরণে ।

দিলীপ কুমার রায় মহাশয় রবীন্দ্র সঙ্গীতে যৎসামান্য তানকারির দাবী নিয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিস্তর পত্র যুদ্ধ করেছেন। তাঁর সাংগীতিক পাণ্ডিত্য – বিশেষত দেশী বিদেশী মার্গ সঙ্গীতের দখল নিয়ে – কোনো কথা হবে না। তিনি কবিকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন যে গায়কের অল্প স্বাধীনতা – রবীন্দ্র সঙ্গীতের গুণগত মান অনেকটাই বাড়িয়ে দেবে । কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তেমন উৎসাহ দেখান নি। তাঁর গানের চলন বা সুরের কোন পরিবর্তনের পক্ষে ‘রা’ কাড়েন নি। দু একজন অতি ঘনিষ্ঠ গায়ক বা গায়িকাকে একটু সস্নেহ ছাড় দিয়েছিলেন। কিন্তু বাকি ক্ষেত্রে নৈব নৈব চ। এমন কি পিয়ানো তে ‘হ্যাঁ’ হলেও – হারমোনিয়াম যন্ত্রটির কার্যকারিতা সম্বন্ধেও তিনি সন্দিহান ছিলেন। কারণ তাতে মীড় বা গমক – যথার্থ ভাবনায় বিকশিত হয় না। তাই তিনি নিজে বাজাতে জানলেও তার জীবিতাবস্থায় যন্ত্রটি শান্তিনিকেতনের লাল মাটি দেখতে পায়নি। বলা যেতে পারে তাঁর সুরের রাখালিতে তিনি কিছুটা ‘গোরা’ বা গোঁড়া ছিলেন। নজরুল চারণক্ষেত্রে অবশ্য হারমোনিয়ামের প্রবল পৃষ্ঠপোষকতা , সুরের উদার অভ্যুদয়।

আরেকটি প্রসঙ্গ ছুঁয়ে যাওয়া যেতে পারে। ঘটনার অভিঘাত ভিত্তিক গান যদিও রবীন্দ্রনাথ তাৎক্ষনিক আবেগে রচনা করেছেন। কিন্তু খুব সীমিত ক্ষেত্র ছাড়া ফরমায়েশি গান – তিনি লেখেন নি। ব্যতিক্রমী উদাহরণ – ১৭ এপ্রিল, ১৯২২ – শান্তিনিকেতনে নলকূপ প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে লিখেছিলেন ‘তৃষ্ণার জল এসো এসো হে’। তাছাড়া বর্ষামঙ্গল বা জন্মদিন উদযাপনের জন্যেও গান লিখেছেন – কিন্তু সেসব ঠিক ফরমায়েশি গান বলা চলে না। অবশ্য শৈলজারঞ্জন মজুমদার মাঝে মধ্যে চিরকুট দিতেন বিশেষ কোনো গানের জন্যে। কবি বিরক্ত হলেও লিখে দিতেন – সুরারোপ সহ। শৈলজারঞ্জন মশাই গল্প করেছেন – একবার কবির লেখার টেবিলে – কাগজে ‘বাগেশ্রী তে বর্ষার গান’ লিখে পাথর চাপা দিয়ে রাখলেন। পরে রবীন্দ্রনাথ ফরমান দেখে তাঁকে সেই পাথরটিই ছুঁড়ে মারেন আর কি। তাঁর পক্ষে যতটা সম্ভব – গর্জন করে বললেন ‘বাগেশ্রীতে বর্ষার গান হয়’? নির্ভয় ও শান্ত শৈলজারঞ্জন বললেন ‘হয়’। কবি তাঁকে দূর হতে বললেন এবং শৈলজারঞ্জন বুঝলেন কবিকে বাগে পাওয়া গেছে। পরদিন ভোরে পাওয়া গেল হৃদয় পোড়ান সেই গান – ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে’। অহো ভাগ্য, শৈলজারঞ্জন রবির প্রতাপে দিকভ্রান্ত হন নি।

হাবিলদার কবির অবশ্য তাৎক্ষনিক সঙ্গীত রচনার ক্ষেত্রে ব্যুৎপত্তি পঞ্চমে পৌঁছত । সে হয়ত তাঁর যুদ্ধ ক্ষেত্রের শিক্ষা। পরিস্থিতি দেখেই অস্ত্র হাতে নেওয়া। একটুকরো কাগজ আর কলম জোগাড় হলেই হল – রচনা করে ফেলতেন গান, সুর চলত হাতে হাত ধরে। রচনাটি সম্পূর্ণ হলেই ফেলে রাখতেন এদিক ওদিক। স্বজন বন্ধুরা সংগ্রহে রাখলে – ঠিক। নইলে ঠাঁই হল বাজে কাগজের ঝুড়িতে। কেমন হত সেই সব সর্জন।

বন্ধুদের আড্ডায় তুমুল তর্ক। অনেক টাকা পেলে প্রিয়তমাকে কেমন সাজাবে? কবি কাগজ টেনে নিলেন । প্রাপ্তির নিরিখে নয় – স্বপ্ন সম্ভব আর্তিতে লিখলেন ‘মোর প্রিয়া হবে এস রানী দেব খোঁপায় তারার ফুল’।

হুগলী কারার জেলার সাহেব চরম অত্যাচারী। লালিকা বা প্যারোডির জন্ম হল ‘ তোমারি জেলে পালিছ ঠেলে তুমি ধন্য ধন্য হে’।
(উদ্ভব সূত্র ‘ তোমারি গেহে পালিছ স্নেহে তুমি ধন্য ধন্য হে’, রবীন্দ্রনাথ)

অনুরূপ পরিস্থিতিতে আলিপুর জেলে রয়েছেন দেশবন্ধু। তাঁর অবর্তমানে বাসন্তী দেবী সম্পাদনা করছেন ‘বাঙ্গালার কথা’ নামক সাপ্তাহিক পত্রিকা। নজরুলকে লেখার জন্যে অনুরোধ জানালেন সুকুমার-রঞ্জন দাশের মাধ্যমে। তাঁকে বসতে বলে তৎক্ষণাৎ নজরুল লিখলেন ‘কারার এই লৌহ কপাট’। চিত্তরঞ্জন সহ-বন্দিদের নিয়ে সে গান গাইলেন কারা প্রাচীরের অন্তরালে। একটি মজার তথ্য – গানে উল্লেখিত ‘বন্দী-শালা’ বন্দি দের সম্বন্ধী সম্বোধন করা হচ্ছে এ রকম একটা গুঞ্জন উঠেছিল প্রথমে। দেশবন্ধুর সময়োচিত হস্তক্ষেপে শঙ্কা নির্মূল হয়।

বন্ধুর বাড়িতে বসার ঘরের এক কোনায় এক গোছা গোলাপ রাখা রয়েছে। কবি গান ধরলেন ‘কেন দিলে এ কাঁটা যদি গো কুসুম দিলে’।

হিন্দু বন্ধুর বিয়েতে গিয়েছেন । শ্বশুর বাড়ি তার ধর্ম পরিচয়ে ঈষৎ বিব্রত। তাদের বিব্রততর পরিস্থিতিতে ফেলে তাদেরই কালি মন্দিরের আঙিনায় শ্যামা সঙ্গীত জুড়লেন নজরুল।

ধীরেন দাশ জানাচ্ছেন ১৯৩৫ সনের এচ এম ভি স্টুডিওতে বসে আছেন তারা দুজনে। নিত্য অর্চনায় এসেছেন উড়িয়া পুরোহিত। অন্য পূজার্চনা সাঙ্গ হলে তার সাজিতে বেঁচে থাকা একটি জবা ফুল মা কালীর চরণে ঠাই পেল। নজরুল দেখলেন , বললেন আচ্ছা ধীরু – কেন জবা ফুলই শুধু মায়ের পূজায় ব্যাবহার করা হয়? তারপর নিজের ঘরে গিয়ে বসলেন বড় জোর এক ঘণ্টা। জন্ম হল ‘ বল রে জবা বল, কোন সাধনায় পেলি শ্যামা মায়ের চরণ তল’।

প্রথম বিয়ের রাতে, ঘর জামাই হবার প্রস্তাব নামঞ্জুর করে, সেই রাত্রেই চলে এসেছিলেন কবি। যোগাযোগ ছিলনা তারপর। বহু পরে এক পত্র বাহক পাঠালেন প্রথমা পত্নী। জবাবে সৃষ্টি হল অমর গীতি -‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই কেন মনে রাখো তারে’।

এ রকম উদাহারন বহু। তিনি যেন ঐন্দ্রজালিক । শূন্য থেকে আনছেন সজীব পারাবত। কিম্বা কোন গন্ধর্ব বসে আছেন বহতা সুরধুনীর তীরে আর থেকে থেকে গাগরী ভরে নিচ্ছেন অনায়াসে ।

প্রায় তিন হাজারের কিছু অধিক নজরুল গীতি পেয়েছেন সংগ্রাহকরা । কত হারিয়েছে বা অন্য কবির নামাঙ্কিত হয়ে চলছে আজও, বলা শক্ত। এই সন্ন্যাসীসুলভ নিরাসক্তির ফলে তাঁর অধিকাংশ গানই সৃষ্টির পর প্রসাধনের রূপটান পায়নি। কাজেই কাব্যে প্রসাদ গুণের তারতম্য ঘটেছে।স্মৃতি বলছে ইউরোপ যাত্রী রবীন্দ্রনাথ জাহাজে একদিন ছ’টি বা সাতটি গান রচনা করেছিলেন কিন্তু তৎক্ষণাৎ প্রকাশ করেন নি। মাজা ঘষা করেছেন। সুর বা গীতের মান নিয়ে সমঝোতা করেন নি। নজরুলে বেশ কিছু গান লিখেছেন, যার সুরারোপন তাঁর নয়। কবি স্বরাজ দিয়েছেন অন্য সুরকারদের। অধিকাংশ গানের স্বরলিপি করেছেন অন্য কেউ, তখন বা বহু পরে । নাম নেওয়া যায় – সুধীন দাশ, অনিল বাগচী, গিরীন চক্রবর্তী, ব্রহ্মমোহন ঠাকুর সহ আরো অনেক গুণগ্রাহীর। অর্থাৎ তাঁর সৃষ্টি সুখের উল্লাসে সবাইকে সামিল করেছেন তিনি। নিজের সৃজনের উপরে এতটা উদাসীনতা কি ভালো হয়েছিল? দুখিরামের সস্তা জ্ঞানের চশমায় তত-দূর দেখা যায় না। অবশ্য সে চেষ্টাও তাঁর নয়।

এ লেখা কারু মূল্যায়নের অযাচিত পণ্ডিতম্মন্যতা নয়। মুগ্ধ শ্রোতার মন্ত্রোচ্চারণে একটি সূত্র ধরবার প্রয়াস যাতে বোঝা যায় ‘কাজীদার কোল’ কি ও কেন। কেমন করে নজরুল সঙ্গীতে অ/ সাধারণ সুরসেবকরা পেয়েছেন তাঁদের স্বাধীন কণ্ঠসম্পদ প্রয়োগের সুযোগ। যে পথ ধরে আলোকবর্ষ দূরের কবিও বন্ধুভাবে আসতে পারেন মনের কাছাকাছি।

রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব বলা বনফুল পছন্দ করতেন না। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং করতেন কিনা দুখিরাম জানে না। তবে এই তকমা সরাবার কিছুটা সম্ভ্রম জনিত বাধা আছে। খবরে প্রকাশ কিছুদিন আগে এলগীন রোডে ‘সুভাষ-দার বাড়ি যখন তাকেই ডেকে দিন’ বলে একজন কম্বু-নাদ শুনিয়েছিলেন শ্রী সুগত বসু মহাশয়কে। ‘নেতাজী’কে আম নেতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছিলেন বোধ করি। জোড়াসাঁকোয় ‘রবিকা’ অব্দি চলেছে কিন্তু – ‘রবিদা আছেন’? বলে রব তুলতে পারেননি কেউ। (ভানু দাদা বলতেন বটে একজনা।) ‘গুরুদেব’ সম্বোধনের এক ধরনের যবনিকা বাঙালিকে এ পাপ থেকে বাঁচিয়েছে। অন্যপক্ষে নজরুলকে কাজীদা বলতে পেরেছেন বেশ কিছু সমকালীন সৌভাগ্যবানরা। কাজে কাজেই কাজীদার কোলে চড়ার পথও কিছুটা সুগম বৈকি।

দুখিরাম তাঁকে প্রথম আবিষ্কার করে কাজী সব্যসাচীর আবৃত্তি আর মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গানের মাধ্যমে। আবৃত্তির বাগিচায় – ফুল শাখাতে দোল দেবেন অন্য কেউ। রবিচক্রের অনুসারীরা সে ‘সৌরভ’ হয়ত পাবেন ভবিষ্যতে। এখন বরং আহাম্মকের আড্ডায় শুনুন গান গল্প। তবে আগে পড়ুন বিধি সম্মত সতর্কীকরণ – অনুগ্রহ করে এ’ লেখায় কোনো নতুন তথ্য আশা করবেন না । এ হল অমলেটে মাখন বেশী দিয়ে মামলেট বানানোর চেষ্টা ।

শুরুতে ‘মানব’ কথা। প্রাথমিক বিরাগে বিমান (মুখোপাধ্যায় ) বাবুকে সরিয়ে দিয়েছিলেন বাবু মানবেন্দ্র। কিন্তু নাছোড় বান্দা বিমান বাবু দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় তাঁকে শুনিয়েই ছাড়লেন কয়েকটি অন্যরকম নজরুল গীতি। মানবেন্দ্রবাবু শুনলেন এবং ডুবলেন সেই অজানা খনির নূতন মনির মুগ্ধতায়। হাঁ হয়ে গেলেন এবং সেই হাঁ থেকেই বেরোল বেহাগের বিলম্বিত লয় ‘ভরিয়া পরান শুনিতেছি গান’। দাদরা তালে পিলু খাম্বাজের মদির মিশ্রণ ‘আমার কোন কুলে আজ ভিড়ল তরী সে কোন সোনার গাঁয়’। বাজারে এলো অধুনা বিলুপ্ত সাত ইঞ্চি ব্যাসের এক্সটেন্ডেড প্লে রেকর্ড নং ৭ ই পি ই ১০৪৫। সন ১৯৬৭, দুখিরাম ও তার মা তখন সদ্য সদ্য ইশকুলে ভর্তি হয়েছে। মোট চারটি গান। স্বরলিপি – শিল্পীর কাছা টেনে থাকেনি। ঢিল মারে নি বরং ঢিল দিয়েছে ঘুড়িকে খোলা হাওয়ায় উড়তে। এখান থেকেই সেই সোনা ঝরা কণ্ঠ শ্রোতাদের উপহার দিলো পরপর প্রায় সার্ধ শত নজরুল গানের মালা। বেজে উঠল নজরুল গীতির পুনরুজ্জীবনের ঘণ্টা। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম প্রাপ্ত শিল্পীরা খুঁজে পেলেন নবীন আকাশ। ষাটের দশকে সে গানের শুরু – দুর্ভাগ্য নিজের জীবন ষাট অতিক্রম করতেই সেই কণ্ঠ থেমে গেল। নজরুল চলে গেছেন আগেই। তাছাড়া ১৯৪২ থেকেই তো মন্বন্তর চলেছে তার মনোভূমিতে। মনি কাঞ্চনে ভাব বিনিময় হল না।

প্রতিভা বসু তাঁর ‘জীবনের জলছবি’ গ্রন্থে লিখছেন , ‘আমার কোন কূলে আজ ভিড়ল তরী’ গানটির জন্ম কথা। নজরুল ঢাকাতে এক নিশীথে এই গানটি রচনা করেছিলেন। তার পরের দিন সকালেই এই গানটি প্রতিভা বসুকে শেখাচ্ছেন তাঁদের বনগ্রামের বাড়িতে, যাতে ভুলে না যান। (এ ব্যাধি কিঞ্চিৎ রবীন্দ্রনাথেরও ছিল, দীনু তাঁর কাণ্ডারি।) অনুষঙ্গে হারমোনিয়াম, পানের বাটা, ঘনঘন চা। শেখাতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে গানটির বয়ান কানে ঠিক ঠেকছে না, সুরেরও হেরফের হচ্ছে। তাতে কি? গাইছেন, শেখাচ্ছেন। ঠিক করছেন আবার শেখাচ্ছেন। অনমনীয় থাকছেন না।

‘ক্ষ্যাপা হাওয়াতে মোর আঁচল উড়ে যায়’। যখন নজরুল সক্রিয় – তখন ১৯৩২ যে সুরে রেকর্ড করেছেন মিস হরি বাইজি ( টুইন রেকর্ড, এফ টি ২২১৫, ) – সে সুর আমূল বদলে গেছে পূরবী দত্তের সন ১৯৭৯ ( ইনরেকো – এল পি নং ২৪২৪-৫০৯০) নিবেদনে। তখন নজরুল অবশ্য আর নেই। কিন্তু আজীবন নজরুল গীতির চর্চায় নিমজ্জিত পুরবী কোথাও তো সুরটি পেয়েছিলেন এবং তাতে নজরুলের পৃষ্ঠপোষকতাও অনুমান করে নেওয়া যায়। দুটিই ভালো লাগছে।

আরেকটি উল্লেখ। ১৯২৯ সালে মনোমোহন থিয়েটারে নাট্যকার মন্মথ রায়ের মহুয়া নাটক। দ্বিতীয় অঙ্কে ‘ভরিয়া পরান শুনিতেছি গান আসিবে আজি বন্ধু মোর’ এই গানটি মঞ্চে – স্বরলিপিকার অনিল বাগচী মশাইকে অনুসরণ করে বেহাগ-বসন্ত মিশ্র রাগে গাইছেন সরযূবালাদেবী। অথচ জন্মগত ভাবে মূল সুর ছিল শুধু বেহাগে নিবদ্ধ। নজরুলের আপত্তি নেই। গানটি শ্রুতি সুখকর হলেই হল। সৃষ্টির খেলায় অহং নয় আনন্দের জোগান থাক বেশী। এরকম আরো ইতিহাস রয়েছে।

নজরুল গীতি সম্ভারের সঙ্গে তুলনীয় কোনো অত্যাধুনিক বিপণন বিপণী । যেখানে সব কিছুই লভ্য , বিভিন্ন বৈচিত্র্য সহ। কণ্ঠের সীমানা বুঝে তুলে নিলেই হল।

ধরা যাক আপনি সনাতনী আর আজ মন্দ্র সপ্তক থেকে তার সপ্তক পর্যন্ত আপনার গলা অনায়াসে যাতায়াত করছে। বাহ। বিশুদ্ধ দরবারি কানাড়াতে ধরুন ‘ওর নিশীথ সমাধি ভাঙিও না’, ধীরেন বাবু না অখিল বাবু কার কথা যে কই।
অন্য পক্ষে হয়ত আজ গলা খুলছে না তেমন। একটি সপ্তকেই ঘোরাফেরা। সমস্যা কি ? ধরুন ‘ মেঘ মেদুর বরষায় কোথা তুমি’। ১৯৩৮ এ দীপালি নাগ – ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ এর একটি জয়জয়ন্তী বন্দিশ শোনালেন নজরুলকে এবং একাসনেই তিনি লিখলেন গানটি। কেয়াবাত।
খেয়ালাঙ্গে খেলিয়ে ফোটাতে চান কণ্ঠের কারুকাজ ? বেশ। জৌনপুরীতে নিবদ্ধ ‘ মম মধুর মিনতি শোনো ঘনশ্যাম গিরিধারী’, জ্ঞান গোঁসাই তার শেষ কথা কয়ে গেছেন।
একাধিক রাগমালায় বিধৃত গান চাই? বেহাগ- তিলক-কামোদ – খাম্বাজে গাঁথা ‘কেন কাঁদে পরান কি বেদনায় কারে কহি ‘, মানব বাবুর পায়ে একশ বার মাথা ঠুকতে হয়।
দানার কাজ আজ গলায় স্পষ্ট হচ্ছে না ? আপনার জন্যে রইল কাব্য গীতি ‘ আমার আছে এই কখানি গান’ এ গানের মাধুরী বুঝিয়েছেন মাধুরী চট্টোপাধ্যায়।
ইসলামি গীতে সমাজ দর্পণ ‘রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ সতীনাথ এই একটি গান গেয়েও বেঁচে থাকতে পারতেন সহস্র বছর। কাওয়ালি – ‘কাবার জিয়ারতে তুমি যাও মদিনায়’ অনুপ ঘোষাল বাগিয়ে গেয়েছেন এ গান।
লোক গীতি ‘নদীর নাম সই অঞ্জনা’, আব্বাসউদ্দিনকে এক বার স্মরণ করে নেবেন। বিদেশী সুরে শিশু নাচানো ‘মোমের পুতুল মমির দেশের মেয়ে’ ইন্দ্রাণী আমাদের নিয়ে যান মরু পারে ।
টপ্পা গাইবেন? তথাস্তু। যৎ তালে ধরে ফেলুন ‘ আমার শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে জপি আমি শ্যামের নাম’ সুকুমার বাবু তার সৌকুমার্য ছড়িয়ে দিয়েছেন প্রতি পঙক্তিতে ।
ঠুমরী দাদরা কিছু ? আছে আছে। ‘বঁধু, তোমার আমার এই যে বিরহ এক জনমের নহে’ আবার মানব বাবুকে গড় করেও অধীর বাবুর উল্লেখ না করলেই নয়।
স্বদেশ পর্যায় গাইতে পারেন আলিপুর কারান্তরালে রচিত ‘এই শিকল পরা ছল মোদের এ শিকল-পরা ছল’ আহা গিরীন চক্রবর্তীর কণ্ঠের সেই তেজ – ভুলিবার নয় । গজলের তো অফুরন্ত বাগিচা ।
ভক্তি গীতি আর শ্যামা সঙ্গীতের প্রসঙ্গ তোলাই বাতুলতা। তবু দুখিরামের মানস পটে ভাসে তার মা গাইছেন ‘বর্ণচোরা ঠাকুর এলো রসের নদীয়ায়’ আর কেঁদে আকুল তাবৎ শ্রোতা। শ্যামা সঙ্গীতে শুধু ‘কালো মেয়ে’ আর ‘ পান্নালাল’ই তো যথেষ্ট।
হয়ত হাল আমলের শ্রোতা কিছুটা কম জানতে পারেন তাঁর কীর্তন ও হাসির গান। সেও কিন্তু কুবেরের বিষয় আসয়। এত বিপুল পটে মেলেছেন তাঁর সুরের ভুবন – বিশ্ব মেলায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার ।
‘যে নিবিড় সমাধির গভীর আনন্দে’ আমরা হিমালয়ের সামনে মৌন হই সেই বিস্ময় দিয়ে বুঝতে হবে এক ধূমকেতুর প্রজ্ঞা পথ। পুঁথিগত বিদ্যা মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত, তাও ব্যাহত হয়েছে বার বার। মক্তবে বুঝলেন কোরান ও ইসলাম ধর্ম। আজান থেকে সুর চিনলেন। গান লেখা শিখলেন লেটো গানের দলে। উর্দু ফার্সির ইল্ম দিলেন সেনা বাহিনীর সহযোদ্ধা। সংস্কৃত পড়লেন নিজের তাগিদে। তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায় অসীম অনুসন্ধিৎসা, সে কেতাবি হোক বা প্রায়োগিক। গোগ্রাসে পড়তেন যা পাওয়া যায়। যাযাবরদের জীবন ও সুর জানতে তাদের দলে ঘুরে বেড়ালেন দু তিন মাস ( ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই’, সাল ১৯৩৯, ছায়াচিত্র ‘সাপুড়ে’, শিল্পী কানন দেবী)। কোনও ওস্তাদের কাছে দীর্ঘ দিনের নাড়া বাঁধা তার কুষ্ঠিতে লেখেনি। অথচ উত্তর বা দক্ষিণ ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতে কিম্বা লুপ্ত প্রায় রাগের পুনর্জাগরনে কি অনায়াস দক্ষতার প্রকাশ। পৃথিবী তার পাঠশালা, মৌমাছির মতই তাঁর জ্ঞান আহরণ। এ যেন অসম্ভবের লীলা কীর্তন। প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া মানুষ কি করে পারে ? অবশ্য আরেক জন ইশকুল পালানো অতিমানব তো আছেনই কাছাকাছি , তাঁর নাম _
কাজীদার কোল বাক্য-বন্ধ হয়ত কিছুটা স্পষ্ট হচ্ছে ধীরে ধীরে । মাত্র বাইশ বছর এই ধূমকেতুর সক্রিয় সাংস্কৃতিক জীবন। কিন্তু তার ব্যাপ্তি মাপে জগতে তেমন মাপক কই? সবার জন্যেই গালিচা পাতা দুখু মিয়াঁর দরবারে। দুখী কেউ নেই সেখানে, এমন কি দুখিরামও নয়। যার গলায় ষড়জ থেকে নিষাদ কিছু লাগে না তার জন্যেও আছে অন্তত একটি গান – যার ইতিহাস বলা আছে এই ঢাকের বাদ্যির মুখ বন্ধে। শেষ পাতে থাকবে প্রাসঙ্গিকতা।
ঘটনাটি ব্যক্তিগত। এই শতকের গোড়ায় দুখিরামের জন্ম শহরে একটি সর্ব ভারতীয় বঙ্গ সম্মেলন হয়েছিল। সেখানে বর্তমান রবিচক্রের সম্পাদক মশাইও হাজির ছিলেন। উভয়ের সাক্ষাত বা পরিচয় হতে তখনো দু যুগ বাকি। দুখিরাম মঞ্চ পরিচালনায় অর্থাৎ অনুষ্ঠান সংক্রান্ত ঘোষণায় আর দুটি অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তী বিরক্তিকর ফাঁক ফোঁকর পুরিয়ে দেবার কাজে ব্যস্ত ছিল। সেরকমই এক অন্তর্বর্তী অন্তরালে দুখিরাম শুনিয়ে ছিল প্রথমে উল্লেখিত দুটি গানের একটি। আশ্চর্য। দু’যুগ পরে সম্পাদক মশাই আড্ডা-ছলে সহাস্যে মনে পড়ালেন সেটি। এমন অত্যাশ্চর্য অঘটনে দুখিরাম হাঁ। তিনি মনে রেখেছেন। মনে রাখতে পেরেছেন এটিই দুখিরামের ক্ষেত্রে নজরুলের কোলে বসার সম্মান। তিনি যদি সংস্থান না করে যেতেন সে যেত কোথায়?

পরিশেষে অনুরোধ । এ লেখায় তথ্য বিচ্যুতি থাকা খুব সম্ভব। হাতের কাছে প্রয়োজনীয় বইপত্র ছিল না। আর বেশ বোঝা গেল শুধু মাত্র নেট নির্ভর হয়ে পানসি চালানো যায় না। ঠিক ভুল তথ্যের তরজায় ভোটের বাজারে তাপ কিছু বেশী ছিল। এখন বোমা বারুদ কিছু বাড়তি হলে দুখিরামের উপর ফেলবেন না। এ পণ্ডশ্রম কোনো জ্ঞান বর্দ্ধক সালসা নয়। শ্রদ্ধা ছাড়া এ লেখায় সংরক্ষণ যোগ্য কিছু নেই। । রবিচক্রের মায়া মুকুরে যে স্তরের গদ্য জাতক খেলে বেড়ায় – এ রচনা তাদের একপাতে বসার যোগ্য নয়। ধরে নিন অন্ধ আঁকছে হাতি কিম্বা আরো বড় অনন্ত আকাশ। মুগ্ধতার চশমা নাকের উপর থাকলে – তবেই তা পাঠযোগ্য হবে। আর হ্যাঁ, যদি তথ্য কেউ সংশোধন করে কৃতজ্ঞ করেন – দুখিরাম তাঁকে শোনাবে সিঙ্ঘেন্দ্র মধ্যম রাগে একটি নজরুল গীতি। ভয় নেই, সে গানে গর্জন নেই, আছে শ্রাবণ মেঘের বিরহ বহমানতা । আপনারা মহাকবি কালিদাস কৃত মেঘদূতের সুললিত বাংলা ভাবানুবাদ পড়ছেন ‘রবিচক্রের’ পাতায়। সুরে যেমন ভেবে ছিলেন নজরুল … গানটি তাই ।

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.


5 1 vote
Article Rating
4 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Alak Basuchoudhury
Alak Basuchoudhury
3 months ago

বাহা রে দুখিরাম! সাবাস! দুখু মিয়াকে নিয়ে এমন বৈঠকি লেখা তো তাঁরই সাধ্য! মনে পড়ে, তখন সবে কলেজে ঢুকেছি, বাড়িতে এসেছে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের অভিনব নজরুল-জীবনী ‘জৈষ্ঠের ঝড়’। সেটি আমার বোনকে উপহার দিতে গিয়ে প্রথম পাতায় বাবা একটি কবিতা লিখেছিলেন। তার প্রথম লাইনটি ছিল :- “শ্যামা মায়ের কোলে বসে জপেন যিনি শ্যামের নাম!…” নজরুল নিজেও লিখেছিলেন, “মহাকালের কোলে বসে গৌরী হলো মহাকালী!” আমাদের দুখিরামও অবলীলায় কাজীদার কোলে বসে অবলীলায় চালিয়ে গেলেন তাকে নিয়ে এই জমকালো কালোয়াতি! লেখাটি পড়তে গিয়ে মনে পড়ে গেল আমাদের যৌবনকালের সেই দিনগুলো যখন নজরুল ক্রমে ক্রমে মাটি ফুঁড়ে উঠে দাঁড়াচ্ছেন আমাদের সামনে। এটা সেই ট্রাংকবন্দী জীবনানন্দের উপন্যাসের মতো নতুন কোন ভূখণ্ড আবিষ্কার নয়। এটা ছিল স্বল্প-জানা আলো-আঁধারের নজরুলের প্রখর আলোয় ক্রম-উন্মোচন!
সেটা বোধহয় আশির দশক হবে। নজরুল যে ‘ধ্রুব’ নামে একটি সিনেমা পরিচালনা করেছিলেন এবং তাতে নারদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন এগুলো ছিল আমাদের কাছে শোনা কথা। হঠাৎ শোনা গেল, সিনেমাটির কিছু অংশ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য দপ্তরে পুনরাবিষ্কৃত হয়েছে এবং সেই পুনরুদ্ধার করা অংশটি দেখানো হবে নজরুলের জন্মদিনে কলকাতা তথ্যকেন্দ্রে। তখন আমার নতুন হস্তগত হয়েছে একটা টেপ রেকর্ডার যন্ত্র। সেটিকে ঝোলা ব্যাগে পুরে হাজির হলাম প্রেক্ষাগৃহে। হল অন্ধকার করে যখন ধ্রুব ও নারদের মোলাকাতের সেই অংশটি পর্দায় দেখানো হচ্ছে, আমার কোলের ওপর রাখা ব্যাগের মধ্যে টেপ রেকর্ডারের বোতাম টিপে দিয়েছি। বালক ধ্রুবর সঙ্গে মাথায় চুড়োবাঁধা নারদবেশী নজরুলের সংলাপ ও গানের সেই অংশ ধরা পড়ে যাচ্ছে আমার ক্যাসেটে। আলো জ্বলে ওঠার পর যে অনুষ্ঠান হয়েছিল, সেটিও ভোলার নয়। মঞ্চে উপবিষ্টা সেই সোনালী যুগের নজরুলের ছোঁয়ায় ধন্যা গায়িকা বৃদ্ধা আঙ্গুরবালা দেবী তাঁর কম্পিত কন্ঠে গান ধরেছেন, “চেয়ো না সুনয়না”, তাঁকে হারমনিয়মে সঙ্গত করছেন কল্যাণী কাজী। আজও আমার ক্যাসেটে ধরা আছে কাঁপা কাঁপা গলার সেই গান!
এই সূত্রে আরও মনে পড়ে গেল, ওই ঘটনারই কয়েক বছর পর দেশ পত্রিকায় সুনীল গাঙ্গুলি না কে যেন এই চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে লিখেছিলেন ‘দাড়িওয়ালা নারদমুনির’ বেশে নজরুলের আবির্ভাবের কথা। আমি তখন চিঠি লিখে জানিয়েছিলাম যে, ওই ছবিতে নারদবেশী নজরুলের কোন দাড়িই ছিল না। চিঠিটি দেশ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল এবং তার সঙ্গে নারদবেশী নজরুলের একটি কার্টুন এঁকেছিলেন স্বনামধন্য হিমানীশ গোস্বামী। “তে হি নো দিবসা গতা!”

দুখীরামের লেখাটি এমনই বিচিত্র সব দুখ-জাগানিয়া, স্মৃতি জাগানিয়া!

সৌরভ হাওলাদার
সৌরভ হাওলাদার
3 months ago

এক নিঃশ্বাসে পুরোটা পড়লাম। এমন রসসিক্ত ঝর্ণায় নজরুল চর্চার সুযোগ আগে হয়নি। লেখাটি নিজের সংরক্ষণে রেখে দিলাম।

Sulata Bhattacharya
Sulata Bhattacharya
3 months ago

কাজি সাহেবের গানের ভেলায় বসে সুরনদী পার হওয়া, সেইসঙ্গে গীতসুধারসপিপাসু
পাঠকচিত্তকে নজরুলগীতির তীর্থনীরে অবগাহন করানোর
মুন্সিয়ানায় সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে
আপনার নিবন্ধটি।অনেক ধন্যবাদ।

Chandan Sen Gupta
Chandan Sen Gupta
3 months ago

মজলিশী কথা দিয়ে সাজানো কাজী নজরুল চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলে চমৎকৃত করলেন।মুগ্ধতার সীমা নেই কোন।