তখনও সূর্য ওঠেনি, একটা ডাহুক অনেকক্ষণ ধরে কিছু একটা খুঁজে চলেছে। জলের ধারে ঢোলকলমির জঙ্গল ছিল, তার গা জড়িয়ে বেশ খানিক জায়গা, নরম ঘন নির্বিঘ্ন কচুরিপানায় মুড়ে বিছানার মতো সাজানো ছিল। গতরাতের ‘রেমাল’ ঝড়ের তান্ডবে, সেসব যে কোথায় ভেসে গেছে, জানা নেই। কিছু ঘন্টা আগেও যেসব ডাঙা ছিল, আজ তারা জলের তলায়। পাতলা ছানা কাটা ভোরের আলোতে শুধু ইতস্ততঃ ভেসে থাকা কয়েকটা বেগুনি পাপড়ি জানান দিচ্ছে, এইখানেই কোথাও ছিল।
ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়ে অনেকেই আগেভাগে উড়ে গেছে, গাঙ শালিক, ফিঙে, জলপিপি, পানকৌরি; সবাই। এই ডাহুক-টি যেতে পারেনি। গত কয়েকদিন ধরে, মুখে রক্ত তুলে ডিমগুলোকে তা দিয়ে পৃথিবীর আলো দেখানোর চেষ্টা করছিল। তাদের ফেলে যাবে কী করে?
নদী লাগোয়া একটা মানুষের গ্রামও ছিল। দুদিন ধরে মাইক নিয়ে প্রচার হয়েছে। সকলকে ত্রাণ শিবিরের বাড়িতে যেতে বলা হয়েছে। গ্রামের অধিকাংশ বাড়িই এখন ফাঁকা। রাস্তা জুড়ে এক কোমর জল, ঘর বারান্দাও জলের নিচে। কাঁচা বাড়িগুলোকে চেনা যায় না, দুমড়ে মুচড়ে পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হয়ে গিয়েছে। উঁচু গাছের ডালে সাপ জড়িয়ে আছে।
ডাহুক গোল হয়ে ঘুরছে আর খুঁজছে, হদিশ মেলে না।
ভোটের মুখে এমন ঝড়! নেতা নেত্রীরা ঘর গোছাতে ব্যস্ত। ভাঙা দেওয়াল, জুড়ে দেওয়ার জন্য এখনই কাউকে পাওয়া যাবে না। আশ্রিত মানুষ বুঝতে পারে, এর মধ্যেই সংখ্যার নিয়মে ভোট দিতে যেতে হবে। কাকে ভোট দেবে ভাবতে থাকে, যদি ভোটে হেরে গিয়ে আর ত্রাণ বিলি করতে না আসে?
ক্রমে ক্রমে ভোটের দিন এসে গেল। ঝড়ের দুদিন পর জল নেমে গেছে। ভেঙে যাওয়া বাঁধ, পড়ে যাওয়া দেওয়াল হাতে হাতে নিজেরাই চেষ্টা করে, আবার খাড়া করতে। জল নেমে যেতে ফুটে ওঠে থকথকে কাদা আর রাশিকৃত আবর্জনা। ভোটের জোয়ার চলে গেলে, তার ক্লেদাক্ত চেহারা নিয়ে সমাজও ফিরে আসে।
নাগরিক জীবনে, গণতান্ত্রিক দিন বদলের চাবিকাঠি, সাধারণ নির্বাচন। যাকে ঘিরে সকলে স্বপ্ন দেখে, আশাপূরণের। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাঁধে বর্তায় সেই গুরুভার। সংবিধানের নিয়মে আসমুদ্র হিমাচলে সংগঠিত হল এই নির্বাচন। প্রায় ছিয়ানব্বই কোটি মানুষ নিজের পছন্দের প্রতিনিধি নির্বাচিত করে লোকসভায় পাঠালেন। এই প্রতিনিধিরা তাদের ভবিষ্যতের দায়িত্ব নেবে। অন্ন বস্ত্র বাসস্থান সুরক্ষিত করবে। বিশ্বের কাছে নতুন ভারতবর্ষের মুখ উজ্জ্বল করবে। কিন্তু সত্যই কি মানুষের দিন বদল হয়?
“রাজা আসে যায় রাজা বদলায়
নীল জামা গায় লাল জামা গায়
এই রাজা আসে ওই রাজা যায়
জামা কাপড়ের রং বদলায়….
দিন বদলায় না!”
নাকি জীবনসংগ্রাম যেমন চলছে, তেমন ভাবে চলতে থাকে, চলতেই থাকে?
প্রতি বছর এমনি করেই ঝড় আসে, তছনছ করে দিয়ে যায়, তার পরেও মানুষগুলো মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকে। বেঁচে থাকার আশা মানুষকে উদ্দীপিত করে আরেকটা নতুন লড়াই শুরু করার জন্য। ভোট শেষে নতুন সরকার তৈরী হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
এই সরকারের কাছে মানুষের তেমনই প্রত্যাশা। নড়বড়ে স্বপ্নগুলো যেন বেড়ে ওঠার জমি ফিরে পায়। আবার ডাঙা জেগে উঠেছে, ডাহুকটাও ফিরে এসেছে, ওকে নতুন করে বাসা বাঁধতে হবে।
আমরাও প্রতীক্ষায় থাকি, ভালো কিছু হোক।
রবিচক্র অনলাইন আপনাদের কেমন লাগছে? নিচের ঠিকানায় লিখে জানান। ইমেল-ও করতে পারেন। চিঠি অথবা ইমেল-এর সঙ্গে নাম, ঠিকানা এবং ফোন নম্বর থাকা বাঞ্ছনীয়।
রবিচক্র
‘প্রভাসতীর্থ’, ৭৬ ইলিয়াস রোড, আগরপাড়া, কলকাতা – ৭০০০৫৮, ভারত
editor@robichakro.com
ভাঙাগড়ার খেলা নিরন্তর সমাজ
এবং প্রকৃতিতে।তবু আশা জেগে রয়। “জগৎপারাবারের তীরে শিশুরা করে খেলা।”
সমাজে এবং প্রকৃতিতে নিত্য এই ভাঙা গড়ার খেলা চলছে। অপরাজিত মানুষ আবার আশায় ঘর বাঁধে। মাথা তুলে দাঁড়ায়।
“জগৎপারাবারের তীরে ছেলেরা করে খেলা।”
।