শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আলোচনা ও চর্চা

আঁধার ঘরের বহ্নিমান দীপশিখা (পর্বঃ১)

বছর কুড়ির এক অর্ধান্ধ তরুণী। নাম অ্যানি সালিভান। ম্যাসাচুসেটস-এর বস্টনে অবস্থিত বিখ্যাত অন্ধদের স্কুল পারকিনস ইনস্টিটিউশন থেকে সেরা ছাত্রী হিসাবে গ্রাজুয়েট হয়ে বর্ণিল বিদায় সম্বর্ধনা পেয়ে বেরিয়ে এসেছেন। জীবনে এত আনন্দ বোধহয় আর কখনও পাননি। এবার তিনি স্বাবলম্বী হয়ে মুক্ত জীবনে যোগ দিতে পারবেন। কিন্তু আনন্দের রেশ মিলিয়ে যাবার আগে এক প্রবল দুশ্চিন্তা তাঁকে ঘিরে ধরে। এবার তিনি কোথায় যাবেন, কি করবেন জীবন অতিবাহিত করার জন্য? তিনি যে আক্ষরিক অর্থে স্বজনহীন, আশ্রয়হীন, সহায় সম্বল হীন। দুশ্চিন্তা তাঁর শরীরে মনে অসুস্থতার আভাস দিতে থাকে।

ঠিক এই সময় তাঁর কাছে পার্কিনস ইনস্টিটিউশনের ডিরেক্টর মি অ্যনাগনসের কাছ থেকে একটা চিঠি এসে পৌঁছয়। সাথে একটি অন্ধ, মুক বধির বাচ্চা মেয়ের বাবা, ক্যাপ্টেন আর্থার কেলারের প্রার্থনা ভরা একটি চিঠি, তাঁর মেয়েটির শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করার আবেদন জানিয়ে। মিঃ.অ্যনাগনস তাঁকে ওই মেয়েটির শিক্ষার ভার নেবার কথা বিবেচনা করে জানাতে বলেছেন।

অ্যানি আশান্বিত হন। পরক্ষণেই আশাহত হন এখনই একটা কাজ তাঁর চাই, কিন্তু একটি অন্ধ, বধির মেয়েকে কিছু শেখানোর চেষ্টা করা খুব কঠিন কাজ এবং এর মধ্যে কোন আনন্দ নেই। তিনি এতদিন জানতেন যে এই পৃথিবীতে কেউ কোথাও তাঁর পথ চেয়ে বসে থাকার মত মানুষ নেই। কিন্তু হঠাৎ যখন তাঁর মনে হয় কেউ একজন বোধহয় সত্যি সত্যিই তাঁর পথ চেয়ে বসে আছে তখন তিনি ক্যাপ্টেন কেলারকে চিঠি লিখে তাঁর সম্মতির কথা জানিয়ে দেন।

অ্যানির জীবনে এই উত্তরণের পথটি কিন্তু আদৌ মসৃণ ছিলনা। উপেক্ষা, অবহেলা,দুঃখ, আঘাত ভরা সেই জীবনের কথা জানতে হলে আমাদের কিছু বছর পিছিয়ে যেতে হবে।

অ্যানি সালিভ্যান

১৮৬০ সালের গোড়ার দিকে সালিভান পরিবার আয়ারল্যান্ড ত্যাগ করে আমেরিকা গামী এক বিশাল জনস্রোতের সঙ্গে রওনা হয়েছিলেন। বিশ বছর যাবৎ আয়ারল্যান্ডে ঠিকমত ফসল জন্মাচ্ছিল না। মূলতঃ খাদ্যাভাব ও কর্মহীন হয়ে যাবার জন্যই এঁরা আমেরিকায় চলে যান।অ্যানির বাবা টমাস সালিভান কৃষিজীবী ছিলেন বলে ম্যাসাচুসেটস এর ফিডিং হিলস নামে এক কৃষিজীবীদের আবাস স্থানে চলে আসেন এবং কাছেই একটি খামারে দিনমজুরের কাজ পান। তাঁর স্ত্রী অ্যালিস খুবই সংসারী ছিলেন বলে কোনমতে তাঁদের সংসার চলছিল। ১৮৬৬ সালের ১৪ই এপ্রিল তাঁদের প্রথম সন্তান অ্যানির জন্ম হয়। অ্যানির জীবন খুব সুখের ও আনন্দের ছিল প্রথম দিকে। তিনি তাঁর বাবার অত্যন্ত আদরের ছিলেন।

কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে সালিভান পরিবারের দুঃখের দিন শুরু হয়। তিন বছরের কম বয়সে অ্যানির চোখে এক দুরারোগ্য এবং যন্ত্রনাদায়ক অসুখ হয়। ডাক্তারী চিকিৎসায় কোন ফল হয়না। রোগটির নাম ‘ট্রাকোমা ‘ । একমাত্র সচ্ছল পরিবারের পক্ষেই এই রোগের চিকিৎসা সম্ভব হতো। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকার কারণেই গরীব মানুষদের মধ্যে এই রোগের খুব প্রকোপ ছিল। অ্যানির দৃষ্টি ক্রমশঃ ঝাপসা হয়ে যেতে থাকে।

এর কিছুদিন পরেই জানা যায় অ্যালিস টিউবার্কুলোসিস রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁর কাশি,গলাব্যথা দিন দিন বাড়তে বাড়তে তাঁর জীবনীশক্তি ক্রমশঃ কমতে থাকে। অভাবী মানুষদের মধ্যে এই রোগের ভীষণ প্রকোপ ছিল। এর মধ্যেই কিছুদিন পরে তাঁদের দ্বিতীয় সন্তান জিমির জন্ম হয়। জিমি একটি যক্ষা রোগাক্রান্ত নিতম্ব নিয়েই জন্ম নেয়।

এতগুলি বিপদের মোকাবিলা করার মত আর্থিক সামর্থ্য টমাসের ছিলনা। এই নিদারুণ অবস্থা সামাল দিতে না পেরে তিনি সবকিছু ভুলে থাকার জন্য মদ খাওয়া শুরু করে দিলেন। টমাস ঘন ঘন মাতাল অবস্থায় বাড়ি ফিরতে লাগলেন। অ্যালিস এর জীবনীশক্তি ফুরিয়ে আসছিল। তার মধ্যে আরও একটি সন্তান জন্মেছে। একদিকে ক্ষয়রোগ, অন্যদিকে নবজাত শিশুটির চাহিদা–এই দুইয়ের মধ্যে অ্যানি ক্রমশ অবহেলিত হতে লাগলেন।

সব শিশুরাই মনোযোগ আর ভালবাসার আবহে বেড়ে উঠতে চায়।অ্যানি যখন বুঝতে পারলেন মা বাবা কেউই আর তাঁকে সময় দিতে পারছেন না তখন তাঁর মনে ক্ষোভ ও অভিমান জমা হতে লাগল। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে লাগল তাঁর দুর্বিনীত ও হিংস্র ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। ক্রমশ সকলের কাছে তিনি অপছন্দের পাত্রী হয়ে উঠলেন। এমনকি যে বাবার আদর ভালবাসার স্মৃতি তাঁর মনে জমা ছিল সেই বাবাও যখন একদিন তাঁকে পরিবারের দুর্ভাগ্যের কারণ বলে দায়ী করলেন, সেইদিন তাঁর বুকে যেন শেল বিঁধে ছিল। সেই দিনটির কথা পরবর্তী জীবনে তাঁর মনে ঘুরেফিরে এসেছিল।

এমনি করে আরও দু তিন বছর কাটতে কাটতে একদিন চরম দুর্যোগ নেমে এল সালিভান পরিবারে। অ্যালিস মারা গেলেন আর পরিবারটি টুকরো হয়ে ভেসে গেল।

কৈশোরে অ্যানি সালিভ্যান

সালিভানদের আত্মীয়রা যাঁরা কাছাকাছি থাকতেন তাঁরা আলাপ আলোচনা করে কর্তব্যের খাতিরে তিনটি শিশুর দায়িত্ব নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতে চাইলেন। পিসি এলিন সালিভান স্বেচ্ছায় জিমি ও শিশু মেরীর দায়িত্ব নিলেও অ্যানির দায়িত্ব নিতে কেউই রাজী হচ্ছিলেন না। তাঁর দৃষ্টি রোগগ্রস্ত, তার উপর বদমেজাজী। শেষ পর্যন্ত অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের চাপে স্যালিভান পরিবারের জন ও স্তাশিয়া সালিভান অ্যানির দায়িত্ব নিল

অনাদর আর অবহেলার জীবনে অ্যানি আরও দুর্বিনীত ও হিংস্র হয়ে উঠলেন। কারো কোন রকম কর্তৃত্ব তিনি মানতে চাইতেন না। ফলে তাঁকে কঠোরভাবে একলা রাখার ব্যবস্থা হল।অ্যানি নিজের খুশী মতো মাঠে ঘাটে ঘুরে অলসভাবে দিন কাটাতেন। প্রকৃতির সান্নিধ্যে তাঁর মন একটু স্বস্তি খুঁজত।

অ্যানির ক্রমাগত অবাধ্যতা এবং জিমির চিকিৎসার খরচ যোগাতে না চাওয়ার জন্য আত্মীয়রা আবার মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন ওদের দুজনকে অনাথ আশ্রমে পাঠিয়ে দিতে হবে। সেইমত ব্যবস্থা করে অ্যানি ও জিমিকে তাঁরা টিউক্সবেরি সরকারী আতুরালয়ে পাঠিয়ে দিলেন। অ্যানিদের জীবনের আর এক অধ্যায়ের শুরু হল।

টিউক্সবেরী আতুরালয়ে যখন তাঁদের দুজনকে আলাদা আলাদা ওয়ার্ডে পাঠানোর ব্যবস্থা হচ্ছিল তখন ভাই বোন দুজনেই কেউ কারো থেকে আলাদা হতে চাইছিলেন না। শেষ পর্যন্ত ব্যবস্থা হল, জিমিকে একটা অ্যাপ্রন পরিয়ে অ্যানির সাথে মহিলা ওয়ার্ডে থাকতে দেওয়া হবে। অ্যানি জিমিকে বুঝিয়ে রাজী করিয়েছিলেন। সেইদিন জীবনে প্রথম অ্যানি কারো প্রতি ভালবাসা অনুভব করেছিলেন।

টিউক্সবেরী আতুরালয়টি আসলে ছিল নানা ধরনের স্বজন পরিত্যক্ত মানুষের আবাস। সেখানে অসুস্থ,বিকৃত মস্তিষ্ক ও মদ্যপ লোকদের সাথে কিছু কুড়িয়ে পাওয়া বাচ্চা থাকত। এবার অ্যানি ও জিমি তাদের দলে যোগ দিল। মহিলা ওয়ার্ডে রোগগ্রস্ত বয়স্কা মহিলারাই নিজেদের মত থাকতেন। কথাবার্তার আওয়াজ প্রায় শুনতে পাওয়া যেতনা। এঁরা প্রায় সকলেই ছোট ছেলমেয়ে দুটিকে পছন্দ করতেন না। কারণ এরা সবসময় হই হই করত আর বড়দের কোন সম্মান দিত না। অ্যানিও এঁদের অধিকাংশকে মোটেই পছন্দ করতেন না। কিন্তু ওই ওয়ার্ডে দুজন বৃদ্ধা ছিলেন যাঁরা অ্যানির বন্ধু হয়ে যান। একজন ছিলেন দৃষ্টিহীন মহিলা, যিনি অ্যানির হাত ধরে চমৎকার সব গল্প বলতেন। অপরজন ম্যাগি ক্যারল, যিনি বাতের প্রকোপে চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়েছিলেন। অ্যানি সবসময় তাঁকে ওঠা বসা, পাশ ফেরায় সাহায্য করতেন। ম্যাগি দেখতে পেতেন। অ্যানি তাঁর সামনে একটি করে বই ধরে থাকতেন। ম্যাগি অ্যানি কে পড়ে শোনাতেন। এভাবে মাসের পর মাস চলছিল আর ছাপা পৃষ্ঠা পড়ার খিদে অ্যানির মধ্যে ক্রমেই বাড়তে থাকে।

টিউক্সবেরিতে অ্যানি ও জিমি বেশ খুশিই ছিলেন। তাঁরা যথেষ্ট খেতে পেতেন, পরস্পরের সান্নিধ্যে থাকতে পারতেন এবং নিজেদের মত থাকতে পারতেন। অ্যানির লড়াই করার কোন সুযোগ ছিল না। কখনো রেগে গেলে পরিচারিকারা তাঁকে যখন জিমিকে পুরুষদের ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেবার ভয় দেখাতেন তখন অ্যানি শান্ত হয়ে যেতেন। অ্যানি খুঁজতে খুঁজতে হলের পিছনের একটি দেয়াল আলমারি থেকে এক স্তূপ ইঁদুরে খাওয়া ম্যাগাজিন আবিষ্কার করেছিলেন। শীতের দিনগুলিতে যেহেতু বাইরে খেলতে যাওয়া সম্ভব ছিলনা, দুই ভাইবোন সেই ম্যাগাজিন গুলি দেখেই সময় কাটাতেন। মহিলাদের ম্যাগাজিনের সাজানো সুন্দর মহিলাদের ছবি দেখে অ্যানি মুগ্ধ হয়ে যেতেন। কিন্তু সবসময় যথেষ্ট ছবি পাওয়া যেতনা। তখন অ্যানির হাতের আঙ্গুলগুলো ছাপার অক্ষর এর লাইনের উপর দিয়ে যেতে যেতে সেই অক্ষর গুলি কি বলতে চায় বোঝার প্রাণপণ চেষ্টা করত। তার সেই নিষ্ফল চেষ্টা তাঁকে অসম্ভব বিক্ষুদ্ধ করে তুলত। লেখাপড়া শেখার প্রবল ইচ্ছা তাঁকে গ্রাস করত।

অল্পদিনের মধ্যে অ্যানির জীবনে আবার দুর্যোগ ঘনিয়ে এল। জিমির অসুস্থতা ক্রমশঃ বেড়ে তাকে চলৎশক্তিহীন করে তুলেছিল। ব্যথা যন্ত্রনা ক্রমশঃ বাড়ছিল। অ্যানি দিবারাত্রি তার সেবা করতেন এবং সবসময় তার কাছে থাকতেন। অ্যানি অনুভব করতে পারছিলেন আবার একটা বিপদ তাঁর চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলছে। অবশেষে একদিন অ্যানি যখন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, তখনই জিমির মৃত্যু হয়। ঘুম ভেঙে অ্যানি সর্বনাশের গন্ধ পান। প্রথমে আর্ত চিৎকার করেছিলেন। তারপর শান্ত হয়ে পড়ে থেকে নিজেরও মৃত্যু কামনা করছিলেন। শেষ পর্যন্ত একজন বৃদ্ধা আবাসিক তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে পাশে বসিয়ে মমতা মাখানো কথা বলে বলে তাঁকে আত্মস্থ হতে সাহায্য করেন।

জিমির মৃত্যুর পর অ্যানি টিউক্সবেরি আতুরালয় থেকে পালিয়ে যাবার চিন্তা করছিলেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, বাইরে চলে গেলে তাঁর বেঁচে থাকার জন্য অন্যের সাহায্যের প্রয়োজন হবে। প্রতি রবিবার ফাদার বারবারা নামের একজন যাজক মহিলাদের বিভাগে উপাসনা পরিচালনা করতে আসতেন। তিনি দয়াপরবশ হয়ে অ্যানিকে একজন চোখের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। উদ্দেশ্য ছিল, অ্যানির চোখের একটা ব্যবস্থা করার পর তাঁর জন্য অন্য কোথাও একটা বাসস্থান খুঁজবেন। চোখের হাসপাতালে অ্যানির চোখের তিনবার অপারেশন করার পরেও অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি। ঘটনাচক্রে ইতিমধ্যে ফাদার বারবারা অন্যত্র বদলী হয়ে যাওয়ায় অ্যানিকে ফের টিউক্সবেরিতেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও এখানে ফিরে আসার যন্ত্রনা থেকে অ্যানির মনে এক কঠিন সংকল্প গড়ে ওঠে, যে কোন উপায়ে এখান থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য। এবং অ্যানি তা প্রকাশ ও করে দেন।ফলে অন্য আবাসিকদের কাছে তিনি হাসি তামাশার পাত্রী হয়ে ওঠেন। অনেকে তাঁকে নানারকম ভাবে বোঝাতেও চেষ্টা করেন। কিন্তু অ্যানি কে বিরত করা যায় না। হঠাৎ একদিন একজন অন্ধ বৃদ্ধা অ্যানিকে শোনান, অন্ধদের জন্য বিশেষ ধরনের স্কুল আছে। সেখানে ভর্তি হতে পারলে তিনি সেখানে লেখাপড়া শিখতে পারবেন। অ্যানির প্রথমে সেটা বিশ্বাস হতে চায়নি। তখন ওই বৃদ্ধা মহিলা তাঁকে বুঝিয়ে বলেন, উঁচু উঁচু করে ছাপা অক্ষরের বইয়ে আঙ্গুলের ডগা দিয়ে অক্ষর চিনতে শিখে দৃষ্টিহীন রা পড়তে শিখতে পারে। তখন অ্যানির মনে আশার সঞ্চার হয়।

অ্যানি বুঝতে পারেন না, কেমন ভাবে সেই স্কুলে তিনি পৌঁছবেন। এই পরিবেশ থেকে বেরোবার কি উপায়? একদিন তিনি জানতে পারলেন ফ্রাঙ্ক. বি. স্যানবর্ন নামে একজন হর্তাকর্তা মানুষ এই আতুরালয়ের সাথে যুক্ত। তাঁর কাছে ঠিকমত আর্জি জানাতে পারলে অ্যানির জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা হতে পারে। ঘটনাচক্রে একদিন সেই সুযোগটা এসে গেল। একটা তদন্তের কাজে মি.স্যানবর্ন আতুরালয়ে এলে অ্যানি মরিয়া হয়ে তাঁর কাছে দরবার করেন। ওঁর আবেদনে এমন আর্তি ছিল যে কয়েক দিনের মধ্যেই পারকিন্স ইনস্টিটিউশন ফর দ্য ব্লাইন্ড নামক প্রতিষ্ঠানে দাতব্য ছাত্রী হিসাবে অ্যানির পড়ার ব্যবস্থা মি.স্যানবর্ন করে দেন।

জায়গাটা বস্টনে,টিউক্সবেরি থেকে কুড়ি মাইল দূরে।আতুরালয়ের সেই ঘোড়ায় টানা ব্ল্যাক মারিয়া ওয়াগণে করেই অ্যানি স্কুলে যাবার জন্য রওনা হলেন।আতুরালয়ের বৃদ্ধা বন্ধুরা তাঁকে ভাল হয়ে থাকার জন্য অনেক উপদেশ দিলেন। ড্রাইভার টিম তাঁকে নিজের পাশে বসিয়ে নিয়ে যাবার সময় তাঁকে বললেন ওখানে গিয়ে এমন কিছু না করতে যাতে তাঁকে কোনদিনই আর এখানে ফিরে আসতে না হয়। যেদিন প্রথম বাচ্চাদুটিকে তিনি স্টেশন থেকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন, সেদিনই বাচ্চাদুটি এখানে কি করে বেঁচে থাকবে ভেবে বিচলিত হয়েছিলেন। সারা জীবন অ্যানি এই শেষ উপদেশটাই মনে রেখেছিলেন।

স্কুলে যাবার পর নতুন সমস্যা শুরু হল। অ্যানির বয়স তখন চোদ্দ বছর। কিন্তু তিনি কিছুই জানতেন না। তাই শিশুদের সাথে তাঁকে শুরু করতে বাধ্য করা হল। শিশুরা তাদের মাঝে অত বড় একটি মেয়েকে দেখে হাসি তামাশা করে তাদের অপছন্দের ভাব প্রকাশ করত। অ্যানির দিনগুলি বিভ্রান্তি, বিদ্রোহ আর নৈরাশ্যে কাটতে লাগল। কয়েক মাসের মধ্যে অ্যানি যদিও ব্রেল পদ্ধতিতে লিখতে ও পড়তে শিখেছেন, তিনি তখনও বানান জানেন না এবং শিখতেও চাইতেন না। ইংরেজির শিক্ষিকা তাঁকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন, সব কিছুই একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে শিখতে হয়। কিন্তু ফল হল উল্টো। অ্যানি কিছুতেই সেটা বুঝতে চাইছিলেন না। একদিন তুমুল কাণ্ড হল অ্যানি চরম অবাধ্যতা দেখিয়ে ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। অ্যানিকে ডিরেক্টর মি.অ্যনাগনসের ঘরে ডেকে পাঠানো হল। তিনি অ্যানিকে বোঝাতে চাইলেন শিক্ষিকার প্রতি রুঢ় আচরণ করে অ্যানি ঠিক করেননি। তাঁকে শিক্ষিকার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। অ্যানি বেঁকে বসলেন। হাল ছেড়ে দিয়ে ডিরেক্টর ওনাকে আবার ফেরৎ পাঠিয়ে দেবার কথা ভাবছিলেন।

সেই সময় স্কুলের অন্য একজন শিক্ষিকা মিস মেরি মুর ডিরেক্টরের কাছে অ্যানিকে সংশোধনের দায়িত্ব নেবার প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে এলেন। তিনি অ্যানির দিকে বাড়তি মনোযোগ দিলেন। ঘনিষ্ট সান্নিধ্য দিয়ে, স্নেহের ছোঁয়া দিয়ে তিনি ধীরে ধীরে অ্যানিকে শান্ত ও নম্র হতে শেখালেন। এতদিন যে আচরণ তিনি করে আসছিলেন, সেটা যে ঠিক ছিলনা অ্যানি ক্রমে বুঝতে পেরেছিলেন। তারপরই অ্যানির শিক্ষা ও আচরণে দ্রুত উন্নতি হতে লাগল। অন্য সকলের কাছে ধীরে ধীরে তিনি গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠলেন।

স্কুলের ছুটির দিনগুলিতে অ্যানিকে নিয়ে সমস্যা হল। ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষিকারা সকলেই তাঁদের নিজের নিজের ছুটি কাটাতে চলে যান। অ্যানির তো যাবার কোনও জায়গা ছিলনা। তাই তাঁকে ওই সময়ের জন্য মি. ক্লার্কের ভাড়াটে বাড়িতে কাজ খুঁজে দেওয়া হয়েছিল। সেখানকার এক আবাসিকের সঙ্গে অ্যানির খুব বন্ধুত্ব হয়ে যায়। সেই যুবক অ্যানির চোখের চিকিৎসা করাবার জন্য উদ্যোগী হন। প্রথমে অ্যানি জেদ করে তাঁর অনীহা দেখিয়েছিলেন। কিন্তু ওঁর পীড়াপিড়িতে শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে যেতে রাজী হন। পরপর দু’বছর গ্রীষ্মকালে ওই হাসপাতালে অ্যানির চোখে দু বার অপারেশন হয়। অ্যানি চোখের দৃষ্টি ফিরে পান।

অ্যানির চোখ একেবারে ভাল হয়ে যায়নি। তিনি আবছা দেখতে পাচ্ছিলেন। তাঁকে অর্ধান্ধ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল এবং পুরোপুরি দৃষ্টিহীন না হলেও তাঁকে পারকিন্স ইনস্টিটিউশনে রেখে দেবার জন্য আইন শিথিল করা হয়েছিল। অ্যানির চোখদুটোকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষিকারা তাঁকে দিয়ে স্কুলের নানারকম কাজ করাতেন। অ্যানি ছোটদের কাছে ও খুব আদরের মানুষ হয়ে উঠলেন। তিনি তাদের সঙ্গে তাঁর অবসরের বেশ কিছুটা সময় কাটাতেন এবং দু একটা ক্লাসও নিতে দেওয়া হল তাঁকে।


অ্যানি পারকিন্স ইনস্টিটিউশনে আসার আগে এখানেএকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল। প্রায় চল্লিশ বছর আগে এখানে একটি মেয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। যিনি ছিলেন মুক, বধির ও দৃষ্টিহীন। তাঁর নাম লরা ব্রিজম্যান। স্বাভাবিকভাবে জন্মালেও ছাব্বিশ মাস বয়েসে স্কারলেট ফিভারে আক্রান্ত হয়ে তাঁর এই অবস্থা হয়েছিল। ডা: স্যামুয়েল গ্রিডলি হাওয়ে, যিনি পারকিন্স ইনস্টিটিউশন এর প্রতিষ্ঠাতা, প্রথম অধিকর্তা এবং বড় মাপের শিক্ষক ছিলেন, লরার অবস্থার কথা জেনে তাঁকে পারকিন্সে নিয়ে আসেন। যেহেতু তাঁর সঙ্গে ভাব বিনিময়ের জন্য একমাত্র স্পর্শানুভূতির সাহায্য নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না, ডা: হাওয়ে হাতের মাধ্যমে এক বিশেষ বর্ণমালা তৈরি করে তার সাহায্যেই লরার মনের কাছে পৌঁছবার চেষ্টা করেন এবং তাতে সফল হন। এই বর্ণমালার নাম ম্যানুয়াল বর্ণমালা। এই বর্ণমালার প্রতিটি অক্ষরকে হাতের একটি বিশেষ মুদ্রা দিয়ে বোঝানো হত। যেহেতু লরা দেখতে পেতেন না, হাতের মুদ্রাগুলিকে লরার স্পর্শকাতর আঙ্গুলগুলো দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে বুঝতে হত। লরা সেগুলি হুবহু নকল করে ডা: হাওয়ের হাতে এঁকে দিতে পারলেন। কিন্তু লরার কাছে সেগুলো কেবলমাত্র হাতের ভঙ্গি ছিল। সেই ভঙ্গিগুলোর যে আলাদা আলাদা অর্থ আছে সেটা তাঁকে বোঝাতে অনেকদিন ধরে চেষ্টা করে ডা: হাওয়ে সফল হয়েছিলেন। ধাপে ধাপে তিনি লরার হাতে কোন বস্তুকে অনুভব করিয়ে ম্যানুয়াল বর্ণমালার সাহায্যে সেই বস্তুটির নাম লিখে লিখে বস্তুটির সঙ্গে তার নাম শব্দের যোগাযোগটা বোঝাতে পেরেছিলেন এবং অন্যদের সাথে তাঁর যোগাযোগের উপায় তৈরি হয়ে তিনি নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্ত হয়েছিলেন।কিন্তু যেসব শব্দের বস্তুরুপ দেখানো সম্ভব হয়নি সেই সব শব্দ লরাকে শেখানো যায়নি।ডা: হাওয়ে এটুকুতেই সন্তুষ্ট হলেন। তিনি নিশ্চিত হয়েছিলেন যে লরা এই পর্যন্তই যেতে পারেন।

বহু বছর পর্যন্ত লরাকে একটা বিস্ময় মনে করা হত। দূর দূর থেকে লোকে পারকিন্সে আসত লরার হাতের সাহায্যে ভাষা শেখা দেখতে কিন্তু সময়ের সাথে সাথে লরার কীর্তির কথা লোকে প্রায় ভুলে গিয়েছিল। পারকিন্সে সব অন্ধ ছাত্রছাত্রীকে ম্যানুয়াল বর্ণমালা শেখানো হত যাতে তারা লরার সঙ্গে ভাবের আদানপ্রদান করতে পারে। কিন্তু তারা বেশীর ভাগই তাঁর কাছে ঘেঁষতো না। নিঃসঙ্গতা কি জিনিস অ্যানি তা ভাল জানতেন বলেই তিনি লরার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর বন্ধু হয়ে ওঠেন। অ্যানি ইতিমধ্যেই ম্যানুয়াল বর্ণমালা ব্যবহারে খুব কুশলী হয়ে উঠেছিলেন।

পার্কিন্সে অ্যানি একজন নতুন ধাত্রী-মা(হাউস মাদার) পেয়েছিলেন। শ্রীমতী হপকিন্স নামের এই মহিলা ছিলেন দরদী এক নারী। অল্প বয়সে বিধবা হয়েছিলেন। একমাত্র সন্তান, অ্যানির বয়েসী একটি মেয়ে ছিল তাঁর। কিন্তু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে সেই মেয়েটির মৃত্যু হলে শূন্যতা কাটানোর জন্য তিনি পার্কিন্সে হাউস মাদার হিসাবে চাকরিতে যোগ দেন। তাঁর বিপরীত স্বভাবের হলেও অ্যানিকে তিনি নিজের সন্তানের মত স্নেহ ভালবাসা দিয়ে আগলে রাখতে চাইতেন।

১৮৬৬ সালে অ্যানি পারকিন্স থেকে সেরা ছাত্রী হিসাবে গ্রাজুয়েট হন। তার কিছুদিনের মধ্যেই তিনি মি.অ্যনাগনসের কাছ থেকে ক্যাপ্টেন আর্থার কেলারের মুক বধির ও অন্ধ মেয়েটি শিক্ষার ভার নেবার প্রস্তাব পান। সেখানে যাবার জন্য সম্মতি দেবার পর তিনি পারকিন্স কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে লরার শিক্ষা সম্পর্কিত যাবতীয় রেকর্ড মন দিয়ে পড়ে ফেলেন। তিনি অনুভব করতে পারলেন তিনি কঠিন একটি কাজের দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছেন।

(দ্বিতীয় পর্বে সমীপ্য)

চিত্রঋণঃ আন্তর্জাল

Facebook Comments Box

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল।

নতুন লেখা বা ভিডিও সংযোজন, অথবা রবিচক্রের অন্যান্য খবরাখবর সম্পর্কে জানতে, ইমেল নথিভুক্ত করতে পারেন।

We don’t spam! Read our privacy policy for more information.